প্রশ্নকর্তাঃ ইয়া শায়খ! আল্লাহ আপনাকে
হেফাজত করুন। বর্তমান সময়ে ফিতনা (পরীক্ষা, আল্লাহর আযাব-গজব কিংবা দুঃখ-দুর্দশা)
যা সারা পৃথিবীব্যাপী মুসলিমদেরকে স্পর্শ করেছে, সে ব্যপারে আপনার কি উপদেশ রয়েছে?
এ ব্যপারে একজন ‘তালিবুল
ইলম’ (দ্বীন শিক্ষার্থীর) কি ভূমিকা কেমন হওয়া
উচিৎ?
উত্তরঃ মুসলিমদের উপর আপতিত এই ধরণের
বিপর্যয়কর ফিতনাহ আরো বেশি করে আসবে, এইগুলো বন্ধ হবেনা, বরং তা আরো বেশি করে
আসবে, যদিনা মুসলিমরা তাদের দ্বীনে ফিরে, যদি না মুসলিমরা সঠিকভাবে দ্বীনের অনুসরণ
করে। মুসলিমরা যদি দ্বীনে ফিরে না আসে, তাহলে (এ ধরণের বিপর্যয়কর) ঘটনাগুলো আরো
বেড়ে যাবে এবং ইসলামের শত্রুদেরকে আল্লাহ মুসলিমদের উপর ক্ষমতাসীন করে দেবেন।
হে মুসলিম ভাইয়েরা! একটু চিন্তা করে দেখুন –
যখন উহুদ যুদ্ধের সময় কিছু সংখ্যক সাহাবী ভুল করেছিলেন, অল্প কয়েকজন
সাহাবীর একটি মাত্র ভুল! রাসুলু্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম (৫০ জন তীরন্দাজ মুজাহিদকে)
উহুদ পাহাড়ের উপরে থাকতে আদেশ করেছিলেন, যাতে করে কাফের বাহিনী পেছন দিক থেকে মুসলিমদের উপর আক্রমন করতে না পারে,
সেইজন্যে তারা পেছন দিক থেকে মুসলিমদেরকে ‘গার্ড’ দেবে। যখন (উহুদ) যুদ্ধ শুরু হলো, তখন
প্রাথমিকভাবে মুসলিমরা বিজয়ী হলো, সুতরাং তারা ‘গনীমত’ (যুদ্ধে লব্দ কাফিরদের সম্পদ) সংগ্রহ করতে
শুরু করলো। রাসুলু্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি
ওয়া সাল্লাম তীরন্দাজ বাহিনীকে আদেশ করে বলেছিলেন, “সাবধান! যুদ্ধে আমাদের জয় কিংবা পরাজয় যাই
হোকনা কেনো, তোমরা কিছুতেই পাহাড় ছেড়ে নামবেনা। এমনকি আমরা যদি আহত হই, তবুও
আমাদেরকে সাহায্য করার জন্যে তোমরা পাহাড় থেকে নামবেনা।”
কিন্তু পাহাড়ের উপর নিযুক্ত তীরন্দাজ মুসলিম বাহিনী যখন দেখলো যে, মুসলিমরা
গনীমতের সম্পদ সংগ্রহ করছে, তারা মনে করলো যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। তাই তাদের মধ্য
থেকে কেউ কেউ বললো, “চলো
আমরা নিচে নেমে যাই এবং আমাদের ভাইদেরকে গনীমত সংগ্রহ করতে সাহায্য করি।”
তাদের দলের অধিনায়ক (আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের ইবনু নুমান আনসারী রাদিয়াল্লাহু আ’নহু) বললেন, “আমরা যুদ্ধে জিতি কিংবা হারি, নবী সাল্লাল্লাহু
আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কি আমাদেরকে পাহাড় ছেড়ে
যেতে নিষেধ করেন নি?”
কিন্তু তারা তাদের অধিনায়কের কথা শুনলোনা,
বরং তারা পাহাড় থেকে নিচে নেমে গেলো। শুধুমাত্র তাদের দলের অধিনায়ক এবং অল্প
কয়েকজন (নয়জন) সাহাবী পাহাড়ের উপরে গার্ড দেওয়ার জন্যে থাকলেন, শেষে তাঁরা
কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করে শহীন হন, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন।
মুশরিকরা এই সুযোগ গ্রহণ করলো এবং পাহাড়ের
উপরে উঠে পেছন দিক থেকে মুসলিমদের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলো। মুসলিমরা এটা বুঝতে
পারেনি, কারণ তারা মনে করছিলো তাদের পেছন দিকে গার্ড রয়েছে। যার ফলে কোন কিছু বুঝে
উঠার আগেই কাফিররা সামনে ও পেছনে, দুই দিক থেকেই মুসলিমদেরকে ঘিরে ফেললো।
যুদ্ধ আবার শুরু হলো এবং একটি মাত্র ভুলের
কারণে অল্প সময়ের মাঝে মুসলিম বাহিনীর কিছু মানুষ নিহত হলো এবং কিছু আহত হলো। নিহত
সাহাবীদের মাঝে ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর অত্যন্ত প্রিয় চাচা,
হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব রাদিয়াল্লাহু
আ’নহু। তাঁর মৃত্যুর কারণে নবী সাল্লাল্লাহু
আ’লাইহি
ওয়া সাল্লাম যেইভাবে কেঁদেছিলেন, অন্য কারো মৃত্যুর জন্যে এইভাবে কখনো কান্না করেন
নি। প্রসিদ্ধ সাহাবী হানযালা রাদিয়াল্লাহু আ’নহু এই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন,
যার গোসল করিয়েছিলেন আল্লাহর ফেরেশতারা।
প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধে আহত ও নিহতদের দৃশ্য
ছিলো অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এমনকি স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-ও এই যুদ্ধে আহত
হয়েছিলেন। কারণ যখন আল্লাহর আযাব আসে, তখন সালেহ (নেককার) ও ফাসেক্ব (পাপী),
সকলকেই তা স্পর্শ করে। আল্লাহ তাআ’লা
এই ব্যপারে সতর্ক করে বলেন,
“আর তোমরা সেই ‘ফিতনাহকে’ ভয় করো, যা তোমাদের মধ্যে যারা জালেম,
শুধুমাত্র তাদেরকেই স্পর্শ করবে না (বরং নেককার কিংবা পাপী, সকলকে তা স্পর্শ
করবে)। আর জেনে রেখ যে,
আল্লাহর আযাব অত্যন্ত কঠোর।” [সুরা আনফালঃ আয়াত ২৫]
উহুদের যুদ্ধে তীরন্দাজ বাহিনী কর্তৃক নবীর
আদেশ অমান্য করার ফলে আল্লাহর আযাব এমনকি আল্লাহর নবীকেও স্পর্শ করেছিলো। কয়েকজন
সাহাবীর শাহাদাত হওয়া, কয়েকজনের আহত হওয়ার পাশাপাশি অরক্ষিত অবস্থায় কাফেরদের
সম্মিলিত আক্রমনের ফলে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন হানির মতো অবস্থা
সৃষ্টি হয়েছিলো। তাঁকে হত্যার জন্যে কাফেররা তলোয়ার দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করে, যার
ফলে তাঁর মাথার হেলমেট চূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। কাফেরদের আক্রমনের ফলে তাঁর সামনের
একটি দাঁতও ভেঙ্গে গিয়েছিলো। তিনি গালে আঘাতপ্রাপ্ত হন, যার ফলে অনেক রক্তপাত হয়।
এ সবই শুধুমাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি
ওয়া সাল্লাম এর একটিমাত্র আদেশের বিরোধীতা করার কারণে হয়েছিলো।
এই ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ তাআ’লা বলেছিলেন,
“আর আল্লাহ সেই ওয়াদাকে সত্যে পরিণত করেছেন, যখন তোমরা তাঁরই নির্দেশে শত্রুদেরকে
হত্যা করছিলে। (যতক্ষণ পর্যন্ত না) তোমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিলে ও কর্তব্য স্থির
করার ব্যাপারে তর্কে লিপ্ত হয়েছিলে। আর যা তোমরা ভালোবাসো, তা দেখার পর (তোমাদের
কেউ কেউ) কৃতঘ্নতা প্রদর্শন করেছিলো। তখন তোমাদের কেউ দুনিয়া কামনা করছিলো, আর কেউ
কামনা করছিলো আখেরাত। অতঃপর, তোমাদেরকে সরিয়ে দিলেন ওদের উপর থেকে (অর্থাৎ তোমরা
পরাজিত হলে), যাতে করে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি তোমাদেরকে
ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর আল্লাহর মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত অনুগ্রহশীল।” [সুরা আলে-ইমরানঃ ১৫২]
যাই হোক, আল্লাহ তাদেরকে এই বলে নিশ্চয়তা
দিয়েছিলেন, “তিনি
তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন” – সুতরাং, ভবিষ্যতে তিনি তাদেরকে শাস্তি
দেবেন না।
উহুদের যুদ্ধের উদাহরণ দ্বারা এটা
স্পষ্টভাবে প্রমানিত হয় যে, এমনকি মানুষের মাঝে যারা শ্রেষ্ঠ, তারাও যদি কোন ভুল
করে, তাহলে তাদের উপরেও আল্লাহর আযাব আসতে পারে। তাহলে এখন কি অবস্থা হতে পারে,
যখন অনেক মুসলিম শুধুমাত্র নিজেদের ‘ইসলাম’ দাবী করে, কিন্তু তারা দ্বীনের অনুসরণ
করেনা।
অনেক মুসলিম ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলেনা,
ইসলামী আইন দ্বারা বিচার-ফয়সালা করেনা, সঠিক ইসলামী আক্বীদাহর প্রতি বিশ্বাস রাখেনা,
‘হুদুদ’ বা ইসলামিক দন্ডবিধির বাস্তবায়ন করেনা,
তারা সৎ কাজে আদেশ করেনা ও অসৎ কাজে বাঁধা দেয়না।
একারণে মুসলিমদের উপর বৃষ্টির মতো একের পর
এক ফিতনাহ বর্ষিত হচ্ছে দেখে আমরা আশ্চর্য হইনা। এই ফিতনাহ থেকে মুক্তির কোন পথ
নেই, একমাত্র আল্লাহর কিতাব (ক্বুরানুল কারীম) ও রাসুলু্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহর দিকে ফিরে আস
ছাড়া।
মূল উৎসঃ শায়খ সালেহ আল-ফাউজান হা’ফিজাহুল্লাহ এর একটি প্রশ্নের উত্তর থেকে
নেওয়া। পাশাপাশি আল্লামাহ শফিউর রহমান মুবারকপুরী রাহিমাহুল্লাহর রাসুলু্লাহ
সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি
ওয়া সাল্লাম এর ‘সীরাহ’ বা জীবনীর উপরে লিখিত অনন্য গ্রন্থ “আর-রাহীখুল মাক্বতুম” থেকে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য সংযোজন করা
হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রায় একই কথা ইমাম মুহাম্মদ ইবনে
উসায়মিন রাহিমাহুল্লাহ বলেছিলেন, “ওহুদ
যুদ্ধে মাত্র অল্প কয়জন সাহাবী রাসুলু্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর ‘একটি মাত্র আদেশ’ অমান্য করার কারণে গোটা মুসলিম বাহিনীর
নিশ্চিত জয় হাতছাড়া হয়ে তাদের উপর বড় বিপর্যয় নেমে এসেছিলো । সেখানে বর্তমানে আমরা
কি করে আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার আশা করতে পারি, যেখানে আমাদের মাঝে
বেশিরভাগ লোকই হচ্ছে পাপী, আর আমাদের পাপের সংখ্যা হচ্ছে অগণিত?”
উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু
বলেছিলেন,
“আমরা তো মর্যাদাহীন লোক ছিলাম, আল্লাহ আমাদেরকে ইসলাম এর
নিয়ামত দিয়ে সম্মানিত করেছেন। সুতরাং, আল্লাহ আমাদেরকে যা
দ্বারা সম্মানিত করেছেন, আমরা যদি সেই ইসলাম থেকে দূরে সরে
গিয়ে অন্য কোথাও সম্মান খুঁজি, তাহলে আল্লাহ পুনরায়
আমাদেরকে অপমানিত করবেন।”
এ থেকে মুক্তির পথ সম্পর্কে ইমাম মালেক
রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যুঃ ১৭৯ হিজরী) বলেছিলেন, “এই উম্মতের শেষ লোকদেরকে কেবলমাত্র ঐ জিনিসই
সংশোধন করতে পারে,
যা তাদের পূর্ববর্তীদেরকে (অর্থাৎ সাহাবাদেরকে) সংশোধন করেছিলো।”
শায়খ মুহাম্মদ ইবনে উসায়মিন রাহিমাহুল্লাহ
বলেন,
“সাহাবাদেরকে যেই জিনিস সংশোধন করেছিলো তা
হচ্ছে, আল্লাহ তাআ’লার
আনুগত্য ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা।”
শায়খ ফাওজানের মূল ফতোয়া এবং তার ইংরেজী
অনুবাদের লিংক –
https://www.youtube.com/watch?v=u41T-f_G8Cw
“আর-রাহীখুল মাক্বতুম” এর ডাউনলোড লিংক –
http://islamhousebd.wordpress.com/ar-raheequl-makhtoom/
অথবা,
http://www.quraneralo.com/ar-rahiqul-makhtum/