রোগের চিকিৎসা করা আর দশটা কাজের মতো না যে,
কিছু বই পত্র পড়ে, অনুমান বা অল্প জ্ঞান নিয়ে কেউ প্র্যাকটিস করা শুরু করে দিবে, জনস্বার্থে
ফ্রী প্রেসক্রিপশান লিখে দিবে। একজন ডাক্তারের জন্যে অপরিহার্য হচ্ছেঃ কোন রোগের জন্য
কোন ঔষুধ, কোন ঔষুধ কখন দিতে হবে, সেই সময়, ডোজ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকতে হবে। কারণ
রোগের চিকিৎসা করার সাথে মানুষের জীবন মরণ জড়িত, ডাক্তারের সামান্য ভুলে রোগীর অনেক
বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ঠিক তেমনি, দ্বীনের ব্যপারে ফতোয়া বা মতামত দেওয়া অনেক বড়
এবং ভারী একটা বিষয়। সেজন্যে শুধুমাত্র গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন সৎ ও যোগ্য আলেমরাই
দ্বীনি বিষয়ে মতামত (আরবীতে ফতোয়া) দিতে পারেন। একজন দ্বীন প্রচারকারীর জন্যে আবশ্যক
হচ্ছে কোন আলেমের কোন ফতোয়া সঠিক অথবা অধিক গ্রহণযোগ্য, কখন কোন শর্ত সাপেক্ষ, এই বিষয়গুলো
সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখা। আর নয়তো দেখা যাবে, সে আলেমদের বক্তব্য না জেনেই নিজেই নিজের
অল্প ইলম নিয়ে মনগড়া ফতোয়া দেওয়া শুরু করেছে। আবার কোন আলেমের, কোন ফতোয়া, কখন, কার
জন্যে প্রযোজ্য হবে সে সম্পর্কে জেনে মানুষের মাঝে তা প্রচার করা। প্রয়োজনীয় জ্ঞান
ও প্রজ্ঞা ব্যতিরেকেই দাওয়াতের প্রতিদানের লোভে কেউ যদি নিজ যোগ্যতার চাইতে বড় কথা
বলে বা দাবী করে, এর দ্বারা সে না কোন সওয়াব না, বরং ইলম প্রচার ও দাওয়াতকে ধ্বংস করলো।
এ বিষইয়ের নিয়ে আমি একটা বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি।
__________________________
(১) শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ
বলেন,
“যে কারো কোনো কথাকে আমরা পরীক্ষা করবো: কথাটা কী ঠিক না ভুল? যদি ঠিক হয় আমরা গ্রহণ
করব, যদি ভুল হয় বর্জন করব। কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে গ্রহণ বা বর্জন নিয়ে বিতর্ক-কলহ
করা ভুল, বড় ধরণের ভুল। তাহলে দেখা যাবে একজন মানুষের সঠিক কথাকেও আমরা প্রত্যাখ্যান
করছি, আবার তার ভুল কথাগুলোকেও গ্রহণ করে নিচ্ছি। এটা বিপদজনক। কারণ, কেউ যখন কাউকে
অন্ধ অনুসরণ করে, তাহলে তার ভুল কথাগুলোকে সে অস্বীকার করবে অথবা এমনভাবে ব্যাখ্যা
করবে যেন সেটা ঠিক শোনায়। তেমনি অন্ধ বিরোধীতাকারী যার বিরোধীতা করবে, তার নামে এমন
কথা বলবে, যেটা সে বলেনি অথবা তার বক্তব্যকে ভুল ব্যাখ্যা করবে।”
__________________________
শায়খ উয়াসী উল্লাহ আব্বাস হা’ফিজাহুল্লাহ বলেন,
“একজন মনপূজারী, বিদাতী যার আকীদা সঠিক নয়, তার কাছ থেকে দ্বীন তো পরের কথা, এমনকি
তার কাছে বাংলা বা ইংরেজী ভাষাও শেখাও ঠিক নয়।”
অনেকে বলে, “আমরা মানুষের (আকিদাহ ও মানহাজের ব্যপারে ভ্রষ্ট হয়েছে এমন ব্যক্তিদের) ভালোটা
নেই, আর খারাপটা বর্জন করি….” তাদের এই কথাকে প্রত্যাখ্যান করে শায়খ উয়াসী উল্লাহ আব্বাস হা’ফিজাহুল্লাহ বলেনঃ “আপনি যদি কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ এটা বুঝতেই
পারেন, তাহলেতো আপনি নিজেই আলেম! আপনারতো আর বিদাতীর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আসল
কথা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেনা কোনটা ভালো (হক্ক বা সুন্নাহ) আর কোনটা মন্দ
(বাতিল বা বিদাত), একারণে একজন মনপূজারী বিদাতীর কথা শোনা যাবেনা।”
অনেকে নিজেদের ‘আকীদাহ’ ও ‘মানহাজ’ সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলেনা, ভ্রান্ত লোকদের
কাছ থেকে ইলম নিয়ে কৌশলে আকীদাহ ও মানহাজগত ভুলের দিকে মানুষকে আহবান করে, এমন লোকদের
সম্পর্কে শায়খ উয়াসী উল্লাহ আব্বাস হা’ফিজাহুল্লাহ আরো বলেন, “যার আকীদাহ ও মানহাজ স্পষ্ট নয়, এমন কোন ব্যক্তির কাছ থেকে ইলম নেওয়া ঠিক নয়। এমন
লোকেরা ক্ষতিকর, এদের কারণে অনেক তরুণেরা গোমরাহ হচ্ছে।”
__________________________
এবার ১নং এবং ২নং ফতোয়ার দিকে লক্ষ্য করুন।
শায়খ ইবনে উসায়মিনের ১নং ফতোয়াকে যদি কেউ আম-খাস, নির্ভরযোগ্য সৎ ও যোগ্য দ্বাইয়ী আর
অল্প ইলম সম্পন্ন গোমরাহী প্রচারকারী, কিন্ত মিষ্টি ভাষায় ওয়াজ করে জনপ্রিয়, এমন দুই
দলের লোকের মাঝে কোন পার্থ্যক্য না করেই গ্রহণ করা হয় তাহলে, একশ্রেণীর মানুষ এখান
থেকে মাওলানা তারিক জামিল, নোমান আলী খান, জসীম উদ্দিন রাহমানীর মতো ব্যক্তিদের কথা
শোনার জন্যে সাধারণ মানুষকে আহবান করার বৈধতা দাঁড় করাতে পারবে। কিন্তু শায়খ উয়াসী
উল্লাহ আব্বাস হা’ফিজাহুল্লাহর ২নং ফতোয়ার দিকে লক্ষ্য করলে
এটা স্পষ্টঃ যার আকীদাহ ও মানহাজ স্পষ্ট নয়, এমন কোন ব্যক্তির কাছ থেকে ইলম নেওয়া যাবেনা।
__________________________
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এই দুই ফতোয়ার মধ্যে
কখন, কোনটা গ্রহণ করবো? কোন ফতোয়াটা কখন, কার জন্যে সঠিক, আর কখন কার জন্যে ভুলে বলে
বিবেচিত হবে?
__________________________
(১) আলেমদের ফতোয়া, বক্তব্য, দিক নির্দেশনা,
এগুলো ক্বুরানের আয়াতের মতো বা রাসুল (সাঃ) এর আদেশের মতো নয় যে, মানলে ঈমান থাকবে,
বা না মানলে ঈমান থাকবেনা। তবে জেনে বুঝে আলেমদের কথাকে যে অস্বীকার বা অবহেলা করে,
নিঃসন্দেহে সেই ব্যক্তি ভ্রষ্টতার মধ্যে পতিত হলো।
(২) আলেমরা বিশেষ কোন এক পরিস্থিতি বা ঘটনার
আলোকে একটা কথা বলেন, যা পবরর্তীতে অন্য সময় তাঁর নিজের বা অন্য আলেমদের দ্বারা সেই
কথার বিস্তারিত ব্যখ্যা জানা ও বুঝা যায়।
(৩) অনেক সময় আলেমরা কথা বলেন সঠিক, কিন্তু
শ্রোতারা তাদের বুঝ কম হওয়ার কারণে বুঝতে ভুল করেন।
(৪) আবার কখনো কোন একজন আলেমের একটা নির্দিষ্ট
ব্যপারে তাঁর অবস্থান ভুল বা দুর্বল হতে পারে, যা অন্য আলেমদের কাছ থেকে জানা ও বুঝা
যায়।
সুতরাং, আলেমদের কথা গ্রহণ ও বর্জন করার জন্যে
আমাদের অনেক কথা ও দিক চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। শুধুমাত্র নিজের ইলমের ভরসা না
করে আলেমদের বুঝ ও দিক নির্দেশনা জানার প্রয়োজন রয়েছে। নিজের ভালো লাগা একজন মাত্র
শায়খের উপরে নির্ভর না করে অন্য আলেমদের বক্তব্য জানা ও বুঝার প্রয়োজন রয়েছে।
__________________________
আমি আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি। সাইয়েদ কুতুব (আল্লাহ
তাকে মাফ করুন) এবং তার লিখা বইগুলোর ব্যপারে আমাদের দৃষ্টিভংগি কেমন হওয়া উচিৎ? এ
ব্যপারে আপনি যদি শায়খ সালেহ আল-মুনাজ্জিদের ফতোয়া দেখেন, তাহলে দেখতে পারবেন, তিনি
সাইয়েদ কুতুবের প্রশংসা করে থাকেন এবং তার বই পড়ার জন্যে মানুষকে উৎসাহিত করে থাকেন।
অথচ, এ ব্যপারে আলেমদের কিছু বক্তব্য আমি তুলে ধরছিঃ
(১) শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসায়মিন রাহিমাহুল্লাহ
বলেন, “যদি আল্লাহর ভয় না থাকতো, তাহলে আমরা সাইয়েদ
কুতুবকে তাকফীর করতাম।”
(২) শায়খ সালেহ আল-ফাউজান হা’ফিজাহুল্লাহ বলেন, “সাইয়েদ কুতুব একজন জাহেল, একারণে তাকে তাকফির
করা হবেনা।”
(৩) শায়খ নাসির উদ্দিন আলবানি রাহিমাহুল্লাহ
বলেন, “সাইয়েদ কুতুব এর দ্বারা অনেকে ইসলামের দিকে
উৎসাহিত হয়েছে, কিন্তু সে কোন আলেম ছিলোনা। সে মানুষকে ইসলাম-এর দিকে আহবান করতো; কিন্তু
ক্বুরান, সুন্নাহ ও সালফে সালেহীনদে আদর্শ সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিলোনা। তাকে রদ্দ করা
‘ওয়াজিব’, তবে সেটা নম্রভাবে করতে হবে।”
(৪) শায়খ রাবী বিন হাদী আল-মাদখালী হা’ফিজাহুল্লাহ বলেন, “সাইয়েদ কুতুব তাকফিরীদের মাথা।”
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে সাইয়েদ কুতুবের ব্যপারে
শায়খ মুনাজ্জিদের সাথে সালাফী আলেমদের ফতোয়ার পার্থক্য হয়েছে। যারা সাইয়েদ কুতুবের
দাওয়াতের আসল চেহারা এবং তার ব্যপারে আলেমদের বক্তব্য না জানেন, এমন ব্যক্তিরা কিন্তু
শায়খ মুনাজ্জিদের ফতোয়া এবং সেখানে উল্লেখিত শায়খ ইবনে উসায়মিনের কথার দ্বারা খুব সহজেই
ভুল মেসেজ নিতে পারেন।
__________________________
সুতরাং, আমি আমার দ্বীনি ভাইদেরকে আহবান জানাবো,
আপনারা “ফিকহ” বা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করার জন্যে চেষ্টা করুন। প্রকৃত আলেমদের কথা শুনুন এবং
তাদের সংস্পর্শ থাকার চেষ্টা করুন। আর “দ্বাইয়ী” নামের অনেক জাহিল লোক, যারা ফিকহ থেকে বঞ্চিত বা যাদের জ্ঞানে ত্রুটি রয়েছে, তাদের
ব্যপারে সতর্কতা অবলম্বন করুন, যদিওবা আমাদের মাঝে তারা সালাফী, সহীহ আকিদাহ নামে পরিচিত।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে উপকারী ইলম দান করুন, আমিন।
__________________________