_____________________________________
‘মুফতী’ কাকে বলা হয়?
যেই আলেমের ‘ইজতেহাদ’ করে অর্থাৎ, ক্বুরান ও হাদীস গবেষণা করে ‘ফতোয়া’ দেওয়ার মতো যোগ্যতা রয়েছে, তাকে মুফতী বলা হয়। ‘ফতোয়া’ হচ্ছে দ্বীনের কোন বিষয়ে
মতামত দেওয়া। যেমন, কোন আলেমকে জিজ্ঞেস করা হলো, “অমুক কাজটা কি হালাল নাকি হারাম?” এর উত্তরে তিনি বললেন, “ক্বুরান ও হাদীসের উপরে
আমার গবেষণা অনুযায়ী এই কাজটি হারাম” অথবা, “শরিয়তের দৃষ্টিতে এই কাজটি হারাম” – এমন বলা, এটা হচ্ছে সেই আলেমের
ফতোয়া। কোন আলেম কোন কিছুকে
হালাল বা হারাম বানাতে পারেনা, হালাল বা হারাম বলার মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআ’লার। মুফতিরা শুধুমাত্র ক্বুরান ও হাদীস গবেষণা করে বের
করেন, আল্লাহ এটাকে হালাল করেছেন নাকি, হারাম করেছেন।
একজন আলেমের কোন ফতোয়া সঠিক হতে পারে, আবার ভুলও হতে পারে। কারণ, আলেমরাও মানুষ, তাই কোন আলেমের ফতোয়া ভুল
হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে ফতোয়া ভুল হোক আর সঠিক হোক, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যে দ্বীনের
ব্যপারে কোন প্রশ্নের উত্তর বের করার জন্যে তিনি যে কষ্ট করে গবেষণা করেছেন, এর
বিনিময়ে তার জন্যে সওয়াব রয়েছে। কোন আলেম যদি গবেষণা করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন এবং সঠিক ফতোয়া দেন, তাহলে
তার জন্যে দুইটি পুরষ্কার রয়েছে। একটি পুরষ্কার হচ্ছে গবেষণা করার জন্যে, আরেকটি হচ্ছে সঠিক ফতোয়া দেওয়ার জন্য। আর কোন যোগ্য আলেম যদি নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করেন,
কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্তে পোঁছাতে সক্ষম না হন, তবুও তার চেষ্টার জন্যে তিনি একটি
পুরষ্কার পাবেন। কোন আলেমের ফতোয়া ভুল হোক আর সঠিক হোক, আমাদের কাছে তাঁরা সব সময়েই সম্মান ও
মর্যাদার অধিকারী।
আলেমদের মাঝে সবাই মুফতী নন। অর্থাৎ, অনেকে আলেম হতে পারেন, ক্বুরান ও হাদীস সম্পর্কে একজন ব্যক্তি অনেক জ্ঞানী হতে পারেন, কিন্তু তার মানে এই না যে, তিনি একজন মুফতি। আলেমদের মাঝে সবচাইতে জ্ঞানী, পরহেজগার, সুন্নতের অনুসারী,
প্রখর স্মৃতিশক্তি ও তীক্ষ্ণ মেধা সম্পন্ন জ্ঞানী, যারা ‘ইজতেহাদ’ করার মতো যোগ্যতায় পৌঁছাতে সক্ষম হন, তাঁরা হচ্ছেন মুফতি। একজন আলেমের ফতোয়া দেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জনের জন্যে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। আমাদের দেশের কওমী মাদ্রাসার অনেকে মনে করেন, “কোন ব্যক্তি এতো হাজার ফতোয়া
মুখস্থ বলতে পারলে সে একজন মুফতি”, এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটা ধারণা। অন্য আলেমদের ফতোয়া মুখস্থ করে যে ব্যক্তি তার অন্ধ অনুসরণ করে, সে কোনদিন
মুফতি হতে পারেনা, বরং তিনি একজন ‘মুকাল্লিদ’ বা অন্ধ অনুসারী। কোন আলেম নিজস্ব যোগ্যতার ভিত্তিতে ফতোয়া দিয়ে, এবং অন্য আলেমদের কাছেও মুফতি
হিসেবে গ্রহণযোগ্য এবং স্বীকৃত হলে, তাঁকে আমরা একজন মুফতি বলতে পারি।
মুসলমানদের প্রাণের ভূমি, ইসলামের কেন্দ্র, মক্কা মদীনার দেশ সৌদি আরবের বর্তমান ‘প্রধান মুফতির’ নাম হচ্ছে, শায়খ আব্দুল আ’জিজ বিন আব্দুল্লাহ আহলুশ-শায়খ হা’ফিজাহুল্লাহ। বর্তমান সারা বিশ্বের মাঝে জীবিত আলেমদের মাঝে তিনি শীর্ষস্থানীয় একজন আলেম হিসেবে বিবেচিত। ১৯৯৯ সালে সৌদি আরবের প্রাক্তন প্রধান মুফতি আল্লামাহ আব্দুল আ’জিজ বিন বাজ
রাহিমাহুল্লাহ মৃত্যুবরণ করার পর শায়খ আব্দুল আ’জিজ বিন আব্দুল্লাহ আহলুশ-শায়খ সম্মানিত এই আসনের
উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য, আপনারা প্রতিবছর হজ্জের সময় ৯-ই জিলহজ্জ ‘আরাফাহর ময়দানে’ ইহরামের সাদা পোশাক পড়া অবস্থায় যাকে খুতবা দিতে দেখেন, তিনিই
হচ্ছেন শায়খ আব্দুল আ’জিজ
বিন আব্দুল্লাহ আহলুশ-শায়খ। সুবহা’নাল্লাহ, এটা আল্লাহর একটা নিয়ামত যে, তিনি একাধারে
বিগত ৩৪ বছর ধরে আরাফার ময়দানে খুতবা দিয়ে আসছেন। শায়খ এর জন্ম হয়েছিলো ১৯৪৩ সালে, অর্থাৎ বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৩ বছর। মাত্র ১৭ বছর বয়সে
তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন। আল্লাহ তাঁর
দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেন, কিন্তু এর পরিবর্তে তাঁকে সবচাইতে মূল্যবান জিনিস দ্বীনের
জ্ঞান দান করেন। ফা লিল্লাহিল হা’মদ।
সৌদি আরবের আরেকজন বড়
আলেম, শায়খ সালেহ আল-ফাওজান হা’ফিজাহুল্লাহ মুফতি
হিসেবে আরব, অনারব সর্বত্র অত্যন্ত পরিচিত এবং গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিত্ব। বিগত শতাব্দীর
শীর্ষস্থানীয় দুইজন আলেম ও মুফতি, শায়খ আব্দুল আজিজ বিন বাজ রাহিমাহুল্লাহ এবং শায়খ মুহাম্মদ বিন
সালেহ আল-উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ-কে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “আপনার পরে ফতোয়া
নেওয়ার জন্যে আমরা কার কাছে যাবো?” তাঁদের দুইজনেই
প্রথমেই যারা নাম বলেছিলেন এবং যার প্রশংসা করেছিলেন তিনি হচ্ছেনঃ শায়খ সালেহ
আল-ফাওজান। শায়খ সালেহ আল-ফাওজান হা’ফিজাহুল্লাহ ১৯৩৩ সালে
জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, বর্তমান (২০১৬ সালে) তাঁর বয়স হচ্ছে ৮৩ বছর। আকিদাহ, ফিকহ এবং
দ্বীনের অনেক বিষয়ের উপরে তাঁর অসংখ্য কিতাব রয়েছে, যার অনেকগুলো ইতিমধ্যে বাংলা,
ইংরেজীসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতে অনুদিত হয়েছে।
__________________________________________
দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের
ব্যপারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ
বর্তমানে টেলিভিশন, ইউটিউব, ফেইসবুক কিংবা
ইন্টারেন্টে এমন অনেক জনপ্রিয় বক্তা বা লিখক আছে, যাদেরকে মানুষ বড় ‘আলেম’ বা ‘দ্বাইয়ী’ মনে করে, কিন্তু তারা ‘সালফে সালেহীন’ (সাহাবীদের) আক্বীদাহ
(ধর্মীয় বিশ্বাস) ও মানহাজে (কর্ম পদ্ধিত বা চলার নীতিতে) বিশ্বাসী নয়। কিন্তু তারা সেটা
প্রকাশ করেনা বা তাদের আক্বিদাহ কি, তা কখনো স্পষ্ট করে বলেনা। অনেক সময় তারা
মনভোলানো যুক্তি ও কথার দ্বারা আহলে সুন্নাহর বিরোধীতা করে এবং কৌশলে তার
ভক্ত-শ্রোতাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। এমন ব্যক্তি যারা
মূলত বিদআ’তের অনুসারী, কিন্তু মানুষের কাছে
নিজেদের বিদআ’তকে লুকিয়ে রাখার
চেষ্টা করে, তাদের চেনার সহজ উপায়
হচ্ছেঃ সে কার সাথে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা রাখে, সে কোন ব্যক্তিদের
সাথে উঠা-বসা করে,
কার
প্রশংসা করে, সেইদিকে লক্ষ্য করা। কারণ, একজন মানুষ সাধারণত
তার বন্ধুর দ্বীনের অনুসারী হয়ে থাকে।
(১) রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “একজন মানুষ তার বন্ধুর
দ্বীনের অনুসারী হয়ে থাকে। সুতরাং সে যেনো লক্ষ্য রাখে, সে কার সাথে বন্ধুত্ব
করছে।” তিরমিজিঃ ২৩৭৮, হাদীসটি হাসান সহীহ, শায়খ আলবানী
রাহিমাহুল্লাহ।
(২) এজন্যেই ইমাম
আল-আউযায়ী (মৃত্যু-১৫৮ হিজরী) রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমাদের
কাছে তার বিদআ’তকে লুকিয়ে রাখে, সে কখনো আমাদের কাছে
তার সংগীদেরকে লুকিয়ে রাখতে পারবেনা।” আল-ইবানাহঃ ২/৪৭৬।
অনেকে ইসলামী বক্তা ও
লেখক প্রকাশ্য বিদআ’তি ব্যক্তি বা দলগুলোকে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে সমর্থন করার
চেষ্টা করে। এমন ব্যক্তিদের ব্যপারেও আমাদের আলেমরা সতর্ক করেছেন।
(৩) ইমাম ইবনে তাইমিয়া
রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
“যে ব্যক্তি বিদআ’তিদের প্রতি সু-ধারনা
রাখে এবং এই দাবি করে যে,
তাদের
অবস্থা অজ্ঞাত, তাহলে তাকে তাদের
(বিদআ’তিদের) অবস্থা
সম্বন্ধে অবহিত করতে হবে। সুতরাং,
সে
যদি বিদাতীদের ব্যপারে বিরোধী মনোভাবাপন্ন না হয়, এবং তাদের প্রতি
প্রতিবাদমূলক মনোভাব প্রকাশ না করে,
তাহলে
তাকেও বিদআ’তিদেরই মতাবলম্বী ও
দলভুক্ত বলে জানতে হবে।” মাজমুয়া ফাতাওয়াঃ
২/১৩৩।
(৪) শায়খ সালিহ
আল-লুহাইধান হা’ফিজাহুল্লাহ কে প্রশ্ন
করা হয়েছিলো,
প্রশ্নকর্তাঃ এক
ব্যক্তি আহলে সুন্নাহ এবং আহলে বিদআ’হ সবার সাথেই বসে এবং বলে, “এখন উম্মতের মাঝে অনেক
বিভক্তি হয়েছে, তাই আমি সবার সাথেই
বসি।” এমন দ্বাইয়ীদের
ব্যপারে কি বলা হবে?
উত্তরে শায়খ বলেনঃ “সে একজন বিদআ’তি। উম্মতের ঐক্যের
স্বার্থে হক্ক (আহলে সুন্নাহ) ও বাতিল (আহলুল বিদআ’হ, যেমন শীয়া, সূফী, খারেজী ইত্যাদি দলের
মাঝে) কোন পার্থক্য না করা,
এটা
একটি বিদআ’ত। আমরা তার হেদায়েতের
জন্য দুয়া করি।”
বিঃদ্রঃ আমার এই লেখায়
নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি বা দলের নাম উল্লেখ করা হলোনা। কারণ, তা অনেক সময় মানুষের
জন্যে ‘ফিতনাহ’ হয়ে দাঁড়ায়। কোন ব্যক্তি বা দলের
প্রতি আবেগ বা ভালোবাসার কারণে অনেকে লেখার মূল উদ্দেশ্য নিয়ে ভুল বুঝেন। আমাদের উদ্দেশ্য
মানুষের মাঝে ‘ইলম’ তুলে ধরা, গ্রহণ করা বা না করা
সেটা সবার নিজ নিজ ব্যক্তিগত ব্যপার।
(৫) সর্বশেষ, প্রখ্যাত তাবেয়ী
বিদ্বান, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে
সিরীন রহিমাহুল্লাহ এর মূল্যবান একটা উপদেশ দিয়ে এখানেই শেষ করছি। তিনি বলেছেন, “নিশ্চয়ই এই ই’লম , এটাই হচ্ছে তোমার
দ্বীন। সুতরাং, তোমরা কার নিকট থেকে ই’লম অর্জন করছো, তার সম্পর্কে ভালো করে
জেনে নিও।” সহীহ মুসলিম,
মুকাদ্দিমা।
__________________________________________
“আলেম” কে? বর্তমান যুগের
আলেম কারা? বিসমিল্লাহ। আলহা’মদুলিল্লাহ।
ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আ’লা রাসুলিল্লাহ।
আম্মা বাআ’দ। আজকাল মানুষ যাদেরকে “আলেম” বলে মনে করেঃ
১. টিভিতে কাউকে কুরআন ও হাদীস নিয়ে কিছু কথা
বলতে দেখলে,
২. কুরান হাদীসের মনগড়া ব্যখ্যা করে কিছু লেখালিখি
করতে পারলে,
৩. ইউটিউব বা ইন্টারনেটে কিছু ওয়াজ-লেকচার ছেড়ে
জনপ্রিয়তা পেলে,
৪. ফেইসবুক, টুইটারে কয়েক লক্ষ লাইক, ফলোয়ার
বা একনিষ্ঠ মুরীদ জোটাতে পারলে,
৫. বড় কোন মাদ্রাসা বা সংগঠনে পজিশান বা ক্ষমতা
দখল করে বসে থাকলে,
৬. মুফতি, মুহাদ্দিস হিসেবে সার্টিফিকেট নিতে
পারলে অথবা নামের পূর্বে মাওলানা, শায়খ ইত্যাদি টাইটেলে যোগ করলে,
৭. হৃদয় গলানো বা গরম গরম আবেগী বক্তৃতা দিয়ে
বা মনভুলানো কিছু লেখালিখি করে মানুষের মগজ ধোলাই করতে পারলে।
যাই হোক, এইগুলো কি আসলেই কারো “আলেম” হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ?
ইসলাম কি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, এই গুণগুলো
কারো মাঝে থাকলেই সে আলেম হয়ে যাবে?
আমাদের পূর্ব যুগের মুসলমানেরা এইভাবে মানুষকে
“আলেম” হিসেবে গ্রহণ করতোনা। কারণ আমরা যারা সাধারণ মানুষ, দ্বীন সম্পর্কে, কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে জ্ঞানী
না, তাদের সামনে যদি একজন মূর্খ লোকও সামান্য কিছু পড়াশোনা করে আলেমের লেবাস ধরে, আমরা
কিন্তু ধরতে পারবোনা এই লোকটা আসলেই কি একজন আলেম? নাকি আলেম না হয়েও আলেম সেজে আমাদেরকে
ধোঁকা দিচ্ছে? যেমন একজনু জুহুরীই কেবলমাত্র চিনতে পারে কোনটা আসল রত্ন কোনটা সস্তা
পাথর, একজন স্বর্ণকারই চিনতে পারে কোনটা খাঁটি স্বর্ণ আর কোনটা সিটি গোল্ড বা ইমিটেশান। ঠিক তেমনি একজন প্রকৃত আলেমই আসলে চিনতে পারেন, কে আলেম আর কে জাহেল (মূর্খ)।
এজন্য সাহাবীদের পর থেকে তাবেয়ীদের যুগ থেকে,
যখন থেকে মুসলমানদের মাঝে “উলামায়ে সু” (মন্দ বা পথভ্রষ্ট
আলেম) ও আয়াম্মায়ে দ্বোয়াল্লিন (পথভ্রষ্ট ইমাম বা নেতা) মুসলিম উম্মাহর মাঝে প্রবেশ
করেছে, তখন থেকেই আমাদের আলেমরা বার বার সতর্ক করে গেছেনঃ ইসলাম শেখার জন্য যাকে-তাকে
“উস্তাদ” বা শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ
না করার জন্য। অপরিচিত কোন ব্যক্তি,
যাকে সম সাময়িক আলেমরা চিনেন না, বা যারা আলেমদের কাছ থেকে দ্বীন শিখেনি, তাঁদের সাথে
কোন সম্পর্ক রাখেনা, তাদের কথা বা ওয়াজ-লেকচারা শোনা বা বই না পড়ার। দ্বীনের ব্যপারে “প্রকৃত আলেম” ছাড়া অপরিচিত, অজ্ঞ
লোকদেরকে আলেম মনে করে তাদের কথা বিশ্বাস করবেনা। যদি করো, তাহলে যেন তুমি তোমার দ্বীনকেই ধ্বংস করলে!
অপরিচিত (অজ্ঞ/বেদাতী) লোকদের কথা শোনা খুবই
মারাত্মক একটা বিষয়। কারণ অতীত থেকে আজ পর্যন্ত
এমন অনেক ঘটনাই হয়েছে যে একজন অপরিচিত লোক, সে কি প্রকৃত আহলে সুন্নাহ নাকি আহলে বিদআ'ত
ভালোভাবে খোজ না নিয়েই তার কথা শুনেছে। আর ধোঁকাবাজ, চতুর লোকেরা
নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে কৌশলে শিরক-বিদআ'ত ও তাদের গোমরাহী সুন্দরভাবে সাধারণ মানুষের
সামনে উপস্থানপন করেছে। প্রথম প্রথম অনেকেই,
“উনার কথা শুনতে ভালো
লাগে”, “সেতো কুরান হাদীসের
কথাই বলছে” এই যুক্তিতে তার কথা শুনেছে, কিন্তু জ্ঞানের অভাবে তার ভুল
অথবা শিরক-বিদআ'ত ধরতে না পেরে অনেক সৎ ও ধার্মিক মুসলমানও শেষ পর্যন্ত সেই সমস্ত শিরক-বিদআ'তগুলোর
মাঝে পতিত হয়ে তাদের দ্বীনকে ধ্বংস করেছে। আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয়
প্রার্থনা করছি।
এজন্য আলেমরা অপরিচিত কেউ এবং কেউ প্রকৃত আহলে
সুন্নত নাকি ভেজাল আহলে সুন্নত, আহলে বিদআতের লোক কিনা, আলেম নাকি জাহেল, এই বিষয়গুলো
ভালোভাবে যাচাই না করে তার কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান নিতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
এই ব্যপারে প্রখ্যাত তাবেয়ী, ইমাম মুহাম্মাদ
ইবনে সিরীন রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ১১০ হিজরী), তিনি বলেছেন, “এই যে জ্ঞান (দ্বীনের
ব্যপারে), এটাই হচ্ছে তোমার দ্বীন। সুতরাং, কার কাছে থেকে
তুমি দ্বীনের জ্ঞান নিচ্ছ সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকো।” সহীহ মুসলিম।
এইজন্য আমার যাকে ভালো লাগে, যার বই পড়ে বা ওয়াজ
শুনে আমার কাছে বড় আলেম, জ্ঞানী ব্যক্তি মনে হয়, তাকেই আলেম হিসেবে মনে করা মারত্মক
ভুল। বরং দেখতে হবে, যার ব্যপারে কথা হচ্ছে, তার ব্যপারে
তার পূর্বে যারা “আলেম” ছিলেন, তারা কি তাকে
একজন আলেম বলে মনে করতেন, নাকি জাহেল (মূর্খ) বলে মনে করতেন?
“ইলম” বা দ্বীনের জ্ঞান আকাশে
বাতাসে ঘুরে বেড়ায় না, যার ইচ্ছা নিয়ে সে আলেম হয়ে যাবে অথবা এমনটা ঠিকনা যে, বই পড়েই
কেউ আলেম হয়ে যাবে। এটা ঠিক ভালো কিছু বই
পড়ে, বা কিছু উপকারী কথা শুনে আমার ইলম বাড়বে, কিন্তু তার মানে এইনা যে এর দ্বারা আমি
বড় কোন “মুফতি”, “আলেম”, “আল্লামাহ” হয়ে যাবো। যেমন কেউ নিজে নিজে ডাক্তারীর উপরে কিছু বই পড়েই ডাক্তার হয়ে যায়না, তার জন্য
তাকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে হবে, প্রফেসর ডাক্তারদের কাছ থেকে হাতে-কলমে ডাক্তারী
শিখতে হবে। ঠিক তেমনি কেউ নিজে
নিজে শুধু কুরআন হাদীস পড়েই আলেম হয়ে যেতে পারেনা। তাকে অবশ্যই আলেমদের কাছে যেতে হবে, দীর্ঘদিন ধরে তাদের সাথে থেকে, তাদের সাথে
সময় কাটিয়ে কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এইভাবে আলেমদের সাথে ছাত্র-শিক্ষকের যে সম্পর্ক তৈরী হবে, এর মাধ্যমেই আসলে
পরবর্তী প্রজন্মের আলেম তৈরী হয়। অর্থাৎ, পূর্বের যারা
আলেম, তাঁরা তাদের ছাত্রদের মাঝে যারা জ্ঞানী, বিচক্ষণ, আল্লাহওয়ালা তাদেরকে “আলেম” বলে ঘোষণা করে যান। উম্মতের লোকদেরকে তাদের কাছ থেকেই উপকৃত হতে নসীহত করে যান।
এর উদাহরণ হিসেবে ইমাম মালেক এর বিখ্যাত ঘটনা
বলা যেতে পারে। ইমাম
মালেক রাহিমাহুল্লাহ বলেছিলেনঃ “আমি ততদিন পর্যন্ত কোন ফাতওয়া দেইনি,
যতদিন পর্যন্ত না ৭০ জন আলেম আমাকে ফাতওয়া দিতে বলেছেন।”
অর্থাৎ ইমাম মালেক নিজে থেকে কোন ফাতওয়া দেন
নি (অর্থাৎ আলেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নি), যতদিন পর্যন্ত না ৭০ জন আলেম তাকে “আলেম” বলে ঘোষণা করেছেন। এইভাবে পূর্ববর্তী আলেমরা যখন কাউকে “আলেম” হিসেবে ঘোষণা করেন,
আমরা সাধারণ মানুষেরা ঐ আলেমদেরকে অনুসরণ করবো, তাদের কাছ থেকে ইলম নেবো – তবে অন্ধভাবে নয়, কুরআন
ও সুন্নাহর ভিত্তিতে।
মুসলিমদের চিরাচরিত নীতি অনুযায়ী, বর্তমান যুগের
আলেম কে এটা জানার জন্য আমরা দেখবো এর আগের যুগে যারা “আলেম” ছিলেন তারা কাকে আলেম
বলে ঘোষণা করেছেন। বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ
আলেমদের মাঝে সৌদি আরবের সাবে প্রধান মুফতি আল্লামাহ শায়খ আব্দুল আ’জীজ ইবনে আব্দুল্লাহ
ইবনে বাজ রাহিমাহুল্লাহ, শীর্ষস্থানীয় অন্য আরেকজন আলেম আল-ফকীহ, শায়খ মুহা’ম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমিন,
এই দুইজনকেই যখন প্রশ্ন করা হয়েছিলোঃ আপনাদের পরে ফতোয়া নেওয়ার জন্য আমরা কার কাছে
যাবো? তারা দুইজনেই সবার প্রথম যার কথা বলেছিলেন তিনি হচ্ছেনঃ আল্লামাহ সালেহ আল-ফাওজান
হা’ফিজাহুল্লাহ। উল্লেখ্য শায়খ বিন বাজ, শায়খ উসাইমিনসহ আরো অন্যান্য বড় বড় আলেমরা আমাদেরকে
শায়খ ফাওজানের কাছ থেকে ইলম নিতে বলেছেন।
এমনিভাবে বর্তমান যুগে জীবিত আছেন, এমন আরো কিছু
আলেমদের নাম নিচে দেওয়া হলো। উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গা
ছাড়াও আহলে সুন্নতের আরো কিছু বড় আলেম রয়েছেন, আল্লাহ তাদের সকলকে হেফাজত করুন, আমিন।
১. শায়খ সালেহ আল-ফাওজান হা’ফিজাহুল্লাহ
২. শায়খ আব্দুল আজীজ ইবনে আব্দুল্লাহ আর-রাজিহি
হা’ফিজাহুল্লাহ
৩. শায়খ আব্দুল আজীজ আলে-শায়খ হা’ফিজাহুল্লাহ
৪. শায়খ সুলায়মান আর-রুহাইলি হা’ফিজাহুল্লাহ
৫. শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ হা’ফিজাহুল্লাহ
৬. শায়খ রাবী বিন হাদী আল-মাদখালী হা’ফিজাহুল্লাহ
৭. শায়খ সালেহ বিন আব্দুল আজীজ আলে-শায়খ হা’ফিজাহুল্লাহ
৮. শায়খ উয়াসী উল্লাহ আব্বাস হা’ফিজাহুল্লাহ
৯. শায়খ সালেহ আল-লুহাইধান হা’ফিজাহুল্লাহ
১০. শায়খ উবায়েদ আল-জাবেরী হা’ফিজাহুল্লাহ
১১. শায়খ সালেহ আস-শুহাইমি হা’ফিজাহুল্লাহ
১২. শায়খ ফালাহ ইসমাঈল মান্দিকার হা’ফিজাহুল্লাহ
১৩. শায়খ মুহাম্মদ রামাজান আল-হাজিরি হা’ফিজাহুল্লাহ
১৪. শায়খ মুহাম্মাদ সাঈদ রাসলান হা’ফিজাহুল্লাহ
১৫. শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ
হা’ফিজাহুল্লাহ
*******************************
‘আলেম’ কে? একজন
‘আলেম’ এর কি কি যোগ্যতা থাকা
চাই?
এই পোস্টটি লিখেছেনঃ শায়খ আব্দুর রাকীব বুখারী
বাংলা ভাষায় দ্বাইয়ীঃ খাফজী ইসলামিক সেন্টার
সৌদি আরাবিয়া
এই বিষয়টির উপর ৪০০ হিজরীর একজন বড় আলেম, ইমাম
আব্দুল বার (রহঃ) তার ‘জামি বায়ানুল ইলম ওয়াল-ফাজলি’ নামক কিতাবে একজন ‘আলেম’ হওয়ার জন্য যে সমস্ত
শর্ত আরোপ করেছেন, নিম্নে তা উল্লেখ করা হল।
(১) ক্বুরানুল কারীম সম্পর্কে জ্ঞান
হাফেজে কিতাবুল্লাহ, ৩০ পারা অর্থাৎ সম্পূর্ণ
ক্বুরানুল কারীম তার মুখস্থ থাকতে হবে। কোন ব্যক্তির আলেম হওয়ার
জন্য এটা আব্যশক, তবে ওয়াজিব নয়।
=> জরুরী হল আয়াতে আহকাম অর্থাৎ যে সমস্ত
আয়াতগুলো হুকুম (আদেশ-নিষেধ) আছে সেগুলো হিফজ করা।
=> আয়াতের শানে নুজুল ও তাফসির জানা।
=> ক্বুরান বোঝার জন্য সকল উৎস জানা।
=> নূন্যতম ১০ পারা হিফজ করা।
(২) হাদীস বা ‘সুন্নাহ’ সম্পর্কে জ্ঞান
কুতুবে সিত্তাহ তথা প্রসিদ্ধ ৬টি হাদীসের কিতাব
আর সেইগুলো হচ্ছে,
ক. সহীহ বুখারী, খ. সহীহ মুসিলীম,
গ. জামি তিরমিজি, ঘ. সুনানে আবু দাউদ,
ঙ. সুনানে নাসাঈ, চ. সুনানে ইবনে মাজাহ।
(এবং) অন্যান্য হাদীসের কিতাবগুলো যেমন,
সুনানে দারেমি,
মুসনাদে আহমাদ
বাইহাক্বী ও
সহীহ ইবনে খুজাইমা।
এই সমস্ত কিতাবের সবগুলো হাদিসে কারিমা সম্পর্কে
জ্ঞান থাকা, কোনটা সহীহ, কোনটা জাল বা জয়ীফ বিস্তারিত ‘তাহকীক’ সহ।
(৩) ৫টি কিতাব সম্পর্কে জ্ঞান
উপরে বর্ণিত হাদীসের কিতাবগুলো থেকে সংকলন করা
গুরুত্বপূর্ণ কিছু হাদীস নিয়ে ৫ জন ইমামের লিখিত পাঁচটি কিতাব সম্পর্কে একজন আলেম এর
ইলম থাকা জরুরী। সেই কিতাবগুলো হচ্ছে
–
ক. বুলুগুল মারআ’ম মিন আদিল্লাতীন আহকাম।
খ. উমদাতু আল-আহকাম
গ. আল মোহাররার হাদিসিল আহকাম
ঘ. আল ইলমাম
ঙ. মিশাকাতুল মাসাবিহ
(৪) উসুলে হাদিসের ইলম বা হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি
সম্পর্কে জ্ঞান
(৫) উসুলে ফিকহের ইলম বা ফিকহ শাস্ত্রের মূলনীতি
সম্পর্কে জ্ঞান
(৬) আরবি গ্রামার এর ইলম
(৭) নাসেখ, মানসুখের ইলম
(৮) নাহু ছরফের ইলম
(৯) ইজমা এ উম্মাহ বা উম্মতের ঐক্যমতের দলিল
জানা ইত্যাদি
সমাপ্ত
পরিশেষে বলছি, এই গুণগুলোর অধিকারী এমন ব্যক্তি
যাকে একজন ‘আলেম’ হিসাবে মানা যায়, আমাদের দেশে এই রকম
কেউ আছে বলে আমি (আব্দুর রাকীব বুখারী) জনিনা।
জাজাকাল্লাহু খাইরান। এডমিন কর্তৃজ কিছুটা সম্পাদিত। আপনারা আরো জানার জন্য
শায়খের এই লেকচারটা দেখুন –
“আলেম কাকে বলে এবং আলেমদের
পরিহাস করা কেমন?”
https://www.youtube.com/watch?v=byX8867pyvk&feature=youtube_gdata_player