সালাফি অথবা খালাফি, হানাফী
কিংবা আহলে হাদীস - এই উভয় শ্রেনীর লোকদের
মাঝে, বিশেষ করে তরুণ ভাইদের মাঝে সাধারণ একটা ব্যাধি হচ্ছেঃ
নিজের পছন্দের লোককে আলেম বলে দাবী করা। আর তাইতো আমরা দেখতে পাই, আরবী ভাষা জানেন না, এমন লোককেও কিছু মানুষ দুনিয়ার
শ্রেষ্ঠ আলেম বলে দাবী করে। আক্বীদাহ ও তাওহীদ কি বুঝেনা, দ্বীনের
বড় বড় বিষয় নিয়ে, আলেম ওলামাদেরকে নিয়ে কটাক্ষ করে, এমন লোকদেরকেও কুরান এক্সপার্ট, ইমাম, মুফতি বলে দাবী করার মতো লোকের অভাব বর্তমান পৃথিবীতে নেই। যাই হোক,
আসুন আমরা জেনে নেইঃ আ’লেম কাকে বলে?
__________________________
• আ’লেম কাকে
বলে?
আলহামদু লিল্লাহ, ওয়াস
স্বালাতু ওয়াস সালামুআলা রাসূলিল্লাহ, আম্মা বাদঃ
আজকাল একটি কথা
অনেকের মুখ থেকে শুনা যাচ্ছে, তা হলঃ
‘এদের কথা
শুনবেন না, এরা আলেম না’।
এটা তখন শুনা যায়, যখন
কোন সাধারণ মুসলিম ভাই অপর মুসলিম ভাইকে দ্বীনের কোনো এমন শিক্ষা দিতে চায় কিংবা
এমন ভুল-ত্রুটি সংশোধন করতে চায়, যা আগে থেকে সমাজে
গতানুগতিক ভাবে চলে আসছে। যেমন ধরুন
- কেউ নামাযের
শুরুতে জায়নামায পাক করার দুআ পড়ছে,
- কিংবা গদ বাঁধা
নিয়ত পড়ছে,
- কিংবা সালাম শেষে
এক হাত মাথায় রেখে এবং অন্য হাত বুকে রেখে কিছু পড়ছে কিংবা
- নামাযের কাফফারা
নির্ধারণ করছে কিংবা
- তাবীজ-কব্চ
পরিধান করছে...
ইত্যাদি ফেকহী ও
আক্বাদী বিষয়।
এই রকম ক্ষেত্রে
কোন সাধারণ জ্ঞানের দ্বীনী ভাই যদি সেই সব বিষয় আমলকারীকে তা করতে নিষেধ করে, তখন
সে তা পরিত্যাগ না করে কোন মসজিদের ইমাম কিংবা কোন দাওরা পাস মৌলানার নিকট তা
জিজ্ঞেস করে। এমন সময় সেই ইমাম বা মৌলানা তাকে দলীল-প্রমাণ সহ বিষয়টি না বুঝিয়ে
সংক্ষিপ্তাকারে একটি উত্তর দেয়ঃ
সে আলেম নয়, ওর
কথা শুনবেন না কিংবা তারা আলেম নয়, কোন মাদ্রাসায় তারা
পড়া-শুনা করেনি, তাই তাদের কথা শুনবেন না, শুনলে গুমরাহ হয়ে যাবেন।
বলাবাহুল্য, ২০১২
সালে চট্টগ্রামের হাটাজারি স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ইসলামী মহাসম্মেলনে
বাংলাদেশের এক শ্রেণীর লোকের বিশ্বাসানুযায়ী তাদের শ্রেষ্ঠ মুফতী ও শায়খুল হাদীস,
মাওলানা আহমাদ শফী আহলে হাদীসদের সম্পর্কে এই মন্তব্য বারংবার করেন।
তাই সাধারণ ভাইদের জ্ঞাতার্থে সংক্ষিপ্তকারে আলেম কাকে বলে? বিষয়টি
উপস্থাপন করার ইচ্ছা করলাম।
কোন মাদ্রসা থেকে
ফারেগ হলে কিংবা মাদ্রাসার ডিগ্রী হাসেল করলেই কি তাকে আলেম বলা হবে?
যেমন সমাজে মনে করা
হয়, না অন্য কিছু। আশা করি সত্যান্বেষী ভাইয়েরা বিষয়টি অনুধাবন করবেন ও উপকৃত
হবেন। ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।
__________________________
‘আ’লেম’ [দ্বীনের
জ্ঞানী], ‘ফকীহ’ [দ্বীনের পন্ডিত] এবং
‘মুজতাহিদ’ [দ্বীনের
গবেষক] - এমন কয়েকটি উপাধি, যে সবের অর্থ প্রায় এক, তা হচ্ছে, যিনি শারয়ী বিধান জানার উদ্দেশ্যে চেষ্টা
ও গবেষণা চালায় এবং শরীয়ার দলীল-প্রমাণ থেকে শারয়ী বিধান উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়।
[দেখুন শারহুল
কাওকাবিল্ মুনীরঃ ৪/৪৫৮, আল্ ইহকাম, আমেদীঃ
৪/১৬২-১৬৪]
অনেকে মনে করেন যে, সেই
গবেষণা এত গভীর হতে হবে যে, গবেষক সেই বিষয়ে আর অধিক গবেষণায়
অপারগতা বোধ করবে।
[ইহকাম, আমেদী,
৪/১৬২]
গবেষণার এই আসনে
পৌঁছানোর জন্য গবেষকের মধ্যে যে সব শর্ত থাকা জরূরী, তার ব্যখ্যা একাধিক
উসূলে ফিকহের গ্রন্থাদিতে বর্ণিত হয়েছে। আমি নিম্নে সেই শর্ত সমূহ তুলে ধরব,
ইনশাআল্লাহ।
__________________________
১. সে যেন কিতাব ও
সুন্নাহর দলীল সমূহ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। অনেকের মতে বিধি-বিধান সম্পর্কীয় কুরআনের
আয়াতগুলি যেন তার জানা থাকে, যার সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারের মত।
অনুরূপ সুন্নতে বর্ণিত আহকামের হাদীস সমূহ যেন তার জানা থাকে। আর এর সঠিক সংখ্যা
কত? তা নিয়ে উলামাগণের মতভেদ রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ হাদীস
গ্রন্থ সমূহে বর্ণিত হাদীসগুলি সম্পর্কে সে যেন ভাল জ্ঞান রাখে। যেমন, বুখারী, মুসলিম, সুনান আবু
দাঊদ, সুনান তিরমিযী, সুনান নাসাঈ,
সুনান ইবনু মাজাহ সহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ।
এই ক্ষেত্রে যেমন
তাকে আয়াতগুলির শুধু হাফেজ হলেই হবে না বরং সেই আয়াত সমূহের তফসীর জানতে হবে, তেমন
শুধু হাদীস সমূহ জানলে হবে না; বরং সেই সকল হাদীসের, সনদ (সূত্র) ও মাতন এবং সহীহ-যয়ীফ সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।
২. সে যেন আরবী
ভাষায় পারদর্শী হয়। আরবী শব্দের উৎস, গঠন, অর্থ,
অর্থাৎ নাহু, সার্ফ ও আরবী অলংকার শাস্ত্রের
জ্ঞানী হয়। কারণ শরীয়ার বিধান সমূহ আরবী ভাষায় লিপিবদ্ধ।
৩. সে যেন ‘ইজমা’র মাস্আলা-মাসায়েল
সম্বন্ধেজ্ঞাত হয়। অর্থাৎ উম্মতের গবেষক উলামায়ে কেরামের ঐক্যমত সম্পর্কে অবগত হয়।
৪. সে যেন উসূলে
ফিকহ (ফিকহের মূলনীতি) সম্পর্কে অবগত হয়। কারণ এই বিষয় জানাই হচ্ছে গবেষণার
নীতি-নিয়ম জানা।
৫. সে যেন নাসেখ
(রহিতকারী দলীল) এবং মানসূখ (রহিত দলীল)সম্পর্কে অবগত থাকে।
উৎসঃ দেখুন,ইরশাদুল
ফহূল, ইমাম শাওকানী, পৃঃ ২০৬-২০৮/আল
উসূল মিন ইলমিল উসূল, ইমাম ইবনে উসাইমীন, পৃঃ ৮৫-৮৬/ শারহুল কাওকাবিল মুনীর, ইবনুন নাজ্জার,
৪/৪৫৯-৪৬৬]
__________________________
এছাড়াও অনেকে আরো
শর্তের বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু উপরোল্লেখিত শর্ত সমূহই মূল শর্ত। উল্লেখ্য যে, আলেম,
ফকীহ, মুজ্তাহিদ ও মুহাদ্দিস শারয়ী পরিভাষা,
যার বিশেষ অর্থ রয়েছে এবং এর জন্যে বিশেষ শর্তও রয়েছে। তাই এসবের
প্রয়োগের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা জরূরী। কারণ কেউ দাঈ হতে পারে, কেউ ভাল বক্তা হতে পারে, কেউ মাদ্রাসার শিক্ষক হতে
পারে কিংবা মাদ্রসার ডিগ্রীধারী হতে পারে কিন্তু আলেম বা মুজ্তাহিদের স্তরে উন্নিত
নাও হতে পারে।
উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত
আলোচনার মানদন্ডে এটা স্পষ্ট যে, বর্তমান যুগে দেশে বর্ণিত শর্তানুযায়ী
আলেমের সংখ্যা খুবই নগন্য। আর মাদ্রাসায় ফারেগ হলেই তাকে আলেম বলা বা সে নিজেকে
আলেম বলে প্রচার করা একটি ভুল প্রথা।
পরিশেষে দুআ করি, আল্লাহ
যেন আমাদের জ্ঞান বাড়িয়ে দেন ও সেই অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দেন। আমীন।
__________________________
লিখেছেনঃ শায়খ
আব্দুর রাকীব মাদানী
দাঈয়ী, দাওয়া
সেন্টার, খাফজী, (সউদী আরব)।