রবিবার, ১৫ জুন, ২০১৪

রোযা নিয়ে মাসলা মাসায়েলঃ পর্ব – ৩



রোযা নিয়ে মাসলা মাসায়েলঃ পর্ব – ৩

হয়তোবা অনেকেই জানেন, তারপরেও কারো যদি কোন ভুল ধারনা থাকে তাই আবারও বলছি। এই সিরিজের ২য় পর্ব পড়ুন এই লিঙ্কে –

http://ansarus-sunnah.blogspot.com/2014/04/blog-post_14.html

১. অনিচ্ছাকৃতভাবে শরীর থেকে কম বা বেশি (রক্ত প্রবাহিত হলেও) রোযা ভেঙ্গে যাবেনা বা রোযার কোনো ক্ষতি হবেনা। তবে যদি রক্তপাতের কারণে রোযা রাখতে কষ্ট হয় তাহলে সে রোযা ভাংগতে পারবে, পরে কাজা করে নেবে।
২. কফ বা থুথু সেটা অল্প বা বেশি হোক, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় গিলে ফেললে রোযা ভাংবেনা বা হালকা হয়ে যাবেনা। তবে অহেতুক মুখে কফ জমিয়ে রাখবেন না, একবার জমানো শুরু করলে বারবার থুথু আসবে। তাই অল্প থাকতেই গিলে ফেললে বা ফেলে দিলে এই সমস্যা আর হবেনা।
৩. বাচ্চাকে দুধ খাওয়ালে রোযা ভাংবেনা। তবে রোযা রাখলে যদি সন্তানের বা মায়ের স্বাস্থের ক্ষতি হয়, তাহলে রোযা না রেখে পরে সন্তান একটু বড় হলে কাযা রোযা আদায় করে নিতে হবে।
৪. চোখে বা কানে ড্রপ ব্যবহার করলে রোযা ভাংবেনা। তবে নাকে ড্রপ দিলে যদি তা নাড়ি পর্যন্ত পৌছে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে, কারণ রাসুল সাঃ রোযা অবস্থায় নাকে নরম অংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত পানি দিতে নিষেধ করেছেন, রোযা রেখে ওযু করার সময় শুধু স্বাভাবিক সীমাপর্যন্ত নাকে পানি দিবে যাতে করে গলায় পানি চলে নাযায়। এ থেকে উলামাদের ফতোয়া হচ্ছে, কানে বা চোখে ড্রপ দিলে রোযা ভাংবেনা কিন্তু নাকের ড্রপ দিলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। 
৫. আতর বা সুগন্ধি দিলে বা এর ঘ্রাণ নিলে রোযা ভাংবেনা।
৬. কুলি করার সময় বা নাকে পানি দেওয়ার সময় ‘অনিচ্ছাকৃতভাবে’ পেটে পানি চলে গেলে রোযা ভাংবেনা।
৭. না গিলে শুধুমাত্র খাদ্যের স্বাদ নিলে রোযা ভাংবেনা। তবে একান্ত দরকার না হলে এমনটা করা উচিত নয়।
৮. রক্ত পরীক্ষার জন্য অল্প পরিমাণ রক্ত দিলে রোযা ভাংবেনা।
৯. নাক দিয়ে বা মাড়ি থেকে রক্ত বের হলে রোযা ভাংবেনা। তবে রক্ত গিলে ফেলা যাবেনা, ফেলে দিতে হবে।
১০. এমন ইনহেলার যা শুধুমাত্র গ্যাসীয় পদার্থ থাকে তা নিলে রোযা ভাংবেনা। কিন্তু কিছু আছে যা ক্যাপসুল, পাওডার আকারে থাকে, সেটা যদি পেটে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
১১. কেউ যদি সতর্ক থাকে গিলে না ফেলার জন্য, তাহলে পেস্ট দিয়ে ব্রাশ করলে রোযা ভাংবেনা। তবে যেহেতু পেস্টের কড়া স্বাদ তাই কিছু আলেম দিনের বেলায় এটা ব্যবহার না করাই উত্তম বলে ফতোয়া দিয়েছেন।
১২. রক্ত দিলে রোযা ভেঙ্গে যায় কারণ রক্ত দেওয়া শিংগা লাগিয়ে রক্ত বের করার সমান। সহীহ হাদীসে এসেছে, শিংগা লাগিয়ে রক্ত বের করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। তবে জীবন বাচানোর জন্য জরুরী রক্ত দেওয়া জায়েজ হবে, পরে ঐ রোযার কাজা আদায় করে নিতে হবে।
-  ফাতওয়া লাজনা আদ-দায়িমাহ
১৩. ঋতুবতী নারী, মুসাফির, অসুস্থ বা শরয়ী কারণে যারা রোযা ভংগ করেন, তারা রমযান মাসে দিনের বেলায় খাওয়া-দাওয়া করতে পারবেন।
১৪. ইচ্ছাকৃতভাবে মুখে আঙ্গুল দিয়ে বা কোন গন্ধ শুকে বমি করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। অনিচ্ছাকৃত বমি করলে রোযা ভাংবেনা।
১৫. নেবুলাইজার শুধু গ্যাস হলে রোযা ভাংবেনা
১৬. রোযা রেখে হস্তমৈথুন করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। এটা কঠিন গুনাহ, এর জন্য তোওবা করে পরে একটা কাজা রোযা রাখতে হবে আর ঐদিন না খেয়েই থাকতে হবে। কারণ তার রোযা ভাঙ্গার কোন কারণ ছিলোনা।
১৭. রক্ত বা স্যালাইন নিলে রোযা ভেঙ্গে যাবে, কারণ এটা খাবার বিকল্প।
১৮. ইঞ্জেকশান – এমন ইঞ্জেকশান যাতে কোন পুষ্টি বা নিউট্রিশান (গ্লুকোজ…ইত্যাসি) থাকেনা (যেমন – ইনসুলিন…), এবং রোযা অবস্থায় সেটা দেওয়া যদি জরুরী হয়ে পড়ে, তাহলে রোযা রেখে সেটা দেওয়া জায়েজ হবে, এতে রোযা ভাংবেনা। তবে যদি সম্ভব হয় পিছিয়ে রাতে দেওয়া, তাহলে সেটা করাই নিরাপদ ও উত্তম হবে।
-  ফাতওয়া লাজনা আদ-দায়িমাহ
১৯. সফর - সফরে যদি কোন প্রকার কষ্ট না হয়, আরামদায়ক সফর হয় তাহলে রোযা রাখা যাবে এবং এইক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে রোযা রাখা ফরয আদায় করে নেওয়া। অবশ্য, সফরে কারো কষ্ট না হলেও ইচ্ছা হলে সফরে সে রোযা ভাংগতে পারে, পরে কাজা আদায় করে নিবে।
আর যদি সফরে এমন কষ্ট হয় যা সহ্য করা সম্ভব, তাহলে উত্তম হচ্ছে রোযা ভেঙ্গে পরে কাজা আদায় করে নেওয়া। এইক্ষেত্রে রোযা রাখা মাকরুহ (অপছন্দনীয়)
আর যদি সফরে রোযা রাখলে অত্যধিক কষ্ট হয়, তাহলে সেইক্ষেত্রে রোযা ভাঙ্গা তার জন্য ওয়াজিব, এমন সফরে রোযা রাখা হারাম।  
২০. ভুলে কিছু খেয়ে ফেললে রোযা ভাংবেনা, তবে মনে হওয়ার সাথে সাথে খাবার ফেলে দিতে হবে, রোযা মনে থাকা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত সামান্য খাবার খেলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে।
২১. ইফতারি করে মাগরিব নামায পড়া সুন্নত। কম খেয়ে নামায পড়বেন, কষ্ট হবেনা। পেটভর্তি করে খেলে নামায পড়তে কষ্ট হবে। ইফতারি করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। এটা বাদ দেওয়া যাবেনা, সামান্য খেয়ে হলেও সুন্নত পালন করতে হবে।
২২. চোখে সুরমা দিলে রোযা ভাংবেনা।
২৩. রোযা রাখার কষ্টের কারণে গোসল করলে, পানি ঢাললে বা এসিতে বিশ্রাম করলে রোযার কোন ক্ষতি হয়না।
২৪. অনেকে রোযা রেখে দিনে ঘুমিয়ে কাটায়। এটা অত্যন্ত খারাপ একটা অভ্যাস। অবশ্যই এটা যেই হুকুম করা হয়েছে, তার বিপরীত! রোযা হচ্ছে তাকওয়া অর্জনের জন্য, সেই জন্য রোযা রেখে কুরান তেলাওয়াত, যিকর, সালাত, দান সাদাকা, ইলম অর্জন করা ইত্যাদিনে নেকীর কাজে সময় ব্যয় করা উচিত।
২৫. অনেকে আছে রোযার মাস আসলে মেজাজ খারাপ করে, বাইরে রোযা ঠিকই রাখে কিন্তু ভেতরে ভেতরে মেজাজ খারাপ করে থাকে। স্পষ্টত এই লোকগুলো একেবারেই অজ্ঞ, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা অনেক কম, ঈমানের দিক দুর্বল, এদের অন্তর ব্যধিগ্রস্থ। এদের উচিত ইসলাম শিক্ষা করা, আল্লাহ ও তার রাসূলের পরিচয় জানা।
আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।


*** ২-১টা ছাড়া প্রায় সবগুলো ফতওয়াই শায়খ মুহা’ম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন (রহঃ) এর “ফতওয়া আরকানুল ইসলাম” বই থেকে নেওয়া। বিস্তারিত জানতে আপনার সেই বইয়ের “সাওম অধ্যায়” দেখুন।