প্রশ্নঃ নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করার বিধান কি?
উত্তরঃ নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করার ব্যাপারে বিদ্বানদের থেকে
নিম্নরূপ মত পাওয়া যায়।
প্রথম মতঃ নামাযে কখনই সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব নয়। স্বরব,
নীরব কোন নামাযেই ইমাম, মুক্তাদী, একাকী- কারো জন্য পাঠ করা ওয়াজিব নয়। ওয়াজিব হচ্ছে
কুরআন থেকে সহজ যে কোন কিছু পাঠ করা। তাদের দলীল হচ্ছেঃ আল্লাহ্ বলেন, فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنْ الْقُرْآنِ “অতএব
তোমরা কুরআন থেকে সহজ কোন কিছু পাঠ কর।” (সূরা মুযাম্মিল- ২০) তাছাড়া নবী (ছাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামায শেখাতে গিয়ে গ্রাম্য লোকটিকে বলেছিলেন, “কুরআন থেকে তোমার
জন্য সহজ হয় এমন কিছু পাঠ করবে।”
দ্বিতীয় মতঃ স্বরব, নীরব সকল নামাযে ইমাম, মুক্তাদী, একাকী-
সবার জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা রুকন বা অবশ্য কর্তব্য। অনুরূপভাবে মাসবূক এবং নামাযের
প্রথম থেকে জামাআতে শামিল ব্যক্তির জন্যও রুকন।
তৃতীয় মতঃ ইমাম ও একাকী ব্যক্তির জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা
রুকন। কিন্তু স্বরব বা নীরব কোন নামাযেই মুক্তাদীর জন্য ওয়াজিব নয়।
চতুর্থ মতঃ ইমাম ও একাকী ব্যক্তির জন্য স্বরব বা নীরব নামাযে
সূরা ফাতিহা পাঠ করা রুকন। কিন্তু মুক্তাদীর জন্য নীরবের নামাযে রুকন স্বরব নামাযে
নয়।
আমার মতে প্রাধান্যযোগ্য মতটি হচ্ছেঃ স্বরব, নীরব সকল নামাযে
ইমাম, মুক্তাদী, একাকী- সবার জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা রুকন বা ফরয। তবে মাসবূক যদি
ইমামের রুকূর সময় নামাযে শামিল হয়, তবে সূরা ফাতিহা পাঠ করা রহিত হয়ে যাবে। একথার দলীল
হচ্ছে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাধারণ বাণীঃ তিনি বলেন,
لاصَلاةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ
“যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না তার নামায হবে না।”
তিনি আরো বলেন,
مَنْ صَلَّى صَلَاةً لَمْ يَقْرَأْ فِيهَا بِأُمِّ الْقُرْآنِ فَهِيَ خِدَاجٌ ثَلَاثًا غَيْرُ تَمَامٍ
“যে ব্যক্তি ছালাত আদায় করবে অথচ তাতে উম্মুল কুরআন সূরা ফাতিহা
পাঠ করবে না তার ছালাত অসম্পূর্ণ- রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)
কথাটি তিনবার বলেছেন।” অর্থাৎ- তার নামায বাতিল।
উবাদা বিন ছামেত বর্ণিত হাদীছে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) একদা ফজরের নামায শেষ করে ছাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেনঃ
لَعَلَّكُمْ تَقْرَءُونَ خَلْفَ إِمَامِكُمْ قُلْنَا نَعَمْ هَذًّا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ لَا تَفْعَلُوا إِلَّا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَإِنَّهُ لَا صَلَاةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِهَا
“তোমরা কি ইমামের পিছনে কোন কিছু পাঠ কর? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ,
হে আল্লাহ্র রাসূল! দ্রুত পাঠ করে থাকি। তিনি বললেন, তোমরা এরূপ করো না। তবে উম্মুল
কুরআন সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। কেননা যে ব্যক্তি উহা পাঠ করবে না তার নামায হবে না।”
স্বশব্দের নামাযের ক্ষেত্রে এটি সুস্পষ্ট দলীল যে, সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হবে না।
কিন্তু মাসবূকের জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা রহিত হয়ে যাবে। একথার
দলীল হচ্ছেঃ আবু বাকরা (রাঃ) এর হাদীছ। তিনি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে
রুকূ অবস্থায় পেলেন। তখন দ্রুতগতিতে কাতারে পৌঁছার আগেই তিনি রুকূ করলেন। এরপর ঐ অবস্থায়
হেঁটে হেঁটে কাতারে প্রবেশ করলেন। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামায শেষ
করে জিজ্ঞেস করলেন, কে এরূপ করেছে? আবু বাকরা বললেন, আমি হে আল্লাহ্র রাসূল! নবী
(ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ
زَادَكَ اللَّهُ حِرْصًا وَلَا تَعُدْ “আল্লাহ্
তোমার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিন। তবে এরূপ আর কখনো করিও না।” এ হাদীছে দেখা যায় আবু বাকরা
যে রাকাআতটি ছুটে যাওয়ার ভয়ে তাড়াহুড়া করলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
তাকে ঐ রাকাআতটি পুনরায় আদায় করার আদেশ করলেন না। এটা ওয়াজিব হলে নবী (ছাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সে আদেশ করতেন। যেমনটি আদেশ করেছিলেন ঐ ব্যক্তিকে যে কিনা তাড়াহুড়া
করে নামায আদায় করেছিল, আর নামাযের রুকন ওয়াজিব যথাযথভাবে আদায় করছিল না। তখন নবী
(ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে নামায ফিরিয়ে পড়ার আদেশ করেছিলেন।
মাসবূকের সূরা ফাতিহা পাঠ রহিত হওয়ার যুক্তিগত দলীল হচ্ছেঃ
এই মাসবূক তো কিরআত পাঠ করার জন্য দাঁড়ানোর সুযোগই পায়নি। অতএব সুযোগ না পেলে তার আবশ্যকতাও
রহিত হয়ে যাবে। যেমন হাত কাটা ব্যক্তি ওযু করার সময় তার হাতের কাটা অংশের পরিবর্তে
বাহু ধৌত করবে না। বরং ধৌত করার স্থান উপস্থিত না থাকার কারণে এ ফরয রহিত হয়ে যাবে।
অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ইমামকে রুকূ অবস্থায় পেল তার জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা রহিত
হয়ে যাবে। কেননা ক্বিরআত পাঠ করার জন্য দন্ডায়মান হওয়ার সুযোগই সে পায়নি। আর ইমামের
অনুসরণ করতে গিয়ে এখানে দন্ডায়মান হওয়াও রহিত হয়ে যাবে।
আমার দৃষ্টিতে এমতটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ। পূর্বোল্লেখিত উবাদা
বিন ছামেত (রাঃ) এর হাদীছটি- (ফজরের নামাযে ক্বিরআত পাঠ সংক্রান্ত হাদীছটি) যদি না
থাকতো, তবে স্বরবে কিরাআত বিশিষ্ট নামাযে মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠ করা আবশ্যক হতো
না। আর সেটাই হতো প্রাধান্যযোগ্য মত। কেননা নীরবে শ্রবণকারী পাঠকের মতই ছাওয়াবের অধিকারী
হয়। এজন্যই আল্লাহ্ তা‘আলা মূসা (আঃ) কে বলেনঃ قَدْ أُجِيبَتْ دَعْوَتُكُمَا “তোমাদের
উভয়ের দু’আ কবূল করা হয়েছে।” (সূরা ইউনূসঃ ৮৯) অথচ সে সময় দু’আ শুধু মাত্র মূসা (আঃ)
এককভাবে করেছিলেন। আল্লাহ্ বলেনঃ
وَقَالَ مُوسَى رَبَّنَا إِنَّكَ آتَيْتَ فِرْعَوْنَ وَمَلَأَهُ زِينَةً وَأَمْوَالًا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا رَبَّنَا لِيُضِلُّوا عَنْ سَبِيلِكَ رَبَّنَا اطْمِسْ عَلَى أَمْوَالِهِمْ وَاشْدُدْ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُوا حَتَّى يَرَوْا الْعَذَابَ الْأَلِيمَ
“আর মূসা বললেন, হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয় আপনি ফেরাউন ও
তার সভাসদদের প্রদান করেছো দুনিয়ার জীবনের চাকচিক্য, সৌন্দর্য ও সম্পদ। হে আমাদের পালনকর্তা!
ওরা আপনার পথ থেকে বিভ্রান্ত করে। হে আমাদের পালনকর্তা! তাদের সম্পদ নিশ্চিহ্ন করে
দিন, তাদের হৃদয় কঠোর করে দিন, যাতে তারা ঈমান না আনে। যাতে করে তারা যন্ত্রনাদায়ক
শাস্তি প্রত্যক্ষ করতে পারে।” (সূরা ইউনূসঃ ৮৮) এখানে কি আল্লাহ্ হারূনের দু’আর কথা
উল্লেখ করলেন? উত্তরঃ না। তারপরও আল্লাহ্ বললেনঃ “তোমাদের উভয়ের দু’আ কবূল করা হয়েছে।”
বিদ্বানগণ বলেনঃ এক ব্যক্তি দু’আ করা সত্বেও দ্বিবচন শব্দ এখানে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে,
মূসা (আঃ) দু’আ করছিলেন আর হারূন (আঃ) আমীন বলছিলেন।
আর আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ: (من كان له إمام، فقراءة الإمام له قراءة) “যার
ইমাম রয়েছে, তার ইমামের ক্বিরাতই তার ক্বিরাত (হিসেবে যথেষ্ট)।” কিন্তু হাদীছের সনদ
যঈফ (দুর্বল)। কেননা তা মুরসাল সূত্রে বর্ণিত
হয়েছে। যেমন হাফেয ইবনু কাছীর তাঁর তাফসীর গ্রনে'র ভূমিকায় বলেছেন। আরো কয়েকটি সূত্রে
হাদীছটি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু কোনটিই ছহীহ্
নয়। তারপরও হাদীছটি দ্বারা যারা দলীল নিয়ে থাকে তারা সাধারণভাবে বলেন না যে, কোন অবস্থাতেই
সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে না। বরং তাদের মধ্যে অনেকে বলেনঃ নীরবের নামাযে মুক্তাদীকে
অবশ্যই সূরা ফাতিহা পড়তে হবে।
যদি প্রশ্ন করা হয়ঃ ইমাম যদি না থামেন (অর্থাৎ- ফাতিহা শেষ
করার পর মুক্তাদীদের ফাতিহা পাঠ করার সুযোগ দেয়ার জন্য কিছু সময় নিরব না থাকেন।) তবে
মুক্তাদী কখন সূরা ফাতিহা পাঠ করবে? উত্তর হচ্ছেঃ ইমামের পড়ার সময়ই মুক্তাদী পড়বে।
কেননা ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর পড়ার সাথে সাথেই
পড়তেন। তখন তিনি তাদেরকে বলেনঃ
(لَا تَفْعَلُوا إِلَّا بِأُمِّ الْقُرْآنِ فَإِنَّهُ لَا صَلَاةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِهَا)
“তোমরা উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) ছাড়া অন্য কিছু পাঠ করবে
না। কেননা যে ব্যক্তি তা পাঠ করবে না তার নামায হবে না।”
প্রশ্নঃ মুক্তাদী কখন সূরা ফাতিহা পাঠ করবে? ইমামের ফাতিহা
পাঠ করার সময়? নাকি ইমাম সূরা ফাতিহা শেষ করে অন্য সূরা পাঠ শুরু করলে?
উত্তরঃ উত্তম হচ্ছে ইমামের ফাতিহা পাঠ শেষ হওয়ার পর মুক্তাদী
ফাতিহা পাঠ করবে। কেননা ফরয ক্বিরআত পাঠ করার সময় নীরব থাকা রুকন। ইমামের পড়ার সময়
যদি মুক্তাদীও পাঠ করে তবে রুকন আদায় করার সময় নীরব থাকা হল না। আর ফাতিহা পাঠ করার
পর যখন ইমাম অন্য ক্বিরআত শুরু করবে, সে সময় তা শোনার জন্য নীরব থাকা মুস্তাহাব। অতএব
উত্তম হল, ফাতিহা পাঠ করার সময় নীরব থাকবে। নামাযের সুন্নাত ক্বিরআত পাঠের সময় নীরব
থাকার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অন্যতম রুকন সূরা ফাতিহা পাঠ করার সময় নীরব থেকে
তা শ্রবণ করা। তাছাড়া ইমামের ‘ওয়ালায্ যওয়াল্লীন’ বলার সময় মুক্তাদীও (‘ওয়ালায্ যওয়াল্লীন’)
পাঠ করলে তাঁর সাথে ‘আমীন’ বলা সম্ভব হবে না।
প্রশ্নঃ সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর কিছুক্ষণ চুপ থাকার বিধান
কি?
উত্তরঃ ফিক্বাহবিদদের মধ্যে থেকে কেউ মত প্রকাশ করেছেন যে,
ইমাম সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর অন্য সূরা শুরু করার পূর্বে কিছুক্ষণ নীরব থাকবেন, যাতে
করে মুক্তাদী ফাতিহা পাঠ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এব্যাপারে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম) থেকে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়নি। তবে তা হচ্ছে সামান্য বিরতী নিঃশ্বাস নেয়ার
জন্য এবং এই ফাঁকে মুক্তাদি সূরা ফাতিহা পাঠ করা আরম্ভ করে দিবে। এরপর ইমাম অন্য ক্বিরাত
শুরু করে দিলেও কোন অসুবিধা নেই। কেননা সূরা ফাতিহা পাঠ করা মুক্তাদীর জন্য রুকন। কিন্তু
ইমামের ক্বিরআত শ্রবণ করা তার জন্য মুস্তাহাব। মোটকথা নীরব থাকার মুহূর্তটি অতি সামান্য
দীর্ঘ নয়।
গ্রন্থঃ ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, বিভাগঃ সালাত, প্রশ্ন নং- ২৪২,২৪৩।
২৪৫।
ফাতওয়া দিয়েছেন আল্লামাহ, শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন
(রহঃ)