সিদরাতুল মুনতাহা ও রফরফ
আরবী ‘সিদরাহ’ শব্দের
অর্থ হচ্ছে কুল বা বড়ই গাছ, আর ‘মুনতাহা’ শব্দের
অর্থ হচ্ছে শেষ সীমানা। সুতরাং, ‘সিদরাতুল
মুনতাহা’ অর্থ
হচ্ছেঃ একেবারে শেষ সীমানায় অবস্থিত বড়ই গাছ। এই গাছটি সাত আসমানের উপরে, একেবারে শেষ সীমানায় অবস্থিত, যা অত্যন্ত
সুন্দর ও সুসজ্জিত। এই গাছটিকে সিদরাতুল মুনতাহা বলা হয় কারণ এটা হচ্ছে আল্লাহ তাআ’লার আরশ ও
তাঁর সমগ্র সৃষ্টির মাঝে একটা সীমানা বা বাউন্ডারী। সিদরাতুল মুনতাহার উর্ধে কোন
ফেরেশতা গমন করতে পারেনা, এমনকি আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত কোন ফেরেশতাও না।
সিদরাতুল মুনতাহার উর্ধে আল্লাহর আরশে মুআ’ল্লাকা অবস্থিত।
মিরাজের
রাত্রিতে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া
সাল্লাম-কে জিব্রাঈল আ’লাইহিস সালাম সিদরাতুল
মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে একা রেখে চলে যান, কারণ সিদরাতুল মুনতাহার
সীমানা অতিক্রম করে আরশের দিকে অগ্রসর হলে আল্লাহ তাআলা’র নূরে
জিব্রাঈল আ’লাইহিস
সালাম-এর ডানাগুলো পুড়ে যেত। আর তাঁর যাওয়ার অনুমতিও ছিলোনা।
আল্লাহ তাআ’লা যত
ওয়াহী (আদেশ বা বিধানাবলী) নাযিল করেন, তা আরশ থেকে প্রথমে
সিদরাতুল মুনতাহা নাযিল করা হয়। অতঃপর, সেখান থেকে ওয়াহী
বহনকারী সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদের মাধ্যমে তা দুনিয়াতে প্রেরিত হয়। অনুরূপভাবে,
বান্দাদের আমলনামা সমূহ প্রথমে সিদরাতুল মুনতাহা নিয়ে আসা হয়।
অতঃপর, এখান থেকে আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। ফেরেশতা বা
নবী-রাসুল কেউই সিদরাতুল মুনতাহার স্থান অতিক্রম করতে পারেননি, একমাত্র আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম
ছাড়া।
মিরাজের রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে এসে সিদরাতুল মুনতাহা
সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমি সিদরাতুল মুনতাহা দেখলাম। এর ফল (বড়ই) যেন ‘হাজার’ নামক
স্থানের (বড়) মটকার ন্যায়। আর তার পাতা যেন হাতীর কানের মতো বড়। সিদরাতুল মুনতাহার
মূল থেকে চারটি ঝরনা প্রবাহিত হয়েছে। দুইটি ঝরণা ভেতরে, আর
দুইটি ঝরণা বাইরে। এই (চারটি ঝরণা) সম্পর্কে আমি জিবরাঈলকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি
বললেন, ভেতরের দুইটি ঝরণা জান্নাতে
অবস্থিত। আর বাইরের ঝরণা দুইটির একটি হল (ইরাকের) ফুরাত, আর অপরটি হল (মিশরের) নীল নদ।
সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে ‘রফরফ’ নামক একটি বাহন আরশে মুআ’ল্লাকা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। রফরফ আরবী শব্দ, যার
অর্থ হচ্ছেঃ রেশমী কাপড়, বালিশ, চাদর,
মাদুর ইত্যাদি। রফরফ হল সবুজ রংয়ের গদি বিশিষ্ট একটা পালকী বিশেষ,
এক প্রকার বাহন, যার মাধ্যমে নবী
সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া
সাল্লাম সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আরশে মুআ’ল্লাকা গিয়েছিলেন।
অতঃপর, নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এক
টুকরা মেঘ আচ্ছাদিত করে ফেলে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম
সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। এসময় মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার অতীব নিকটে আসেন এবং তাঁর দিকে
ঝুকে পড়েন। এ সময় উভয়ের মাঝে দূরত্ব ছিল দুই ধনুক বা, দুই
গজেরও কম। তখন আল্লাহ তাঁকে ওয়াহী করেন। এই ঘটনা আল্লাহ তাআ’লা কুরআনুল কারীমেও উল্লেখ করেছেন, “অতঃপর তিনি নিকটবর্তী হলেন এবং ঝুলে গেল। তখন (তাঁদের মাঝে ব্যবধান ছিলো) দুই ধনুকের ব্যবধান বা তার চাইতেও কম। তখন আল্লাহ স্বীয়
বান্দার প্রতি যা ওয়াহী (প্রত্যাদেশ) করার তা
করলেন।” সুরা আন-নাজমঃ ৮-১০।
উল্লেখ্য, মিরাজের রাতে আল্লাহ তাআ’লা নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-কে যা ওয়াহী করেছিলেন, তার মাঝে অন্যতম ছিলোঃ দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত বা
নামায ফরয করার বিষয়টি। প্রথমে আল্লাহ তাআ’লা আমাদের উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছিলেন। কিন্তু নবী
সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া
সাল্লাম যখন এই আদেশ নিয়ে ফিরে আসছিলেন, তখন সাইয়্যিদিনা
মুসা আ’লাইহিস
সালাম তাঁকে বলেন, হে মুহাম্মাদ আপনার উম্মতের
লোকদের জন্যে দিনে-রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায় করার বোঝা ভারী হয়ে যাবে, যার
কারণে তারা তা আদায় করবেনা। সুতরাং, আপনি আল্লাহর কাছে আবার যান এবং নামায কমিয়ে
নিন। এভাবে কমাতে কমাতে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ নামাযকে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করে দেন।
এরপরে আরো কমানোর জন্যে আল্লাহর কাছে যেতে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সংকোচ বোধ করলেন। কিন্তু আল্লাহ তাআ’লা তাঁর দয়াবশত আমাদের জন্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করলে তার জন্য প্রথমে
নির্ধারিত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের সওয়াব দান করবেন বলে ঘোষণা করলেন। সুবহা’নাল্লাহি ওয়া বিহা’মদিহী, সুবহা’নাল্লাহিল আ’যীম।