ইন্নাল হা’মদালিল্লাহ। ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু
আ’লা রাসুলিল্লাহ। আম্মা বাআ’দ। আমি চাই আপনারা সকলেই সুরা আ’লা হিফজ করে নিন।
প্রশ্ন করতে
পারেন, সুরা আ’লা (ক্বুরানুল কারীমের ৩০ নম্বর পারার ৮৭ নাম্বার সুরার) মাঝে কি এমন ফযীলত
আছে যে এটা মুখস্থ করতে হবে?
জওয়াব হচ্ছেঃ
মুসনাদে আহমাদে আলী রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, “নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এই সুরাটিকে খুবই ভালোবাসতেন।” [তাফসীর ইবনে কাসীর]
নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম যে সুরা আ’লা-কে অনেক ভালোবাসতেন,
তার কিছু নিদর্শন রয়েছে। যেমন,
(১) নবীজী প্রায়ই জুমুয়া’হ এবং দুই ঈদের
সালাতের প্রথম রাকাতে সুরা আ’লা এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা গাশিয়াহ তেলাওয়াত করে মুসল্লিদেরকে শোনাতেন।
প্রত্যেক সপ্তাহে জুমুয়া’হর সালাত এবং প্রতি বছরে দুই ঈদের সালাত
মুসলিমদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটা সমাবেশ। এ উপলক্ষ্যে অধিক সংখ্যক লোক সমবেত হয়ে
থাকে। তাই ইমাম-এর জন্যে আবশ্যক হচ্ছে, অল্প কথায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা মুসলিমদেরকে
স্বরণ করিয়ে দেওয়া, যাতে করে তাদের অন্তর নরম হয়, ক্বুরান ও হাদীস থেকে উপদেশ গ্রহণ
করে, সর্বদা আল্লাহর কথা স্বরণে রাখে, পরকালের আশায় পাপকাজ বর্জন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি
অর্জিত হয় এমন কাজের দিকে উৎসাহিত হয়। সুরা আ’লা এবং সুরা গাশিয়াহ এ দুটি সুরাই হচ্ছে ‘মাক্কী’ সুরার অন্তর্ভুক্ত।
অর্থাৎ, নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর মক্কা থেকে মদীনাতে
হিজরত করার পূর্বেই এই সুরা দুইটি নাযিল হয়েছিলো। মাক্কী সুরাগুলোর সাধারণ
বৈশিষ্ট্য হচ্ছেঃ এই সুরাগুলো ছোট ছোট, এবং এর আয়াতগুলো ছড়ার মতো ছন্দ মিলযুক্ত,
যা পড়তে ভালো লাগে, শুনলে অন্তরে প্রভাব বিস্তার করে। মাক্কী সুরাগুলোর ‘থিম’ বা আলোচনার মূল বিষয়বস্তু
হচ্ছে ঈমান-আক্বীদার মৌলিক দিকগুলো, যেমন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, গায়েব এবং
মৃত্যুর পরের জীবন, ক্বিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস, বিচার দিনের হিসাব-নিকাশ, জান্নাত ও
জাহান্নামের বর্ণনা, পাপী লোকদের সমালোচনা এবং তাদের জন্যে নির্ধারিত শাস্তির
বর্ণনা এবং এর বিপরীতে নেককার লোকদের বৈশিষ্ট্য ও তাদের প্রশংসা, তাদের কর্মের কি
উত্তম প্রতিদান রয়েছে ইত্যাদি। এই সুরাগুলো পড়লে আল্লাহর প্রতি ঈমান ও ভালোবাসা
বৃদ্ধি পায়, নেক কাজের প্রতি উৎসাহ আসে এবং পাপ কাজের প্রতি অন্তরে ঘৃণা এবং আল্লাহর
শাস্তির ভয় সৃষ্টি হয়। মাক্কী সুরাগুলোর মাঝে বিশেষ করে সুরা আ’লা এবং সুরা গাশিয়াহ দুইটি সুরাতেই অল্প কথায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ
কিছু বিষয়ের উপর আল্লাহ তাআ’লা আলোকপাত করেছেন। সুরা দুইটির অর্থের দিকে লক্ষ্য করলে খুব সহজেই বুঝা যায়, নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কেনো এই দুইটি সুরাকে
জুমুয়া’হ এবং দুই ঈদের সালাতে বেশি বেশি করে তেলাওয়াত করতেন। এমনকি কখনো একই দিনে জুমুয়া’হ এবং ঈদ অনুষ্ঠিত হলেও তিনি সালাতের ক্বিরাত
হিসেবে এ দুটি সুরাকেই বেছে নিতেন। হাদীসের দলীল –
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম জুমুয়া’হর সালাতে ‘সাব্বি হিসমা রাব্বিয়াল আল্লা’ (সুরা আ’লা) এবং ‘হাল আতাকা হাদীসুল গাশিয়াহ’ (সুরা গাশিয়াহ) পাঠ করতেন। যদি ঘটনাক্রমে একই দিনে জুমুয়া’হ এবং ঈদের সালাত পড়ে যেতো, তখন উভয় সালাতেই
এই সুরা দুটি পড়তেন।”
সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু
দাউদ, জামে তিরমিযী, সুনান নাসাঈঃ ১৪২৫, হাদীসটি সহীহ।
(২) নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম যে সুরা আ’লা-কে অনেক ভালোবাসতেন
তার আরেকটি নিদর্শন হচ্ছে তিনি বিতির সালাতের প্রথম রাকাতে সুরা আ’লা পড়তেন। হাদীসের
দলীলঃ
“নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বিতির সালাতের প্রথম রাকাতে সুরা আল-আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সুরা কাফিরুন ও তৃতীয়
রাকাতে সুরা ইখলাস পাঠ করতেন।”
সুনানে নাসাঈঃ ৩/২৪৪, দারা
কুতনীঃ ২/৩১; হাদীসটিকে ইমাম নাসাঈ এবং ইমাম হাকিম ‘সহীহ’ বলেছেন।
সুতরাং, আপনারা সুরা আ’লা মুখস্থ করে নিলে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এই সুন্নাতের
উপর আমল করতে পারবেন। এ থেকে প্রমানিত হয় যে, বিতির সালাত তিন রাকাত
পড়লে তার প্রথম রাকাতে সুরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সুরা কাফিরুন ও তৃতীয়
রাকাতে সুরা ইখলাস পড়া ‘মুস্তাহাব’। (সুন্নাহ দ্বারা
প্রমানিত পছন্দনীয় বা উত্তম একটি কাজ)।
(৩) এছাড়াও এমনিতে যোহর,
আসর বা যেকোন সালাতের জন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সুরা আ’লা তেলাওয়াত করতে
উৎসাহিত করেছেন।
মুয়াজ বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আ’নহু (একজন প্রসিদ্ধ
সাহাবী) মদীনাতে কিছু সাহাবীদের সালাতে ইমামতি করতেন। অধিক সওয়াবের আশায় তিনি
সালাতে লম্বা ক্বেরাত পড়তেন যে কারণে দীর্ঘ
জামাত পড়া কারো কারো জন্য অসুবিধা হতো। একবার একজন যুবক বয়সী ছেলের
ব্যস্ততা থাকায় সে লম্বা কেরাতের কারণে জামাত ছেড়ে দিয়ে আলাদা একাকী সালাত পড়ে
নেয়। বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে উত্থাপন করা
হলে নবীজী মুয়াজ রাদিয়াল্লাহু
আ’নহুকে জামাতে উপস্থিত
অসুস্থ, বৃদ্ধ বা তাড়া আছে এমন সকলের জন্যে উপযোগী সংক্ষিপ্ত ক্বিরাত পড়তে নসীহত
করে বলেন, “তুমি কেন সালাতে সুরা
শামস, সুরা আ’লা, সুরা আলাক্ব, সুরা
লায়ল এমন সুরাগুলো পড়োনা?”
সহীহ বুখারী,
সহীহ মুসলিম, সুনানে নাসাঈ।
সুরা আ’লা বা উপরে উল্লেখিত
অন্য সুরাগুলো মুখস্থ থাকলে আপনারা চাইলে যেকোন
ওয়াক্তের ফরজ, সুন্নত, নফল যেকোন সালাতের ক্বিরাত হিসেবে পড়তে পারেন। বেশি সওয়াব
পেতে চাইলে এক রাকাতে সুরা আ’লা সম্পূর্ণটা, অথবা তাড়া থাকলে বা যখন কষ্টকর হবে তখন একটা সুরাকে ভেঙ্গে দুই
রাকাতে পড়তে পারেন। সুরা আ’লাকে ভেঙ্গে দুই রাকাতে পড়তে চাইলেঃ প্রথম রাকাতে প্রথম আয়াত থেকে তের নং আয়াত
(সুম্মা লা-ইয়ামুতু ফীহা-অলা-ইয়াহ্’ইয়া) পর্যন্ত পড়বেন। আর দ্বিতীয় রাকাতে চৌদ্দ
নং আয়াত থেকে (ক্বাদ্ আফলাহা মাং-তাযাক্কা) থেকে শেষ আয়াত পর্যন্ত তেলাওয়াত করবেন।
(৪) সুরা আ’লার তাফসীরঃ
সুরা আ’লার আয়াতগুলো ছোট ছোট, কিন্তু প্রত্যেকটা
আয়াতের অর্থ অনেক ভারী। আপনারা সুরাটির তর্জমা বারবার পড়লে এবং আয়াতগুলোর অর্থ
নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে বুঝতে পারবেন। এছাড়া তাফসীর জানার জন্যে ‘তাফসীর ইবনে কাসীর’ এর সর্বশেষ ১৮-তম খন্ডটি দেখতে
পারেন। আপনার যারা তাফসীর পড়তে চান তারা প্রথমেই সুরা বাক্বারাহ, সুরা
নিসা...এইগুলো দিয়ে শুরু করবেন না। কারণ এই সুরাগুলি অনেক বড়, আর এখানে অনেক
মাসলা-মাসায়েল, রাষ্ট্রীয় জীবন, উত্তরাধিকার এমন ফুরুয়ী (দ্বীনের শাখা-প্রাশাখার)
বিষয় বেশি আলোচিত হয়েছে। সেইজন্য দ্বীন শিক্ষার্থীদের জন্যে উত্তম হচ্ছে প্রথমে
৩০নং বা আমপারা থেকে ছোট সুরাগুলোর তর্জমা ও তাফসীর জানা এবং আস্তে আস্তে মুখস্থ
করার চেষ্টা করা। এইগুলো জানা হলে এরপর আপনারা ২৮ ও ২৯ নং পারা, এর পরে ২৭ নং পারা
দেখতে পারেন। এই সুরাগুলোর অর্থ বুঝা হলে এর পরে আপনারা আস্তে আস্তে বড় সুরাগুলোর
তর্জমা ও তাফসীর দেখতে পারেন। [দ্বীন শিক্ষার্থীদের জন্যে প্রথমে শেষের ৩-৪ পারার
তাফসীর পড়ার জন্যে - এই কথাটা সৌদি আরবের একজন বড় আলেম, শায়খ সালেহ বিন আব্দুল
আজীজ হা’ফিজাহুল্লাহ তার লিখিত একটা কিতাবে উল্লেখ করেছেন।]
(৫) তিলাওয়াতঃ
সুরা আ’লার শুদ্ধ ও সুন্দর তিলাওয়াত শোনার
জন্যে আপনারা ক্বারী সা’দ আল-গামদীর এই ভিডিওটি দেখতে পারেন। সা’দ আল-গামদী আমার প্রিয় একজন
ক্বারী, সুবহানাল্লাহ! এতো দরদমাখা মিষ্টি একটি কন্ঠ। আজ (২৭/১২/২০১৫) দুপুর বেলায়
তার সুরা আ’লার তেলাওয়াত শুনতে শুনতে হঠাৎ মনে হলোঃ আমার ভালোবাসার এই সুরাটি আপনাদেরকে
হিফজ ও শিক্ষা করার জন্যে বলি। সেজন্যে আজকে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত সুরা আ’লার উপরে আমার এই পোস্ট লিখা।
আল্লাহ আমাদেরকে তোওফিক দান করুন।
https://www.youtube.com/watch?v=wjEgwB_aBJM
অডিও ডাউনলোড
করতে পারবেন এই লিংক থেকে –
http://quranicaudio.com/download/12243
(৬) এখন আমি
সুরা আ’লার বাংলা উচ্চারণ এবং সরল তর্জমা ও ‘আহসানুল বায়ান’ থেকে তাফসীরসহ বর্ণনা করছি। আমি
আরবী দিচ্ছিনা কারণ আরবী টেক্সট দিলে অনেক সময় পুরো পোস্টের ফন্ট উলট-পালট হয়ে
যায়। আরবী সবার বাসাতেই আছে, আপনারা বাসায় আরবী খুলে পড়বেন। যারা অনলাইনে পড়তে চান
তারা এই লিংকে দেখুন –
http://www.quransharif.net/index.php?option=com_content&view=article&id=256&Itemid=83
বাংলা উচ্চারণ দেখে ক্বুরান পড়লে সেটা শুদ্ধ
হয়না, সুতরাং আপনারা অবশ্যই চেষ্টা করবেন আরবী দেখেই মুখস্থ বা তেলাওয়াত করার
জন্যে। আমি বাংলা উচ্চারণ দিচ্ছি যাতে করে যারা ক্বুরান তেলাওয়াতে দক্ষ নন, তারা
যাতে বাংলাতে উচ্চারণ দেখে সাহায্য নিতে পারেন। আপনারা আরবী পড়ার জন্যে বাংলা
উচ্চারণ দেখে সাহায্য নিতে পারেন, কিন্তু শুদ্ধ উচ্চারণের জন্যে অবশ্যই আরবী দেখেই
তিলাওয়াত বা হিফজ করবেন।
সুরা নং – ৮৭ ::: আল-আ’লা।
বাংলায় উচ্চারণ, অর্থ ও
তাফসীরসহ সুরা আল-আ’লা, মক্কায় অবতীর্ণ, আয়াত সংখ্যাঃ ১৯, রুকুঃ ১।
আরবী উচ্চারণঃ আ’উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম।
বিসমিল্লাহির-রাহ’মানির
রাহীম।
অর্থঃ
আরবী উচ্চারণঃ সাব্বি-হিসমা
রব্বিকাল্ আ’লা।
(১) আপনি আপনার সুমহান
প্রতিপালকের নামে পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন।
আয়াতের তাফসীরঃ আল্লাহ
তাআলা ঐ সব জিনিস থেকে পবিত্র যা তাঁর জন্য শোভনীয় বা উপযুক্ত নয়। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে
যে, নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এই সূরাটির প্রথম আয়াতের জওয়াবে “সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা” বলতেন। [মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ নামায
অধ্যায়, নামাযে দুআ’র পরিচ্ছেদ; শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।]
আরবী উচ্চারণঃ আল্লাযী
খালাক্বা ফাসাওয়্যা।
(২) যিনি সৃষ্টি করেছেন,
অতঃপর সুবিন্যস্ত করেছেন।
আয়াতের তাফসীরঃ অর্থাৎ,
আল্লাহ মানুষকে তুচ্ছ বীর্যবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছেন, অথচ ইতিপূর্বে তার কোন অস্তিত্বই
ছিল না। তারপর মানুষকে একটি পূর্ণাঙ্গ দেহ অবয়বরূপে সৃষ্টি করেছেন। যাতে মানুষ শুনতে
পারে, দেখতে পারে এবং জ্ঞান-বুদ্ধি প্রয়োগ করতে পার।
আরবী উচ্চারণঃ ওয়াল্লাযী
ক্বাদ্দারা ফাহাদা।
(৩) এবং যিনি ‘তাক্বদীর’ (নিয়তি) নির্ধারণ করেছেন। তারপর পথ প্রদর্শন করেছেন।
আয়াতের তাফসীরঃ অর্থাৎ,
মানুষকে পাপ ও পুণ্যের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। অনুরূপ জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছুর
পথ তিনি দেখিয়েছেন। এই পথনির্দেশ পশু-পক্ষীকেও করা হয়েছে। ‘ক্বাদ্দারা’ শব্দের অর্থ হল প্রত্যেক বস্তুর শ্রেণী
ও তার প্রকারভেদ, গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে মানুষকেও তার প্রতি তিনি পথ প্রদর্শন
করেছেন, যাতে মানুষ উপকৃত হতে পারে।
আরবী উচ্চারণঃ ওয়াল্লাযী
আখরাজ্বাল মারআ’।
(৪) এবং যিনি (চারণ-ভূমির)
তৃণাদি উৎপন্ন করেছেন।
আয়াতের তাফসীরঃ যাতে চতুষ্পদ
জন্তুরা চরে বেড়ায়।
আরবী উচ্চারণঃ ফাজ্বা আ’লাহু গুসা-য়ান্ আহ্’ওয়া।
(৫) অতঃপর তাকে শুষ্ক খড়-কুটায়
পরিণত করেছেন।
আয়াতের তাফসীরঃ ঘাস শুকিয়ে
গেলে তাকে ‘গুসা-য়ান’ বলা হয়, ‘আহ্ওয়া’ শব্দের অর্থ হল কালো করে দিয়েছেন। অর্থাৎ, তাজা-সবুজ ঘাসকে
শুকিয়ে কালো করে দিয়েছেন।
আরবী উচ্চারণঃ সানুকরিয়ুকা
ফালা তাংসা।
(৬) অচিরেই আমি আপনাকে
(ক্বুরান) পাঠ করাব, ফলে আপনি ভুলে যাবেন না।
আয়াতের তাফসীরঃ জিবরীল
আ’লাইহিস সালাম যখন ওয়াহী (আল্লাহর প্রত্যাদেশ) নিয়ে আসতেন, তখন তা রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাড়াতাড়ি পড়তে শুরু করতেন; যাতে করে ভুলে না যান। আল্লাহ তাআ’লা এই আয়াতে বলছেন যে, ক্বুরান মুখস্থ করা
ও মনে রাখার এত তাড়াতাড়ি করে পড়ার প্রয়োজন নেই। বরং, নাযিলকৃত ওয়াহী তোমাকে পাঠ করাবার
দায়িত্ব আমার। অর্থাৎ, তোমার মুখে তা সঞ্চালিত করব; ফলে তুমি তা ভুলবে না। তবে আল্লাহ
যা চাইবেন, তা ভুলে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এইরূপ চাননি। এই জন্য তাঁর সমস্ত মুখস্থ
ছিল। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এর অর্থ হল এই যে, যা আল্লাহ মনসুখ (রহিত) করতে চাইবেন,
তা তোমাকে ভুলিয়ে দিবেন। [ফাতহুল ক্বাদীর]
আরবী উচ্চারণঃ ইল্লা-মা-শা-য়াল্লা-হ্;
ইন্নাহু ইয়া’লামুল্ জ্বাহরা
ওয়ামা- ইয়াখফা।
(৭) আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন
তা ছাড়া। নিশ্চয় তিনি জানেন সমস্ত ‘ব্যক্ত’ ও ‘গুপ্ত’ বিষয়।
আয়াতের তাফসীরঃ এ কথাটি
ব্যাপক। ‘ব্যক্ত’ কুরআনের ঐ অংশকেও বলা যায়; যা নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম মুখস্থ করে নেন। আর যা তাঁর অন্তর থেকে মুছে দেওয়া হয়, তা হল ‘গুপ্ত’ বিষয়। অনুরূপভাবে যা সশব্দে পড়া হয়, তা ‘ব্যক্ত’ এবং যা নিঃশব্দে পড়া হয়, তা ‘গুপ্ত’ এবং যে কাজ প্রকাশ্যে করা হয় তা ‘ব্যক্ত’ এবং যে কাজ গোপনে করা হয়, তা ‘গুপ্ত’ এ সকল বিষয়ে আল্লাহই ভালো জানেন।
আরবী উচ্চারণঃ ওয়ানু ইয়াস-সিরুকা
লিল্-ইয়ুসরা।
(৮) আমি আপনার জন্য (কল্যাণের
পথকে) সহজ করে দেব।
আয়াতের তাফসীরঃ এ কথাটিও
ব্যাপক। যেমন, আমি তোমার জন্য ওয়াহীকে সহজ করে দেব, যাতে তা মুখস্থ করা এবং তার উপর
আমল করা সহজ হয়ে যায়। তোমাকে সেই পথ প্রদর্শন করব, যা হবে সরল। যে আমল জান্নাতে নিয়ে
যাবে, আমি তোমার জন্য সেই আমল সহজ করে দেব। আমি তোমার জন্য ঐ সমস্ত কর্ম ও কথাকে সহজ
করে দেব, যাতে মঙ্গল নিহিত আছে এবং আমি তোমার জন্য এমন শরীয়ত নির্ধারণ করব, যা সহজ,
সরল এবং মধ্যপন্থী হবে; যার মধ্যে কোন প্রকার বক্রতা, কঠিনতা ও সংকীর্ণতা নেই।
আরবী উচ্চারণঃ ফাযাক্কির
ইন্না ফাআ’তিয্-যিকরা।
(৯) অতএব আপনি উপদেশ দিন;
যদি উপদেশ ফলপ্রসূ হয়।
আয়াতের তাফসীরঃ অর্থাৎ,
সেখানে ওয়ায-নসীহত কর, যেখানে অনুমান হয় যে, তা উপকারী হবে। এই আয়াতের মাধ্যমে মহান
আল্লাহ ওয়ায-নসীহত এবং শিক্ষাদানের একটি নীতি ও আদর্শ বর্ণনা করেছেন। (তাফসীর ইবনে
কাসীর)। ইমাম শওকানী রাহিমাহুল্লাহ এর নিকট আয়াতের অর্থ হল এই যে, ‘তুমি উপদেশ দাও; যদি উপদেশ ফলপ্রসূ হয় অথবা
না হয়।’ কেননা, সতর্কীকরণ ও তবলীগ উভয় অবস্থাতেই
তাঁর জন্য জরুরী ছিল।
আরবী উচ্চারণঃ সাইয়ায্যাক্কারু
মাইঁ-ইয়াখশা।
(১০) যে ভয় করে, (শুধুমাত্র)
সে ব্যক্তিই উপদেশ গ্রহণ করবে।
আয়াতের তাফসীরঃ অর্থাৎ,
তোমার উপদেশ নিশ্চয় ঐ সমস্ত লোকেরা গ্রহণ করবে, যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে। আর তার
মাধ্যমে তাদের মধ্যে আল্লাহ-ভীতি ও নিজেদের সংস্কার-প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পাবে।
আরবী উচ্চারণঃ ওয়া-ইয়াতাজ্বান্নাবুহাল্
আশক্বা।
(১১) আর যে হতভাগা, সে
তা (উপদেশ) উপেক্ষা করবে,
আয়াতের তাফসীরঃ অর্থাৎ,
সেই উপদেশ দ্বারা তারা উপকৃত হবে না। কেননা, কুফুরীতে অবিচলতা ও আল্লাহর অবাধ্যাচরণ
তাদের মাঝে অব্যাহত থাকে।
আরবী উচ্চারণঃ আল্লাযী
ইয়াছ্লান্না-রাল্ কুবরা।
(১২) সে (হতভাগা) মহা অগ্নিতে
প্রবেশ করবে।
আরবী উচ্চারণঃ সুম্মা লা-ইয়ামুতু
ফীহা-অলা-ইয়াহ্'ইয়া।
(১৩) অতঃপর সে সেখানে মরবেও
না, বাঁচবেও না।
আয়াতের তাফসীরঃ এর বিপরীতে
এক শ্রেণীর (তওহীদবাদী) জাহান্নামী এমনও হবে, যারা শুধু নিজেদের কৃত পাপের শাস্তি ভোগের
জন্য সাময়িকভাবে কিছুকাল জাহান্নামে অবস্থান করবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এক প্রকার
মৃত্যু দেবেন। এমনকি তারা আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে। তারপর মহান আল্লাহ নবীগণের সুপারিশে
তাদেরকে একদল একদল করে বের করা হবে। অতঃপর তাদেরকে জান্নাতের (হায়াত) নহরে নিক্ষেপ
করা হবে। জান্নাতীগণও তাদের উপর পানি ঢালবেন। তখন তারা এতে এমন সজীব হয়ে উঠবে যেমন
শস্যদানা স্রোতবাহিত আবর্জনার উপর অঙ্কুরিত হয়ে উৎপন্ন হয়। [এই ঘটনাগুলো বর্ণিত হয়েছেঃ
সহীহ মুসলিম ঈমান অধ্যায়, শাফাআ’ত প্রমাণ এবং জাহান্নাম থেকে একত্ববাদীদের বের হওয়া পরিচ্ছেদ-এ]
আরবী উচ্চারণঃ ক্বাদ্ আফলাহা
মাং-তাযাক্কা।
(১৪) নিশ্চয় সে সাফল্য
লাভ করবে, যে নিজেকে শুদ্ধ করে।
আয়াতের তাফসীরঃ অর্থাৎ,
যে নিজের আত্মাকে নোংরা আচরণ থেকে এবং অন্তরকে শিরক ও পাপাচারের পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র
করে।
আরবী উচ্চারণঃ ওয়াযাকারসমা
রাব্বিহী ফাছোয়াল্লা।
(১৫) এবং নিজ প্রতিপালকের
নাম স্মরণ করে ও সালাত আদায় করে।
আরবী উচ্চারণঃ বাল্ তু’ছিরূনাল্ হা’-ইয়া-তাদ্দুন্ইয়া।
(১৬) বস্তুতঃ তোমরা পার্থিব
জীবনকে অগ্রাধিকার দাও,
আরবী উচ্চারণঃ ওয়াল্ আ-খিরাতু
খাইরুঁও-ওয়া আবক্বা।
(১৭) অথচ পরকালের জীবনই
হচ্ছে উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী।
আয়াতের তাফসীরঃ কেননা,
পৃথিবী এবং তার সমস্ত বস্তু ধ্বংসশীল। পক্ষান্তরে পরকালের জীবনই হল চিরস্থায়ী জীবন।
বলা বাহুল্য, জ্ঞানী ব্যক্তি কোন দিন চিরস্থায়ী বস্তুর উপর ধ্বংসশীল ক্ষণস্থায়ী বস্তুকে
অগ্রাধিকার দেয় না।
আরবী উচ্চারণঃ ইন্না হা-যা-লাফিছ্
ছুহু’ফিল্ উলা।
(১৮) নিশ্চয়ই এটা পূর্ববর্তী
গ্রন্থসমূহেও (লিখিত) আছে।
আরবী উচ্চারণঃ ছুহুফি ইব্রা-হীমা
ওয়া মুসা।
(১৯) ইব্রাহীম ও মূসার
সহীফাতে (গ্রন্থসমূহে)।
সুরা আ’লা নিয়ে আজকে এখানেই সমাপ্ত। সুবহা’নাকা আল্লা-হুম্মা ওয়া বিহা’মদিকা আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা
আস্তাগফিরুকা ওয়া আতুবু ইলাইকা।