শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করেনা তাঁদের হুকুম


আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করেনা তাঁদের হুকুম
প্রশ্নঃ (৬৮) যারা আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে মানব রচিত আইন দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে তাদের হুকুম কি?
- আল্লামাহ, শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ)
উৎস গ্রন্থঃ ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, বিভাগঃ ঈমান
উত্তরঃ আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে বলছি যে, আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত বিধান দিয়ে রাষ্ট্র চালানো বা বিচার-ফয়সালা করা তাওহীদে রুবূবীয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত। কেননা তাতে আল্লাহর রুবূবীয়্যাত, পরিপূর্ণ রাজত্ব এবং পরিচালনা ক্ষমতার দাবী অনুযায়ী তাঁর হুকুম কার্যকর করার নামান্তর। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলেম ও ধর্ম-যাজকদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে এবং মারইয়ামের পুত্র মাসীহকেও অথচ তাদের প্রতি শুধু এই আদেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা শুধুমাত্র এক মাবূদের এবাদত করবে, যিনি ব্যতীত মাবূদ হওয়ার যোগ্য কেউ নয়। তিনি তাদের অংশী স্থাপন করা হতে পবিত্র। সূরা তাওবাঃ ৩১।

এখানে আল্লাহ তাআলা ইয়াহুদী-নাসারাদের ধর্ম-যাজকদেরকে রব হিসাবে নাম করণ করেছেন। কারণ তারাও আল্লাহর বিধানের মত বিধান রচনা করত। তাদের রচিত বিধানের অনুসারীদেরকে গোলাম বা বান্দা হিসাবে নাম দেয়া হয়েছে। কারণ তারা আল্লাহর বিধানের বিরোধীতা করে ঐ সব পাদ্রি ও আলেমদের কাছে নতি স্বীকার করত এবং তাদের অনুসরণ করত। আদী বিন হাতেম (রাঃ) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বললেন, তারা তো তাদের এবাদত করে না। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তারা হালালকে হারাম করে এবং হারামকে হালাল করে। আর সাধারণ লোকেরা তাদের অনুসরণ করে থাকে। এটার নামই এবাদত।

আপনি জেনে নিন, যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না; বরং অন্যের বিধান দ্বারা বিচার-ফায়সালা করতে চায়, তাদের ব্যাপারে কুরআনের আয়াতগুলো দুভাগে বিভক্ত। প্রথম প্রকারের আয়াতে তাদেরকে ঈমানহীন (মুনাফেক) দ্বিতীয় প্রকারের আয়াতে কাফের, জালেম ও ফাসেক বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
আপনি কি তাদেরকে দেখেন নি, যারা দাবী করে যে, আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তারা সে সমস্ত বিষয়ের উপর ঈমান এনেছে। তারা বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য শয়তানের কাছে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়। আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেনঃ তোমরা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং তাঁর রাসূলের দিকে এসো তখন আপনি মুনাফেকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আরোপিত হয়, তখন কেমন হবে? অতঃপর তারা আল্লাহর নামে কসম খেয়ে ফিরে আসবে যে, কল্যাণ ও সমঝোতা ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এরা হল সে সমস্ত লোক, যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অবগত। অতএব, আপনি ওদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোন কথা বলুন, যা তাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাদের (রাসূলগণের) আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসূলও যদি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবান রূপে পেত। অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবূল করে নিবে।
সূরা নিসাঃ ৬০-৬৫।

এখানে আল্লাহ তাআলা ঈমানের দাবীদার মুনাফেকদের কয়েকটি বৈশিষ্ট তুলে ধরেছেনঃ

(১) মুনাফেকদের প্রথম বৈশিষ্ট হলো তারা তাগুতের নিকট বিচার-ফায়সালার জন্য গমণ করে থাকে। প্রত্যেক ঐ বিষয় বা ব্যক্তির নামই তাগুত, যে আল্লাহর বিধানের বিরোধীতা করে। সমস্ত বিচার-ফায়সালা এবং হুকুমের মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
জেনে রাখ তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ করা। আল্লাহ বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক। সূরা আরাফঃ ৫৪।

(২) তাদেরকে আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দিকে আহবান করা হলে তারা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

(৩) তারা কোন বিপদে পড়লে অথবা তাদের কৃতকর্ম মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়ে গেলে শপথ করে বলে থাকে যে, সৎ উদ্দেশ্য এবং পরিস্থিতি শান্ত রাখা ব্যতীত আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। বর্তমানে যারা ইসলামের বিধান বাদ দিয়ে মানব রচিত বিধান দিয়ে রাষ্ট্র চালায়, তাদের কথাও একই রকম। তারা বলে, আমাদের উদ্দেশ্য হল যুগোপযোগী শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের উপকার সাধন করা।

আল্লাহ তাআলা উপরোক্ত চরিত্রের অধিকারী মুনাফেকদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরের খবর জানেন এবং তাদেরকে নসীহত করার জন্য এবং কঠোর ভাষায় কথা বলার জন্য নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে আদেশ দিয়েছেন। রাসূল পাঠানোর উদ্দেশ্য হল, যাতে শুধুমাত্র তাঁদেরই অনুসরণ করা হয়। অন্য মানুষের অনুসরণ নয়। তাদের চিন্তাধারা ও মতবাদ যতই শক্তিশালী হোক না কেন। অতঃপর আল্লাহ তাআলা নিজের রুবূবীয়্যাতের শপথ করে তাঁর রাসূলকে বলছেন যে, তিনটি বিষয়ের সমন্বয় ব্যতীত কারও ঈমান সংশোধন হবে না।

১) সকল প্রকার বিরোধপূর্ণ বিষয়ে রাসূলের দিকে ফিরে আসা।

২) রাসূলের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার জন্য অন্তরকে প্রশস্ত করা।

৩) পরিপূর্ণভাবে রাসূলের ফায়সালাকে মেনে নেয়া এবং কোন প্রকার শীথিলতা ব্যতীত তা বাস্তবে রূপদান করা।
দ্বিতীয় প্রকারের আয়াত সমূহে আল্লাহ বলেন,
যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা কাফের। সূরা মায়েদাঃ ৪৪।

যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা জালেম। সূরা মায়েদাঃ ৪৫।

যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা ফাসেক। সূরা মায়েদাঃ ৪৭।

যারা আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না তাদেরকে আল্লাহ উপরের তিনিটি আয়াতে পরপর কাফের, জালেম এবং ফাসেক বলেছেন। তিনটি গুণই কি এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে? অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করল না, সে কাফের, ফাসেক এবং জালেমও বটে। কেননা আল্লাহ কাফেরদেরকে জালেম এবং ফাসেক হিসাবেও বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলেন,
বস্তুতঃ কাফেরেরাই প্রকৃত জালেম। সূরা বাকারাঃ ২৫৪।

আল্লাহ আরো বলেছেন, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করেছে এবং ফাসেক অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। সূরা তাওবাঃ ৮৪।

প্রত্যেক কাফেরই কি জালেম এবং ফাসেক??
নাকি আল্লাহর আইন দিয়ে ফায়সালা না করার কারণে বিভিন্ন প্রকার মানুষের উপর অবস্থাভেদে এ সমস্ত বিধান প্রযোজ্য হবে। দ্বিতীয় মতটি আমার নিকট গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার না করলে মানুষ কখনো কাফের হয়, কখনো জালেম হয় আবার অবস্থাভেদে কখনো ফাসেক হয়।

সুতরাং আমরা বলব যে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ মনে করে এবং অন্য বিধানকে অধিক উপযোগী ও উপকারী মনে করে তার মাধ্যমে মানুষের বিচার-ফায়সালা করে, তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে কাফের হয়ে যাবে। এদের অন্তর্ভুক্ত ঐ সমস্ত লোক, যারা মানুষের জন্য পথ হিসাবে ইসলাম বিরোধী বিধান রচনা করে। তারা তাদের রচিত বিধানকে মানুষের জন্য অধিক উত্তম ও উপযোগী মনে করেই তৈরী করে থাকে। এ কথা স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞাত হওয়া যায় যে, মানুষ এক পথ ছেড়ে দিয়ে যখন অন্য পথে চলে, তখন এটা মনে করেই চলে যে, প্রথম পথের চেয়ে দ্বিতীয় পথটি উত্তম।

আর যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে অন্যের বিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করে এবং বিচার-ফায়সালা করে কিন্তু সে আল্লাহর বিধানকে অবজ্ঞা করে না এবং অন্য বিধানকে অধিক উপকারী এবং উপযোগীও মনে করে না বরং সে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার কিংবা প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য এরূপ করে থাকে, তাহলে কাফের হবে না বরং জালেম হিসাবে গণ্য হবে।

আর যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে অন্য বিধানের মাধ্যমে রাষ্টীয় বিচার-ফায়সালা করে কিন্তু সে আল্লাহর বিধানকে অবজ্ঞা করে না এবং অন্য বিধানকে অধিক উপকারী এবং উপযোগীও মনে করে না, বরং বিচার প্রার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে কিংবা ঘুষ গ্রহণের জন্য কিংবা অন্য কোন পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য এরূপ করে থাকে, তা হলে কাফের হবে না; বরং ফাসেক হিসাবে গণ্য হবে।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলেমদেরকে রব্ব (প্রভু) হিসাবে গ্রহণ করে, তারা দুপ্রকার।

(১) তারা জানে যে, তাদের গুরুরা আল্লাহর দ্বীন পরিবর্তন করে ফেলেছে। তারপরও তারা তাদের অনুসরণ করে এবং তাদের হালাল করা বস্তকে হালাল ও হারামকে হারাম হিসাবে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে তাদের নেতাদের অন্ধ অনুসরণ করে থাকে। তারা ভাল করেই জানে যে, তাদের নেতারা রাসূলদের আনীত দ্বীনকে পরিবর্তন করে ফেলেছে। এটা নিঃসন্দেহে কুফরী। এটাকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল শির্ক হিসাবে ব্যক্ত করেছেন।

(২) তারা কেবলমাত্র হারামকে হালাল এবং হালালকে হারাম করার ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করে। তারা আল্লাহর নাফরমানীতে তাদের নেতাদের অনুসরণ করেছে। যেমনভাবে মুসলমানেরা হারাম জেনেও পাপকাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। তাদের হুকুম অন্যান্য পাপীদের মতই।
______________________
এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্যে নীচে শায়খের এই অডিও ও ভিডিও টেপগুলো দেখুন-

Shaykh Ibn 'Uthaymeen about the Arab rulers (exclusive, detailed Fatwâ)
https://www.youtube.com/watch?v=iLhBFIvWiI4
______________________
Ibn Uthaymeen: The ruler who doesn't rule by Allah's Law
https://www.youtube.com/watch?v=F7Ov2gcEopY
______________________
Ibn 'Uthaymîn shuts the door to misused Takfîr upon the rulers
https://www.youtube.com/watch?v=1t8rLrn6FiQ
______________________
Labeling People as Murji'ah For Not Making Takfir of the Rulers - Shaykh Al 'Uthaymeen
https://www.youtube.com/watch?v=M_gzGQK3upg
______________________
Shaykh Ibn 'Uthaymîn about the Saudi Arabian government
https://www.youtube.com/watch?v=sHRyLyI0Wlo