আল্লাহর
সাহায্য প্রাপ্তির প্রকৃত কারণসমূহ
গ্রন্থের নামঃ “রমযান মাসের ৩০ আসর”
সংকলনঃ আল্লামাহ মুহা’ম্মদ বিন সালেহ আল-উসায়মিন রাহিমাহুল্লাহ
.
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি তাঁর মর্যাদায়
মহান, তাঁর দমনে প্রবল পরাক্রমশালী, বান্দার
গোপন ও প্রকাশ্য সকল অবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানী, জিহাদকারীর
উপর বিজয় প্রদানের মাধ্যমে বদান্যতা প্রদর্শনকারী, তাঁর জন্য
বিনয় অবলম্বনকারীকে উঁচু মর্যাদায় আসীনকারী, তিনি ছত্র লেখার
সময় কলমের খচখচ শব্দ শুনতে পান, জনমানবহীন মরুপ্রান্তরে পিপড়ার
চলার গতি দেখতে পান। আমি তার প্রশংসা করছি তাকদীরের ফয়সালা, তা
মিষ্ট হোক কিংবা তিক্ত।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ
ব্যতীত কোনো হক ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, এ সাক্ষ্য তার স্মরণকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে
মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাকে তিনি জলে-স্থলে
সর্বস্থানের সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন।
আল্লাহ তাঁর উপর সালাত পেশ করুন
আর তাঁর সাথী আবু বকরের উপর, যিনি তাঁর অন্তরে আছড়ে পড়া ঈমান নিয়ে সর্বপ্রথম সাড়া
দিয়েছিলেন, অনুরূপ ‘উমারের
উপর, যিনি
তাঁর সাবধানতা ও নিয়ন্ত্রণক্ষমতা দ্বারা ইসলামকে সম্মানিত করেছেন, আর উসমানের উপর, যিনি ছিলেন দুই নূরের মালিক,
কঠিন বিপদের মধ্যে নিজের বিষয়ে পূর্ণ ধৈর্যশীল। তদ্রূপ আলীর উপর,
যিনি ছিলেন তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতা। আর তাঁর সকল পরিবার-পরিজনের
উপর, সকল সাহাবীর উপর এবং তাদের সকল সুন্দর অনুসারীর উপর
যতদিন মেঘ তার বৃষ্টি নিয়ে বদান্যতা দেখাবে। আর আল্লাহ তাদের সবার উপর যথাযথ
সালামও প্রদান করুন।
.
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের বহু স্থানে সাহায্য করেছেন। যেমন, বদর, আহযাব, মক্কা বিজয় ও হুনাইনের যুদ্ধসহ অন্যান্য
স্থানে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে তার কৃত অঙ্গীকার পূরণার্থে,
তিনি বলেছেনঃ
‘আর মুমিনদের সাহায্য করা আমার কর্তব্য।’ সূরা আর-রূম, আয়াত: ৪৭।
তিনি আরও বলেন,
“নিশ্চয় আমরা আমাদের রাসূলদেরকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে
সাহায্য করব দুনিয়ার জীবনে,
আর যেদিন সাক্ষীগণ দাঁড়াবে। যেদিন যালিমদের ‘ওজর-আপত্তি তাদের কোন কাজে আসবে না। আর তাদের জন্য রয়েছে লা‘নত এবং তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাস।”। সূরা গাফির:৫১-৫২।
আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এ কারণে সাহায্য করেছেন যে, মুমিনরা তাদের দ্বীন
ইসলামের উপর অটল থেকেছে। আর ইসলাম এমন একটি দ্বীন যাহা অন্যসব দ্বীনের উপর বিজয়ী।
অতঃপর যে ব্যক্তি এ মহান দ্বীনকে আকড়ে ধরেছে সে অবশ্যই অন্যান্য জাতির উপর বিজয়ী
হবে।
“তিনিই সে মহান সত্তা যিনি তার রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত
ও সত্যদ্বীনসহ যেন তিনি অন্যসব দ্বীনের উপর দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করতে পারেন। যদিও
মুশরিকরা তা অপছন্দ করে থাকে।”
মহান আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করেন; কেননা তারা বস্তুগত
ও মানসিক উভয় প্রকার সাহায্য ও বিজয় লাভের উপকরণ নিয়ে আল্লাহর জন্য দাঁড়িয়েছিলেন।
তাঁদের কাছে ছিল এমন দৃঢ়তা যা তাদেরকে শত্রুদের বিরুদ্ধে জয়ী করেছিল। তারা গ্রহণ
করেছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাদের জন্য
প্রদত্ত দিক-নির্দেশনা,
তারা তাঁর দেওয়া হেদায়াত অনুসারে চলেছিল আর তিনি তাদেরকে সৃদৃঢ়
করেছিলেন।
“আর তোমরা নিষ্ঠুর হয়ো না, হতাশ হয়ো না। আর তোমরাই বিজয়ী হবে; যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক। যদি তোমাদেরকে আঘাত স্পর্শ করে থাকে তবে তোমাদের
মতই তাদের উপরও ইতিপূর্বে আঘাত এসেছিল। আর এভাবেই আমরা দিনগুলো মানুষের মাঝে
চক্রাকারে ঘুরিয়ে থাকি।” সূরা আলে-ইমরানঃ
১৩৯-১৪০।
“আর আর শত্রু সম্প্রদায়ের সন্ধানে তোমরা হতোদ্যম হয়ো না। যদি
তোমরা যন্ত্রণা পাও তবে তারাও তো তোমাদের মতই যন্ত্রণা পায় এবং আল্লাহ্র কাছে
তোমরা যা আশা কর ওরা তা আশা করে না। আর আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” সূরা আন-নিসা: ১০৪।
“কাজেই তোমরা হীনবল হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না, যখন তোমরা প্রবল;
আর আল্লাহ্ তোমাদের সঙ্গে আছেন এবং তিনি তোমাদের কর্মফল কখনো
ক্ষুণ্ণ করবেন না। দুনিয়ার জীবন তো শুধু খেল-তামাশা।” সূরা মুহাম্মাদ: ৩৫-৩৬।
সুতরাং তারা এ শক্তি ও সৃদৃঢ়করণ
দ্বারা শক্তি, দৃঢ়তা ও পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে পথ চলেছিল এবং সব ধরণের শক্তি থেকে কিছু
অংশ নিতে সক্ষম হয়েছিল।
* এ ব্যাপারে তারা
আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করেছেন। তিনি বলেন,
“আর তোমরা তোমাদের সাধ্যানুযায়ী শক্তি সামর্থ্য নিয়ে প্রস্তুতি
গ্রহণ কর।” সূরা আল-আনফালঃ ৬০।
আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অপ্রকাশ্য আত্মশক্তি এবং প্রকাশ্য সৈন্যশক্তি দিয়ে
যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন;
কারণ তারা তার দ্বীনকে সাহায্য-সহযোগিতায় নিজেদের নিয়োজিত করেছিল।
* আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَيَنصُرَنَّ
ٱللَّهُ
مَن
يَنصُرُهُۥٓۚ
إِنَّ
ٱللَّهَ
لَقَوِيٌّ
عَزِيزٌ
٤٠
ٱلَّذِينَ
إِن
مَّكَّنَّٰهُمۡ
فِي
ٱلۡأَرۡضِ
أَقَامُواْ
ٱلصَّلَوٰةَ
وَءَاتَوُاْ
ٱلزَّكَوٰةَ
وَأَمَرُواْ
بِٱلۡمَعۡرُوفِ
وَنَهَوۡاْ
عَنِ
ٱلۡمُنكَرِۗ
وَلِلَّهِ
عَٰقِبَةُ
ٱلۡأُمُورِ
٤١
﴾
[الحج:
٤٠،
٤١]
“আর অবশ্যই আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন যারা আল্লাহকে সাহায্য
করবে, নিশ্চয়
আল্লাহ শক্তিশালী ও প্রবল পরাক্রমশালী। যাদেরকে আমরা যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠিত করলে
তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে, সৎ কাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজের নিষেধ করে। আর আল্লাহর জন্যই সকল কাজের
পরিণাম ফল নির্ধারিত হয়ে আছে।” সূরা আল-হজঃ ৪০-৪১।
উল্লেখিত আয়াত দু’টিতে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বিজয় ও সাহায্য
করার ওয়াদা দিচ্ছেন যারা তার দ্বীনকে সাহায্য করবে। আর এ ওয়াদা শব্দগত ও অর্থগত
সবধরণের তাগিদের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে।
o তন্মধ্যে শব্দগত
তাগিদ হচ্ছে: গোপন শপথ, কারণ, এখানে
অর্থ হচ্ছে, “আল্লাহর শপথ অবশ্যই অবশ্যই আল্লাহ
তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা আল্লাহকে সাহায্য করে।” অনুরূপভাবে ‘লাইয়ানসুরান্না’ শব্দের মধ্যে ‘লাম’ এবং ‘নূন’ নিয়ে আসা হয়েছে, যা তাগিদের জন্য
ব্যবহৃত হয়।
o আর অর্থগত তাকিদ
হচ্ছে: মহান আল্লাহর বাণী, إِنَّ ٱللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ “নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিশালী ও
প্রবল পরাক্রমশালী” এ কথার মধ্যে। এর
দ্বারা বোঝা গেল যে, মহান আল্লাহ শক্তিমান তাকে কেউ দুর্বল
করতে পারে না, তিনি প্রবল প্রতাপশালী তাকে কেউ হীন করার
ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং যে কোনো শক্তি ও প্রতাপ তাঁর বিপরীতে দাঁড়াতে চাইবে সে
অবশ্যই অপমানিত ও দুর্বল হতে বাধ্য।
* অনুরূপভাবে
আল্লাহর বাণী, وَلِلَّهِ عَٰقِبَةُ ٱلۡأُمُورِ “আর আল্লাহর জন্যই সকল কাজের পরিণাম
ফল নির্ধারিত হয়ে আছে”। এর মাধ্যমে মুমিনদের
অন্তরকে সুদৃঢ় করা হয়েছে,
যখন মুমিনের দৃষ্টিতে সাহায্য আসা সুদূর পরাহত মনে হবে, কারণ তার সাহায্য আসার মত উপায়-উপকরণ অবলম্বন করতে পারে নি। তাই আল্লাহ তা‘আলা মুমিনকে সান্ত্বনা ও তার অন্তরকে দৃঢ়তা প্রদান করার জন্যই
বলেছেন, সবকিছুর
শেষ পরিণাম তো আল্লাহর হাতেই, সুতরাং তিনি তাঁর প্রজ্ঞা
অনুসারে যখন ইচ্ছা অবস্থা পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম।
আর এ আয়াত দুটিতে: যে সব গুণাবলী
থাকলে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা
পাওয়ার অধিকারী হয় তার বর্ণনা রয়েছে। মুমিন এগুণগুলো যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার
পর অর্জন করবে, সুতরাং যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে সে যেন গর্ব, অহংকার, অহমিকা, সীমালঙ্গন ও
ফেতনা-ফাসাদে জড়িত না হয়, বরং এ প্রতিষ্ঠিত হওয়া যেন আল্লাহর
দ্বীনের জন্য শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে এবং দ্বীনকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে, এটাই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
.
আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার জন্য
অপরিহার্য গুণাবলি:
প্রথম গুণ: “যাদেরকে আমরা যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠিত করলে তারা সালাত
প্রতিষ্ঠা করে।”
তবে যমীনে প্রতিষ্ঠা লাভের
পূর্বশর্ত হচ্ছে, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত বাস্তবায়ণ করা। ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য
নির্দিষ্ট না করা (অর্থাৎ শির্ক বন্ধ না করা) পর্যন্ত যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠা লাভ
করতে পারবে না। যেমন,
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَعَدَ
ٱللَّهُ
ٱلَّذِينَ
ءَامَنُواْ
مِنكُمۡ
وَعَمِلُواْ
ٱلصَّٰلِحَٰتِ
لَيَسۡتَخۡلِفَنَّهُمۡ
فِي
ٱلۡأَرۡضِ
كَمَا
ٱسۡتَخۡلَفَ
ٱلَّذِينَ
مِن
قَبۡلِهِمۡ
وَلَيُمَكِّنَنَّ
لَهُمۡ
دِينَهُمُ
ٱلَّذِي
ٱرۡتَضَىٰ
لَهُمۡ
وَلَيُبَدِّلَنَّهُم
مِّنۢ
بَعۡدِ
خَوۡفِهِمۡ
أَمۡنٗاۚ
يَعۡبُدُونَنِي
لَا
يُشۡرِكُونَ
بِي
شَيۡٔٗاۚ﴾
[النور:
٥٥]
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে, তাদের সঙ্গে আল্লাহর
ওয়াদা হলো, আল্লাহ অবশ্যই পৃথিবীতে তাদেরকে প্রতিনিধি
বানাবেন, যেমন পূর্ববর্তীদের বানিয়েছিলেন। আর তাদের জন্য
মনোনীত দ্বীন (ইসলাম) কে তিনি তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে নিরাপত্তা দান করবেন, যারা শুধুমাত্র
আমার ইবাদত করবে, আমার সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না।’ সূরা আন-নূরঃ ৫৫।
সুতরাং বান্দা যখন তার কথা, কাজ ও ইচ্ছায়
একান্তভাবে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে, শুধু আল্লাহর
সন্তুষ্টি ও আখেরাতের সফলতাই তার লক্ষ্য থাকবে, কোনো
মান-মর্যাদা, সম্পদ, মানুষের প্রশংসা
বা জাগতিক অন্য কিছু তার কাম্য হবে না, সুখে দুঃখে বিপদাপদে
সর্বাবস্থায় অবিচলভাবে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতে অটল থাকবে তখন আল্লাহ তাদেরকে
পৃথিবীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করবেন।
তাহলে বুঝা গেল যে, যমীনের বুকে ক্ষমতায়
অধিষ্ঠিত হতে হলে এর আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ অর্জন করতে হবে, আর সেটি হচ্ছে: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, যার কোনো
শরীক নেই।
আর যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠিত ও
ইখলাসের পর আসবে দ্বিতীয় গুণটি।
.
দ্বিতীয় গুণ: সালাত প্রতিষ্ঠা
করা:
আর সালাত প্রতিষ্ঠা করার অর্থ
হচ্ছে, বান্দার
কাছ থেকে যেভাবে সালাত আদায় চাওয়া হয়েছে সেভাবে সেটা সংঘটিত হওয়া, তার সকল শর্ত, রুকন ও ওয়াজিবসমূহ যথাযথভাবে
প্রতিষ্ঠা করা।
আর এর পূর্ণরূপ হচ্ছে, সালাতের যাবতীয়
মুস্তাহাব পালন করা, সুতরাং সুন্দরভাবে অযু করবে, রূকু, সিজদা, কিয়াম ও বসা
সুন্দরভাবে সম্পন্ন করবে, সময়ের প্রতি যথাযথ যত্নবান হবে,
জুম‘আ ও জামাআতের প্রতি গুরুত্ব
দিবে, সালাতে
খুশু‘ তথা বিনয়াবনত হবে,
আর তা হচ্ছে, সালাতে মন উপস্থিত রাখা ও
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুস্থির রাখা। কেননা সালাতের মূল ও প্রাণই হচ্ছে বিনয়াবনত থাকা।
বিনয়াবনত ব্যতীত সালাত আদায় যেন আত্মা ব্যতীত শরীর।
* আম্মার ইবন
ইয়াসের রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “নিশ্চয় কোনো লোক সালাত থেকে ফিরে এমতাবস্থায় যে তার সালাতের
এক দশমাংশ লিখা হয়েছে, এক নবমাংশ, এক অষ্টমাংশ, এক
সপ্তমাংশ, এক ষষ্ঠাংশ, এক পঞ্চমাংশ,
এক চতুর্থাংশ, এক তৃতীয়াংশ, অর্ধেক লেখা হয়েছে।”
.
তৃতীয় গুণ: যাকাত প্রদান
﴿وَءَاتَوُاْ
ٱلزَّكَوٰةَ﴾
যাকাতের
বিধান অনুসারে তার সঠিক প্রাপককে কোনো প্রকার ত্রুটি ছাড়া খুশি মনে আল্লাহর
সন্তুষ্টি লাভের আশায় যাকাত দেওয়া। এর মাধ্যমে নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি, সম্পদের
পবিত্রতা এবং গরীব দুঃখী ইত্যাদি অভাবী ভাইদের উপকার হয়। যাকাতের হকদার কারা এ
বিষয়টি সপ্তদশ আসরে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
.
চতুর্থ গুণ: সৎকাজে আদেশ করা
﴿وَأَمَرُواْ بِٱلۡمَعۡرُوفِ﴾
মা‘রূফ হচ্ছে, আল্লাহ তাঁর রাসূল
কর্তৃক নির্দেশিত সকল ওয়াজিব ও মুস্তাহাব কাজ। সুতরাং যারা আল্লাহর সাহায্য পেতে
চায় তারা শরীয়তের পূনর্জীবন দান করা, বান্দাদের সংস্কার এবং
আল্লাহর রহমত ও সন্তুষ্টি কামনায় এ কাজগুলো করে থাকে।
বস্তুত মুমিন হচ্ছে দেয়ালের মত।
যার একটি ইট অপরটিকে মজবুত করে। সুতরাং একজন মুমিন যেভাবে নিজের জন্য পছন্দ করে যে
সে তার রবের আনুগত্যে সদা তৎপর থাকবে, সেভাবে সে নিজের মত করে তার অন্যান্য ভাইদের
জন্যও আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকা পছন্দ করা ওয়াজিব।
সৎকাজের নির্দেশ যদি সত্যিকারের
ঈমান ও সততার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় সেটা আবশ্যক করে যে নির্দেশদাতা নিজেও সেটা
যথাযথভাবে পালন করবে; কেননা সে সৎকাজের আদেশের উপকারিতা ও ইহ ও পারলৌকিক ফলাফল সম্পর্কে ঈমান ও
পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের কারণেই সে সেটার নির্দেশ প্রদান করে থাকে।
.
পঞ্চম গুণ: মন্দের প্রতিকার
﴿وَنَهَوۡاْ
عَنِ
ٱلۡمُنكَرِۗ﴾মুনকার বলতে বুঝায়:
এমন প্রত্যেক বিষয় যা থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল নিষেধ করেছেন। ইবাদতের সাথে
সংশ্লিষ্ট কিংবা চরিত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট অথবা লেন-দেনের সাথে সম্পৃক্ত সকল কবীরা
গুনাহ, সগীরা গুনাহ এর অন্তর্ভু্ক্ত। সুতরাং যারা আল্লাহর সাহায্য পেতে চায় তারা
আল্লাহর দ্বীনকে হেফাযত করার জন্য, আল্লাহর বান্দাদের রক্ষা
করার জন্য এবং ফেতনা-ফাসাদ ও শাস্তির কারণসমূহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য এসকল কাজ
থেকে নিষেধ করে থাকেন।
বস্তুত উম্মতের স্থায়িত্ব, সম্মান ও একতা বজায়
রাখার জন্য সৎ কাজের আদেশ প্রদান এবং মন্দের প্রতিবিধান দু’টি শক্তিশালী স্তম্ভবিশেষ। যাতে করে উম্মতকে প্রবৃত্তির তাড়না
বিচ্ছিন্ন করতে এবং বিভিন্ন মত ও পথ তাদেরকে ছিন্ন-ভিন্ন করতে সক্ষম না হয়। আর
এজন্যই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়; যা সকল মুসলিম
নারী-পুরুষের ওপর সাধ্যানুযায়ী ফরয।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি
আহ্বান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ
করবে। আর তারাই সফলকাম। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা
বিভক্ত হয়েছে এবং মতবিরোধ করেছে তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পর। আর তাদের
জন্যই রয়েছে কঠোর আযাব।’ সূরা আলে ইমরানঃ
১০৪-১০৫।
যদি ভালো কাজের আদেশ প্রদান আর
মন্দের প্রতিবিধান না থাকতো তবে মুসলিম সমাজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে
ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। এমন হতো যে, প্রত্যেক দলই তার কাছে যা আছে তা নিয়ে খুশী
হয়ে যেতো। (অথচ সত্য কখনো মানুষের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে না।)
এ আহ্বান থাকার ফলেই এ উম্মত
অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পেরেছে। আল্লাহ তা‘আলা
বলেনঃ “তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের
জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে,
আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ সূরা আলে ইমরানঃ ১১০।
যারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে
নিষেধ করে না তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদেরকে দাঊদ ও মারইয়াম
পুত্র ঈসার মুখে লা‘নত করা হয়েছে। তা এ কারণে যে, তারা অবাধ্য হয়েছে
এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত। তারা পরস্পরকে মন্দ থেকে নিষেধ করত না, যা তারা করত। তারা যা করত, তা কতইনা মন্দ! সূরা
আল-মায়িদাহ্ঃ ৭৮-৭৯।
o উল্লেখিত পাঁচটি
গুণসহ আল্লাহর নির্দেশিত সতর্কতা, দৃঢ়তা ও বাহ্যিক বস্তুগত
শক্তি যখন লাভ করবে, তখন আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই আসবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
‘আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহ তাঁর ওয়াদা খেলাফ করেন না। কিন্তু
অধিকাংশ লোক জানে না। তারা দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক দিক সম্পর্কে জানে, আর আখিরাত সম্পর্কে
তারা গাফিল।’ সূরা আর-রূমঃ ৬-৭।
সুতরাং এ গুণগুলো অর্জিত হলে
উম্মত অকল্পনীয় আসমানী সাহায্য দ্বারা ধন্য হবে। আর আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল
ব্যক্তি নিশ্চিতরূপে জানে যে বাহ্যিক উপকরণ যতই শক্তিশালী হোক তা এগুলোর স্রষ্টা ও
অস্তিত্বদানকারী আল্লাহর শক্তির সামনে অতি নগণ্য।
* আদ সম্প্রদায়
নিজেদের শক্তিমত্তায় অন্ধ হয়ে ঘোষণা করেছিল:
“অর্থাৎ কে আমাদের চেয়ে বেশি শক্তিমান?!!”
আল্লাহ তা‘আলা তার উত্তরে বলেন, “তবে কি তারা লক্ষ্য করেনি যে, নিশ্চয় আল্লাহ যিনি
তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? আর তারা
আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করত। তারপর আমি তাদের উপর অশুভ দিনগুলোতে ঝঞ্ঝাবায়ু
পাঠালাম যাতে তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক আযাব আস্বাদন করাতে পারি। আর
আখিরাতের আযাব তো অধিকতর লাঞ্ছনাদায়ক এবং তাদেরকে সাহায্য করা হবে না।’ সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ১৫-১৬।
* ফির‘আউন কতই না দম্ভ করেছিল তার মিসরের রাজত্ব নিয়ে এবং যে সকল
নদী-নালা তার নিম্নভাগে প্রবাহিত আছে তা নিয়ে!!
অতঃপর আল্লাহ তাকে সে পানিতেই
ডুবে মেরেছিলেন যা নিয়ে সে অহংকারে ফেটে পড়েছিল। আর তার রাজত্বের ওয়ারিস বানিয়েছেন
মূসা ও তার জাতিকে; যারা ছিল ফের‘আউনের দৃষ্টিতে হীন ও কথা
বলতে অক্ষম।
* আর এই যে কুরাইশ,
তারা তাদের মর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে অন্ধ হয়ে সর্বশক্তি
নিয়ে তাদের নেতা ও কর্তা ব্যক্তিরা গর্ব ও লোকদেখানোর জন্য বেরিয়ে পড়েছিল। তারা
ঘোষণা দিয়েছিল, আমরা ততক্ষণ কখনো ফিরবো না যতক্ষণ না বদরে
পৌঁছব, সেখানে উট যবেহ করব, মদ পান করব,
আমাদের উপর গায়ক-গায়িকা, নর্তকীরা গান গাইবে
এবং আমরা সেটা উপভোগ করব, আর আরবরা সেটা শুনবে এবং সব সময়ের
জন্য আমাদেরকে ভয় পেতে থাকবে!!
কিন্তু তারা নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীদের হাতে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ও শোচনীয় পরাজয় বরণ
করেছিল। আর তাদের লাসগুলো বদরের দুর্গন্ধময় কূপে টেনে-হেঁচড়ে ফেলা হয়েছিল। এভাবে
তারা অপমান-অপদস্থের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে মানুষের মুখে কিয়ামত পর্যন্ত আলোচিত
হবে।
আমরা মুসলিমরা যদি এ যুগেও
আল্লাহর সাহায্যের জন্য অপরিহার্য গুণাবলি অর্জন করতে পারি, যদি দীনের প্রতিটি
নির্দেশ মান্য করে চলতে পারি, যদি আমরা অন্যদের জন্য
অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারি, অন্যদের অনুসারী না হয়ে পথপ্রদর্শক
হতে পারি, অনুসরণকারী না হয়ে অনুসরণীয় হতে পারি, ন্যায়-নিষ্ঠা আর পরিশুদ্ধ মানসিকতা নিয়ে যুদ্ধের যাবতীয় আধুনিক সামগ্রী
অবলম্বন করতে পারি, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ আমাদেরকে শত্রুর ওপর
বিজয়ী করবেন; যেমন অতীতে আমাদের পূর্বসূরীদের সাহায্য
করেছিলেন, আল্লাহ তাঁর ওয়াদা সত্য করেছিলেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছিলেন এবং যাবতীয় বিরোধী শক্তিকে একাই পরাস্ত
করেছিলেন।
‘তোমাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদের ব্যাপারে এটি আল্লাহর
নিয়ম; আর
আপনি আল্লাহর নিয়মে কোনো পরিবর্তন পাবে না।’ সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৬২।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য
আপনার এমন সাহায্যের উপায়-উপকরণগুলোর ব্যবস্থা করে দিন, যাতে রয়েছে আমাদের
বিজয়, ইয্যত, সম্মান আর ইসলামের জন্য
উঁচু মর্যাদা ও কুফরি ও অবাধ্যতার জন্য অপমান ও হীনতা। নিশ্চয় আপনি দানশীল ও দাতা।
আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন
আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তার পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।