সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৭

লজ্জা ছাড়া, তাক্বওয়া ছাড়া মিলবে কি সেই সফলতা?

টিভি, ফেইসবুক, ইন্টারনেট, ইউটিউব সহ আধুনিক যুগের বিভিন্ন মিডিয়াগুলোতে থেকে জনপ্রিয়তা পাওয়া অল্প ইলম সম্পন্ন, সেলেব্রিটি বক্তা ও লিখকদের কাছ থেকে যারা দ্বীন শিখে থাকেন, তাদের অনেকে আলেমদের মর্যাদা ও গুরুত্বকে অস্বীকার করেন, কথায় কথায় আলেমদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। তাদের অনেকের স্লোগান হচ্ছেঃ
(ক) আমি শুধু কুরআন ও হাদীস মানি, কোন আলেমের তাকলীদ করিনা।
(খ) শুধু কুরআন ও হাদীসই যথেষ্ঠ, শরিয়ত মানার জন্য কোন আলেম লাগে না।
(গ) আলেমদেরকে মানা হারাম।
যদিও তারা নিজেরা কুরআন ও হাদীস বুঝে না, বুঝার মতো যোগ্যতা তাদের নেই, কিন্তু দুই-চারজন বক্তার টুটা-ফাটা কিছু বক্তব্য গ্রহণ করে তোতা পাখির মতো বুলি আওড়ান। এইভাবে তারা মনে করছেন, তারা কুরআন-হাদীস মানছেন, অথচ প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে তারা আসলে তাদের বক্তা সাহেবের অন্ধ অনুকরণ করছেন। অনেকে আবার অল্প ইলমের উপর সওয়ার হয়ে নিজে নিজে ফতোয়া বিলি করে বেড়ান, এইভাবে নিজেরা পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হচ্ছেন, অন্যদের জন্য ফিতনা সৃষ্টি করছেন। এমন ব্যক্তিদের বক্তব্যের অসারতা তুলে ধরে শায়খ মুজাম্মেল হক্ক হাফিজাহুল্লাহ লিখেছেনঃ
লজ্জা ছাড়া, তাক্বওয়া ছাড়া মিলবে কি সেই সফলতা?
আলেমের মুল্য সকল সৃষ্টির উপরে মুসলমান হয়ে তা অস্বীকার করার উপায় নাই আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন
(১) সে আমার উম্মতের কেউনা, যে বড়দের সম্মান করেনা, ছোটদের স্নেহ করেনা এবং আলেমদের অধিকার বুঝেনা সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম
(২) আলেমের সম্মান আবেদের তুলনায় এমন, যেমন নাকি আমার সম্মান তোমাদের মধ্যে অতি সাধারন একটি মানুষের উপর সুনানে তিরমিযী।
(৩) আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতারা, আসমান ও জমিনের সকল বাসিন্দা, এমনকি গর্তের একটি পিঁপড়া এবং পানির নীচের মাছগুলিও সেই আলেমের জন্যে দুয়া করে, যিনি মানুষকে উত্তম শিক্ষা দান করেন সুনানে তিরমিযী।
(৪) আল্লাহ আলেমদেরকে তার তাওহীদ (একত্ববাদের) পক্ষে সাক্ষী বানিয়েছেন, ফেরেশতাদের পরেই স্থান দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাআআল বলেন, আল্লাহ সাক্ষ্য দেন, তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই ফেরেশতা এবং আলেমগন ইনসাফের ভিত্তিতে উক্ত সাক্ষ্য প্রদান করেন সুরা আলে-ইমরানঃ ১৮
(৫) (যেসব উপমা দেওয়া হলো, তা) আলেমগন ছাড়া কেউ বুঝবেনা সুরা আনকাবুতঃ ৪৩
(৬) সকল বান্দাদের মধ্যে আলেমগনের আল্লাহ ভীতিই হচ্ছে প্রকৃত ভীতি সুরা ফাতিরঃ ২৮
(৭) যে জানে, আর যে জানেনা, তারা কি কখনো সমান হতে পারে?
(৮) যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় অনেক উঁচু করবেন সুরা মুজাদালাঃ ১১
বর্তমান যুগে অনেকের মনোভাব এমন রয়েছে, মনে হয় যেন আলেমের মানহানি করতে, মূল্য হ্রাস করতে, আলেমদেরকে একঘরে করতে শয়তানের সম্মিলিত বাহিনী আদা-জল খেয়ে লেগেছে! ঝাঁক ঝাঁক মুন্সি সাহেব (ইলম বিহীন নকলকারী ব্যক্তি) কোত্থেকে উড়ে এসে আলেম-উলামার স্থানে জুড়ে বসছেন (মুন্সি সাহেবরা) খুতবাহ দিচ্ছেন, আর আলেম-ফকীহ তাদের কথা শুনতে বাধ্য হচ্ছেন মুন্সিরা নামায পড়ান, আর আলেম মুক্তাদী হয়ে পিছনে দাঁড়ান মুন্সিরা মজলিসের রওনাক, আর ELOQUENT (বাক্যবাগীশ) আলেম ও বক্তা তাদের কথাগুলো গলাধঃকরন করার চেষ্টা করেন তাদের কেউ দুই-একদিন টোপলা নিয়ে ঘুরেছেন কেউ কয় ক্লাস স্কুল-কলেজে সাইয়েন্স, অংক, ইতিহাস পড়ে ফকীহ হয়েছেন! তারা কুরআনের তাফসীরও করেন, উম্মতকে দিক-নির্দেশনা দেন, ইসলামী দর্শনের জন্ম দেন তারা আলেমদেরকে কোন কাজের যোগ্য মনে করেন না, এমন কি দ্বীনের কাজেও না আলেমরা দ্বীন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, অনেকে এমনটি বলেও থাকেন তারা আলেম উলামার দাঁত দেখেন, সাইজ মাপেন আলেমদেরকে নিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমন ব্যংগ-বিদ্রুপ করেন 
এমন মুন্সি সাহেবরা যেমন আলেমদের স্থান দখল করে নিজদেরকে আলেমদের থেকে দূরে রাখছেন, তেমনি জনগণকেও আলেম থেকে সরিয়ে রাখছেন এটাই প্রকৃত সাদ্দুন আন সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা, যা আল্লাহর কিতাবে বলা হয়েছে
প্রশ্ন জাগে, এমন ব্যক্তিদের আদৌ কোন লজ্জাবোধ আছে কি? আদৌ তাঁরা আল্লাহকে ভয় করেন কি? তাক্বওয়া ও লজ্জাবোধ ছাড়া মুত্তাক্বী হওয়ার কোন বিকল্প রাস্তা আছে কি? মুত্তাক্বী না হতে পারলে, কেয়ামতে সফলতা লাভের কোন চোরা-গলি আছে কি?

এমনই যদি চলতে থাকে, তাহলে আল্লাহর গজব থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে কি? দ্বীনের ব্যপারে এমন প্রতিবন্ধকতা যারা সৃষ্টি করে, আর যারা তাদের ব্যপারে নীরবতা অবলম্বন করে, সকলেই কি সমান দায়ী নয়?

দ্বীনি জ্ঞানের পরীক্ষা (পর্ব-১)

দ্বীনি জ্ঞানের পরীক্ষা (পর্ব-১)
পূর্ণ নম্বরঃ ৩০, সময় ৩০ মিনিট। আপনারা প্রথমে উত্তর না দেখে নিজেরা একটা খাতায় উত্তর লিখার চেষ্টা করুন। এরপরে প্রদত্ত উত্তরের সাথে মিলিয়ে আপনাদের প্রাপ্ত নম্বর বের করুন।
এক কথায় উত্তর দিনঃ
প্রতিটি প্রশ্নের জন্যে এক নম্বর করে, মোট ১৫*১=১৫ নম্বর 
(১) কুআনের কোন সুরাটিকে উম্মুল কিতাব বলা হয়?
(২) হাদীসে কুদসী কি?
(৩) কোন আয়াতে সুদকে হারাম করা হয়েছে?
(৪) হুদাইবিয়ার সন্ধি কত হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিলো?
(৫) মুসলিমদের প্রথম লিখিত সংবিধান কোনটি?
(৬) কোন সুরাতে বিসমিল্লাহ-হির রাহমানির রাহীম দুইবার রয়েছে?
(৭) ইয়াসরিব কি?
(৮) মুজাদ্দিদ কে? ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মুজাদ্দিদ কাকে বলা হয়?
(৯) কাকে যিন-নুরাইন বলা হয়?
(১০) বনী ঈসরাইলীদের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত খাবারের নাম কি ছিলো?
(১১) তাজবীদ কি?
(১২) রুহুল্লাহ বলা হয় কোন নবীকে?
(১৩) সিহাহ সিত্তাহ এবং সহীহাইন কি?
(১৪) রিদ্দা বা মুর্তাদদের যুদ্ধ কোন খলিফার সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো?
(১৫) কুনে মোট কতটি সুরা এবং কতগুলো আয়াত রয়েছে?
রচনামূলক অংশঃ
(১৬) আল্লাহর গুণবাচক নাম সমূহের অর্থ কি? ৫*০.৫ = ২.৫
(ক) আর-রাহীম, (খ) আল-ওয়াদুদ, (গ), (৪) আস-সামী (৫) আল-বাসীর
নিচের প্রশ্নগুলোর উপর সংক্ষিপ্ত নোট লিখুনঃ প্রতিটি প্রশ্নের জন্যে ২.৫ করে, মোট ৫*২.৫= ১২.৫
(১৭) তায়াম্মুম কখন, কিভাবে করতে হয়?
(১৮) ঈমানে মুফাসসাল এর বিষয়গুলো কি কি?
(১৯) ঈমান ও ইসলাম বলতে কি বোঝায় এবং তাদের পার্থক্য কি?
(২০) শরিয়তের মূল উৎস কয়টি ও কি কি?
(২১) ফিরকায়ে নাজিয়াহ কি? ফিরকায়ে নাজিয়াহ এর নাম কি?
____________________________
প্রশ্নগুলোর উত্তরঃ
() সুরা ফাতিহামর্যাদা এবং গুরুত্বের দিক থেকে সবচাইতে বড় ও মহান সুরা হচ্ছে সুরা ফাতিহা। একারণে এই সুরাটিকে উম্মুল কিতাব বলা হয় 
() আল্লাহর যেই ওয়াহী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজ জবানে হাদীস হিসেবে বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোকে হাদীসে ক্বুদসী বলা হয়হাদীসে ক্বুদসীর কথাগুলো আল্লাহর, কিন্তু তা কুরআনের অংশ নয়।
() কয়েকটি আয়াতে সুদকে হারাম করা হয়েছে, যার মাঝে সুরা বাক্বারার ২৭৮ নাম্বার আয়াত উল্লেখযোগ্য
() ষষ্ঠ হিজরীতে
() মদীনা সনদ
() সুরা নমল-এ। এই সুরার প্রথমে ও মাঝখানে বিসমিল্লাহ-হির রাহমানির রাহীম দুইবার রয়েছে।  
() মদীনাতুর-রাসুল বা সংক্ষেপে মদীনাহ শহরের পূর্ববর্তী নাম ছিলো ইয়াসরিব 
() মুজাদ্দিদ অর্থ সংস্কারক বা পুনঃপ্রবর্তনকারী যখন সমাজে ইসলামের বিধি-বিধান ব্যপকভাবে লংঘন করা হয় তখন কোন খলিফা, আমীর বা আলেম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মাধ্যমে কিংবা দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে ব্যপকভাবে সমাজ সংস্কার ও লোকদের ইসলাহ বা সংশোধনের কাজ করলে তাকে মুজাদ্দিদ বলা ইসলামের ইতিহাসে তাবেয়ীদের যুগে খলিফা উমার ইবনে আব্দুল আজীজ রাহিমাহুল্লাকে প্রথম মুজাদ্দিদ ধরা হয় (খুলাফায়ে রাশেদীনের উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু নয়)
() খুলাফায়ে রাশেদীনে তৃতীয় খলিফাহ, উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহুকেরাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দুই কন্যাকে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুসাথে বিয়ে দিয়েছিলেন, একারণে তাঁকে যিন-নুরাইন বলা হত, অর্থ দুইটি নূর বা আলোর অধিকারী 
(১০) মান্না ও সালওয়া
(১১) কুরআন শুদ্ধ করে পাঠ করার পদ্ধতিকে তাজবীদ বলা হয়
(১২) ঈসা আলাইহিস সালামকে
(১৩) সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আবু দাদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ এই ছয়টি হাদীসের কিতাবকে একত্রে সিহাহ সিত্তাহ বলা হয়সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম এই দুইটি সহীহ হাদীসের গ্রন্থকে একত্রে সহীহাইন বলা হয় 
(১৪) খুলাফায়ের রাশেদীনের প্রথম খলিফাহ আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতের সময়রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর কিছু মানুষ ঈমান, নামায, রোযাকে মেনে নেয়, কিন্তু তারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিলো। যাকাত দিতে অস্বীকার করার কারণে আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে মুর্তাদ ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন একে রিদ্দার যুদ্ধ বলা হয় 
(১৫) ১১৪-টি সুরা, ৬২৩৬-টি আয়াত। যারা বিশ্বাস করবেন না, তারা নিজেরা বাসায় কুরআনুল কারীম খুলে সবগুলো সুরার আয়াত সংখ্যা যোগ করে দেখুন।  
(১৬) (ক) আর-রাহীম = অসীম দয়ালু, (খ) আল-ওয়াদুদ = যিনি স্নেহ বা ভালোবাসাময়, (গ) আল-হাইয়্যু = চিরঞ্জীব, (ঘ) আস-সামী = যিনি সবকিছু শুনেন/সর্বশ্রোতা, (ঙ) আল-বাসীর = যিনি সবকিছু দেখেন/সর্বদ্রষ্টা 
(১৭) তায়ম্মুম কখন করতে হয়ঃ পানি না পাওয়া গেলে কিংবা, পানি ব্যবহার করলে অসুস্থতা বৃদ্ধি পাবে, এমন আশংকা থাকলে পানি দিয়ে ওযু বা গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম বা মাটি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা যায়
তায়ম্মুম কিভাবে করতে হয়ঃ (ক) তায়ামুম বা মাটি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের জন্য নিয়ত করতে হবে (খ) প্রথমে দুই হাত মাটিতে স্পর্শ করতে হবে, ফুঁ দিয়ে ধূলা-বালি ফেলে দিতে হবে (গ) দুই হাত দ্বারা মুখমন্ডল মাসাহ করতে হবে (ঘ) এক হাত দিয়ে অন্য হাতের কবজি পর্যন্ত মাসাহ করতে হবে, প্রথমে ডান হাত পরে বাম হাত 
(১৮) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাব সমূহের প্রতি বিশ্বাস, নবী-রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস, তাক্বদীরের ভালো-মন্দের প্রতি বিশ্বাস, মৃত্যুর পরের জীবন বা আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস, কিয়ামত বা বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস 
(১৯) এটার বিস্তারিত পরে লিখবো ইন শা আল্লাহ
(২০) সঠিক হচ্ছে শরিয়তের মূল উৎস দুইটিঃ কুন ও হাদীস তবে আমাদের দেশে পড়ানো হয় চারটি কু, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস। প্রকৃতপক্ষে ইজমা ও কিয়াস শরীয়তের মূল উৎস হয়, কারণ ইজমা ও কিয়াসের উৎস হচ্ছে কুন ও সুন্নাহ এছাড়া ইজমা ও কিয়াস এদুটি কুন ও সুন্নাহর উপর নির্ভরশীল 

(২১) মুসলিমদের মাঝে মোট ৭৩-টি দলের মাঝে একটিমাত্র নাজাতপ্রাপ্ত দলকে ফিরকায়ে নাজিয়া বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল বলা হয় প্রাচীনকাল থেকে মুসলিমদের মাঝে নাজাতপ্রাপ্ত দলটি আহলুস-সুন্নাহ, কখনোবা আহলুল-হাদীস নামে পরিচিত হয়ে আসছে। 

সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৭

ডা. জাকির নায়েক (পর্ব-২)

ডা. জাকির নায়েক (পর্ব-২)
(১) ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন রাহিমাহুল্লাহ একজন বিখ্যাত তাবেয়ী। তিনি ১১১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেছিলন। আজ হচ্ছে ১৪৩৭ হিজরী। অর্থাৎ, তিনি প্রায় ১৩২৬ বছর পূর্বে আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর একটা কথা খুব বিখ্যাত ও স্বরণযোগ্য। কথাটা এতো গুরুত্বপূর্ণ যে, সহীহ মুসলিমের সংকলক ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ তাঁর সহীহ মুসলিম এর ভূমিকাতেই কথাটা উল্লেখ করেছেন।
ইমাম ইবনে সিরীন রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, মানুষেরা পূর্বে হাদীসের সনদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতোনা। কিন্তু যখন ফিতনাহ এসে পড়ল, তখন তারা বলা শুরু করলেন, তোমাদের হাদীসের রাবী বা বর্ণনাকারীর নাম বল। এরপর কেবল আহলুস সুন্নাহ ব্যক্তিদের হাদীস গ্রহণ করা হত। আর আহলুল বিদআহ হলে তার কাছ থেকে হাদীস গ্রহণ করা হতোনা। সহীহ মুসলিম, মুক্বাদ্দিমাহ অধ্যায়।
আপনার আহলে হাদীস লাইব্রেরী প্রকাশনী কিংবা ইসলামী ফাউন্ডেশান থেকে অনুদিত সহীহ মুসলিমের প্রথম খন্ডের ভূমিকাতেই এই কথাটি খুঁজে পাবেন।
.
(২) ইমাম ইবনে সিরীন রাহিমাহুল্লাহর এই কথার দ্বারা প্রমানিত হয় যে, রাসুলুলাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস মোতাবেক মুসলিমদের মধ্যে যে মোট ৭৩-টি দল-উপদল সৃষ্টি হবে, সেইগুলোর মাঝে একমাত্র নাজাতপ্রাপ্ত দলটি অন্তত ১৩২৬ বছর পূর্ব থেকে নিজেদেরকে আহলুস সুন্নাহ বলে পরিচয় দিয়ে আসছে। ইমাম ইবনে সিরীন রাহিমাহুল্লাহর মৃত্যুর পরে ১৩২৬ বছরের মাঝে মুসলিম উম্মাহর মাঝে নক্ষত্রের মতো যেই সমস্ত আলেম গত হয়েছেন, তাঁদের কয়েকজন হচ্ছেনঃ
- নূমান বিন সাবিত রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ১৫০ হিজরী), যিনি ইমাম আবু হানীফা নামে পরিচিত।
- মালেক বিন আনাস রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ১৭৯ হিজরী), যিনি ইমাম মালেক নামে পরিচিত।
- মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ২০৪ হিজরী), যিনি ইমাম শাফেয়ী নামে পরিচিত।
- আহমাদ ইবনে হাম্বাল রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ২৪১ হিজরী), যিনি ইমাম আহমাদ নামে পরিচিত।
- মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ২৫৬ হিজরী), যিনি ইমাম বুখারী নামে পরিচিত।
- মুহাম্মদ ইবনে আল-হাজ্জাজ রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ২৬৪ হিজরী), যিনি ইমাম মুসলিম নামে পরিচিত।
- ইমাম তাহাবী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৩২১ হিজরী)
- আব্দুল ক্বাদির জিলানী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৫৬১ হিজরী)
- ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৬৭৬ হিজরী)
- ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৭২৮ হিজরী)
- ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৮৫২ হিজরী)
আধুনিক যুগের আলেমদের মধ্যে রয়েছেনঃ
- সৌদি আরবের বিগত প্রধান মুফতি, আল্লামাহ আব্দুল আজিজ বিন বাজ রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ১৪২০ হিজরী)
- বিগত শতাব্দীর প্রধান মুহাদ্দিস, আল্লামাহ নাসির উদ্দীন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ১৪২০ হিজরী)।
.
উপরে যাদের নাম উল্লেখ করা হলো, তাঁরা সকলেই ক্বুরানুল কারীম হিফজ করেছেন, তাঁর আয়াত সমূহ পড়েছেন, বুঝেছেন, সেইগুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং সেই অনুযায়ী উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁদের সকলেই ক্বুরানুল পড়তেন, যেখানে এই আয়াতটিও পড়তেন
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তার চাইতে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে ব্যক্তি মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, নেক আমল করে এবং বলেঃ আমি একজন মুসলিম (আজ্ঞাবহ)? সুরা হা মীম আস-সাজদাহঃ ৩৩।
.
উপরে উল্লেখিত সমস্ত আলেমগণ সুরা হা মীম আস-সাজদাহর ৩৩ নাম্বার আয়াত পড়তে, বুঝতেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত আলেমদের মধ্যে কোন একজন আলেম এই ফতোয়া দেন নি যে,
- ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন রহিমাহুল্লাহ হক্কপন্থী মুসলিমদেরকে আহলুস সুন্নাহ নামে ডেকে ভুল করেছেন।
অথবা,
- নিজেকে আহলুস সুন্নাহ বা সুন্নী নাম বলে পরিচয় দেওয়া যাবে না, দিলে সেটা সুরা হা মীম আস-সাজদাহর ৩৩ নাম্বার আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়।
বরং, উপরে উল্লেখিত সমস্ত আলেমরা ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন রহিমাহুল্লাহর মতোই নিজেকে আহলুস সুন্নাহ বা সংক্ষেপে সুন্নী নামে পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা নিজেরাও আহলুস সুন্নাহর অনুসারীদের আকিদাহ, মূলনীতি, কর্মপদ্ধতি কি, এনিয়ে কত শত বই লিখেছেন।
.
কিন্তু ১৯৬০ সালে পাকিস্থানের মাসুদ আহমেদ বি.এস.সি. নামক জনৈক এক ব্যক্তি জামাতে মুসলিমিন নামে নতুন একটি চরমপন্থী, বিদআতী দল গঠন করলেন এবং মুসলিমদের সামনে এই থিওরী পেশ করলেনঃ
আমাদেরকে শুধুমাত্র মুসলিম বলে পরিচয় দিতে হবে, অন্য কোন নাম (যেমন সুন্নী, সালাফী) নামে পরিচয় দেওয়া চরম অপরাধ।
.
আশা করি, আমার বক্তব্য পরিষ্কার। আর পোস্টের শুরুতে একটা নাম উল্লেখ করেছি, তাঁর নাম কেনো উল্লেখ করলাম, বিস্তারিত উল্লেখ করলাম না। বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের জন্য ইশারাই যথেষ্ঠ।
.
আহলে সুন্নাহ নামে পরিচয় দেওয়া কি ক্বুরানের সাথে সাংঘর্ষিক?
https://www.facebook.com/dawati.kaj/posts/1847270068878483
.
সর্বশেষ, যারা আমাদের পেইজ আনলাইক করতে চান, আমাদেরকে গালি দিতে চান, জ্ঞান ছাড়াই কথা বলে বা তর্ক করে নিজেদের ও আমাদের সময় নষ্ট করতে চান, তাদের জন্য ক্বুরানের একটি আয়াত পেশ করে আজকের মতো এখানেই শেষ করছিঃ
উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম।
(হে নবী!) সুতরাং আপনি আমার বান্দাদেরকে সুসংবাদ দিন। (আমার সেই সমস্ত বান্দাদের জন্যে সুসংবাদ), যারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে, অতঃপর তারা মাঝে যা উত্তম, তার অনুসরণ করে। আল্লাহ তাদেরকেই সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই হচ্ছে সত্যিকারের বুদ্ধিমান সুরা আয-যুমারঃ ১৭-১৮।

.