প্রসংগঃ “তারাবীহ” এর সালাত
তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, বিতর – এইসবগুলো নামায আসলে একই নামাযের
ভিন্ন ভিন্ন নাম – হাদীস ও ক্বুরানের ভাষায় যাকে ‘কিয়ামুল লাইল’ বলা
হয়।
রামাযান মাসে ‘কিয়ামুল লাইল’ বা রাতের নফল সালাতকে ‘তারাবীহ’ বলা
হয়। ‘তারাবীহ’ এর
সালাতকে আল্লাহ ‘তারাবীহ’ বলেন নি, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তারাবীহ
বলেন নি। তারাবীহ নামটা আসলে পরবর্তীতে দেওয়া হয়। নাম ভিন্ন হলেও - মূলত এটা ‘কিয়ামুল
লাইল’ এর
অন্য নাম, এইজন্য এই সালাতকে ‘তারাবীহ’ বলা ‘বেদাত’ হবেনা।
যেমন, আমরা সালতকে ফার্সি শব্দ ‘নামায’ বলি, কিন্তু যেহেতু এর দ্বারা উদ্দেশ্য একই
থাকেঃ সালাত - তাই এটা গর্হিত কোন অপরাধ নয়। তবে আমাদের চেষ্টা করা উচিত, আস্তে আস্তে
কুরান ও হাদীসের মূল শব্দগুলো চালু করার জন্য, যাতে করে এনিয়ে মানুষের মাঝে কনফিউশান
তৈরী না হয়।
‘তারাবীহ’ বা
‘কিয়ামুল লাইল’ রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়মিত পড়তেন। সেইজন্য তারাবীহর সালাত পড়া আমাদের
জন্য সুন্নত। আবার, তারাবীহর সালাত ফরয ওয়াজিব নয়, সুতরাং এটা না পড়লে গুনাহ নেই, তাই
এটাকে আমরা ‘নফল’ বা অতিরিক্ত নামায বলতে পারি। কিন্তু কেউ এটাকে অবহেলা করে
না পড়লে, সে তার সওয়াব ও বিরাট ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে।
নফল সালাতের ব্যপারে ‘উসূল’ বা মূলনীতি হচ্ছেঃ
“নফল
নামাযের আমীর বান্দা সে নিজে। কারো ইচ্ছা হলে সে ২ রাকাত তারাবীহ পড়তে পারে, কারো ইচ্ছা
হলে ৪, কারো ইচ্ছা হলে ৮, কারো ইচ্ছা হলে ২০, কারো ইচ্ছা হলে ৩০/৪০ যেকোন রাকাআ’ত পড়া
যায়েজ আছে। যে যত বেশি পড়বে সে তত বেশি সওয়াব পাবে।”
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে কয় রাকাআ’ত তারাবীহ
পড়তে বলেছেন?
এক সাহাবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে
জিজ্ঞেস করেন, রাতের নামায কিভাবে পড়তে হবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এই প্রশ্নের উত্তরে নির্দিষ্ট কোন রাকাআ'ত বেধে দেন নি, তিনি এর নিয়ম বলে দিয়ে রাকায়াত
অনির্দিষ্টভাবে ছেড়ে দিয়েছেন – যার যত রাকাত ইচ্ছা পড়বে। তিনি বলেছেন, ২ রাকাত রাকাত করে
রাতের সালাত পড়ার জন্য, আর সর্বশেষ ১ রাকাত পড়ে সমস্ত নামাযকে বিতর বা বিজোড়ে পরিণত
করে দিতে। যেহেতু এটা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখের কথা –
অর্থাৎ 'ক্বাওলী' সুন্নাহ – অর্থাৎ তিনি নিজে এইভাবে আমাদেরকে করতে বলেছেন। সুতরাং
এটা তার ব্যক্তিগত আমল থেকে প্রাধান্য পাবে।
হাদীসের দলীলঃ
ইবন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)
এর নিকট রাতের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেন, “রাতের সালাত
দুই দুই (রাকায়া’ত) করে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ফজর হওয়ার আশংকা করে, সে
যেন এক রাকায়া’ত মিলিয়ে
সালাত আদায় করে নেয়। আর সে যে সালাত আদায় করল, তা তার জন্য বিতর (বেজোড়) হয়ে যাবে”।
সহিহ বুখারী, খন্ড ২, অধ্যায় ১৬, হাদিস ১০৫।
উপরের হাদীসটা ইমাম বুখরী (রহঃ) যেই অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন
তার নাম হচ্ছেঃ- “বিতরের স্বলাত”
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, “বিতরের স্বলাত” আর
কিয়ামুল লাইল একই নামায!
এবার হাদীস দেখুন – তাহাজ্জুদ আর কিয়ামুল লাইল আসলে একই সালাতঃ
উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক রাতে মসজিদে সালাত আদায় করছিলেন, কিছু লোক তাঁর সঙ্গে সালাত আদায়
করলো। পরবর্তী রাতেও তিনি সালাত আদায় করলেন এবং লোক আরো বেড়ে গেল। এরপর তৃতীয় কিংবা
চতুর্থ রাতে লোকজন সমবেত হলেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা) বের হলেন না। সকাল হলে তিনি
বললেনঃ তোমাদের কার্যকলাপ আমি লক্ষ্য করেছি। তোমাদের কাছে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে শুধু
এ আশংকাই আমাকে বাধা দিয়েছে যে, তোমাদের উপর তা ফরয হয়ে যাবে। আর ঘটনাটি ছিল রামাযান
মাসের (তারাবীহ্র সালাতের)।
সহিহ বুখারী, খন্ড ২, অধ্যায় ২১, হাদিস ২২৯।
উপরের হাদীসটা ইমাম বুখরী (রহঃ) যেই অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন
তার নাম হচ্ছেঃ- “তাহাজ্জুদ বা রাতের স্বলাত অধ্যায়”।. লক্ষ্যণীয় এই তাহাজ্জুদ সালাতের
কথা বলা হচ্ছে, হাদীসে শেষে উল্লেখ করা আছে – এই ঘটনা রমযান মাসে। সুতরাং সাহাবা ও
মুহাদ্দিসিন ইকরাম যারা সাহাবাদের কাছ থেকে আমাদের কাছে হাদীসগুলো পৌছে দিয়েছেন তাদের
কাছে - তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, কিয়ামুল লাইল, বিতির – এইসবগুলো নামায আসলে এক বলেই স্বীকৃত।
যদিও আমাদের দেশের মানুষ মনে করে তাহাজ্জুদ আলাদা আর তারাবীহর নামায আলাদা!
এবার দেখি রাসুল (সাঃ) কত রাকাত তারাবীহ পড়তেনঃ
আবূ সালামা ইবন আ’ব্দুর রাহমান (রহঃ), একজন তাবেয়ী) থেকে বর্ণিত।
তিনি আা’য়িশাহ
(রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেন যে, রমযানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর (রাতের) সালাত কিরূপ ছিল?
তিনি বললেন, “রমযান মাসে ও রমযান ছাড়া অন্য সময়ে (রাতে) তিনি এগারো রাকআ’ত হতে
বেশি পড়তেন না। তিনি চার রাকআত সালাত আদায় করতেন, সে চার রাকআতের সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য
ছিল প্রশ্নাতীত। এরপর চার রাকআ’ত সালাত আদায় করতেন, সে চার রাকআতের সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য ছিল
প্রশ্নাতীত। এরপর তিন রাকআত সালাত আদায় করতেন। আমি (আ’য়িশাহ
(রাঃ)) বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি বিতর আদায়ের আগে ঘুমিয়ে যাবেন? তিনি বললেনঃ হে
আ’য়িশাহ!
আমার দুইচোখ ঘুমায় বটে কিন্তু ,আমার অন্তর ঘুমায় না।”
সহিহ বুখারী, খন্ড ৩, অধ্যায় ৩২, হাদিস ২৩০।
উপরের হাদীসটা ইমাম বুখরী (রহঃ) সাওম অধ্যায়ের পরে যেই অধ্যায়ে
বর্ণনা করেছেন তার নাম হচ্ছেঃ- “রাতের স্বলাত (তারাবিহ) অধ্যায়”।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
রমযান মাসে ৪ রাকাত, ৪ রাকাত মোট ৮ রাকাত নামায পড়তেন এবং এই ৮ রাকাত হতো অনেক দীর্ঘ
ও সুন্দর যার প্রশংসা মা আ'ইয়িশাহ (রাঃ) করেছেন। এই ৮ রাকাতের পরে তিনি বিতির হিসেবে
৩ রাকাত পড়তেন।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ৮ রাকাত ও শেষে বিতির
হিসেবে ৩ রাকাত এই মোট ১১ রাকাত তারাবীহর নামায পড়তেন।
তাই আমাদের জন্য ‘সুন্নাহ’ হচ্ছেঃ- ৮+৩=১১ রাকাত বিতির
পড়া।
তবে, তারাবীহর নামায এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কেউ ইচ্ছা করলে
এর বেশি বা কম পড়তে পারবেন – যেই হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাঃ ২+২ করে পড়তে বলেছেন সেখানে
তিনি রাকাত অনির্দিষ্টভাবে ছেড়ে দিয়েছেন। সুতরাং কেউ ইচ্ছা করলে ১১র বেশি বা কম যেকোন
রাকাতই পড়তে পারবেন। এখানে রাকাতের কোয়ান্টিটি (সংখ্যা) থেকে কোয়ালিটি (গুণ) প্রাধান্য
পাবে। অর্থাৎ, কেউ যদি তাড়াহুড়া করে ২০ রাকাত পড়ে তার থেকে বেশি সওয়াব সে পাবে, যে
আস্তে ধীরে বেশি কেরাত পড়ে ঐ ২০ রাকাতের চেয়ে বেশি সময় ধরে ৮ রাকাত নামায পড়বে। আবার
কেউ যদি ২০ রাকাত পড়ে যথাযথ নিয়ম মেনে, সে তার থেকে সওয়াব বেশি পাবে যে ৮ রাকাত পড়েছে
ঠিকমতোই কিন্তু মোট সময় বা কেরাতের দিক থেকে ২০ রাকাতের চেয়ে কম সময় নামায পড়েছে।
বর্তমানে প্রচলিত ২০ রাকাত কোত্থেকে আসলো?
রাসুল (সাঃ) জীবনে কোনদিন ১১ রাকাতের বেশি পড়েন নি – এই কথা
সহীহ হাদীস দিয়ে প্রমানিত যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। এর বিপরীতে ইবেন আব্বাস (রাঃ) থেকে
বর্ণিত এক হাদীস তাবারানি, বায়হাকীতে আছে যেখানে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাঃ ২০ রাকাত
বিতির পড়েছেন। কিন্তু মুহাদ্দিসিন যারা হাদীস বর্ণনা করেছেন তার নিজেরাই বলেছেন, এই
হাদীস সহীহ নয় – আর সহীহ হাদীসে এর বিপরীত ১১ রাকাত আছে – তাই মুহাদ্দিসিন ইকরামরা
এই হাদীসকে বাতিল বলেছেন। কারণ, সহীহ হাদীসের বিপরীতে জয়ীফ হাদীস কোনদিন গ্রহণযোগ্য
নয়।
আর ইমাম মালিক এর মুয়াত্তা গ্রন্থে আছেঃ–
উমার (রাঃ) খলিফা হওয়ার পর জামাতে তারাবীহ পড়া পুনঃপ্রবর্তন
করেন – কিন্তু মুয়াত্তাতে উমার (রাঃ) কত রাকাত তারাবীহ পড়তে আদেশ দিয়েছে সেই সম্পর্কে
২ টা হাদীস আছে ২ রকম রাকাত বর্ণিত হয়েছেঃ
- প্রথম হাদীসে আছে
১১ রাকাত
- দ্বিতীয় হাদীসে আছে
২৩ রাকাত
১ম হাদীসটা সহীহ, আর বুখারীতের হাদীসে রাসুল (সাঃ) ১১ রাকাত
তারাবীহ পড়েছেন এই বর্ণনাই আছে। কিন্তু, ২৩ রাকাত (২০+৩) যেটা বলা হচ্ছে উমার (রাঃ)
চালু করেছিলেন – এই হাদীসটা হচ্ছে মুনকাতি – অর্থাৎ এর সনদ বিচ্ছিন্ন। এইধরণের হাদীসগুলো
জয়ীফ। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে সহীহ হাদীস দিয়ে প্রমানিত হয় – উমার (রাঃ) ২০ রাকাত নয় বরং,
১১ রাকাত তারাবীহ পড়তেই আদেশ দিয়েছিলেন – আর এই রাকাত সংখ্যাই রাসুল সাঃ এর কাছ থেকে
প্রমানিত। এছাড়া, রাসুল (সাঃ) ২০ রাকাত তারাবীহ পড়েছেন অথবা উমার (রাঃ) ২০ রাকাত পড়েছেন
– এর পক্ষে কোন সহীহ হাদীস নেই। হাদীসের ব্যপারে সবচাইতে বড় ইমামদের একজন, ইমাম ইবনে
হাজার আসকালানী রহঃ ও একই কথা উল্লেখ করেছেন।
আমরা কয় রাকাত পড়বো?
আগেই বলা হয়েছে, তারাবীহ হচ্ছে সুন্নত, ফরয নয়। তাই সবাই সবার
সামর্থ্য অনুযায়ী পড়বেন। ১১ রাকাত পড়তেই হবে, বা ২০ রাকাত পড়তেই হবে এমন কোন ধরাবাধা
নিয়ম নেই। তবে হ্যা, কেউ চাইলে রাসুল (সাঃ) অনুসরণ করে ১১ রাকাত পড়তে পারেন এটা করা
ভালো। কিন্তু যারা একাকী পড়বেন ১১র বাইরে অন্য কোন রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্ট না করে পড়াই
ভালো, যতটুকু সামর্থ হয় ততটুকু পড়বেন।
পড়ার নিয়ম হচ্ছেঃ
তারাবীহর নামায সুন্নত, এটা এশার পর থেকে ফযরের পূর্ব পর্যন্ত
যেকোন সময়েই পড়া যায়। জামাতে যদি আস্তে ধীরে নিয়ম মেনে সুন্দরভাবে পড়ানো হয় তাহলে জামাতে
পড়াই ভালো। জামাতে ৮ পড়ালে ৮ পড়বেন, ২০ পড়ালে পুরো ২০ পড়ার চেষ্টা করবেন। কারণ, ইমামের
সাথে শেষ পর্যন্ত নামায পড়ার ফযীলত হচ্ছে – তাহলে সে সারারাত নফল নামায পড়ার সওয়াব
পাবে। আর যদি ইমাম তাড়াহুড়া করে নামাযকে নষ্ট করে, তাহলে তার সাথে না পড়ে একাকী যতটুকু
সম্ভব পড়বেন।
২ রাকাত ২রাকাত করে তারাবীহর নামাযের নিয়তে নামায পড়বেন। প্রতি
রাকাতে চেষ্টা করবেন বেশি করে কেরাত পড়ার জন্য, বড় সুরা না পারলে ছোটছোট ২-৩টা বা আরো
বেশি সুরা একসাথে পড়তে পারবেন। তবে ১ম রাকাতের চেয়ে ২য় রাকাতে কম আয়াত তেলাওয়াত করবেন।
এইভাবে যত রাকাত সম্ভব পড়বেন, যদি রাসুল সাঃ এর সুন্নাহ হিসেবে ৮/১০ পড়েন তাহলে উত্তম।
এর পরে ৩ অথবা ১ (৮ পড়লে ৩ অথবা ১০ পড়লে ১ রাকাত) বিতির পড়ে নামায শেষ করবেন।