মুমিন কারা? মুমিনদের বৈশিষ্ট্য কি?
জান্নাতুল ফেরদাউসে কারা যাবে?
সুরা মুমিনুনের প্রথম ১১টি আয়াতের তর্জমা ও
তাফসীর।
আ’উযুবিল্লা-হিমিনাশ শায়তানীর রাজীম। বিসমিল্লাহির-রাহমানির
রাহীম।
অর্থঃ বিতাড়িত শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে আমি আল্লাহর কাছে
আশ্রয় প্রার্থনা করছি। পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে।
(১) ক্বাদ আফলাহা’ল মু’মিনুন।
অর্থঃ নিশ্চয়ই মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে।
আয়াতের তাফসীরঃ আরবীতে ‘ফালাহ’
(সফলতা) শব্দের আভিধানিক অর্থ হল চিরা, বিদীর্ণ করা, কাটা। চাষীকে ফাল্লাহ বলা হয়,
যেহেতু সেও মাটি চিরে ওর মধ্যে বীজ বপন করে থাকে। মুফলিহ (সফলকাম) সে হয়, যে অনেক কষ্ট
ও সংকটের বুক চিরে নিজ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। অথবা তার জন্য সাফল্যের পথ খুলে যায়; তার
জন্য সে পথ বন্ধ হয় না। শরীয়তের দৃষ্টিতে সফলকাম সেই ব্যক্তি, যে ধূলির ধরায় বাস করে
নিজ প্রভুকে সন্তুষ্ট করে নেয় এবং তার বিনিময়ে আখেরাতে আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার অধিকারী
বিবেচিত হয়। আর সেই সাথে যদি পার্থিব সুখ-শান্তি লাভ হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তবে
সত্যিকার সফলতা পরকালের সফলতা; যদিও দুনিয়ার মানুষ এর বিপরীত দুনিয়ার আরাম-আয়েশ ও সুখ-সম্পদকে
আসল সফলতা মনে করে। আয়াতে সেই সব মু’মিনদেরকে সফলতার সুসংবাদ শোনানো হয়েছে, যাঁদের মধ্যে উক্ত গুণাবলী
বিদ্যমান আছে।
(২) (মুমিন হচ্ছে তারাই) যারা নিজেদের নামাযে খাশিয়ু’ন (বিনয়ী, নম্র)।
আয়াতের তাফসীরঃ খাশিয়ু’ন অর্থ আন্তরিক ও বাহ্যিক (অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে) একাগ্রতা ও নিবিষ্টতা।
অন্তরের একাগ্রতা হল, নামাযের অবস্থায় ইচ্ছাকৃত খেয়াল, কল্পনা বিহার ও যাবতীয় চিন্তা
(সুচিন্তা, কুচিন্তা ও দুঃশ্চিন্তা) হতে হৃদয়কে মুক্ত রাখা এবং আল্লাহর মহত্ত্ব ও মহিমা
তাতে চিত্রিত করার চেষ্ট করা। আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একাগ্রতা হল এদিক ওদিক না তাকানো,
মুদ্রা দোষজনিত কোন ফালতু নড়া-চড়া না করা, চুল-কাপড় ঠিক-ঠাক না করা। বরং এমন ভয়-ভীতি,
কাকুতি-মিনতি ও বিনয়ের এমন ভাব প্রকাশ পাওয়া উচিত, যেমন কোন রাজা-বাদশা বা মহান কোন
ব্যক্তিত্বের নিকট গিয়ে প্রকাশ হয়ে থাকে।
(৩) যারা অসার ক্রিয়া-কলাপ হতে বিরত থাকে।
আয়াতের তাফসীরঃ (অসার ক্রিয়া-কলাপ) সেই প্রত্যেক কাজ ও কথা,
যাতে কোন উপকার নেই অথবা যাতে দ্বীন বা দুনিয়ার কোন প্রকার ক্ষতি আছে। সে সব থেকে বিরত
থাকার অর্থঃ সে সবের প্রতি ভ্রূক্ষেপ পর্যন্তও না করা; সে সব বাস্তবে রূপ দেওয়া তো
দূরের কথা।
(৪) যারা যাকাত দানে সক্রিয় ।
আয়াতের তাফসীরঃ যাকাতের অর্থ কারো কারো নিকটে ফরয যাকাত
(যার বিস্তারিত বর্ণনা অর্থাৎ, তার নিসাব, হকদার প্রভৃতির বিশদ বিবরণ মদীনায় দেওয়া
হয়েছে। পরন্তু) তার আদেশ মক্কাতেই দেওয়া হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ এমন কাজকর্ম
ও আচরণ অবলম্বন করা, যাতে আত্মার পবিত্রতা ও চরিত্রের সংশোধন সাধন হয়।
(৫) যারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে।
(৬) নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত; এতে তারা
নিন্দনীয় হবে না।
(৭) সুতরাং কেউ এদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে কামনা করলে তারা
হবে সীমালংঘনকারী।
আয়াতের তাফসীরঃ এখান থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামে ‘মুতআর’ (কিছু টাকা-কড়ি দিয়ে কোন মহিলাকে সাময়িকভাবে স্ত্রীরূপে গ্রহণ
করার, অনুরূপ হস্তমৈথুন করার) কোন অনুমতি নেই। যৌন বাসনা পূর্ণ করার রাস্তা মাত্র দুটি;
স্ত্রী-সঙ্গম অথবা মালিকানাভুক্ত ক্রীতদাসীর সাথে মিলন। (যেহেতু বর্তমানে কোথাও
কোন দাসী নেই), সুতরাং বর্তমানে যৌন বাসনা পূরণের জন্য কেবলমাত্র স্ত্রীই বাকি রয়ে
গেছে। কারণ, অধিকারভুক্ত যুদ্ধবন্দিনী বা ক্রীতদাসীর অস্তিত্ব বর্তমানে বিলুপ্ত। কিন্তু
যদি (ভবিষ্যতে মুসলিমদের শক্তিশালী হওয়া এবং নিয়মিত জিহাদের কারণে) কখনও এমন অবস্থা
সৃষ্টি হয় যে, যখন ক্রীতদাসী বিদ্যমান থাকবে, তখন তাদের সাথে স্ত্রীর মতই যৌন মিলন
বৈধ হবে।
(৮) এবং যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।
আয়াতের তাফসীরঃ ‘আমানত রক্ষা করা’ বলতে অর্পিত কর্তব্য পালন করা, গুপ্ত কথা ও মালের আমানতের হিফাযত
করা। আর ‘প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা’ বলতে আল্লাহর সঙ্গে কৃত ও মানুষের সঙ্গে কৃত
ওয়াদা, অঙ্গীকার ও চুক্তি পূরণ সবই শামিল।
(৯) আর যারা নিজেদের নামাযে যত্নবান থাকে।
আয়াতের তাফসীরঃ পরিশেষে আবার নামাযে যত্নবান হওয়া সফলতার
জন্য জরুরী বলা হয়েছে। যাতে নামাযের গুরুত্ব ও মর্যাদা স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বড় দুঃখের
বিষয় যে, আজকাল মুসলিমদের নিকট অন্যান্য নেক আমলের মত নামাযেরও কোন গুরুত্ব নেই। সুতরাং,
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রা-জিঊ’ন!
(১০) তারাই হবে উত্তরাধিকারী।
(১১) উত্তরাধিকারী হবে (জান্নাতুল) ফিরদাউসের; যাতে তারা
চিরস্থায়ী হবে।
আয়াতের তাফসীরঃ উক্ত গুণাবলীর অধিকারী মু’মিনই কেবলমাত্র সফলতা অর্জন করতে পারবে, যে জান্নাতের
উত্তরাধিকারী ও হকদার বিবেচিত হবে। কেবল সাধারণ জান্নাতই নয়; বরং জান্নাতুল ফিরদাউস
যা আটটি জান্নাতের সর্বোচ্চ জান্নাত; যেখান হতে জান্নাতের নদীমালা প্রবাহিত হয়েছে।
সহীহ বুখারী জিহাদ অধ্যায়, তাওহীদ অধ্যায়।