বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪

জিহাদ, কিতাল ও খিলাফাহ ( পর্ব – ২ )

জিহাদ, কিতাল ও খিলাফাহ ( পর্ব ২ )

প্রথম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/Back.to.Allah.bangla/photos/pb.125167817515974.-2207520000.1409140925./888197884546293/?type=1

জিহাদের সামগ্রিক প্রকারভেদঃ
উপরের আলোচনায় বুঝা গেল জিহাদ প্রথমে দুই প্রকার। বড় জিহাদ ও ছোট জিহাদ। আর এ দুইটিই আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হবে তখন, যখন আল্লাহ খুশী হবেন। আর আল্লাহ খুশী তখন হবেন, যখন তা শুদ্ধ উপায়ে কুরান-সুন্নাহর সঠিক অনুসরণে করা হবে। যে জিহাদে তিনি খুশী নন, তাতে দুনিয়ার সকল জাহেল ইমোশনাল (আবেগ দিয়ে পরিচালিত, প্রবৃত্তির অনুসারী) মানুষগুলো খুশী হলেও সেটা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ হবেনা, বরং তা হবে জিহাদ ফি সাবিলিত-তাগুত বা শয়তানের রাস্তায় জিহাদ।

এমন দৃষ্টিকোন থেকে জিহাদকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন আহলুল লম বা উলামায়ে কেরামঃ
১. জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ।
২. জিহাদ ফি সাবিলিত্তাগুত।

জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ হল সেই জিহাদ, যাতে আল্লাহ্‌ খুশী হন, শয়তান কষ্ট পায়। জিহাদ ফী সাবিলিত্তাগুত হল সেই জিহাদ যাতে শয়তান খুশী হয়, আর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।
যে জিহাদে সম্পদ লাভ, ক্ষমতা লাভ, সুনাম অর্জন ও মনরঞ্জণ উদ্দেশ্য হয়, যা কোরআন হাদিসের বর্ণনা মতে সঠিক নয় তা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ নয়, বরং জিহাদ ফি সাবিলিস শাইতান বা শয়তানের রাস্তায় জিহাদ তাতে কোন সন্দেহ নেই। সে জিহাদে যতই ইসলামের নাম ও ব্যানার ব্যবহার করা হোক না কেন, কোন ভাবেই সেটা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ বলে গণ্য হবেনা। সে জিহাদে যারা মারা যাবেন তাঁরা শহীদ নন, বরং জাহান্নামি সে কথা বলতে দ্বিধা করার অবকাশ নেই। এ লেখার প্রতিপাদ্য সেই জিহাদ, যাতে আল্লাহ খুশী হন। যেটাকে বলা হয় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ।

ক. জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ দুই প্রকারঃ
০১. জাহের বা প্রকাশ্য জিহাদ
০২. বাতেন বা অপ্রকাশ্য জিহাদ।

প্রকাশ্য জিহাদ দুই প্রকারঃ
০১/০১. কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ। এটি হবে তখন যখন তারা শুধু ইসলামের কারণেই মুসলমানদেরকে আক্রমণ করবে। ইসলামের পথ বন্ধ করতেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
০১/০২. মুনাফেক, জালেম ও ফিতনা বাজদের বিরুদ্ধে জিহাদ।

প্রকাশ্য জিহাদ এর প্রত্যেকটি আবার ৪ প্রকারঃ
০১. মরণের ঝুঁকি নিয়ে, জীবনের ক্ষতি স্বীকার করে অস্ত্রের জিহাদ
০২. সম্পদের খরচ করে জিহাদ
০৩. মুখে ও লিখনির মাধ্যমে দাওয়াতি কাজ করে জিহাদ
০৪. মনের ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করে জিহাদ
= (০৪ x ০২= ০৮)।

অপ্রকাশ্য জিহাদ দুই প্রকারঃ
০২/০১. কাফের, মুশরেক, মুনাফেক, শয়তানের চর ও অনুচরদের বিরুদ্ধে জিহাদ। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এ জিহাদের প্রধান হাতিয়ার। এসবের সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ এ জিহাদে সফলতা আল্লাহর ইচ্ছায় এনে দিতে পারে।
০২/০২. মনের ইচ্ছা ও লালসার বিরুদ্ধে জিহাদ।

এর প্রত্যেকটি আবার ০৪ প্রকারঃ
০২/০২/০১. দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে জিহাদ
০২/০২/০২. জ্ঞানের উপর আমলের মাধ্যমে জিহাদ
০২/০২/০৩. শিক্ষা বিস্তার ও দাওয়াহ কাজের মাধ্যমে জিহাদ
০২/০২/০৪. এ কাজে সকল কষ্ট সহ্য করার মাধ্যমে জিহাদ
=(০৪ x ০২=০৮)।

ইমাম ইবনুকাইয়্যি রাহিমাহুল্লাহ তাঁর ‘’জাদুল মাআ’’ এবং ‘’হেদায়াতুল হায়ারা’’ নামক কিতাবে জিহাদের বর্ননা করতে গিয়ে জিহাদকে যেসব শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন তার মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য প্রকারভেদে উক্ত ১৬ টি। যদিও অন্যান্য আলেমগন আরও ভিন্ন ভাবে জিহাদ এর শ্রেণী বিন্যাস করেছেন। কেউ কাফের ও মুনাফেকের সঙ্গে জিহাদকে ও দুই ভাগ করেছেনঃ
১. প্রতিরক্ষামুলক; কাফেররা আক্রমণ করলে প্রতিরক্ষা করা যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

وَقَاتِلُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ الّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُوَاْإِنّ اللّهَ لاَ يُحِبّ الْمُعْتَدِينَ

তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করো (যে যুদ্ধে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়), তাদের সাথে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করছে। জেনে রা! তোমরা কখনো যেন সেই যুদ্ধে সীমা অতিক্রম না করো। কেননা আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদেরকে ভালবাসেন না
সুরা আল-বাক্কারাহঃ ১৭৮।

২. আক্রমনাত্মক; কাফেররা যদি ইসলামের দাওয়াতের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে বা অতীতে মুসলমানদেরকে নানাভাবে অত্যাচার করে থাকে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلّه الأنفال/39

তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যদিনা তা ফেতনায় রূপ না নেয় এবং যতদিন না এই দ্বীন সম্পূর্ণরূপে ছড়িয়ে পড়ে
সুরা আনফালঃ ৩৯।

পূর্বে ক্ষতি সাধন করে থাকলেও তার প্রতিশোধ গ্রহণ করা এই ধরনের জিহাদের মধ্যেই পড়ে। তবে এক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ

وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُم بِهِ وَلَئِن صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِّلصَّابِرِينَ-النحل/126

যদি তোমরা প্রতিশোধ নিতে চাও তাহলে (যখন পারবে) শুধু ততটুকু প্রতিশোধ নেবে, যতটুকু তারা তোমাদের প্রতি অন্যায় করেছিল। তবে হ্যাঁ, যদি ধৈর্যধারণ করতে পারো, তাহলে ধৈর্যধারণকরীদের জন্যে হবে অনেক উত্তম
সুরা নাহলঃ ১২৬।

মনে রাখতে হবে একথাও যে সশস্র জিহাদের জন্যে সকল শর্ত সমূহ অবশ্যই পূর্ণ হতে হবে। ইতিঃপূর্বে উল্লেখিত ১৬ প্রকার জিহাদের সংক্ষিপ্ত প্রকারভেদ নিম্নে তুলে ধরা হলঃ

(১) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদ
(২) সম্পদের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদ
(৩) দাওয়াতি কাজের জিহাদ
(৪) বলতে না পাড়লে মন দিয়ে ঘৃণা করে জিহাদ

এর প্রত্যেকটিকে আবার চার ভাগ করা হয়েছেঃ
(১) কাফেরদের বিরুধ্যে জিহাদ
(২) জালেম ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ
(৩) শয়তান ও তার সেনাদের বিরুদ্ধে জিহাদ
(৪) নাফস বা মনের খারাপ চাহিদার বিরুদ্ধে জিহাদ

(((০৪ x ০৪ = ১৬)))

বাস্তবতা এই যে, আজকাল জিহাদ বলতে শুধু সশস্ত্র যুদ্ধকেই বুঝানো হয়ে থাকে। এমন ভুলের খণ্ডন আগে হওয়া উচিত বলে মনে করা হয়।

উল্লেখিত প্রকার গুলির মধ্যে জীবন ও সম্পদের জিহাদ বেশী ঝুঁকিপূর্ণ। এ জাতীয় জিহাদে ব্রতী হওয়ার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট লামায়ে কেরাম যে শর্ত আরোপ করেছেন তা হলঃ

০১) ঝুঁকির চেয়ে লাভের সম্ভাবনা বেশী থাকতে হবে।
০২) শত্রুর পক্ষ থেকে আগে শুরু হতে হবে।
০৩) ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু (অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইত্যাদি কো) কারনে হলে জিহাদ গ্রহণযোগ্য হবেনা।
০৪) শত্রুর মোকাবিলায় যথোপযুক্ত শক্তি ও প্রস্তুতি থাকতে হবে।
০৫) কেন্দ্রীয় শীর্ষ স্থানীয় (জাতীয়) নেতা ও তাঁর পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে হবে। কোন বিশেষ দল বা গোষ্ঠী এমন জিহাদের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেনা।
০৬) আক্রোশের সীমা অতিক্রম করা যাবেনা। ক্ষতি যতটুকু হয়েছে, ঠিক ততটুকুই পুষিয়ে নেওয়া বৈধ হবে। তার চেয়ে বেশি কিছু করলে হবে সেটা অবৈধ।
০৭) এমন কোন ফেতনার জন্ম দেওয়া যাবেনা, যা চাইলেও পরবর্তীতে নিবারণ করা সম্ভব হবেনা।

উপরের আলোচনা থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, ময়দানের জিহাদ আর অন্যান্য জিহাদের স্বরূপ ও শর্ত এক নয়। ভিন্নতা সাপেক্ষে যখন প্রতিটি জিহাদের শর্ত বর্তমান পাওয়া যাবে, স্বরূপ পরিষ্কারভাবে উম্মোচিত হবে, তখনি মাত্র জিহাদে অবতীর্ণ হওয়া যাবে। আর সেই জিহাদের মধ্যে যেটা সশস্র জিহাদ তাতে একদল মুসলমান কেন্দ্রীয় কমান্ডের আওতায় অংশ নিলেই সকলের পক্ষ থেকে সে ফরজ আদায় হয়ে যাবে। তবে যদি সরকার প্রধান নাফির আম বা সকলের প্রতি জিহাদ করার আহ্বান জানায় তখন শুধু নারী-বৃদ্ধ-শিশু ও অপারগ ব্যক্তি ছাড়া সকলের উপর অংশ নেওয়া ফরজ হয়ে যাবে। অন্যান্য জিহাদের জন্যে কোন দল বা গ্রুপ হওয়া জরুরী নয়। প্রতিটি ব্যক্তিই তার সামর্থ্য অনুসারে সেসব জিহাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
চলবে (ইন শা আল্লাহ).......


Collected from শায়খ মুজাম্মেল আল-হাক্ক।