প্রশ্নঃ ‘ইবনে তাইমিয়া’ কে ছিলেন?
উত্তরঃ শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ
ছিলেন হিজরী সপ্তম শতাব্দীর একজন ‘মুজাদ্দিদ’। তিনি ছিলেন,
(ক) অসাধারণ মেধা, আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি,
সূক্ষ্ম বিচারশক্তি ও সুদক্ষ তাকির্কতার পারদর্শী আলেমে-দ্বীন,
(খ) অসাধারণ পান্ডিত্যের অধিকারী ফকীহ,
(গ) জারাহ ও তাদীলের ইমাম,
(ঘ) ক্বুরান ও হাদীসের হিফজকারী ও সঠিক
ব্যখ্যা প্রদানকারী, এবং
(ঙ) আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদ।
সুবহা’নাল্লাহি ওয়াবি হা’মদিহি! ইলমের ময়দানে এবং জিহাদের ময়দানে
তাঁর খিদমত এতো বেশি যে, পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত সমস্ত মুসলিম আলেমরা যুগে যুগে
তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন এবং আছেন।
নামঃ ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহর আসল নাম
হচ্ছে আহমাদ ইবনে আব্দুল হালিম ইবনে তাইমিয়া। তাঁর উপাধি হচ্ছে শাইখুল ইসলাম। তিনি
‘ইবনে তাইমিয়া’ নামে বেশি পরিচিত, এটা তাঁর দাদীর নাম। উল্লেখ্য,
তাঁর দাদী ছিলেন একজন আলিমাহ, এবং ইবনে তাইমিয়ার অসংখ্য উস্তাদের মাঝে তাঁর দাদীও
একজন ছিলেন।
জন্ম ও মৃত্যুর স্থানঃ ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহর
জন্ম হয়েছিলো দামেস্কের হাররান প্রদেশে, আর মৃত্যু হয়েছিলো দামেস্কে।
জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ ও বয়সঃ ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহর
জন্ম হয়েছিলো ৬৬১ হিজরি বা ইংরেজী ১২৬৩ খ্রিষ্টাব্দে। আর মৃত্যু হয়েছিলো ৬৫ বৎসর
বয়সে, ৭২৮ হিজরি বা ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দে।
জীবনীঃ ইসলামী ইতিহাসের অনন্য প্রতিভার
অধিকারী এই আলেমের জীবনী অত্যন্ত ঘটনা বহুল এবং সংগ্রাম মুখর। তাঁর সারাটা জীবন
কেটেছে মুসলমানদের মধ্য থেকে শিরক, বিদাত দূর কতার জন্যে মনপূজারীদের বিরুদ্ধে
লিখনী, বক্তৃতার মাধ্যমে যুদ্ধ করে কাফির মুশরিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রের জিহাদ করে।
বিদাতী আলেমদের চক্রান্তে জীবনে তাঁকে অনেক সময় জেলে কাটাতে হয়েছিলো। এমনকি ইমাম
আবু হানীফার মতো তাঁর মৃত্যুও হয়েছিলো জেলখানাতে। ঐতিহাসিকগণদের কেউ কেউ উল্লেখ
করেছেন, তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় দুই লক্ষ মুসলমান তাঁর জানাজা পড়ার জন্যে সমবেত হয়েছিলো।
তাঁর জীবনী সম্পর্কে জানার জন্যে আপনারা শায়খ আলীমুদ্দিন (রাহিমাহুল্লাহ) রচিত “শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ” এই বইটা পড়তে পারেন।
শায়খুল ইসলাম এর জীবনী সম্পর্কে আলোকপাত না
করলেও, আমি তাঁর সম্পর্কে আমাদের পূর্ববর্তী আলেমরা কে কি বলেছেন, সে সম্পর্কে
কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি।
(১) ‘সহীহ বুখারীর ব্যখ্যাকারী’, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ
বলেন,
“একজন ইমাম হিসেবে শায়খ তাক্বী উদ্দিন (ইবনে
তাইমিয়ার) সম্মান ও মর্যাদা আমাদের কাছে সূর্যের চাইতেও উজ্জ্বল, এবং ‘শায়খুল ইসলাম’ হিসেবে তাঁর উপাধি আজ পর্যন্ত আমাদের কাছে
আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। যে ব্যক্তি তাঁকে (ইবনে তাইমিয়াকে) ‘শায়খুল ইসলাম’ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করবে, সে শায়খের
মর্যাদা সম্পর্কে জাহেল,
অথবা সে ব্যক্তি পক্ষপাতদুষ্ট। এমন কাজ যে করে সে কতইনা বড় ভুল
পন্থা অবলম্বন করলো!”
আল-রাদ্দ আল-ওয়াফিরঃ পৃষ্ঠা ১৪৫-১৪৬, আল-জাওয়াহির ওয়াল-দু’রারঃ ২/৭৩৪-৭৩৬।
(২) ‘তাফসীরে জালালাইন’ এর বিখ্যাত লেখক, ইমাম জালাল উদ্দিন
সুইয়ুতী রাহিমাহুল্লাহ ইবনে তাইমিয়ার জীবনী সম্পর্কে আলোচনায় বলেছেন,
“ইবনে তাইমিয়া হচ্ছেন আমাদের উস্তাদ, ইমাম (নেতা বা আদর্শ), একজন
‘আল্লামাহ’ (মহা পন্ডিত ব্যক্তি), হাফিজ (ক্বুরান ও
অসংখ্য হাদীসের মুখস্থকারী), জারহ ও তাদীলের আলেম, ফক্বীহ, মুজাহিদ, অসাধারণ
মুফাসসির, একজন ‘শায়খুল
ইসলাম’, যাহিদ (দুনিয়া বিমুখ ও পরকালমুখী) লোকদের
জন্যে আদর্শ বা নেতা। আমাদের যুগে তাঁর সমান আর কেউ নেই।”
তাবাকাত আল-হুফফাজঃ পৃষ্ঠা ৫১৬-৫১৭।
(৩) ‘তাফসীর ইবনে কাসীর’ এর লেখক, ইমাম ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহর
প্রধান উস্তাদ ছিলেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া। তিনি ইবনে তাইমিয়ার পক্ষ নিয়ে শায়খের
বিরোধীতাকারীদের জবাব দিতেন। ইমাম ইবনে কাসীর শায়খের পক্ষে তাঁর ‘ক্বুরানের তাফসীর’ ও তাঁর বিখ্যাত ইতিহাসের কিতাব ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিয়াহা’ তে অনেক ঘটনা ও ফতোয়া উল্লেখ করেছেন।
(৪) রিজাল শাস্ত্রের বড় আলেম, ইমাম
আয-যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন,
“তিনি (ইবনে তাইমিয়া) হচ্ছেন আমাদের উস্তাদ, একজন শায়খুল ইসলাম। আমাদের
যুগে (হিজরী সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে) ইলম, সাহস, বুদ্ধিমত্তা, আধ্যাত্বিক উৎকর্ষতা, দানশীলতা, উম্মতের জন্যে কল্যাণকামীতা, সৎ কাজে আদেশ করা ও অসৎ কাজে নিষেধ করার ব্যপারে তাঁর মতো আর কেউ নেই। হাদীসের
রিজালশাস্ত্র, দোষ-ত্রুটি বিচার-বিশ্লেষণ ও স্তর নির্ধারণ, মুহাদ্দিসের নিকট হাদীস
পৌঁছতে রাবীর কম-বেশি হওয়া সম্পর্কিত জ্ঞান, কোন হাদীস সহীহ নাকি জয়ীফ সেটা নির্ণয়
করার জন্যে মতন মুখস্থ সহ যাবতীয় জ্ঞানে তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ। তাঁর যুগে তাঁর সমান
মর্যাদায় কিংবা তাঁর ধারে-কাছেও কেউ পৌঁছতে পারেনি। তিনি যেকোন বিষয়ে তাৎক্ষণিক
দলিল প্রমাণ সহকারে আলোচনা করার জন্য পারদর্শী ছিলেন।”
তাবাকাত আল-হানবালিয়াঃ ৪/৩৯০।
(৫) ইরাকের বিখ্যাত হানাফী আলেম, আল্লামাহ
মোল্লা আলী ক্বারী রাহিমাহুল্লাহ ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাকে সমর্থন করে বলেছেন, “ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা ও তাঁর ছাত্র হাফিজ
ইবনুল কাইয়্যিম আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআ’তের
বড় আলেম ছিলেন এবং এই উম্মতের ওলী ছিলেন।”
মানাকিবুশ-শায়খুল ইসলাম, ৬২৭ পৃষ্ঠা।
(৬) ভারতগুরু শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রাহিমাহুল্লাহ
বলেন,
“আমি ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহর অবস্থা
যথেষ্ঠ পর্যালোচনা করেছি। তিনি ছিলেন আল্লাহর কিতাব (ক্বুরআন) সম্পর্কে অভিজ্ঞ
ব্যক্তি। আভিধানিক ও শরীআ’তী
পদ্ধতির ব্যখ্যায় তিনি ছিলেন সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি, রাসুলু্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাতের হিফাজতকারী, প্রখর স্মৃতি শক্তিধারী
ব্যক্তি। সাহাবা এবং তাবিঈ’নগণের
আদর্শ ও ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে এবং তার আভিধানিক ও শরীআ’তী অর্থগুলো সম্পর্কে তার অগাধ পান্ডিত্য
ছিলো এবং তার সব কথার সাথে ক্বুরান ও সুন্নাহর প্রমান আছে।”
শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রাহিমাহুল্লাহ আরো
বলেছেন, “এই শায়খের (ইমাম ইবনে তাইমিয়্যার) দৃষ্টান্ত
এই পৃথিবীতে বিরল। কে আছে এমন ব্যক্তি যে তার লিখনী ও বক্তৃতার সাথে পাল্লা দিতে
পারবে? যারা তার
সাথে শত্রুতা করেছে তাদের বিদ্যা শায়খের বিদ্যার দশ ভাগের এক ভাগেরও সমান নয়।” [মাকতুবাতঃ ২৭-২৮ পৃষ্ঠা]
(৭) ভারতবর্ষের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব আল্লামাহ
শিবলী নুমান রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “ইমাম
ইবনে তাইমিয়ার মাঝে মুজাদ্দিদ হওয়ার যে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছিলো, তা চার ইমাম
(ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমাদ) এর মাঝেও ছিলোনা।”
“আন-নাদওয়াহ” মাকালাতে শিবলী, ৫ম খন্ড, ৬৫-৬৬ পৃষ্ঠা।
যুগে যুগে মুসলিম নামধারী কিন্তু আসলে বিদাতপন্থী বা মনপূজারী লোকদের মাঝে
কমন একটা বদ চরিত্র হচ্ছে তারা আলেমদেরকে এটাক করে, তাদের সম্পর্কে কুৎসা রটনা করে
এবং তাদেরকে অপমান করার চেষ্টা করে। আলহা’মদুলিল্লাহ, মাওলা এবং সাহায্যকারী হিসেবে
আল্লাহ একাই তাঁর আওলিয়াদের জন্যে যথেষ্ঠ। যুগে যুগে বিদাতপন্থীরা শায়খুল ইসলাম
ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে কুৎসা রটনা করেছে এবং আজ পর্যন্ত করছে।
বিংশ শতাব্দীতে ‘জাহমী’ মতবাদের প্রচারকারী যাহেদ আল-কাউসারী
(মৃত্যু ১৯৫১ খৃস্টাব্দ) ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে লিখালিখি করে নিজেকে অপমানিত
করেছিলো। কাউসারীর কুকীর্তীর ব্যপারে সতর্ক করে শায়খ বিন বাজ রাহিমাহুলাহ লিখেছিলেন, “কাউসারি ঈমানদার পরহেজগার ব্যক্তি ও উলামাদের
বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছেন। আমরা তার ছাত্র আবু গুদ্দাকে তার উস্তাদের এই সব ব্যপার
হতে তওবা করে দূরে সরে আসার জন্যে বারবার বিশেষভাবে আহবান জানাই, কিন্ত সে তা মেনে
নেয়নি। বরং, সে তার উস্তাদের মানহাজের উপর অটল রয়েছে। আল্লাহ তাকে হেদায়েত করুন এবং
তার অনিষ্ট হতে মুসলিমদের হেফাজত করুন।”
সর্বশেষ,
ইমাম ইবনে তাইমিয়া অনেক কিতাব এবং ফতোয়া লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন। বিশেষ করে
আক্বীদাহর ব্যপারে তাঁর কিতাবগুলো আহলে সুন্নত ওয়াল জামআ’তের জন্যে মহামূল্যবান মনি-মুক্তার মতো। আমরা দুয়া করি,
আল্লাহ তাআ’লা ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে
জান্নাতুল ফেরদাউসে সেই প্রতিদান দান করুন, তিনি যার জন্য উপযুক্ত, আমিন।