বুধবার, ৯ জুলাই, ২০১৪

স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অধিকারঃ- বিবাহিত ভাইদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি...



স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অধিকারঃ- বিবাহিত ভাইদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি...

“তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য পোশাকস্বরূপ আর তোমরা তাদের পোশাকস্বরূপ।”
সুরা আল-বাক্বারাহঃ ১৮৭।

স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজনের পোশাকের মতো। পোশাক যেমন আমাদের ইজ্জত-আব্রু হেফাজত করে ও আমাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকাও তেমনি। আমাদের কারো পোশাক যদি কখনো ময়লা হয়ে সেটা যেমন আমরা একেবারে ফেলে না দিয়ে যত্ন করে পরিষ্কার করি, ঠিক তেমনি স্বামী বা স্ত্রীর কারো কোন ত্রুটি থাকলে সেই কারনে তার পুরোটাই খারাপ, তার সাথে আর ভালো ব্যবহার করা যাবে না, এমন না। বরং, স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজন সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হবে, একজন আরেকজনকে নেকীর কাজে সাহায্য করবে – তাহলেই সম্ভব একটা সুখী পরিবার গড়ে তোলা।

স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করা – এটা যেমন সুখী পরিবার গঠনের অপরিহার্য শর্ত, আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, এটা একটা সৃষ্টিকর্তার আদেশ – যা মানতে আমরা সকলেই বাধ্য!

“তোমরা নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতঃপর, যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ তোমাদের জন্য অনেক কল্যাণ রেখেছেন।”
সুরা আন-নিসাঃ ১৯।

“পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর নিয়ম অনুযায়ী। কিন্তু, নারীরদের ওপর পুরুষদের কর্তৃত্ব রয়েছে। আর আল্লাহ হচ্ছে পরাক্রমশালী, বিজ্ঞ।”
সুরা আল-বাক্বারাহঃ ২২৮।

পুরুষদের মাঝে অনেকেই আছে – নামায রোযা ও অন্যান্য ইবাদতের ব্যপারে তারা অগ্রগামী, বাইরের লোকদের সাথে খুব সাধু, মানুষের মাঝে নিজদের সুনাম ধরে রাখার জন্য, নিজের নাম ভালো রাখার জন্য সদা ততপর – কিন্তু ঘরে আসলে তাদের মুখোশ খুলে ‘আসল চেহারা’ বেরিয়ে আসে! পুরুষদের অনেকেই নিজ ঘরের মানুষদের সাথেই ভালো আচরণ করেনা, তাদের হক্ক ঠিকমতো আদায় করেনা – যদিও বাইরের মানুষেরা তাকে ভালো, সদাচরণকারী ও পরোপকারী বলেই জানে। আশচর্যের ব্যপার হচ্ছে, বাইরের মানুষের কাছে যেই লোকটি সবচেয়ে ভালো, তার নিজের স্ত্রীর কাছে সেই লোকটি সবচাইতে খারাপ। বিবাহিত ভাইদের অনেকে নিজদের স্ত্রী ও সন্তানদের সাথেও ভালো আচরণ করেন না, অনেকে নিজদের স্ত্রীদেরকে মানুষই মনে করেন না, তাদের একটু ভুল-ত্রুটি দেখতে পেলেই বাঘের মতো চার্জ করে বসেন।

নিঃসন্দেহে এইটা মারাত্বক রকমের ভুল ও চরিত্রের সাংঘাতিক ত্রুটি যা একজন অনেক ইবাদতকারী বান্দাকেও খুব সহজেই জাহান্নামের অতল গহবরে প্রবেশ করিয়ে দেবে – আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি।

আপনি যদি আল্লাহকে ভয় করেন, জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে বাচতে চান, তাহলে জেনে রাখুনঃ স্ত্রীদের সাথে খারাপ আচরণ করে, তাদের হক্ক নষ্ট করে, তাদের সাথে অন্যায় ও জুলুম অত্যাচার করে আপনি জাহান্নামে যাবেন। স্ত্রীদের সাথে খারাপ আচরণ ও জুলুম করার কারণে কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীকে খারাপ বলে মনে করে, তাহলে আপনি যতই ইবাদত করে থাকেন না কেনো, আল্লাহর কাছেও আপনি খারাপ বলে গণ্য হবেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“পূর্ণ ঈমানদার সেই ব্যক্তি যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর। আর তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।”
তিরমিযীঃ ১১৬২; হাদীস সহীহ, সিলসিলাহ ছহীহাহঃ ২৮৪।

অন্য হাদীসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“স্বামীকে খুশী রেখে যে স্ত্রীলোক মৃত্যুবরণ করে সে জান্নাতে যাবে।”
ইবনে মাযাহ, তিরমিযী ও হাকেম।

সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, জান্নাতী হওয়ার জন্য স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের জন্য উভয়ের ভালো হওয়ার সার্টিফিকেট এর প্রয়োজন আছে!

স্ত্রীদের প্রতি দয়া ও কোমলতা প্রদর্শন করা এবং হিংস্রতা থেকে দূরে থাকাঃ
দুনিয়ার কোন মানুষই ভুল-ত্রুটির উর্ধে নয়। আপনার স্ত্রীও একজন মানুষ, তারা কোন রোবট নয় সুতরাং আপনি যেমন ভুল করতে পারেন, আপনার স্ত্রীও ভুল করতে পারে। আপনি নিজে চিন্তা করুন, আপনি দিনে-রাতে উঠতে বসতে কত ভুল করছেন কিন্তু আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করছেন ও সুযোগ দিচ্ছেন - তাহলে আপনি কেনো অন্য আরেকজনের সূক্ষ্ম ভুলকে পাহাড় সমান বানাচ্ছেন? স্ত্রীদের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করতে শিখুন, তাদেরকে উত্তম ভাষায় উপদেশ দিন, নিজে ভালো হয়ে তার সামনে সুন্দর উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরুন। এতে করে যেমন আপনি নিজে মানসিকভাবে শান্তি পাবেন, স্ত্রী আপনার কটু কথার অত্যাচার থেকে রেহাই পাবে – এবং এইরকম ভালো আচরণ ও কোমলতার অভ্যাসের বিনিময়ে আশা করা যায় আপনার স্ত্রীর কোন ভুল থাকলে সে সংশোধন করতে আগ্রহী হবে।

পক্ষান্তরে আপনি যদি কোমলতা না দেখান, সামান্য ব্যপার নিয়ে স্ত্রীর সাথে বাধাবাধি করেন তাহলে জেনে রাখুন – এতে হিতে বিপরীত হবে। বেশি সমালোচনা দুনিয়ার সবচাইতে ভালো মানুষটাকেও খারাপ বানিয়ে দেয়, এতে তার মাঝে খারাপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়, ফলে সে নিজের ভুল সংশোধন না করে উলটো বেকে বসে। এইজন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষদেরকে খুব বেশি নসীহত করেছেন তাঁর উম্মতদেরকে, তারা যাতে করে তাদের স্ত্রীদের জন্য কল্যানকামী হয়, তাদের সাথে ভালো আচরণ করে।

আ’মর ইবনুল আহ্ওয়াস থেকে বর্ণিত। তিনি বিদায় হাজ্জে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে উপস্থিত ছিলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করেন এবং ওয়াজ-নসীহত করেন। এরপর তিনি বলেনঃ তোমরা নারীদের সাথে উত্তম ব্যবহারের উপদেশ শুনে নাও। কেননা তারা তোমাদের নিকট আবদ্ধ আছে। এর অধিক তাদের উপর তোমাদের কর্তৃত্ব নাই যে, তারা যদি প্রকাশ্য অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়, সত্যিই যদি তারা তাই (প্রকাশ্য অশ্লীলতা) করে, তবে তোমরা তাদেরকে পৃথক বিছানায় রাখবে এবং আহত হয় না এরূপ হাল্কা মারধর করবে। অতঃপর তারা তোমাদের অনুগত হয়ে গেলে তাদের উপর আর বাড়াবাড়ি করো না। স্ত্রীদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তোমাদের উপরও তাদের অধিকার আছে। তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকার এই যে, তারা তোমাদের শয্যা তোমাদের অপছন্দনীয় লোকদের দ্বারা মাড়াবে না এবং তোমাদের অপছন্দনীয় লোকেদেরকে তোমাদের ঘরে প্রবেশানুমতি দিবে না। সাবধান! তোমাদের উপর তাদের অধিকার এই যে, তাদের ভরণপোষণ, পোশাক-পরিচ্ছদ ও সজ্জার ব্যাপারে তোমরা তাদের প্রতি শোভনীয় আচরণ করবে।
সুনানু ইবনে মাজাহ্, নিকাহ বা বিবাহ অধ্যায়ঃ ১৮৫১, তিরমিযী ১১৬৩, হাদীসটি হাসান সহীহ, ইরওয়াহ ১৯৯৭-২০২০।

আপনি নিজে আল্লাহকে মানেন না, আপনার চরিত্র যদি ফেরাউনের মতো হয় তাহলে আপনি কি করে আশা করেন আপনার স্ত্রী আসিয়ার (আঃ) এর মতো উত্তম হবে? আপনি মুহা’ম্মাদ সাঃ এর আদর্শকে অনুসরণ করুন – তাহলে আপনি আশা করতে পারেন আপনার স্ত্রী খাদিজাহ (রাঃ), আয়িশাহ (রাঃ) এর মতো হবে।

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কোনদিন নিজের স্ত্রীদের গায়ে হাত তোলেনি নি, তাদেরকে গালি দেন নি – অন্যায়ভাবে কটু কথা বলে তাদেরকে কষ্ট দেন নি। বরং, তিনি কোমলতা প্রদর্শনের জন্য কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন হাদীসগুলো দেখুনঃ

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ “আমার কাছ থেকে মেয়েদের সাথে সদ্ব্যবহার করার শিক্ষা গ্রহণ কর। কেননা নারী জাতিকে পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। পাঁজরের হাড়গুলোর মধ্যে ওপরের হাড়টা সর্বাপেক্ষা বাঁকা। অতএব তুমি যদি সোজা করতে যাও, তবে ভেঙ্গে ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি ফেলে রাখ তবে বাঁকা হতেই থাকবে। অতএব, নারীদের সাথে ভালো ব্যবহার কর।”
সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম, রিয়াদুস সালেহীনঃ ২৭৩।

আয়েশা (রাযিঃ) থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “নিশ্চয় আল্লাহ দয়ালু, তিনি কোমলতাকে পছন্দ করেন। তিনি কোমলতার বিপরীতে দেন যা তিনি সহিংসতার বিপরীতে দেন না, কোমলতা ব্যতীত অন্য কিছুর বিপরীতে দেন না।”
সহীহ মুসলিম। 

আয়েশা (রাযি:) থেকে আরেকটি হাদিসে এসেছে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “নিশ্চয় আল্লাহ কোমলতাপূর্ণ, তিনি সকল বিষয়ে কোমলতাকে পছন্দ করেন।”
বুখারি ও মুসলিম।

জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযি:) থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, “যাকে কোমলতা থেকে বঞ্চিত করা হল তাকে সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত করা হল।”
সহীহ মুসলিম।

ইমাম আহমদ আয়েশা (রাযি:) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার তাকে খেতাব করে বলেছেন, হে আয়েশা! তুমি কোমলতা অবলম্বন করো; কেননা আল্লাহ তাআলা যখন কোনো পরিবারের কল্যাণ চান তখন তাদেরকে কোমলতার পথ দেখান, অন্য এক বর্ণনা মতে- আল্লাহ যখন কোনো পরিবারের কল্যাণ চান, তিনি তাদের মধ্যে কোমলতার প্রবেশ ঘটান।”
মুসনাদে আহমদ।

দুনিয়াবাসীর মাঝে আপনার স্ত্রী ও পরিবারের লোকজনই আপনার কোমলতা পাওয়ার সবচেয়ে বেশি দাবীদার।

সর্বশেষ, আপনি যদি আপনার ঘরের নারীদের সাথে খারাপ আচরণ করেন - আপনার পরকাল নষ্ট হবে, সাথে সাথে আপনি দুনিয়ার জীবনে থার্ডক্লাস নিম্নশ্রেণীর পুরুষ হিসেবেই গণ্য হবেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
“শুধুমাত্র সম্মানিত লোকেরাই নারীদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করে। আর যারা অসম্মানিত, নারীদের প্রতি তাদের আচরণও হয় অসম্মানজনক।”

সুনানে আত-তিরমিযী।