তেলাওয়াতের সেজদাহ ও সেজদার আয়াত
বিসমিল্লাহ।
আলহা’মদুলিল্লাহ।
ওয়াস সালাতু
ওয়াস সালামু আ’লা রাসুলিল্লাহ।
ছোটবেলায়
আমরা যখন উস্তাদের কাছে আমপারা বা কুরআন পড়া শুরু করতাম, তখন আমাদের অনেকের মনে একটা ভয় কাজ করত, আর তা
হচ্ছে সেজদার আয়াত। কোন সেজদার আয়াত পড়লে বা শুনলে সেজদা দিতে হবে, এই ভয়ে অনেকেই সেজদার আয়াত পড়তে চায়না, বা কোন তেলাওয়াতের সেজদাহ আছে এমন সুরাতে যখন সিজদার আয়াত আসতো, তখন সেই আয়াত না শোনার চেষ্টা করতো, যাতে করে সেজদাহ দেওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়। এমনকি, বড় হয়েও এখন পর্যন্ত অনেকের মাঝেই দেখা যায় যে,
তেলাওয়াতের সেজদার আয়াতের ব্যপারে একটা ভয়, আতংক বা অনীহা কাজ করে। অথচ এটা ঠিকনা, তেলাওয়াতের সেজদাহ করা একটা মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত, যা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উপায়। সুতরাং, মহান
প্রভুর দরবারে বিনীত হয়ে একটা সেজদা করার
সুযোগ লাভ করাতো আমাদের জন্যে একটা সৌভাগ্যের বিষয়। সেজন্য, সেজদার আয়াতকে আমাদের
ভয় নয়,
বরং আরো বেশি ভালোবাসা উচিৎ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে আল্লাহর কালামকে ভালোবাসার তোওফিক
দান করুন, আমিন।
যাই হোক, এবার আমরা মূল আলোচনায় প্রবেশ করি, বি ইজনিল্লাহি
তাআ’লা।
(১) সেজদার আয়াত কি?
কুরআনুল
কারীমে এমন কিছু আয়াত আছে, যেইগুলো পড়লে বা শুনলে সেজদাহ করতে হয়, এই আয়াতগুলোকে ‘সেজদার আয়াত’ বলা হয়। সাধারণত, এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ
তাআ’লা আমাদেরকে সরাসরি সেজদাহ করার জন্য আদেশ করেছেন, অথবা
কখনো উৎসাহিত করেছেন সেজদাহ করার জন্য। এজন্যে এই আয়াতগুলো পড়লে, আয়াতের হক্ক হিসেবে,
আল্লাহর আদেশ পালনের জন্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি
ওয়া সাল্লাম একটা সেজদাহ করতেন। আমরা
আমাদের প্রিয়নবীর অনুসারী হিসেবে সেই সুন্নতের অনুসরণ করি। সাধারণত কুরআনে বিভিন্ন চিহ্ন ও কথার দ্বারা স্পষ্ট বলা থাকে, এটা সেজদার আয়াত।
(২) কুরআনে সেজদার আয়াত কয়টি ও কি কি?
এ ব্যপারে আলেমদের মাঝে কিছুটা ইখতিলাফ বা মতবিরোধ হয়েছে। তবে অনেক আলেম কুরআনে
মোট ১৫টি সেজদার আয়াত রয়েছে বলে একমত পোষণ করেছেন। আর সেই আয়াতগুলো হচ্ছেঃ
সুরা আ’রাফঃ ২০৫, সুরা রা’দঃ ১৫, সুরা নাহলঃ ৪৯, সুরা বনী ইসরাঈলঃ ১০৭,
সুরা মারিয়ামঃ ৫৮, সুরা হাজ্জঃ ১৮, সুরা হাজ্জঃ ৭৭, সুরা ফুরক্বানঃ ৬০, সুরা
নমলঃ ২৫, সুরা সাজদাহঃ ১৫, সুরা ছোয়াদঃ ২৪, সুরা হা মীম সাজদাহঃ ৩৭, সুরা নজমঃ ৬২,
সুরা ইনশিক্বাকঃ ২১, সুরা আ’লাক্বঃ ১৯।
(৩) সেজদার আয়াত পড়লে বা শুনলে সেজদাহ দেওয়ার হুকুম কি?
আল্লামাহ আব্দুল আ’জিজ বিন বাজ
রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “নামাযের ভেতরে কিংবা বাইরে, সেজদাহর আয়াত পড়লে বা শুনলে একটা সেজদাহ দেওয়া সুন্নত,
ফরয কিংবা ওয়াজিব নয়।” মাজমু’ ফাতওয়া ওয়া মাক্বালাত সামাহা’ত আল-শায়খ ইবনে
বাজ, ১১/৪০৬।
আল্লামাহ মুহা’ম্মদ বিন সালেহ আল-উসায়মিন
রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “সেজদাহর আয়াত পড়লে বা শুনলে তার জন্যে একটা সেজদাহ দেওয়া সুন্নত, ফরয কিংবা ওয়াজিব
নয়।” মাজমু’ আল-ফাতওয়াঃ ১৪/৩১৮।
(৪) তেলাওয়াতের সেজদাহ কিভাবে করতে হয়?
নামযের ভেতরে কিংবা বাইরে সেজদার আয়াত পড়া বা শোনার পর তাকবীর দিয়ে
(অর্থাৎ, আল্লাহু আকবার) বলে সরাসরি সেজদাতে চলে যেতে হবে। সেজদাতে যাওয়ার পর স্বাভাবিক নামাজের
সেজদার মতোই সুবহা’না রাব্বীয়্যাল আ’লা তাসবীহ পড়তে হবে। এরপরে কেউ যদি অন্যান্য
সেজদার তাসবীহ পড়তে চায়, পড়তে পারবে। যেকোন সেজদাতে অন্তত “সুবহা’না রাব্বীয়্যাল
আ’লা” এই তাসবীহ পড়া ওয়াজিব।
এর অতিরিক্ত অন্য তাসবীহগুলো (যেমন- সুবহা’নাকা আল্লাহুম্মা
রাব্বানা ওয়াবি হা’মদিকা, আল্লাহুম্মাগ ফিরলী) পড়া সুন্নত বা মুস্তাহাব। উল্লেখ্য, তেলাওয়াতের সেজদাহর জন্যে বিশেষ একটা দুয়া
আছে, সেই দুয়াটা মুখস্থ থাকলে সেটা পড়া আরো ভালো। আপনারা সেই দুয়াটা মুখস্থ করতে চাইলে
হিসনুল মুসলিম বই থেকে দেখে নিন। তাসবীহ পড়া শেষ হলে, একটা মাত্র সেজদাহ দিয়েই দাঁড়িয়ে
যেতে হবে। কারণ, তেলাওয়াতের সেজদার জন্যে সেজদা করতে হয় মাত্র একটা, দুটো নয়। উল্লেখ্য,
যদি নামাযের মধ্যে হয় তাহলে আল্লাহু আকবার তাকবীর দিয়ে দাঁড়াতে হবে। আর যদি নামাযের
বাইরে হয় তাহলে একটা সেজদাহ দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, আল্লাহু আকবর বলতে হবেনা বা সালাম ফেরাতে
হবেনা। এহচ্ছে তেলাওয়াতের সেজদার সুন্নতী পদ্ধতি।
(৫) তেলাওয়াতের সেজদাহ করার কি ফযীলত?
রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আদম সন্তান যখন কোন সেজদার আয়াত পড়ে অতঃপর
সেজদাহ করে, তখন শয়তান তার কাছ থেকে কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় আর বলেঃ “হায় আফসোস, আমার কি দুর্ভাগ্য! আদম সন্তানকে
সেজদাহ করতে আদেশ করা হয়েছে, আর সে সেজদাহ করেছে। একারণে তাকে জান্নাত দেওয়া হবে। আর
আমাকে সেজদাহ করতে আদেশ করা হয়েছিলো, কিন্তু আমি সেই আদেশ অমান্য করেছিলাম। একারণে
আমি জাহান্নামে যাবো।” সহীহ মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ।
(৬) সুরা মুখস্থ করার সময় সেজদার আয়াত বারবার পড়লে কয়টা সেজদাহ দিতে হয়?
আল্লামাহ মুহা’ম্মদ বিন সালেহ আল-উসায়মিন
রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “কেউ যদি মুখস্থ করার জন্যে একই সেজদার আয়াত বারবার পড়ে, তাহলে প্রথম একবার পড়ার
পরে একটা সেজদাহ দিলেই হবে। এরপরে সে যখন একই সেজদার আয়াত পুনরায় পড়বে, তখন আবার সেজদাহ
না দিলেও হবে।” মাজমু’ আল-ফাতওয়াঃ ১৪/৩১৮।
(৭) তেলাওয়াতের সিজদার জন্য ওযু থাকা ফরয কি না?
এ ব্যাপারে
আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, ওযু থাকতেই হবে। কোন কোন আলেম বলেছেনঃ তেলাওয়াতের সিজদার জন্যে ওযু থাকা ফরয নয়, ওযু ছাড়াও তেলাওয়াতের সিজদাহ করা যাবে। কারণ, আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু
আ’নহু ওযু ছাড়াই তেলাওয়াতের সেজদা করতেন। এখান থেকে অনেক আলেম দলিল নিয়েছেন, যেহেতু
তেলাওয়াতের সিজদা কোন নামায নয়, একটা সেজদাহ, আর কুরআন বা হাদীসে কোথাও তেলাওয়াতের
সিজদার জন্যে ওযু থাকতেই হবে, একথা উল্লেখ নেই, তাই ওযু সহ
কিংবা ওযু ছাড়া, সর্বাবস্থাতেই তেলাওয়াতের সিজদাহ করা যাবে। মাজমু’ ফাতওয়া ওয়া মাক্বালাত
সামাহা’ত আল-শায়খ ইবনে বাজ, ১১/৪০৬।
(৮) মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা অডিও ভিডিও রেকর্ডিং থেকে কুরআন তেলাওয়াত শোনার সময়
কি তেলাওয়াতের সিজদাহ করতে হবে?
নাহ, করতে হবেনা। অনেক আলেমের মতে, রেকর্ডিং থেকে কুরআন তেলাওয়াত শোনার সময় তেলাওয়াতের
সিজদাহ করার প্রয়োজন নেই। শায়খ আব্দুল আ’জিজ বিন বাজঃ মাজমু’ ফাতওয়া শায়খ ইবনে বাজ ১১/৪১৫; মুহা’ম্মদ বিন
সালেহ আল-উসায়মিনঃ আল-শরাহ আল-মুমতি ৪/১৩৩।