রমাযাবনের ৩০ আসরঃ
আজকের বিষয়ঃ সিয়াম পালনের ফরয আদবসমূহ
- শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমিন
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টি তথা মানুষকে পূর্ণতর
শিষ্টাচারের দিয়েছেন দিক-নির্দেশনা, তাদের জন্য নিজ দয়া ও দানের সর্বপ্রকার ভাণ্ডার
করেছেন উন্মুক্ত, মুমিনদের দৃষ্টিকে করেছেন আলোকিত ফলে তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে
গূঢ় বাস্তবতা এবং তালাশ করেছে সাওয়াব, তাঁর আনুগত্য উপেক্ষাকারীদের দৃষ্টিকে করে দিয়েছেন
অন্ধ ফলে তাদের ও তাঁর নূরের মাঝে পড়ে গেছে পর্দা। তিনি নিজ হিকমত ও ইনসাফ অনুযায়ী
তাদের দিয়েছেন হেদায়াত, আর অন্যদের করেছেন পথভ্রষ্ট। নিশ্চয় এতে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য
উপদেশ।
আর আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য
ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, তিনি প্রবল-পরাক্রমশালী ও মহাদাতা। আমি
আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি উৎকৃষ্টতম ইবাদত ও পূর্ণতর
শিষ্টাচার নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন।
আল্লাহ সালাত বর্ষণ করুন তাঁর ওপর, তাঁর সকল পরিবার-পরিজন ও
সাহাবীর ওপর এবং কিয়ামত পর্যন্ত তাদের উত্তমরূপে অনুসরণকারীদের ওপর। আর তিনি যথার্থ
সালামও পেশ করুন।
o আমার ভাইয়েরা! জেনে
রাখুন, সিয়ামের অনেক আদব বা পালনীয় বিষয় রয়েছে
যা ছাড়া সিয়াম পূর্ণতা পায় না এবং যা যথাযথভাবে সম্পন্ন না করা হলে সিয়ামের উৎকর্ষ
সাধন হয় না।
আর তা দুই প্রকার:
১- প্রথম প্রকার: ফরয করণীয়সমূহ, যা প্রতিটি সাওম পালনকারীকেই
অবশ্যই খেয়াল রাখতে হয় এবং সেগুলোর প্রতি যথাযথ যত্নবান থাকতেই হয়।
২- দ্বিতীয় প্রকার: মুস্তাহাব করণীয়সমূহ, আর তা এমন কিছু মুস্তাহাব
আদব; সাওম পালনকারীকে সেগুলোর প্রতি যত্নশীল হওয়া ও লক্ষ্য রাখা উচিত।
• ওয়াজিব আদবসমূহের মধ্যে রয়েছে: আল্লাহ তা‘আলা
সিয়াম পালনকারীর ওপর যেসব মৌখিক ও কায়িক ইবাদত আবশ্যক করেছেন তা বাস্তবায়ন করা।
o এসব ইবাদতের মধ্যে
ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ফরয সালাত। সালাত ইসলামের অন্যতম রুকন। সালাতের
শর্ত, রুকন ও ওয়াজিবসমূহ আদায় করে নিয়মিত সালাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার যত্ন নেয়া এবং
সময়মত জামাতের সঙ্গে মসজিদে গিয়ে আদায় করা। কেননা এটা তাকওয়ার অন্তর্ভুক্ত, যা অর্জনের
জন্য সিয়ামের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে এবং উম্মতের জন্য ফরয করা হয়েছে। আর সালাত পরিত্যাগ
করা তাকওয়ার পরিপন্থী এবং শাস্তির আবশ্যককারী।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
‘তাদের
পরে আসল এমন এক অসৎ বংশধর যারা সালাত বিনষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং
শীঘ্রই তারা জাহান্নামের শাস্তি প্রাপ্ত হবে। তবে তারা নয় যারা তাওবা করেছে, ঈমান এনেছে
এবং সৎকর্ম করেছে; তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি কোন যুলম করা হবে না।’
{সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৯-৬০}
সাওম পালনকারীদের
মধ্যে কেউ কেউ তার উপর জামায়াতে সালাত আদায় ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও তাতে অবহেলা করে।
অথচ আল্লাহ তাঁর কিতাবে জামাতে সালাতের নির্দেশ প্রদান করেছেন।
* তিনি বলেছেন:
‘(হে
রাসূল) যখন আপনি তাদের মাঝে (যুদ্ধক্ষেত্রে) থাকেন তারপর তাদের নিয়ে সালাত কায়েম করেন
তাহলে তাদের একটি দল যেন আপনার সঙ্গে দাঁড়ায়
এবং তারা যেন তাদের যুদ্ধের অস্ত্রাদি সঙ্গে রাখে। আর যখন তারা সিজদা করে -তাদের সালাতের
প্রথম রাকাত সম্পন্ন করে- তখন যেন পিছনে চলে যায় এবং যেন আবার ২য় দলটি আগমন করে যারা
সালাত আদায় করে নি। অতঃপর তারা যেন আপনার সঙ্গে সালাত আদায় করে এবং তাদের সতর্কতা অবলম্বন
করে এবং যুদ্ধের অস্ত্রাদি সঙ্গে রাখে।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০৬}
দেখুন, যুদ্ধ চলাকালে এবং ভীতিকর মুহূর্তেও আল্লাহ জামাতের
সঙ্গে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন! তাহলে নিরাপদ ও শান্ত অবস্থায় এর গুরুত্ব কত বেশি!
* জামা‘আতে সালাত আদায় করা সম্পর্কে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু বর্ণিত
হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন,
‘একজন
অন্ধলোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে এসে নিবেদন করলেন, হে
আল্লাহর রাসূল! আমার মসজিদে নিয়ে আসার মত কোনো লোক নেই। এ কথা শুনে তিনি তাকে জামা‘আতে
না আসার অনুমতি প্রদান করলেন। অতঃপর লোকটি যখন পিছন ফিরে চলে যাচ্ছিল তখন তিনি তাকে
ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, তুমি কি আজান শুনতে পাও? তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। রাসূল
সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে তোমাকে আযানের ডাকে সাড়া দিতে হবে অর্থাৎ
জামায়াতে আসতে হবে।’
এ হাদীসে দেখা যাচ্ছে যে, নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম
লোকটিকে জামাত পরিত্যাগ করার অনুমতি দেন নি, যদিও লোকটি ছিল অন্ধ আর তার কোনো পরিচালক
ছিল না।
আর জামাত ত্যাগকারী শুধু ওয়াজিবই বাদ দেন না, বহুগুণ সাওয়াবসহ
অনেক কল্যাণ থেকে
বঞ্চিত হন। কারণ জামাতে সালাতের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
* যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু
‘আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘জামাতে
সালাত আদায় করা একাকী সালাতের চেয়ে সাতাশ গুণ বেশি মর্যাদা রাখে।’
আর সে নানা সামাজিক কল্যাণ থেকেও বঞ্চিত হয়, যা মুসলিমগণ একসঙ্গে
হবার মাধ্যমে অর্জন করে থাকেন। যেমন সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি স্থাপন, অজ্ঞকে শিক্ষা দেয়া
এবং অভাবীকে সহযোগিতা করা ইত্যাদি। তেমনি সালাতের জামাত ত্যাগের কারণে শাস্তিযোগ্য
অপরাধ হয় এবং মুনাফিকদের সঙ্গেও সাদৃশ্য সৃষ্টি হয়। যেমন,
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক
বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‘মুনাফিকদের
জন্য সবচেয়ে কঠিন সালাত হলো ফজর ও এশার সালাত। তারা যদি জানতো এ দু’ সালাতের
মধ্যে কী ফযীলত রয়েছে তাহলে অবশ্যই হামাগুড়ি দিয়ে উপস্থিত হতো। আর আমার মনে চায় যে,
আমি সালাতের জন্য নির্দেশ দেই। তারপর সালাতের ইকামত দেয়া হবে। অতঃপর আমি একজন লোককে
নির্দেশ দেই সে যেন লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করে। আর আমি লাকড়ি হাতে কিছু লোক নিয়ে ওইসব লোকের কাছে যাবো
যারা সালাতের জামাতে হাযির হয় না। এরপর আমি তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেই।’
* সহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে
বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:
‘যে ব্যক্তি
এটা পছন্দ করে যে, আগামীকাল তথা মৃত্যুর পর আল্লাহর সঙ্গে মুসলিম হিসেবে সাক্ষাত করবে
তার উচিত সে যেন এ সালাতসমূহের ব্যাপারে যত্নবান হয়; যখনই এগুলোর জন্য ডাকা হয়। কারণ,
আল্লাহ তোমাদের নবীর জন্য হেদায়াতের রীতিনীতি প্রবর্তন করেছেন। আর এ সালাতগুলো সে হেদায়াতের
নীতিসমূহের মধ্যে অন্যতম।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘আমরা আমাদেরকে দেখেছি এরকম যে, স্পষ্ট কপটতা
আছে এমন মুনাফিক ছাড়া কেউ সালাতের জামাত থেকে পিছপা হতো না। এমনকি তখনকার সময় কোনো
কোনো মানুষকে দু’জনের কাঁধে ভর করে জামাতে উপস্থিত করা হতো এবং তাকে কাতারে
দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো।’
কোনো কোনো সাওম পালনকারী
আছে যারা আরও সীমালঙ্ঘন করে থাকে, তারা সময়মত সালাত আদায় না করে ঘুমিয়ে থাকে। এটা সবচে
নিন্দিত কাজ এবং সালাত বিনষ্টের সবচে ঘৃণিত রূপ।
এমনকি বহু আলেম বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি শরয়ী কোনো ওযর ব্যতিরেকে
সালাতকে তার সময় থেকে বিলম্ব করবে তার সালাত ১০০ বার পড়লেও গ্রহণযোগ্য হবে না।’
* কেননা নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
‘যে ব্যক্তি
এমন আমল করল যে আমল আমাদের আমল নয় (যে আমলের সঙ্গে আমাদের আমলের কোনো মিল নেই), সেটা
বাতিল বলে গণ্য হবে।’
আর সময়মত সালাত আদায় না করে দেরী করে আদায় করা নবী সাল্লাল্লাহ
‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি এমনটি করবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে, গ্রহণযোগ্য
হবে না।
• সিয়ামের অন্যতম ওয়াজিব আদব হচ্ছে: আল্লাহ যে সকল
কথা ও কাজ হারাম করেছেন সাওম পালনকারী তা থেকে বেঁচে থাকবে। যেমন:
o মিথ্যা থেকে বেঁচে
থাকবে:
আর মিথ্যা হলো বাস্তবতার বিপরীত কথা বলা। সবচেয়ে নিকৃষ্টতম
মিথ্যা হলো আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে
মিথ্যা বলা যেমন, কোনো হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল বলার বিষয়টিকে আল্লাহর দিকে সম্পর্কযুক্ত
করে বলা।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
‘আল্লাহর
প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তোমাদের জিহ্বা যেন এ কথা না বলে এটা হালাল এবং এটা হারাম। যারা
আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করবে তারা সফলকাম হবে না। তাদের সুখ সম্ভোগ ক্ষণিকের জন্য।
তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।’ {সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১১৬-১১৭}
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে আবূ হুরাইরা
ও অন্যান্য রাবী থেকে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“যে ব্যক্তি
আমার ওপর ইচ্ছা করে মিথ্যা বললো সে যেন তার স্থানকে জাহান্নামে নির্ধারণ করে নিল।”
* তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিথ্যা থেকে সতর্ক
করে বলেছেন:
‘তোমরা
মিথ্যা পরিহার কর। কেননা মিথ্যা পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়, আর পাপাচার জাহান্নামের দিকে
ধাবিত করে। কোনো লোক সর্বদা মিথ্যা কথা বলতে থাকলে ও এতে প্রচেষ্টা চালাতে থাকলে তার
নাম আল্লাহ তা‘আলার
কাছে মিথ্যাবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।’
o গীবত থেকে বেঁচে থাকবে:
গীবত হচ্ছে, কোনো মুসলিম ভাইয়ের অগোচরে তার ব্যাপারে এমন আলোচনা
করা, যা সে অপছন্দ করে। চাই এটা তার শারীরিক ত্রুটি-বিচ্যুতিই হোক না কেন। যেমন কাউকে
নিন্দা ও দোষারোপ করার উদ্দেশ্যে ল্যাংড়া, ট্যারা বা অন্ধ বলা। তেমনি কারো চারিত্রিক
ত্রুটি তুলে ধরা যা সে অপছন্দ করে, যেমন বোকা, নির্বোধ, ফাসেক ইত্যাদি। বাস্তবে ওই
লোকের মধ্যে এ সকল
দোষ-ত্রুটি বিদ্যমান থাকুক বা না থাকুক।
* কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গীবত
সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন:
‘এটা
হলো তোমার ভাই সম্পর্কে এমন আলোচনা করা যা সে অপছন্দ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে
তাহলে এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব
দিলেন, তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলে তুমি গীবত করলে, আর যদি না থাকে তাহলে
তুমি তাকে অপবাদ দিলে।’
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে গীবত করতে নিষেধ করেছেন
ও একে নিকৃষ্ট বস্তু তথা আপন মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
‘আর তোমরা
কারো গীবত করো না, তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা
এটাকে ঘৃণাই কর।’ {সূরা আল-হুজুরাত: ১২}
* অনুরূপভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন
যে,
‘তিনি
মেরাজের রাত্রে কোনো এক সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যাদের পিতলের নখ রয়েছে তারা
এগুলো দিয়ে তাদের মুখমণ্ডল ও বক্ষে আঘাত করছে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বললেন, হে জিব্রাইল এরা কারা? জিব্রাঈল উত্তরে বললেন, এরা ওই সমস্ত লোক যারা পৃথিবীতে
মানুষের গোশত খেতো এবং মানুষের সম্মানহানি ঘটাতো।’
o নামীমা বা চুগলখোরী
থেকে বেঁচে থাকবে:
নামীমা বা চুগলখোরী হচ্ছে, পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্টের উদ্দেশ্যে
কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তির ব্যাপারে কোনো কথা বললে অপর ব্যক্তির কাছে তা ফেরি করে বেড়ানো।
এটি অন্যতম কবিরা গুনাহ।
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে
বলেন:
‘চুগলখোর
জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা হতে
বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘নবী
সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা দুটি কবরের পাশে দিয়ে অতিক্রম করলেন। তারপর বললেন,
দুটো কবরবাসীকে আযাব দেয়া হচ্ছে। অবশ্য বিরাট কোনো কঠিন কাজের জন্য তাদের শাস্তি হচ্ছে
না। (অর্থাৎ যা থেকে বেঁচে থাকা কোনো কঠিন বিষয় ছিল না) তাদের একজন প্রস্রাব করে পবিত্রতা
অর্জন করতো না। অপরজন মানুষের মধ্যে চুগলখোরি করে বেড়াত।’
বস্তুত: নামীমা বা চুগলখোরি ব্যক্তি, সমাজ ও মুসলিমদের মধ্যে
বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা এবং তাদের মধ্যে শত্রুতার আগুন লাগিয়ে দেওয়া।
‘আর তুমি
আনুগত্য করো না প্রত্যেক এমন ব্যক্তির যে অধিক কসমকারী, লাঞ্ছিত। পিছনে নিন্দাকারী
ও যে চুগলখোরী করে বেড়ায়।’ {সূরা আল-কালাম, আয়াত: ১০-১১}
সুতরাং যে আপনার কাছে অপরের নিন্দা ও চুগলখোরি করে সে আপনার
ব্যাপারেও চুগলখোরি করে বেড়ায়। সুতরাং তার থেকে সতর্ক থাকুন।
o সকল প্রকার প্রতারণা
ও ধোঁকা প্রদান থেকে বেঁচে থাকতে হবে:
সিয়ামপালনকারী ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া, শিল্প, বন্ধক ও অন্যান্য
যাবতীয় লেনদেনের মধ্যে প্রতারণা থেকে বিরত থাকবে। অনুরূপভাবে সব ধরনের উপদেশ ও পরামর্শের
ক্ষেত্রেও প্রতারণা পরিহার করবে। কেননা ‘প্রতারণা একটি মারাত্মক কবীরা গুনাহ।
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
‘যে আমাদেরকে
ধোঁকা দেয় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
‘যে প্রতারণা
করে সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।’
হাদীসে উল্লেখিত ‘আল-গিশ’ শব্দের অর্থ ধোঁকা দেয়া, খেয়ানত,
আমানত বিনষ্ট করা, মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলা। আর প্রতারণার মাধ্যমে যা
অর্জিত হয় তা নিকৃষ্ট, হারাম ও ঘৃণ্য। প্রতারণা দ্বারা প্রতারক ও আল্লাহর মাঝে কেবলমাত্র
দূরত্বই বৃদ্ধি পায়।
o সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র
থেকে বেঁচে থাকা:
সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র থেকে দূরে থাকা উচিত। যেমন- বীণা, একতারা,
বেহালা, হারমোনিয়াম, গিটার, পিয়ানো, ঢোল-তবলা ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র। কেননা এসব হারাম।
এগুলোর হারাম ও গুনাহ আরও বৃদ্ধি পায় যখন এর সাথে মিলিত হয় উত্তেজনামূলক গান ও মিষ্টি
আওয়াজ।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
‘মানুষের
মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য গান বাদ্যের উপকরণ ক্রয়-বিক্রয়
করে এবং আল্লাহ প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করে। তাদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর
কঠোর শাস্তি।’ {সূরা
লুকমান, আয়াত: ৬}
* আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহুকে এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করা হলে তিনি বললেন,
‘যিনি
ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই সেই আল্লাহর শপথ করে বলছি, এটা হচ্ছে গান’ ।
* অনুরূপভাবে ইবন আব্বাস, ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকেও
এ তাফসীর সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া ‘আল্লামা ইবন কাসীর এ তাফসীরটি জাবের রাদিয়াল্লাহু
আনহু, ইকরিমা, সা‘ঈদ ইবন জুবাইর ও মুজাহিদ রাহেমাহুল্লাহ থেকেও উল্লেখ করেছেন
।
* হাসান বসরী রহ. বলেন, ‘এ আয়াতটি গান ও বাদ্যের ব্যাপারে নাযিল
হয়েছে।’
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাদ্যযন্ত্র
থেকে সতর্ক করেছেন। তিনি এসবকে যেনা-ব্যভিচারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন:
‘আমার
উম্মতে এমন একদল লোক হবে যারা যেনা-ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে।’
হাদীসে বর্ণিত ‘الْحِرَ’ শব্দটির
অর্থ হচ্ছে, লজ্জাস্থান, যার দ্বারা যেনা-ব্যভিচার বুঝানো হয়েছে। আর ‘يَسْتَحِلُّونَ’ এর
অর্থ হচ্ছে এমনভাবে ভ্রূক্ষেপহীনভাবে করা যেমন হালাল মনে কেউ কোনো কাজ করে থাকে।
বর্তমান সময়ে এমন মানুষ রয়েছে যারা এসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার
করে থাকে অথবা সেগুলো এমনভাবে শ্রবণ করে থাকে যেন এগুলো হালাল জিনিস।
এটা এমন এক ষড়যন্ত্র যা দ্বারা ইসলামের শত্রুরা মুসলিমদেরকে
ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ করতে সফলতা লাভ করেছে। এতে করে তারা মুসলিমদেরকে আল্লাহ তা‘আলার
যিকর-স্মরণ, তাদের দ্বীন ও দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে
পৌঁছেছে যে, মুসলিমদের অনেকেই কুরআন ও হাদীসের পাঠ, ধর্মবেত্তাগণের শরীয়ত ও হিকমত সমৃদ্ধ
বয়ানের চেয়েও এগুলোর প্রতি বেশী এসব গান ও বাদ্যযন্ত্রে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
হে মুসলিমগণ! আপনারা সিয়াম বিনষ্টকারী ও তাতে ত্রুটি সৃষ্টিকারী
বিষয় থেকে সতর্কতা অবলম্বন করুন এবং মিথ্যা বলা ও তদানুযায়ী কাজ ত্যাগ করে সিয়ামের
হক আদায় করুন।
* নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
‘যে ব্যক্তি
মিথ্যা কথা ও মিথ্যার মাধ্যমে আমল করা ও মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারেনি, তার পানাহার
পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’
জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
‘যখন
তুমি সাওম রাখবে তোমার কর্ণ, চক্ষু, জিহ্বাও যেন মিথ্যা কথা ও সব হারাম বর্জনের মাধ্যমে
সাওম পালন করে। তুমি প্রতিবেশিকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকো। অবশ্যই তুমি আত্মসম্মান
ও প্রশান্তভাব বজায় রাখবে। আর তোমার সাওমের দিন ও সাওমবিহীন দিন যেন সমান না হয়।’
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য আমাদের দীন রক্ষা করুন, আমাদের
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলিকে আপনাকে অসন্তুষ্টকারী বিষয়াদি থেকে বিরত রাখুন, আমাদেরকে এবং
আমাদের বাবা-মা ও সকল মুসলিমকে আপনার দয়ায় ক্ষমা করুন হে জগতের শ্রেষ্ঠ করুণাময়। আর
সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর।