আরাফাহর দিন সম্পর্কে
জানুন
(১) আরাফার দিন কি এবং কবে?
জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ, অর্থাৎ ঈদুল আযহার পূর্বের
দিনটিকে ‘ইওয়ামুল আরাফাহ’ বা আরাফার দিন বলা হয়। কারণ, এই দিনে
হাজীরা মক্কার আরাফাহ নামক একটা মাঠে সমবেত হন। হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজ
হলো যিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখ ‘আরাফার
ময়দানে’ অবস্থান করা। এইদিনের
গুরুত্ব সম্পর্ক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আরাফার ময়দানে অবস্থান করাই হলো হাজ্জ।” সুনানে তিরমিযীঃ ২৯৭৫।
অর্থাৎ, আরাফাতে অবস্থান করা হজ্জের সবচাইতে
গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটা হজ্জের প্রধান রুকন, যা ছুটে গেলে পুরো হজ্জই বাতিল হয়ে
যাবে। তাকে পরের বছর আবার হজ্জ করতে হবে (যদি তার উপর হজ্জ করা ফরয হয়ে থাকে)।
(২) আরাফার দিন ফযরের পর থেকেই হাজীরা আরাফার ময়দানে
জড়ো হয়ে যিকির-আযকার করেন, আর বিশেষ করে তোওবা ও ইস্তেগফার করেন। এইদিনে জড়ো হওয়া
মানুষদের দোয়া আল্লাহ সবচাইতে বেশী ভালোবাসেন ও কবুল করেন। এইদিনে আল্লাহ সবচাইতে
বেশি আদম সন্তানকে ক্ষমা করে জান্নাত দান করেন। যোহরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার
কিছুক্ষণের মাঝেই হাজীদের উদ্দেশ্যে বিশেষ খুতবা দেওয়া হয়। খুতবার পর যোহর ও আসর
জমা ও কসর করে একসাথে পড়া হয়। এরপর হাজীরা নামায থেকে অবসর হয়ে মাগরিব পর্যন্ত পুরো
সময়টা প্রাণভরে শুধু দুয়া ও আন্তরিক তোওবা-ইস্তেগফার করে অতিবাহিত
করেন।
(৩) আরাফার ময়দানে অবস্থিত ‘মাসজিদে নামিরা’ থেকে বিগত ৩৪ বছর ধরে হাজীদের উদ্দেশ্যে
হজ্জের খুতবা দিয়ে আসছেন বর্তমান সৌদি আরবের প্রধান মুফতি এবং সর্বোচ্চ ফতোয়া
প্রদান বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, আল্লামাহ শায়খ আব্দুল আজিজ ইবনে আব্দুল্লাহ আলে-শায়খ
হাফিজাহুল্লাহ। শায়খের জন্ম হয়েছিলো ১৯৪৩ সালে। জন্ম থেকেই তার দৃষ্টিশক্তি ছিলো
অত্যন্ত কম। আর ১৭ বছর বয়সে তিনি একেবারেই অন্ধ হয়ে যান। ১৯৯৯ সালে তিনি সৌদি
আরবের প্রধান মুফতি হিসেবে নির্বাচিত হন। দুই বছর পূর্বে ২০১৪ সালে আমাদের পেইজের
এক ভাই Razu Ahmed তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেনঃ
“তিনি দৃষ্টি শক্তিহীন, উনার চোখে নেই আলো
অথচ উনার হৃদয়টা দ্বীনের আলোয় আলোকিত...
আর আমাদের চোখে আলো থাকতেও হৃদয়ে দ্বীনের আলো নেই...
।”
(৪) যারা হজ্জে যাবেন না, আরাফার দিনে তাদের রোযা রাখার
ফযীলতঃ
আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বর্ণনা করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে আরাফার দিনের রোজার
ব্যপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আরাফার দিনের রোজা বিগত ও সামনের এক বছরের গুনাহ সমূহের জন্য
কাফফারা স্বরূপ।” সহীহ মুসলিমঃ ১১৬২।
(৫) হাদীসে আরাফার রোজার কথা এসেছে, জিলহজ্ব মাসের নয়
তারিখের কথা আসেনি। তাই কিছু আলেম সাউদী আরবে হাজীরা যেইদিনে আরাফার মাঠে অবস্থান
করবেন, সেই দিনেই এ রোজা রাখা উচিত বলে মত প্রকাশ করেছেন। কারণ, আরাফাহ ছাড়া অন্য
কোন রোজা স্থানের সাথে সম্পৃক্ত নয়। আবার অন্য আলেমদের মতে, রমযান ও ঈদের মতো
আরাফার রোযাও নিজ নিজ দেশের চাঁদের উপর নির্ভর করে রাখতে হবে, এটা শায়খ ইবনে
উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর ফতোয়া। যাই হোক, আলেমদের মতবিরোধ বা সন্দেহের মাঝে না
গিয়ে, উত্তম হচ্ছে সউদী আরব ও বাংলাদেশের দুই দিনের হিসাবেই দুইটি রোযা রেখে ফেলা।
এতে কোন ক্ষতি নেই, বরং যিলহজ্জ মাসের ১ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত সবগুলো দিনেই রোজা
রাখতে পারেন, এটা সুন্নাত এবং অনেক সওয়াবের ইবাদত। এই দশ দিনের যেকোন ইবাদত
আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও বেশি মর্যাদার।
(৬) যারা হজ্জ করবেন তারা আরাফার দিন রোযা রাখবেন না,
কারণ ঐদিন আরাফাতে বেশি বেশি দুয়া ও যিকির-আযকার করবেন, এটাই রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম
এর নির্দেশ। কারণ, আরাফার ময়দানের দুয়া আল্লাহ সবচাইতে বেশি কবুল করেন। সেইজন্য,
যারা হজ্জ করবেন তারা রোযা না রেখে বেশি বেশি দুয়া করবেন, আর যারা বাড়িতে থাকবেন
তারা ঐদিন রোযা রাখার চেষ্টা করবেন।
(৭) আরাফার দিনে একটি মাত্র রোজা রাখলে যদি দুই বছরের
গুনাহ মাফ হয়ে যায়, তাহলে এই সুযোগ মিস করা কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
(৮) নারীদের হায়েজ বা ঋতু সংক্রান্ত প্রশ্নঃ ঋতু
চলাকালীন সময়ে যেই সমস্ত বোনেরা আশুরা বা আরাফার রোজার রাখতে পারছেন না, তারা কি
পরে কাজা রাখতে পারবেন?
উত্তরঃ আরাফাহ, আশুরা, ইত্যাদি যেই সমস্ত নফল/সুন্নত
রোযা আছে, কেউ যদি সেইগুলো মিস করে এইগুলোর কোনো কাযা নেই। অর্থাৎ, দিনের সাথে
সম্পর্কিত রোযাগুলো নির্ধারিত দিনে রাখতে না পারলে রমযানের রোযার মতো অন্য কোনো
দিনে তা কাযা রাখার সুযোগ নাই। প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন শায়খ আব্দুল হামীদ মাদানী।
তবে যারা এইদিনে
রোযা রাখার নিয়ত করেছিলেন, কিন্তু ঋতুর কারণ এই রোযা থেকে বঞ্চিত হবেন, তারা আফসোস
করবেন না। কারণ, বান্দা তার সৎ নিয়তের কারণে সওয়াব পায়। আর ইচ্ছা করলে অন্য নফল বা
সুন্নত রোযা রাখতে পারেন। ১, ২ অথবা ৩ টা। যাদের দুইটা রোযা রাখার ইচ্ছা ছিলো,
তারা পরবর্তীতে সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবারে যে রোযা রাখা সুন্নত, সেটা পালন করতে
পারেন। হয় মাসের যে কোনো সোমবারে অথবা বৃহস্পতিবারে একটা অথবা দুইটা রোযা রাখবেন।
এছাড়া মাসে যে কোনো তিন দিন রোযা রাখার সুন্নতী একটা পদ্ধতি আছে সেটা করতে পারেন।
এইটা যেকোনো তিন দিনই করা যায়, তবে চাঁদের মাসের ১৩, ১৪, ১৫-তে করলে সবচাইতে বেশি
সওয়াব পাওয়া যাবে। তবে সুন্নতী পদ্ধতিতে যেকোনো ১দিন, ২দিন, ৩দিন যাই করেন না করেন,
একটা নফল রোযার অনেক সওয়াব। তাই আমাদের উচিত আস্তে আস্তে এইভাবে নফল রোযা রাখার
অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করা।
(৯) আরাফাহর রোযা
নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ফতোয়াঃ
প্রশ্নঃ রমযানের রোযা বাকি আছে এমন কোন ব্যক্তি কি কাযা
রোযার নিয়ত করে আরাফাহর দিনে রোযা রাখতে পারবে? আর কাযা রোযার নিয়ত করলে সে কি
আরাফাহর দিনে রোযা রাখার সওয়াব পাবে?
উত্তরঃ ইমাম আব্দুল আ’জিজ বিন বাজ রাহিমাহুল্লাহ ও ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালেহ
আল-উসাইমীন রাহি’মাহুল্লাহর ফতোয়া
হচ্ছেঃ “কোন ব্যক্তি যদি
আরাফার দিনে কাযা রোযার নিয়ত করে রোযা রাখে তাহলে সে দুইটি সওয়াব একই সাথে পাবে,
একটি হচ্ছে ফরয কাযা রোযা রাখার সওয়াব, সাথে সাথে আরাফার দিনে রোযা রাখার সওয়াবও
সে পেয়ে যাবে (ইন শা আল্লাহ)।
উৎসঃ মাজমু’ ফাতওয়া ইবনে উসায়মিনঃ ২০/২৯.
৩, মাজমু’ ফাতওয়া ইবনে বাজঃ
১৬/৪০৬, মালেকী এবং শাফেয়ী মাযহাবের ফুকাহাদের মতামতঃ হাশিয়াত আদ-দাসুকীঃ ৫/৯৫;
হাশিয়াত আত-ই’য়ানা আত-ত্বালিবিনঃ
২/২৫২; আল-ফাতওয়া আল-ফিকহিয়া আল-কুয়াইতিয়াহঃ ২/৮৩।
+ আল্লাহ আমাদের
সকলকে অধিক পরিমাণে নেক আমল করার তোওফিক দান করুন, আমিন।