টিভি, ফেইসবুক, ইন্টারনেট, ইউটিউব সহ আধুনিক যুগের বিভিন্ন
মিডিয়াগুলোতে থেকে জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘অল্প
ইলম সম্পন্ন’, ‘সেলেব্রিটি’ বক্তা ও লিখকদের কাছ থেকে যারা দ্বীন শিখে থাকেন, তাদের অনেকেই আলেমদের মর্যাদা ও গুরুত্বকে অস্বীকার করেন, কথায় কথায় আলেমদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। তাদের অনেকের স্লোগান হচ্ছেঃ
(ক) “আমি শুধু কুরআন ও হাদীস মানি, কোন
আলেমের তাকলীদ করিনা।”
(খ) “শুধু কুরআন ও হাদীসই যথেষ্ঠ, শরিয়ত
মানার জন্য কোন আলেম লাগে না।”
(গ) “আলেমদেরকে মানা হারাম।”
যদিও তারা
নিজেরা কুরআন ও হাদীস বুঝে না, বুঝার মতো যোগ্যতা তাদের নেই, কিন্তু দুই-চারজন
বক্তার টুটা-ফাটা কিছু বক্তব্য গ্রহণ করে তোতা পাখির মতো বুলি আওড়ান। এইভাবে তারা
মনে করছেন, তারা কুরআন-হাদীস মানছেন, অথচ প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে তারা আসলে তাদের
বক্তা সাহেবের অন্ধ অনুকরণ করছেন। অনেকে আবার অল্প ইলমের উপর সওয়ার হয়ে নিজে নিজে
ফতোয়া বিলি করে বেড়ান, এইভাবে নিজেরা পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হচ্ছেন, অন্যদের জন্য
ফিতনা সৃষ্টি করছেন। এমন ব্যক্তিদের বক্তব্যের অসারতা তুলে ধরে শায়খ মুজাম্মেল
হক্ক হা’ফিজাহুল্লাহ লিখেছেনঃ
“লজ্জা ছাড়া, তাক্বওয়া
ছাড়া মিলবে কি সেই সফলতা?”
আলেমের মুল্য সকল সৃষ্টির উপরে। মুসলমান হয়ে তা অস্বীকার করার উপায় নাই। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন।
(১) “সে আমার উম্মতের কেউনা, যে বড়দের সম্মান করেনা,
ছোটদের স্নেহ করেনা এবং আলেমদের অধিকার বুঝেনা।” সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম।
(২) “আলেমের সম্মান আবেদের তুলনায় এমন, যেমন নাকি আমার সম্মান তোমাদের
মধ্যে অতি সাধারন একটি মানুষের উপর।” সুনানে তিরমিযী।
(৩) “আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতারা, আসমান ও
জমিনের সকল বাসিন্দা, এমনকি গর্তের একটি পিঁপড়া এবং পানির নীচের মাছগুলিও সেই আলেমের
জন্যে দুয়া করে, যিনি মানুষকে উত্তম শিক্ষা দান করেন।” সুনানে তিরমিযী।
(৪) আল্লাহ আলেমদেরকে তার
তাওহীদ (একত্ববাদের) পক্ষে সাক্ষী বানিয়েছেন, ফেরেশতাদের পরেই স্থান দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাআ’আল বলেন, “আল্লাহ সাক্ষ্য দেন,
তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। ফেরেশতা এবং আলেমগন
ইনসাফের ভিত্তিতে উক্ত সাক্ষ্য প্রদান করেন।” সুরা আলে-ইমরানঃ ১৮।
(৫) “(যেসব
উপমা দেওয়া হলো, তা) আলেমগন ছাড়া কেউ বুঝবেনা।” সুরা আ’নকাবুতঃ ৪৩।
(৬) “সকল বান্দাদের মধ্যে আলেমগনের আল্লাহ
ভীতিই হচ্ছে প্রকৃত ভীতি।” সুরা ফাতিরঃ ২৮।
(৭)
“যে জানে, আর যে জানেনা, তারা কি
কখনো সমান হতে পারে?”
(৮) “যাদেরকে জ্ঞান দান করা
হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় অনেক উঁচু করবেন।” সুরা মুজাদালাঃ ১১।
বর্তমান যুগে
অনেকের মনোভাব এমন রয়েছে, মনে হয় যেন আলেমের মানহানি করতে, মূল্য হ্রাস করতে, আলেমদেরকে
একঘরে করতে শয়তানের সম্মিলিত বাহিনী আদা-জল খেয়ে লেগেছে! ঝাঁক
ঝাঁক মুন্সি সাহেব (ইলম বিহীন নকলকারী ব্যক্তি) কোত্থেকে উড়ে এসে আলেম-উলামার স্থানে জুড়ে বসছেন।
(মুন্সি সাহেবরা) খুতবাহ দিচ্ছেন, আর আলেম-ফকীহ তাদের কথা শুনতে বাধ্য হচ্ছেন। মুন্সিরা নামায পড়ান, আর আলেম মুক্তাদী হয়ে পিছনে দাঁড়ান। মুন্সিরা মজলিসের রওনাক, আর ELOQUENT (বাক্যবাগীশ) আলেম
ও বক্তা তাদের কথাগুলো গলাধঃকরন করার চেষ্টা করেন। তাদের কেউ দুই-একদিন টোপলা নিয়ে ঘুরেছেন। কেউ কয় ক্লাস স্কুল-কলেজে সাইয়েন্স, অংক, ইতিহাস পড়ে ফকীহ হয়েছেন! তারা কুরআনের
তাফসীরও করেন, উম্মতকে দিক-নির্দেশনা দেন, ইসলামী দর্শনের জন্ম দেন। তারা আলেমদেরকে কোন কাজের যোগ্য মনে করেন না, এমন কি দ্বীনের কাজেও না। আলেমরা দ্বীন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, অনেকে এমনটি বলেও থাকেন। তারা আলেম উলামার দাঁত দেখেন, সাইজ মাপেন। আলেমদেরকে নিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমন ব্যংগ-বিদ্রুপ করেন।
এমন মুন্সি সাহেবরা যেমন আলেমদের স্থান দখল করে নিজদেরকে আলেমদের থেকে দূরে
রাখছেন, তেমনি জনগণকেও আলেম থেকে সরিয়ে রাখছেন। এটাই প্রকৃত “সাদ্দুন আন সাবিলিল্লাহ” – বা আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা, যা
আল্লাহর কিতাবে বলা হয়েছে।
প্রশ্ন জাগে, এমন ব্যক্তিদের আদৌ কোন লজ্জাবোধ আছে কি? আদৌ
তাঁরা আল্লাহকে ভয় করেন কি? তাক্বওয়া ও লজ্জাবোধ ছাড়া মুত্তাক্বী হওয়ার কোন বিকল্প
রাস্তা আছে কি? মুত্তাক্বী না হতে পারলে, কেয়ামতে সফলতা লাভের কোন চোরা-গলি আছে কি?
এমনই যদি চলতে থাকে, তাহলে আল্লাহর গজব থেকে
রক্ষা পাওয়া যাবে কি? দ্বীনের ব্যপারে এমন প্রতিবন্ধকতা যারা সৃষ্টি করে, আর যারা তাদের
ব্যপারে নীরবতা অবলম্বন করে, সকলেই কি সমান দায়ী নয়?