আ’উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম।
“ধন-সম্পদ
এবং সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য মাত্র। আর স্থায়ী সৎকর্মসমূহ আপনার পালনকর্তার
নিকট প্রতিদান প্রাপ্তি ও আশা লাভের জন্যে উত্তম।” [সুরা
কাহফঃ ৪৬]
আমার শৈশব, কৈশোর এর পুরোটাই কেটেছে আমাদের
গ্রামের বাড়িতে। আমার বয়স যখন মাত্র দুই বছরের মতো, তখন একদিন সকালবেলা ৮টা-৯টার
দিকে আমার মা ও বাড়ির অন্যান্যরা সকালের খাবার বানাতে ব্যস্ত ছিলো। এরই ফাঁকে আমি
সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ি। আমাদের বাড়ির পাশেই একটু দূরে একটা পুকুর
ছিলো। হয়তোবা খেলতে খেলতে এক সময় আমি সেই পুকুরে পা পিছলে পড়ে যাই। আশে-পাশে আর
কেউই ছিলোনা, তাই কেউ টেরই পেলোনা যে ছোট্ট একটা বাচ্চা পানিতে পড়ে গেছে। সাঁতার
না জানা মানুষ এবং ছোট বাচ্চা যখন পানিতে ডুবে যায়, তখন দুটো ঘটনা ঘটতে পারে। এক, ডুবন্ত
ব্যক্তি শরীরের ওজনে পানিতে সম্পূর্ণ ডুবে যাবে। এমন অবস্থায় ৩-৫ মিনিটের মাঝে
তাকে পানি থেকে না তুলতে পারলে নিঃশ্বাস নিতে না পেরে দমবন্ধ হয়ে সে মারা যাবে।
দ্বিতীয়ত, অনেক সময় পানিতে পড়ার কিছুক্ষণের মাঝেই পেটে এতো বেশি পানি ঢুকে পড়ে যে,
পেট ফুলে ডুবন্ত ব্যক্তি পানির উপরে ভেসে উঠে। এই ঘটনা যদি খুব অল্প সময়ের মাঝে হয়
তাহলে ব্যক্তিটা প্রাথমিক অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাসের অভাবে অজ্ঞান নির্জীব হয়ে
যাবে, কিন্তু খুব বেশি সময় পানিতে ডুবে না থেকে যদি ভেসে উঠে, তাহলে সে জীবিতি
থাকবে। আমার পানিতে পড়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ঘটনাটাই ঘটেছিলো। অর্থাৎ, পানিতে পড়ে
পেটে পানি ঢুকে পানির উপরে ভেসে উঠি, অজ্ঞান থাকার কারণে যদিও দেখে মনে হচ্ছিলো মরে
ভেসে উঠেছি। যাইহোক, আমার পানিতে পড়ার কতক্ষণ পরে জানিনা, আমার বাড়ির একজন কাজের
মহিলাকে সেই পুকুরে পাঠানো হয়েছিলো থালা-বাসন ধূয়ে নিয়ে আসার জন্যে। সে যখন আমাকে
পানিতে ভাসতে দেখলো, তখন চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করলো। <3 আমার মা <3 ও বাড়িতে একটা কাজের লোক ছিলো, তারা শুনতে
পেয়ে দৌড়ে এসে দুজনেই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো, আমাকে তুলে আনার জন্যে. . .আমাকে যখন
তোলা হলো, তখন কোন শ্বাস-প্রশ্বাস ছিলোনা। অনেক সময় পানিতে ডুবন্ত ব্যক্তির
ফুসফুসের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তার হৃৎপিণ্ড সচল থাকে অর্থাৎ
ব্যক্তিটি জীবিত যদিও তার শ্বাস-প্রশ্বাস সাময়িকভাবে বন্ধ। এমন অবস্থায় তার মুখে
মুখ দিয়ে ফুঁ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে হয়। যাই হোক, আমার
শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ ও নির্জীব শরীর দেখে অনেকে আমাকে মৃত বলে মনে করছিলো। সেই
বয়সে মৃত্যু আমার কপালে লিখা ছিলোনা, তাই পানিতে পড়ে প্রায় মৃত অবস্থায় ভেসে উঠার
পরেও স্থানীয় ডাক্তারের কাছে যখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো, তারা আমাকে জীবিত বলে
ঘোষণা করলো এবং পেট থেকে পানি বের করলো। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় নিয়ে আসার
পরে প্রায় সারাদিন অজ্ঞান থাকার পরে সন্ধ্যার দিকে আমার জ্ঞান ফিরে আসে। আমার মা
বলেন, জ্ঞান ফিরে আসার পরে আমি প্রথম যেই কাজটা করি সেটা হচ্ছে, সারাদিন কোন খাবার
না খাওয়ার কারণে সম্ভবত অনেক ক্ষুদার্থ ছিলাম। তাই টেবিলের উপরে রাখা ফিডারের বোতল
নিয়ে সেটা খাওয়ার চেষ্টা করি। সারাদিন না খাওয়ায় ফিডারের বোতল কিছুটা অপরিষ্কার
ছিলো, আমার মা এসব ব্যপারে অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিছন্ন ছিলেন। তিনি দ্রুত আমার কাছ
থেকে বোতলটা নিয়ে পরিষ্কার করে গরুর দুধ গরম করে এনে খেতে দিলেন। আসলে একটা সন্তান
লালন-পালনে কতটা কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, একমাত্র মা-বাবা ছাড়া আর কেউই
বুঝতে পারবেনা। এ হচ্ছে সংক্ষেপে ছোট্টবেলায় আমার জীবনে ‘দ্বিতীয় জীবন’ পাওয়ার ঘটনা।
আমি যখন বড় হই আস্তে আস্তে বিচার-বুদ্ধি
সৃষ্টি হয়, তখন একটা অনুভূতি আমার মাঝে কাজ করে। “আল্লাহ যদি চাইতেন, সেই ছোট্ট বয়সে আমার
জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পূর্বেই মৃত্যু দিয়ে আমার জীবনটা শেষ হয়ে যেতে পারতো। আকাশ ও
জমীনে আল্লাহ তাআ’লা
কোনকিছুই অহেতুক সৃষ্টি করেন নি, আর তিনি বিনা কারণে কোন কিছুই করেন না। সেই ছোট্ট
বয়সে আমার হায়াত শেষ না হয়ে আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের প্রতারণাপূর্ণ এই দুনিয়ার
জীবনে আমার অতিরিক্ত দিনগুলো বেঁচে থাকার পেছনে আল্লাহ সুবহা’নাহু তাআ’লার নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা
রয়েছে।”
আমি সাধারণত আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে লেখা
পছন্দ করিনা। আজকে ঢাকায় ৫ বছরের একটি শিশু একটা ড্রেনে পড়ে যায় এবং প্রায় ৪ ঘন্টা
পর বুড়িগংগা নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ উদ্ধারের পরে তার মায়ের আহাজারি
দেখে আমার নিজের মায়ের জীবনে অবিস্মরনীয় সেই ঘটনাটা মনে পড়ায় আপনাদের সাথে শেয়ার
করলাম।
অনেকে দুঃখ-কষ্টে পড়ে হতাশ হয়ে পড়ে, মনে
রাখবেন আমরা সবাই এই পৃথিবীতে দুই দিনের মুসাফির মাত্র। অতি শীঘ্রই আমরা আমাদের
রব্বের কাছে ফিরে যাবো আর তখন তিনি আমাদের ভালো কাজের জন্যে পুরষ্কৃত করবেন এবং
মন্দ কাজগুলোর হিসাব নিবেন। তাই পরীক্ষার ব্যপারে হতাশ হবেন না, ধৈর্য ধরুন। যার যা
সাধ্য, সে অনুযায়ী বাকি হায়াতটুকু আল্লাহর ইবাদতের জন্যে ব্যয় করার চেষ্টা করবেন,
যাতে করে পরকালের জীবনে আমরা সুখী হতে পারি। আমি যখনই কিছু লিখি চেষ্টা করি তার
সাথে আল্লাহর কিছু কথার সরল তর্জমা তুলে ধরতে, কারণ আমি বিশ্বাস করি মানুষের উপর
সবচাইতে প্রভাব বিস্তারকারী বিষয় হচ্ছে ‘আল্লাহর কালাম’। সেইজন্যে আজকে সর্বশেষ, আল্লাহর
গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপদেশ দিয়ে এখানেই শেষ করছি।
“তুমি একনিষ্ঠ ভাবে নিজেকে দ্বীনের উপর কায়েম
রাখ। এটাই আল্লাহর প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে
কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। তোমরা সবাই তাঁর
(আল্লাহর) অভিমুখী হও এবং তাঁকে ভয় কর, সালাত কায়েম কর এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো
না।”
সুরা রুমঃ ৩০-৩১।