দুনিয়া vs আখেরাতঃ
মানুষের স্বভাব হচ্ছে যেই জিনিসটা নগদ নগদ বা দ্রুত পাওয়া
যায়, সেটা নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সেটা অল্প হোক কিংবা বেশি। কিন্তু পরবর্তীতে
অনেক বড় কিছু অপেক্ষা করলেও মানুষ সেটাকে মূল্যায়ন করে না। আমি কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি
যাতে করে বিষয়টা বুঝতে আপনাদের জন্যে সহজ হয়।
(১) অনেকে মনে করে,
ইংল্যান্ড-আমেরিকার মতো ইয়াহুদী-খ্রীস্টানদের দেশে বসবাস করতে পারলে নিজের ও ছেলে-মেয়েদের
জীবন সুন্দর ও নিরাপদ হবে। এটা দুর্বল ঈমানদার মুসলমানদের মাঝে মারাত্মক একটা ভুল ধারণা।
যাই হোক, একটু ভালো থাকার আশায় কাফের দেশে যাওয়ার জন্যে হাজার-হাজার মুসলমানেরা মাথার
ঘাম পায়ে ফেলে ইংরেজী ভাষা শিখছে, লক্ষ-লক্ষ টাকা খরচ করছে, মানুষের কাছে বুদ্ধি নেওয়ার
জন্য ছুটাছুটি করছে. . .কিন্তু কুরআন পড়া ও বুঝার জন্যে তারা আরবী ভাষা শিখছেনা। যেই
নামায না পড়লে সাক্বার নামক জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে, যেই নামায সম্পর্কে কিয়ামতের
দিন সর্বপ্রথম প্রশ্ন করা হবে, সেই নামায তাদের অধিকাংশ মানুষই পড়ছেনা। অত্যন্ত দুঃখের
বিষয় হচ্ছে, অনেকে নামায পড়ার সঠিক নিয়ম-কানুন জানেনা, জানার চেষ্টাও করেনা কিংবা এই
বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেনা।
(২) জামাতের প্রথম
কাতারে নামায পড়ার এতো বড় ফযীলত যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “লোকেরা যদি জানতো যে জামাতের প্রথম কাতারে
নামায পড়ার কি সওয়াব রয়েছে, তাহলে লোকেরা (প্রথম কাতারে নামায পড়ার জন্যে এতো বেশি
প্রতিযোগিতা করতো যে), লটারী দেওয়া ছাড়া প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর সুযোগ কেউ কখনো
পেতোনা।” এতো বড় পুরষ্কার
থাকা সত্ত্বেও লোকেরা জামাতের প্রথম কাতারে নামায পড়ার জন্যে কোন প্রতিযোগিতা
করেনা। কিন্তু হলিউড-বলিউডের জেনাকারী, উলংগ নায়িকা-গায়িকাদেরকে নাচ-গান দেখার
জন্যে, হারাম ও জুয়ার সমতুল্য ক্রিকেট-ফুটবল খেলা দেখার জন্য প্রতিযোগীতা করছে,
এইগুলোর টিকেট কেনার জন্যে সারাদিন লম্বা লাইন ধরে হাজার টাকা খরচ করছে, এমনকি
মারামারিও করছে।
(৩) বর্তমান যুগের মুসলমানদের অবস্থা হয়েছে এমন যে, দুনিয়াবি বিষয়ে কারো কখনো বুদ্ধির প্রয়োজন হলে মানুষ হাজার হাজার টাকা খরচ করে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির শরণাপন্ন হয়। কিন্তু দ্বীনের ব্যপারে প্রশ্নের উত্তর জানার প্রয়োজন হলে মানুষ আলেম আর জাহেল দেখেনা। সামনে যাকে পায়, তাকেই জিজ্ঞেস করছে, ফুটপাত থেকে ফতোয়া নিচ্ছে। আজকাল টিভি, ইউটিউব ফেইসবুকের যুগে মূর্খ লোকেরা নিজের মনগড়া দ্বীন প্রচার করেছে। মানুষ আলেমদের কাছে না গিয়ে সহজেই মোবাইল বা কম্পিউটারে হাতের কাছেই পাওয়া যায়, সেইজন্যে জাহেলদের কাছ থেকেই দ্বীন শিখছে।
এই উদাহরণগুলো থেকে সহজেই বুঝা যায়, মানুষ দুনিয়াকে কতটুকু
মূল্যায়ন করছে, আর আখেরাতকে কতটুকু মূল্যায়ন করছে। মানুষের এই চিরন্তন স্বভাবের সমালোচনা
করে আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
“বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে থাক। অথচ, পরকালের
জীবনই হচ্ছে উত্তম এবং চিরস্থায়ী।” সুর আল-আ’লাঃ
১৬-১৭।
আল্লাহ তাআ’লা আরো বলেছেন, “নিশ্চয় তারা দ্রুত চলে আসে এমন জীবনকে (অর্থাৎ দুনিয়াকে) ভালবাসে।
আর তারা পরবর্তীতে আসে এমন কঠিন দিনকে (অর্থাৎ পরকালকে) উপেক্ষা করে চলে।” সুরা আল-ইনসানঃ ২৭।
আয়াতের তাফসীরঃ
মৃত্যুর পরের জীবন আখেরাতকে বিশ্বাস করেনা, বা আখেরাতের
ব্যপারে সন্দেহ পোষণ করে এমন কাফের-মুশরেক এবং তাদের মতোই অন্য লোকেরা সর্বদা দুনিয়াবী
আশা-আকাংখার মায়াজালে বন্দী থাকে। তাদের সমস্ত চেষ্টা ও মনোযোগ দুনিয়ার জন্যেই ব্যয়
করে। কিয়ামত ও তার কঠিনতা, ভয়াবহতাকে তারা ‘উপেক্ষা করে চলে’। অর্থাৎ, কেয়ামতের জন্য তারা কোন প্রস্তুতি গ্রহণ করে না, এবং
তার কোন পরোয়াও করে না।
দুনিয়ার জীবনে ভোগ-বিলাসের প্রতি অনাসক্ত হয়ে আখেরাতকে প্রাধান্য
দেওয়ার মর্যাদা নিয়ে অন্তর ছুঁয়ে যায় এমন একটা হাদীসঃ
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি দুনিয়াকে তার সবচাইতে গুরুত্বপুর্ণ
বিষয় বানাবে, আল্লাহ তার কাজকর্ম এলোমেলো করে দেবেন, তার দুই চোখের মাঝে সর্বদা দারিদ্রতাকে
দৃশ্যমান করে রাখবেন। আর সে দুনিয়া শুধুমাত্র ততটুকুই লাভ করতে পারবে, যতটুকু তার তাকদীরে
লিপিবদ্ধ ছিলো। আর যার কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে পরকাল, আল্লাহ তার সব কাজ
সুন্দরভাবে সমাধান করে দিবেন, তার অন্তরকে তৃপ্ত করে দেবেন। আর দুনিয়া নিজেই তার কাছে
ধরা দেবে, যদিও সে তা কামনা করেনা।”
সুনানে ইবনু মাজাহঃ
৪১০৫। হাদীসের সনদ সহীহ, তাহকীকঃ শায়খ আলবানী (রহঃ)। সিলসিলাহ সহীহাহঃ
৯৫০।