মুসলিম উম্মাহর আলেম ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের
দৃষ্টিতে ‘আইএসআইএস বা আইএস’এর আসল চেহারাঃ পর্ব-৪
সৌদি আরবের বিখ্যাত আলেম আল্লামাহ, ডঃ সালেহ আস-শুহাইমী হা’ফিযাহুল্লাহ ISIS সম্পর্কে বলেনঃ
এটি হচ্ছে একটি খারেজী জামাআ’ত। তারা কয়েকদিন আগে আমার খালাতো
ভাইয়ের ছেলেকে হত্যা করেছে। কারণ সে তাদের দলের বিরোধী অন্য একটি দল তথা জাবহাতুন নুসরার
সদস্য ছিল। তবে উভয় দলই ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের নাম ‘জাবহা’ হোক অথবা ‘দায়েশ’ (ISIS) হোক। কিন্তু দায়েশ জাবহার চেয়ে অধিক ভয়াবহ ও ক্ষতিকর। কারণ তারা মুমিনদের
উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে পরলে আত্মীয়তার সম্পর্ক এবং কোন প্রকার অঙ্গীকার বা
চুক্তির পরোয়া করে না। তারা যে বাতিলপন্থী, তা প্রমাণিত হওয়ার জন্য এতটুকই যথেষ্ট যে, কয়েকদিন আগে
তারা তাদের খলীফার হাতে বাইআ’ত করার জন্য মুসলিমদের কাছে জোর দাবী জানিয়েছে। তাদের সাথে যারা যোগ দিয়েছে, তাদেরকে তারা সর্বপ্রথম যে কাজটি করার আদেশ দিয়েছে তা হচ্ছে নিজ দেশের আমীরের
বা বাদশাহর হাতে কৃত বাইআ’তকে বর্জন করা। আপনারা বাইআ’ত প্রত্যাখ্যান ও ভঙ্গ করার হুকুম অবশ্যই অবগত আছেন। (সৌদি আরবে বসবাসরত)
আমাদের প্রত্যেকের কাঁধে এই দেশের অলীউল আমরের (শাসকের) বাইআ’ত রয়েছে। আপনাদের প্রত্যেকের কাঁধে
রয়েছে এই দেশের শাসকের বাইআত। বাইআত ভঙ্গ করা খেয়ানত ও গাদ্দারী। প্রত্যেক
গাদ্দারের (বাইআত ও অঙ্গীকার ভঙ্গকারীর) জন্য কিয়ামতের দিন একটি করে পতাকা স্থাপন
করা হবে। তাতে লেখা থাকবেঃ এটি উমুকের বাইআত ভঙ্গকারীর পতাকা। যে ব্যক্তি বাইআত
ভঙ্গ করবে, সে কিয়ামতের দিন ভয়াবহ বিপদের সম্মুখনি
হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
“যে ব্যক্তি আমীরের
আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেল এবং মুসলিমদের জামাআ’ত থেকে এক বিঘত পরিমাণ বিচ্ছিন্ন
হয়ে গিয়ে মৃত্যু বরণ করল, সে জাহেলীয়াতের (কুফরীর) উপর
মৃত্যু বরণ করল।”
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৪৮৯২।
“যে ব্যক্তি মুসলিমদের
জামাআ’ত থেকে এক বিঘত পরিমাণ বিচ্ছিন্ন হলো, সে তার গর্দান
থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল”। (তিরমিযী)
এরা বাইআত ভঙ্গ করেছে। হক থেকে তারা বহু
দূরে। তারা আলেমদেরকে কাফের বলে এবং আমাদের শাসকদেরকেও কাফের বলে। তাদের অবস্থা
দেখে মনে হয়, মানুষকে কাফের বলা ছাড়া তাদের আর কোন
কাজ নেই। এটিই তারা জানে এবং এটিকেই তারা তাদের দ্বীন মনে করে থাকে। পর্দার
অন্তরাল থেকে কতিপয় মূর্খ লোক তাদেরকে ফতোয়া দিচ্ছে। এই ফতোয়াগুলোই তাদেরকে
ধোঁকায় ফেলেছে। এই মুফতিরা দুই প্রকার। এক প্রকার মুফতী তাদের সাথেই রয়েছে। তারা
এই মুফতীদেরকে মাশায়েখ হিসাবে গ্রহণ করেছে, তারা তাদের কাছ
থেকেই ফতোয়া নেয়। তারা আল্লাহর কিতাবের দিকে ফিরে আসেনা এবং উলামায়ে রাব্বানীদের
থেকে ফতোয়া নেয়না। এই আলেমরা ঐ দলের সদস্যদের মতই। আরেক শ্রেণীর আলেম আমাদের দেশে
বসেই এদেরকে সমর্থন করে ফতোয়া দিচ্ছে, তাদেরকে সমর্থন
করছে এবং যুবকদেরকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। এরা বিনা উদ্দেশ্যে এসব ফতোয়ার
মাধ্যমে মুসলিম যুবকদেরকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করছে। তারা অন্ধকারচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট
উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধ করে, স্বীয় গোত্র ও দলের আদর্শ
প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করে এবং অন্ধকারচ্ছন্ন ঝান্ডার অধীনে যুদ্ধ করে। রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
“যে ব্যক্তি অস্পষ্ট ও
অপরিচিত দলের পতাকাতলে যোগদান করে যুদ্ধ করে, স্বীয় গোত্রকে
সাহায্য করার জন্য যুদ্ধ করে এবং গোত্রের সাহায্য ও স্বীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য
যুদ্ধ করতে মানুষকে আহবান করে, সে আমার উম্মতের
অন্তর্ভূক্ত নয়”।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৪৮৯২।
এরা মূর্খ, জাহেল এবং এদের বয়স অল্প ও জ্ঞান খুবই সামান্য। এদের থেকে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেনঃ আমি যদি এদের যুগ পেতাম, তাহলে আমি তাদেরকে আদ জাতির ন্যায় হত্যা করতাম। তারা যাকে হত্যা করবে, সে হবে সর্বোত্তম শহীদ। তাদের মধ্যে যারা নিহত হবে, তারা হবে আকাশের নীচে সর্বাধিক নিকৃষ্ট নিহত ব্যক্তি। তিনি আরো বলেছেন, তারা হবে জাহান্নামের কুকুর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই লোকদের
ব্যাপারে বলেনঃ
“আখেরী যামানায় এমন
একদল লোক আসবে, যাদের বয়স হবে অল্প এবং জ্ঞান হবে খুবই
সামান্য। তারা মানুষের সর্বোত্তম বুলি আওড়াবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ইসলাম
থেকে এমন দ্রুতগতিতে বের হয়ে যাবে, যেমভাবে তীর
ধনুক থেকে বের হয়ে যায়। তাদের ঈমান তাদের কন্ঠনালী অতিক্রম করবেনা। তাদেরকে
যেখানেই পাবে সেখানেই হত্যা করবে। যে ব্যক্তি তাদেরকে হত্যা করবে, সে কিয়ামতের দিন এ হত্যাকান্ডের জন্য পুরস্কার লাভ করবে”।
তিনি আরো বলেনঃ
“পূর্ব দিক থেকে একদল
লোক বের হবে। তারা কুরআন পড়বে, কিন্তু কুরআন তাদের
কণ্ঠনালীর নীচে প্রবেশ করবেনা। তীর যেমন ধনুক থেকে বের হয়ে যায়, তারা তেমনি দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে। অতঃপর ধনুকের রশির নিকট নিক্ষিপ্ত তীর
ফেরত না আসা পর্যন্ত তারা দ্বীনের মধ্যে ফিরে আসবেনা। অর্থাৎ তারা দ্বীন থেকে
সম্পূর্ণরূপে বের হয়ে যাবে, তাতে আর ফেরত আসবেনা।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
তাদেরকে জাহান্নামের কুকুর বলেছেন। তারা প্রত্যেক যুগেই বের হবে। তারা প্রত্যেক
যুগেই বের হতে থাকবে। এমনকি তাদের দল থেকেই দাজ্জাল বের হবে। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, “তোমরা তাদের নামাযের তুলনায় তোমাদের নামাযকে নগণ্য
মনে করবে,
তাদের এবাদতের তুলনায় তোমাদের এবাদতকে খুব সামান্য মনে করবে
এবং তারা কুরআন পড়বে, কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালীর নীচে
যাবেনা।”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
তাদের আরো অনেক স্বভাব ও বৈশিষ্ট উল্লেখ করেছেন। তারাই ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা
উছমান ও আলী (রাঃ) কাফের ফতোয়া দিয়েক হত্যা করেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, তারা অমুসলিমদেরকে বাদ
দিয়ে মুসলিমদেরকেই হত্যা করবে। তাদের পূর্ব পুরুষরা উসমান বিন আফ্ফান ও আলী (রাঃ) কে
হত্যা করেছে। তারা যখন উসমান (রাঃ)এর দেহকে তাঁর মাথা হতে বিচ্ছিন্ন করল তখন তাদের
মধ্য হতে একজন অভিশপ্ত নিকৃষ্টি লোক উছমান (রাঃ) এর পবিত্র মাথার খুলির উপর পা
রেখে বলেছেঃ
“আল্লাহর কসম! আল্লাহ
তাআলার সম্মানিত দিনসমূহের মধ্য হতে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের দিনসমূহের মধ্য
হতে আমার নিকট আজকের দিনের চেয়ে অধিক ফযীলতময় অন্য কোন দিন আছে বলে আমার জানা নেই”। (নাউযুবিল্লাহ)
আলী (রাঃ)এর হত্যাকারী আব্দুর রাহমান
বিন মুলজিম বলেছিলঃ আলী (রাঃ)কে হত্যা করার জন্য আমি এই বর্শাটিতে নয়টি মাথা
স্থাপন করেছি। তার মধ্য হতে তিনটি মাথা স্থাপন করেছি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য।
আলীকে ঘৃণার সংকেত হিসাবে আমি এই নয়টি মাথা স্থাপন করেছি। এই জন্যই তার সাথী ইমরান
বিন হাত্তান আলী (রাঃ)কে হত্যা করার কারণে তার প্রশংসা করে বলেছিলঃ
“ওহে এমন একটি আঘাত, যা করা হয়েছে আল্লাহর একজন মুক্তাকী বান্দার পক্ষ হতে। এর মাধ্যমে আল্লাহর
ক্ষমা ও সন্তুষ্টি ছাড়া সে অন্য কিছু কামনা করেনি। আমি এই দিনটিকে একটি ফযীলতময়
দিন হিসাবে স্মরণ করি, যাতে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার
পূর্ণকারী বান্দাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি এই আঘাতটি করেছে।
এই অভিশপ্তের জবাবে পূর্ব যুগের একজন সৎ
লোক বলেছেনঃ
“এটি আঘাতটি ছিল একজন হত্যভাগ্য লোকের পক্ষ হতে। সে এর মাধ্যমে আরশের মালিকের
নিকট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যতীত অন্য কিছু কামনা করেনি। আমি মনে করি, এর মাধ্যমে সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সর্বাধিক হতভাগ্য ও নিকৃষ্ট বলে
বিবেচিত হবে।”
এই পথভ্রষ্ট ও গোমরাহ লোকদের অন্যতম
আলামত হচ্ছে লুকিয়ে থাকা এবং জনমানবের সামনে এসে তারা তাদের কথা প্রচার করেনা। আমি
আপনাদের কাছে প্রশ্ন রাখছি যে, আমাদের দ্বীন কি
সুস্পষ্ট?
না অস্পষ্ট? আমাদের দ্বীন
সুস্পষ্ট। এখানে গোপনীয় কিছু নেই। আমাদের কাছে এমন কিছু নেই, যা গোপন রাখতে হবে। এই সুফিয়ান (রঃ) বলেছেনঃ
তুমি যখন দেখবে যে, একটি দল তাদের দ্বীনি বিষয়ে সাধারণ লোকদেরকে বাদ দিয়ে গোপনে শলা-পরামর্শ করছে, তখন তুমি মনে করবে যে, তারা কোন একটি গোমরাহীর পথ
উন্মুক্ত করছে। এই কথা সুফিয়ান ব্যতীত আরো অন্যান্য আলেম থেকেও বর্ণিত হয়েছে। আমি
কয়েকদিন আগে মসজিদে নববী থেকে তাদের খলীফার দাবীদারের এবং তার হাতে মিথ্যুক
দাজ্জালদের বাইআত করার প্রতিবাদ করেছি।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ইসলামের ইতিহাসে এমন কোন খলীফা কিংবা শাসকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যিনি লুকিয়ে থেকে এবং জনসাধারণের আড়ালে থেকে রাজ্য পরিচালনা করেছেন। (চলবে)
লেকচারটির অনুবাদ করেছেনঃ শায়খ Abdullah Shahed Al-madani
ইন্টারনেটে শায়খের বক্তৃতার লিংকঃ