বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৬

প্রিয়নবী মুহা’ম্মাদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে কুরআনুল কারীমের কয়েকটি আয়াতের তর্জমাঃ (পর্ব-২)

প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে কুরআনুল কারীমের কয়েকটি আয়াতের তর্জমাঃ (পর্ব-২)
(১) প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর সর্বপ্রথম যে ওয়াহী নাযিল হয়েছিলো তা হচ্ছেঃ সুরা আল-আলাক্ব এর প্রথম ৫টি আয়াত। এরপর কিছুদিন ওয়াহী আসা বন্ধ ছিলো। একারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুবই অস্থির ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। এরই মাঝে তিনি একদিন আবারও প্রথমবার হেরা গুহায় ওয়াহী নিয়ে আগমনকারী ফিরিশতা (জিব্রাঈল আলাইহিস সালামকে) আসমান ও যমীনের মধ্যস্থলে একটি কুরসীর উপর বসা অবস্থায় (বিশাল আকৃতিতে) দেখেন। এ থেকে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মধ্যে প্রচন্ড ভীতির সঞ্চার হয়। তাই তিনি ঘরে গিয়ে ঘরের লোকদেরকে বললেন, তোমরা আমাকে কোন কাপড় দিয়ে ঢেকে দাও। আমাকে কোন চাদর দিয়ে ঢেকে দাও। ফলে তাঁরা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শরীরে একটি কাপড় চাপিয়ে দিলেন। ঠিক এই অবস্থাতেই আল্লাহ তাআলা সুরাহ আল-মুদ্দাসসিরের এই আয়াতগুলো ওয়াহী হিসেবে নাযিল করেছিলেনঃ
উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম। বিসমিল্লাহির-রাহমানির রাহীম।
১. ইয়া আইয়্যুহাল মুদ্দাসসির! হে চাদরাবৃত (অর্থাৎ, নবী মুহাম্মাদ)!
২. আপনি উঠুন এবং মানুষদেরকে সতর্ক করুন,
৩. আপনি আপনার পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষনা করুন,
৪. আর আপনার পোশাক পবিত্র রাখুন,
৫. এবং (শিরকের) অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকুন।
সুরাহ আল-মুদ্দাসসিরঃ ১-৫।
উৎসঃ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম, সুরা মুদ্দাসসির ও ঈমান অধ্যায়।
(২) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন, সুন্নাহ বা হাদীস, অর্থাৎ যা কিছু দ্বীন হিসেবে মানুষের মাঝে প্রচার করেছেন, সেইগুলো তিনি নিজে বানিয়ে, আন্দাজে বা মনগড়া কোন কথা বলতেন না। আল্লাহ তাআলা তাঁকে যেই ওয়াহী (প্রত্যাদেশ) করতেন, তিনি সেটাই মানুষের মাঝে প্রচার করতেন।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আর তিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না। বরং তিনি শুধুমাত্র তাই বলেন, যা তাঁকে ওয়াহী হিসেবে প্রেরণ করা হয়। সুরা আন-নাজমঃ ৩-৪।
(৩) কাফের-মুশরেকরা মনে করতো কুরআনুল কারীম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রচিত, বা তিনি ইচ্ছা করলেই এর মাঝে ইচ্ছামতো পরিবর্তন করতে পারবেন, নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক। তাই মুশরেকরা তাঁর কাছে কখনো এমন আবদার করেছিলো যে, হে মুহাম্মদ! তোমার এই কুরআন আমাদের পক্ষে মানা সম্ভব না। সুতরাং, তুমি এই কুরআনের পরিবর্তে অন্য কুরআন আমাদের কাছে নিয়ে আসো, তাহলে আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনবো।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আর যখন তাদের সামনে আমার আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে পাঠ করা হয়, তখন যারা আমার সাক্ষাতের ভয় করে না, তারা বলে, এটা ছাড়া অন্য কোন কুরআন নিয়ে আস। অথবা এই কুরআনের মাঝে পরিবর্তন কর। (হে নবী!) আপনি তাদেরকে বলে দিন, আমার জন্য এটা সম্ভব নয় যে, আমি নিজের পক্ষ হতে এই কুরআনের মাঝে কোন পরিবর্তন করি। আমার প্রতি যা ওয়াহী হয়, আমি তো কেবল তারই অনুসরণ করি। (তোমাদের কথা শুনে কুরআনের মাঝে কোন পরিবর্তন এনে) আমি যদি আমার প্রতিপালকের অবাধ্য হই, তাহলে আমি (নিজের জন্য) এক অতি ভীষণ দিনের শাস্তির আশংকা করি। সুরা ইউনুসঃ ১৫।
মুশরেকদের এমন উদ্ভট, অন্যায় ও অসম্ভব আবদারের প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেনঃ এই (কুরআন) বিশ্বজগতের প্রতিপালক (আল্লাহর) নিকট হতে অবতীর্ণ। সে (মুহাম্মদ) যদি নিজে থেকে কিছু রচনা করে আমার নামে চালানোর চেষ্টা করত, তবে আমি অবশ্যই তাঁর ডান হাত ধরে ফেলতাম, এবং তাঁর জীবন-ধমনী কেটে দিতাম। অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে, তাঁকে (আমার পাকড়াও থেকে) রক্ষা করতে পারত। সুরা আল-হাক্কাহঃ ৪৩-৪৭।
(৪) মৃত ব্যক্তি, সে যেই হোক, যত বড় অলি-আওলিয়া হোক না কেনো, তারা আমাদের এই দুনিয়ার মানুষের কোন কথা শুনতে পারেনা। এমনকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও মৃত ব্যক্তিদেরকে শুনাতে সক্ষম ছিলেন না।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আর সমান নয় জীবিত ও মৃত। আল্লাহ শ্রবণ করান যাকে ইচ্ছা তাকে। (হে নবী!) আপনি কবরে শায়িত (মৃত) ব্যক্তিদেরকে শুনাতে সক্ষম নন। সুরা ফাতিরঃ ২২।
(৫) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিচার-ফয়সালা, আদেশ-নিষেধ সমূহ কেনো, কিভাবে এধরণের কোন প্রশ্ন ব্যতিরকে, বিনা দ্বিধায়, সন্তুষ্ট হৃদয়ে গ্রহণ না করা পর্যন্ত একজন মানুষ কক্ষনো ঈমানদার হতে পারবেনা।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ অতএব, (হে নবী! আমি আল্লাহ) আপনার পালনকর্তার কসম করে বলছি, সেই লোক ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে (নবীকে) ন্যায়বিচারক হিসেবে গ্রহণ না করে। অতঃপর আপনার (নবীর) দেওয়া ফয়সালার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম আপত্তি থাকে না, এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নিবে। সুরা আন-নিসাঃ ৬৫।
(৬) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪০ বছর বয়সে নবুওতপ্রাপ্ত হয়ে সর্বপ্রথম মক্কায় তাঁর দাওয়াতী কাজ শুরু করেছিলেন। মক্কার লোকেরা ছিলো তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্বীয়-স্বজন, নিজ গোত্র, বংশ কিংবা জাতির লোক। যদিও ইতিঃপূর্বে মক্কার কাফের-মুশরকেরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একান্ত বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করতো, এমনকি তাঁকে আল-আমীন অর্থাৎ, অত্যন্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তি উপাধিও দিয়েছিলো। কিন্তু তিনি যখন নবুওত প্রাপ্ত হয়ে এক আল্লাহ ইবাদতের জন্যে, ঈমান-ইসলামের দিকে দাওয়াত দিলেন, তখন অধিকাংশ মানুষ তাঁকে অস্বীকার করে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জাতির লোকদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ মুজিজাহ আল-কুরআন দিয়ে, বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক, দলিল-প্রমান, অতীতের জাতিদের উপর নাযিলকৃত আসমানী কিতাব সমূহে তাঁর নবুওতের সাক্ষীর বর্ণনা দিয়ে তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন, তাদেরকে ঈমানের দিকে দাওয়াত দিলেন। এতোকিছুর পরেও তাঁর জাতির লোকদের মাঝে হাতে গোনা অল্প কজন ছাড়া অধিকাংশ লোকই যখন কুফুরীতে লিপ্ত হলো, তাদের এহেন হঠকারীমূলক আচরণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খুব কষ্ট দিতো। তিনি খুব আশা করতেন, তাঁর জাতির লোকেরা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করবে, অন্য জাতির কাছে তাঁর দাওয়াত পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে। কিন্তু তাঁর এই ইচ্ছা পূরণ হবার ছিলোনা, তাই আল্লাহ তাআলা তাঁকে বলেছিলেনঃ
(হে নবী!) আপনি যতই আকাংখা করুন না কেনো, অধিকাংশ লোকই ঈমান আনবে না। সুরা ইউসুফঃ ১০৩।
কাফের-মুশরেকরা ঈমান না আনার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতো কষ্ট পেতেন এবং পেরাশানিতে ভুগতেন যে, আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা স্বরূপ এই কথা বলেছিলেন,
(হে নবী!) তারা এই বাণী (কুরআনের প্রতি) ঈমান না আনার তাদের পিছনে পিছনে ঘুরে দুঃখে আপনি সম্ভবত নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবেন। এই দুনিয়ার উপরে যা কিছু আছে, আমিতো সেগুলিকে দুনিয়ার জন্যে সৌন্দর্য করেছি, যাতে করে মানুষকে এই পরীক্ষা করবার জন্য যে, তাদের মধ্যে কর্মে কে উত্তম। সুরা আল-কাহফঃ ৬-৭।
এই আয়াতগুলো দ্বারা আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝাচ্ছেনঃ দুনিয়ার জীবন মানুষের জন্যে পরীক্ষা। আর আপনিতো শুধুমাত্র একজন সতর্ককারী, উপদেশদাতা মাত্র। আপনার দাওয়াত আপনি দিয়ে যান, যে গ্রহণ করবে সে নিজের উপকার করবে, যে প্রত্যাখ্যান করবে সে নিজেরই ক্ষতি করবে। তাদের কারণে আপনি কষ্ট পাবেন না।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ হে রসুল! তাদের জন্যে দুঃখ করবেন না, যারা দৌড়ে গিয়ে কুফরে পতিত হয়। সুরা আল-মায়িদাহঃ ৪১।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেনঃ তাদের (আপনার বিরোধীতাকারী কাফের মুশরেকদের) আচরণে আপনি দুঃখ করবেন না, এবং তাদের ষড়যন্ত্রে মনোঃক্ষুণ্ণ হবেন না। সুরা আন-নামালঃ ৭০।
(৭) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম প্রেরিত হয়েছিলেন আরবদের কাছে, আর তাদের ভাষা ছিলো আরবী। সেইজন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভাষা ও কুরআনের ভাষাও আরবী হওয়া জরুরী ছিলো। যাতে করে লোকেরা সহজেই নবীর কথা ও কিতাবের ভাষা বুঝতে পারে। এবং নবী ও কিতাবের ভাষা বুঝতে পারিনি একথা বলে কেউ তাঁর দাওয়াতকে অস্বীকার করতে বা তা থেকে দূরে থাকতে না পারে। কিংবা ভাষাগত বুঝের কারণে দাওয়াতী কাজে কোন বিভ্রান্তি না ঘটে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি সব নবীকেই তাদের নিজ জাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে করে তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারে। সুরা ইবরাহীমঃ ৪।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন, আলিফ লা-ম রা। এইগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত। নিশ্চয় আমি এই (কিতাবকে) অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায়, কুরআনরূপে, যাতে করে তোমরা বুঝতে পার। সুরা ইউসুফঃ ১-২।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন, আমি যদি অনারবদের কোন ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করতাম, তাহলে তারা অবশ্যই বলত, এই (কিতাবের) আয়াতগুলি (বোধগম্য ভাষায়) বিবৃত হয়নি কেন? কি আশ্চর্য যে, এর ভাষা অনারব, অথচ রসুল আরবী! (হে নবী!) আপনি বলুন, ঈমানদার লোকদের জন্য এই (কুরআন) হুদা (পথনির্দেশক) ও শিফা (রোগের চিকিৎসা)। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা, এবং কুরআন হবে তাদের জন্য অন্ধকার স্বরূপ। এরা এমন যে, যেন এদেরকে বহুদূর হতে আহবান করা হয়। সুরা হা মীম সাজদাহঃ ৪৪।
(৮) আল্লাহ তাআলা প্রতিটি মুসলমান ব্যক্তিকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য বিশেষ আদব, শ্রদ্ধা, ভক্তি ও মর্যাদা-সম্মান নিবেদন করতে আদেশ করেছেন। এজন্যে আল্লাহ তাআলা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগে বেড়ে কোন কাজ করা, কিংবা নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো দ্বীনের ব্যপারে তাঁর চাইতে কম-বেশি করতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করছেন। এমনিভাবে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপস্থিতিতে আমরা স্বাভাবিকভাবে যতটা উঁচু স্বরে কথা বলি, তাঁর সামনে সেইভাবে উঁচু স্বরে কথা বলতে আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন। যারা অবহেলাবশত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি এই সম্মান প্রদর্শনে ত্রুটি করবে, তাদের অজান্তেই তাদের সমস্ত আমল বর্বাদ হয়ে যেতে পারে বলে আল্লাহ কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। আর যারা নবীকে এই সম্মান প্রদর্শন করবে, তাদের অন্তরকে আল্লাহ শুদ্ধ করে দেবেন এবং তাদের জন্যে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার রয়েছে বলে ওয়াদা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও রসুলের সামনে অগ্রণী হয়োনা, এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবীর কন্ঠস্বরের উপর তোমাদের কন্ঠস্বর উঁচু করো না, এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো, তাঁর সাথে সেইরূপ উঁচুস্বরে কথা বলোনা। এতে এমন হতে পারে যে, তোমাদের সমস্ত আমল নিস্ফল হয়ে যাবে, অথচ তোমরা সামান্য টেরও পাবে না। যারা আল্লাহর রসুলের সামনে নিজেদের কন্ঠস্বরকে নীচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাক্বওয়ার জন্যে শুদ্ধ করে দিয়েছেন। তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। সুরা আল-হুজুরাতঃ ১-৩।
(৯) প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় অধিকাংশ মানুষই নিজের বাবার বা দাদার বাড়িতে বড় হয়। একারণে মানুষ নানা-নানীর চাইতে দাদা-দাদীর সাহচর্য বেশি পায়। স্বাভাবিকভাবেই সন্তানেরা বড় হয়ে নানা-নানীর চাইতে দাদা-দাদীর কথাই বেশি স্বরণ করে। একারণে অনেকে মেয়ের চাইতে ছেলে সন্তানের আকাংখা বেশি করে, যাতে করে ছেলের মাধ্যমে তার নিজের বংশধারা ও মানুষের মাঝে তার নাম জারী থাকে। আসলে ছেলে বা মেয়ে, উভয়ের সন্তানই একজন মানুষের বংশ। কিন্তু যেহেতু সমাজের মানুষ ছেলের বংশধারাকে বেশি গুরুত্ব দেয়, একারণে আরবরা কোন ব্যক্তির ছেলে সন্তান না থাকলে বা একমাত্র ছেলে সন্তান জন্ম নেওয়ার পরে মৃত্যুবরণ করলে তাকে আবতার বলে হেয় করতো। কারণ তারা মনে করতো, ছেলে সন্তান না থাকলে ঐ ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তাকে স্বরণ করার মতো তার বংশধর বাকি থাকবেনা।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রথম স্ত্রী, যোগ্যতম সংগিনী মা খাদীজাহ রাদিয়াল্লাহু আনহার গর্ভে পরপর চারটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিলো। তাঁদের পঞ্চম সন্তান হয়েছিলো একটি ছেলে, যার নাম রাখা হয়েছিলো আব্দুল্লাহ। কিন্তু আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর অনুযায়ী সেই ছেলে সন্তানটি বেশিদিন বেঁচে ছিলোনা, শৈশবেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনে এটা খুব দুঃখজনক একটা ঘটনা হলেও ইসলাম এবং তাঁর সর্বশেষ নবীর শত্রুরা এতে খুব আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করলো এবং এনিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা আরম্ভ করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ঘোরতর শত্রুতা পোষণকারী আস ইবনে ওয়াইল তাঁর প্রসংগে কোন কথা শুনলেই বিদ্রুপ করে বলতো, মুহাম্মদের কথা রাখো! সেতো একজন আবতার (যার কোন পুত্র সন্তান নেই)। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর নাম-নিশানা শেষ হয়ে যাবে। (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)। কাফের-মুশরেকদের এধরণের কথার জবাব দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
১. নিশ্চয়ই আমি আপনাকে (হাউজে) কাউসার (অথবা প্রভূত কল্যাণ) দান করেছি।
২. সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায আদায় করুন এবং কুরবানী করুন।
৩. নিশ্চয়ই আপনার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী (শত্রুরাই) হচ্ছে আবতার।
সুরা আল-কাউসারঃ ১-৩।
এই সুরাটিতে আল্লাহ তাআলা কাফের মুশরেকদের ঠাট্টা-বিদ্রুপের জবাব দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই বলে সান্ত্বনা দিলেন যে, আপনি তাদের কথা কষ্ট পাবেন না, আমিতো আপনাকে মর্যাদাপূর্ণ কাউসার দান করেছি। এই কাউসারের কি অর্থ, সেটা নিয়ে আলেমদের দুইটি মত রয়েছে।
এক. হাউজে কাউসার বা পানির ঝরণা।
দুই. প্রভূত কল্যাণ।
ইমাম ইবনে কাসীর (রহঃ) প্রভূত কল্যাণ অর্থটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ, এই অর্থ নেওয়াতে এমন ব্যাপকতা রয়েছে, যাতে অন্যান্য অর্থও শামিল হয়ে যায়। যেমন সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, কাউসার এটা একটি ঝরণা, যা জান্নাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দান করা হবে। কোন কোন হাদীসে কাওসার বলতে হাওয বুঝানো হয়েছে। যে হাওয হতে ঈমানদাররা জান্নাতে যাওয়ার পূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুবারক হাতে পানি পান করবে। জান্নাতের ঐ ঝরণা বা নহর থেকেই পানি সেই হাওযের মধ্যে আসতে থাকবে। অনুরূপ দুনিয়ার বিজয়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মর্যাদা ও খ্যাতি, চিরস্থায়ীভাবে তাঁর সুনাম এবং আখেরাতের প্রতিদান ও বিনিময় ইত্যাদি সমস্ত জিনিসই প্রভূত কল্যাণ এ শামিল হয়ে যায়। তাফসীর ইবনে কাসীর, সুরা কাউসার।
নিশ্চয়ই আপনার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী (শত্রুরাই) হচ্ছে আবতার। - এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ তাআলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আপনি নির্বংশ নন; বরং আপনার দুশমনেরাই নির্বংশ হবে। সুতরাং, মহান আল্লাহ তাঁর বংশকে তাঁর কন্যার পরম্পরা দ্বারা বাকী রেখেছেন। এছাড়া তাঁর উম্মতও তাঁর আধ্যাত্মিক সন্তানের পর্যায়ভুক্ত, যাদের আধিক্য নিয়ে তিনি কিয়ামতে অন্যান্য উম্মতের উপর গর্ব করবেন। এ ছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাম সারা বিশ্বে বড় শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে নেওয়া হয়। পক্ষান্তরে, তাঁর শত্রুদের নাম শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতাতেই লেখা পড়ে আছে। কারো অন্তরে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নেই এবং কারো মুখে প্রশংসার সাথে তাদের নাম উল্লেখ হয় না।
উৎসঃ তাফসীর আহসানুল বায়ান, সুরা কাউসার।
(১০) মানুষ যখন কারো কটু কথা, বাজে মন্তব্য বা ঠাট্টা-বিদ্রুপ, মিথ্যা অপবাদের কারণে খুব বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন অনেক সময় কষ্টে বুকটা সংকুচিত হয়ে আসে। কাফের-মুশরিকরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মিথ্যাবাদী, যাদুকর, পাগল, কবি, উন্মাদ, গণক ইত্যাদি মিথ্যা অপবাদ দিত। আর মানুষ হওয়ার কারণে আমাদের মতো তিনিও এসব কথায় দুঃখ পেতেন, মুশরিকদের কটু কথার কারণে তাঁর বুক সংকুচিত হয়ে যেত। মহান আল্লাহ সান্ত্বনা দিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, আমি জানি তাঁদের কথার কারণে আপনার হৃদয় সংকুচিত হয়ে আসে। কিন্তু আপনি সেইগুলোর দিকে লক্ষ্য না করে, আপনি আমার প্রশংসা করুন, নামায পড়ুন এবং আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হন। এর দ্বারা আপনার অন্তর শান্তি লাভ করবে এবং আল্লাহর সাহায্য আসবে।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আমি তো অবশ্যই জানি যে, তারা যেই কথা বলে তার কারণে আপনার হৃদয় সংকুচিত হয়ে যায়। সুতরাং, আপনি আপনার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হন। আর আপনার ইয়াকীন (দৃঢ় বিশ্বাস) উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত আপনি আপনার প্রতিপালকের ইবাদত করুন। সুরা আল-হিজরঃ ৯৭-৯৯।
এখানে সিজদাকারী বলতে নামায পড়ার আদেশ এবং ইয়াকীন বলতে মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে।
যারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে, তাদের জন্যে স্বয়ং আল্লাহই যথেষ্ঠঃ সুতরাং (হে নবী!) আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন, তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন এবং মুশরিকদেরকে উপেক্ষা করুন। আপনার বিদ্রূপকারীদের বিরুদ্ধে আপনার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। সুরা আল-হিজরঃ ৯৪-৯৫।
(১১) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে অনুগ্রহ করে আল্লাহ তাআলা নবী বানিয়েছেন, তাঁর পূর্বের ও পরের সমস্ত ভুল-ত্রুটি মাফ করে দিয়েছেন, দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান দান করেছেন. . .এমন আল্লাহর অসংখ্য অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত তিনি বেশি বেশি নফল ইবাদত করতেন। রাতের বেলায় তিনি এতো দীর্ঘ সময় ধরে তাহাজ্জুদ নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেতো। আল্লাহর ভয়ে তিনি এতো বেশি কান্নাকাটি করতেন যে, তাঁর চেহারা, শরীর, নামাযের স্থানের সামনে মাটি পর্যন্ত চোখের পানিতে ভিজে যেত। তাঁর দেখাদেখি তাঁর বিশ্বস্ত সাহাবীরাও কুরআনুল কারীমের উপর আমল করা শুরু করে দেন। এতে মুশরিকরা বলাবলি শুরু করলো, (কুরআনুল কারীম নাযিলের কারণে) এই লোকগুলো তো বেশ বিপদে পড়ে গেলো।
তখন আল্লাহ তাআআলা এই আয়াত নাযিল করেছিলেন, ত্বোয়া হা। (হে নবী!) আমি তো এই কুরআন আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আপনার উপর নাযিল করিনি। বরং (আমি এই কুরআন নাযিল করেছি) এমন ব্যক্তিকে উপদেশ দেওয়ার জন্য, যে (আল্লাহকে) ভয় করে। সুরা ত্বোয়া হাঃ ১-৩।
অর্থাৎ, মানুষকে কষ্ট দেওয়া ও বিপদে ফেলার জন্যে কুরআন নাযিল হয় নাই। বরং এটা সৎ লোকদের জন্যে শিক্ষণীয় বিষয়। 
আসুন আমরা সকলেই পড়িঃ
আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়া-আলা আলি মুহাম্মাদ, কামা সাল্লাইতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া-আলা আলি ইব্রাহীম, ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিওঁ ওয়া-আলা আলি মুহাম্মাদ, কামা বারা-কতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া-আলা আলি ইব্রাহীম, ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ।