শনিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬

জান্নাতে যাওয়ার সহজ আমল

জান্নাতে যাওয়ার সহজ আমল

আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন দুর্বলভাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে দুর্বলভাবে। সুরা আন-নিসাঃ ২৮।
মানবিক এই দুর্বলতার কারণে ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, জেনে হোক কিংবা না জেনে, নিজের কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, শয়তানের ধোঁকায় পড়ে, মানুষের চাপে পড়ে, প্রলোভনের শিকার হয়ে, কিংবা বাজে সংগীর সাহচর্যের কারণে মানুষ ছোট কিংবা বড় গুনাহতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। মানুষের এমন অনেক পাপ আছে যা মানুষ বুঝতেই পারেনা যে, কোন কথা বা কাজের কারণে বাম পাশের ফেরেশতা তার আমল নামায় পাপ লিখে ফেলছেন। মানুষ তার এই দুর্বলতা ও পাপে লিপ্ত হওয়ার কারণে, আল্লাহ তাআলার রহমত ছাড়া শুধুমাত্র নিজের আমল দ্বারা মানুষের কেউই জান্নাতে যেতে পারবেনা।
আল্লাহর রহমত ব্যতীত, শুধুমাত্র নিজের আমল দিয়ে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়ঃ
উম্মুল মুমিনিন আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আল্লাহ তাআলার রহমত এবং করুণা ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এমন কোন মানুষ নেই যে, আল্লাহ তাআলার রহমত ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।
তখন আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা আবার জিজ্ঞেস করলেন, এমনকি আপনিও নন ইয়া রাসুলুল্লাহ?
তিনি বললেন, না, এমনকি আমিও না। তবে আল্লাহ তাআলা তাঁর স্বীয় রহমত দ্বারা আমাকে ঢেকে রাখবেন।
এ কথাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনবার বললেন।
সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবিহঃ ৪০৮ পৃষ্ঠা।

মানুষ যাতে আল্লাহর রহমত পেতে পারে, সেইজন্য আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর ইবাদত করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। সেই ইবাদত করে মানুষ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারে, বিনিময়ে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে জান্নাত দিবেন। কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত এমন বিশেষ কিছু ইবাদত বর্ণনা করা হলো, যা মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।

(১) আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে কালেমার সাক্ষ্য দেওয়া ও তার হক্ক আদায় করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে সাক্ষ্য দিয়েছে। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এই সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর রাসুল, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন সহীহ বুখারীঃ ৩৪৩৫, সহীহ মুসলিমঃ ২৮, সুনানে তিরমিযিঃ ২৬৩৮

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এই সাক্ষ্য দান করল যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসুল। ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। তিনি (ঈসা) তাঁর এমন এক কালিমা (বাক্য), যা তিনি মরিয়াম আলাইহিস সালামের প্রতি প্রেরণ করেছেন, এবং তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রূহ বা আত্মা। জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য। সে ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা জান্নাত দান করবেন, তার আমল যাই হোক না কেন। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমঃ ৮০।

(২) শিরক থেকে মুক্ত থাকা এবং তাওহীদের উপরে মৃত্যুবরণ করাঃ
ছোট কিংবা বড়, প্রকাশ্য কিংবা গোপন, সমস্ত প্রকার শিরক থেকে বেঁচে থেকে তাওহীদের উপরে মৃত্যুবরণ করা একজন মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, হে আদম সন্তান! তুমি যদি দুনিয়া পরিমান গুনাহ নিয়ে আমার কাছে হাজির হও, আর আমার সাথে কাউকে শরিক না করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ কর, তাহলে আমি দুনিয়া পরিমাণ মাগফিরাত (ক্ষমা) নিয়ে তোমার দিকে এগিয়ে আসবো। সুনানে তিরমিযীঃ ২৩৫৭, হাদীসটির সনদ হাসান।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যু বরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে মৃত্যু বরণ করবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। সহীহ বুখারীঃ ২৮৫৬, সহীহ মুসলিমঃ ১৫৩।

সাহাবী মুআয বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিছনে একটি গাধার পিঠে বসে ছিলাম। তিনি আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, হে মুআয! তুমি কি জানো, বান্দার উপর আল্লাহর কি হক রয়েছে? আর আল্লাহর উপর বান্দার কি হক আছে? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে এই যে, তারা শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হচ্ছে যারা তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না, তাহলে তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন না। আমি (মুআয) বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি কি এই সুসংবাদ লোকদেরকে জানিয়ে দেব না? তিনি বললেন, তুমি তাদেরকে এই সুসংবাদ দিওনা, তাহলে তারা ইবাদত ছেড়ে দিয়ে (আল্লাহর উপর ভরসা করে) হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। সহীহ মুসলিমঃ ৪৬, সহীহ বুখারীর কিতাবুল রিক্বাক, হাদীস নং-৫০৭।

অনেক মুসলিম রয়েছে, যারা জেনে কিংবা না জেনে অনেক সময় এমন কথা বলে ফেলে, কিংবা অজ্ঞতাবশত এমন কাজ করে বসে, আসলে যা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। শিরকি কথা ও কাজ থেকে বাঁচার জন্য প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরয দায়িত্ব হচ্ছে, কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী কোন কাজগুলো শিরক, এ ব্যপারে পূর্ণাংগ জ্ঞান অর্জন করা। এজন্য আমাদের তাওহীদ ও শিরকের উপরে লিখিত কিতাবগুলো পড়া উচিত এবং সহীহ আকিদার অনুসারী আলেমদের ওয়াজ-লেকচার শোনা উচিত। বিশেষ করে শায়খুল ইসলাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহহাব রাহিমাহুল্লাহর কিতাবুত তাওহীদ বইটা সকলের পড়া ও বুঝা উচিত, যাতে করে তারা শিরক থেকে সতর্ক হতে পারে ও বেঁচে থাকতে পারে।
জানা-অজানা যে কোন শিরক থেকে বাঁচার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো ছোট্ট একটা দুয়া আছে, কেউ যদি প্রতিদিন সকাল বিকালবেলা একবার করে এই দুয়াটা পড়ে, তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তাকে শিরক থেকে হেফাজত করবেন। দুয়াটা হচ্ছেঃ
اللَّهُمَّ  إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ وَأَنَا أَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لاَ أَعْلَمُ
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা ইন্নী আউযুবিকা আন উশরিকা বিকা ওয়া আনা আলাম, ওয়া আস-তাগফিরুকা লিমা লালাম
অনুবাদঃ হে আল্লাহ! আমার জানা অবস্থায় তোমার সাথে শিরক করা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি আর আমার অজানা অবস্থায় কোনো শিরক হয়ে গেলে আমি তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
দুয়াটা পাবেন হিসনুল মুসলিম বইয়ের ২৪৬ পৃষ্ঠামুসনাদে আহমাদ ৪/৪০৩, হাদীসটি সহীহ, সহীহ আল-জামে ৩/২৩৩।
দুয়াটা মুখস্থ করে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায়, সালাম ফেরানোর পূর্বে কিংবা মুনাজাতে পড়া উচিত।

(৩) প্রকাশ্যে ও গোপনে, সর্বদা তাক্বওয়া অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করাঃ
তাক্বওয়ার প্রতিদান সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
(সেই দিন) মুত্তাক্বীদের জন্য জান্নাতকে নিকটবর্তী করা হবে। সুরা আশ-শুআরাঃ ৯০।
আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে, তার জন্য রয়েছে দুইটি (জান্নাতের) বাগান। সুরা আর-রাহমানঃ ৪৬।
আর যারা পরম দয়াময় (আল্লাহকে) না দেখে ভয় করে, এবং (আল্লাহ) অভিমুখী অন্তর নিয়ে উপস্থিত হয়, (তাদেরকে বলা হবে) তোমরা শান্তির সাথে (জান্নাতে) প্রবেশ কর; এটা অনন্ত জীবনের দিন। সেখানে তারা যা কামনা করবে, তাই পাবে এবং আমার নিকট রয়েছে তারও অধিক* সুরা আল-ক্বফঃ ৩৩-৩৫। এই আয়াতে অধিক অর্থ হচ্ছে, জান্নাতে আল্লাহকে দেখতে পারার নেয়ামত।
আর যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করেছে এবং প্রবৃত্তি বা খেয়াল-খুশি থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত। সুরা আন-নাযিআতঃ ৪০-৪১।

আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হল, কোন আমল সবচাইতে বেশি পরিমাণে মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে? তিনি বলেন, তাক্বওয়া, সদাচরণ ও উত্তম চরিত্র। তাঁকে আবার প্রশ্ন করা হল, কোন আমল সবচাইতে বেশি পরিমাণে মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে? তিনি বললেন, মুখ ও লজ্জাস্থান। ইবনে মাজাহ, তিরমিযীঃ ২০০৪, মিশকাতঃ ৪৬২১।

(৪) মৃত্যুর পূর্বে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যার জীবনের শেষ কথা হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে। আবু দাউদঃ ৩/১৯০, হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী, সহীহ তিরমিযীঃ ৩/১৫২।
এজন্য যে ব্যক্তি মনে করবে যে, তার মৃত্যুর সময় চলে এসেছে, তাহলে সে একটু পরপর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে থাকবে। মুমূর্ষ ব্যক্তিকে তার কাছের আত্মীয়-স্বজনেরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার জন্য স্বরণ করিয়ে দিবে। খেয়াল রাখতে হবে, কোন কথা বলে ফেললে কথা শেষ করে পুনরায় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে হবে। যাতে করে তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত সর্বশেষ কথাটা হয় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহলা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পর কিছুক্ষণ চুপ করে বা অজ্ঞান থাকার পরেও যদি মৃত্যু হয়, তবুও তার সর্বশেষ কথা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে ধরে নেওয়া হবে, এবং সে ব্যক্তি এই হাদীসে বর্ণিত ফযীলত, অর্থাৎ জান্নাত পাবে বলে আশা করে যায়।

(৫) ওযুর পরে কালিমা শাহাদাত পাঠ করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে ওযু করবে, অতঃপর কালিমা শাহাদাত পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেওয়া হবে। সে যেটা দিয়ে ইচ্ছা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। মুসলিমঃ ১/২০৯, মিশকাতঃ ২৮৯।
কালিমা শাহাদাত হচ্ছেঃ আশহাদু আল্-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারিকা-লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ।

(৬) পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ওয়াক্ত অনুযায়ী আদায় করতে যত্নবান হওয়াঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। সুতরাং, যে ব্যক্তি (এই পাঁচ ওয়াক্ত) সালাতের হকের ব্যপারে কোন প্রকার কমতি ও তাচ্ছিল্য না করে সঠিকভাবে সেইগুলো আদায় করবে, তার জন্য আল্লাহ এ অংগীকার করেছেন যে, তিনি তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যে এই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের ব্যাপারে কমতি ও তাচ্ছিল্য করে তা আদায় করবে, তার প্রতি আল্লাহর কোন অংগীকার নেই। তিনি চাইলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন, আবার ক্ষমাও করতে পারেন’’। হাদীসটি মুয়াত্তা ইমাম মালিক, মুসনাদে ইমাম আহমাদ, সুনানে আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে। শায়খ আলবানী এই হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে সহীহ বুখারীঃ ২৬৭৮, সহীহ মুসলিমঃ ১০৯।

(৭) ফযর ও আসরের সালাত সঠিক সময়ে আদায় করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি দুইটি ঠান্ডা সময়ের (অর্থাৎ, ফযর ও আসর) সালাতের হেফাজত করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সহীহ বুখারীঃ ৫৭৪, সহীহ মুসলিমঃ ১৪৭০।
এই দুইটি সময়ে ব্যস্ততা বা ঘুমের কারণে অনেকেই উদাসীন হয়ে সালাত কাযা করে ফেলে। একারণে এই দুইটি সালাত হেফাজত করার বিশেষ ফযীলত হিসেবে সে জান্নাতে যাবে।

(৮) মানুষের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হল তার জিহবা ও লজ্জাস্থানের হেফাযত করা। কারণ, এই দুইটি অংগের কারণে সবচাইতে বেশি মানুষ জাহান্নামে যাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি এই দুইটি জিনিসের হেফাযতের দায়িত্ব নিবে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জান্নাতের ব্যাপারে দায়িত্ব নিবেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী (জিহবা) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী (লজ্জাস্থান) হেফাযতের নিশ্চয়তা দিবে, আমি তার জান্নাতের ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেব। সহীহ বুখারী।

(৯) প্রত্যেক ফরয সালাতের পরে আয়াতুল কুরসী পাঠ করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয সালাতের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করে, মৃত্যু ছাড়া আর কোন কিছুই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখতে পারবে না। নাসায়ী, ইবনু হিব্বান, হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী।

(১০) প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যাবেলায় আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে সাইয়েদুল ইস্তেগফার দুয়া পড়াঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সাইয়েদুল ইস্তিগফার হচ্ছে বান্দার এই কথা বলা যে, আল্লা-হুম্মা আংতা রাব্বি. . .শেষ পর্যন্ত। যে ব্যক্তি দিনে (সকাল বেলা) দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে এই দুয়াটি পড়বে, অতঃপর সে যদি সেইদিন সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বেই মারা যায়, তাহলে সে জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি রাতে (সন্ধ্যাবেলা) এই দুয়াটি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে পড়ে, অতঃপর সে যদি সেই রাতে ভোর হওয়ার পূর্বেই মারা যায়, তাহলে সে জান্নাতীদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হবে। সহীহ বুখারীঃ ৬৩০৬, তিরমিযীঃ ৩৩৯৩, নাসায়ী।
সাইয়েদুল ইস্তিগফার অর্থ হচ্ছে, বান্দার কৃত গুনাহ থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য সর্বোত্তম দুয়া।

(১১) প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় তিনবার জান্নাতের জন্য দুয়া করা ও তিনবার জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্যে দুয়া করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তিনবার জান্নাত প্রার্থনা করে, তখন জান্নাত আল্লাহর কাছে দুয়া করে, হে আল্লাহ তুমি তাকে জান্নাত দান করো। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তিনবার জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তখন জাহান্নাম আল্লাহর কাছে দুয়া করে, হে আল্লাহ তুমি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দাও। তিরমিযিঃ ২৫৭২, ইবনে মাজাহ ৪৩৪০, হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী, সহীহ আল-জামিঃ ৬২৭৫।
জান্নাত প্রার্থনা করা ও জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাওয়ার জন্য দুয়াঃ
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْجَنَّةَ وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ النَّارِ
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা ইন্নী আস-আলুকাল জান্নাতা, ওয়া আউযুবিকা মিনান্নার।
অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে জান্নাত প্রার্থনা করছি, আর আমি আপনার কাছে জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

(১২) প্রতিদিন সুরা মুলক পড়াঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কুরআনে ত্রিশ আয়াত বিশিষ্ট এমন একটি সুরা আছে, যা তার পাঠকারীর জন্য সুপারিশ করবে এবং শেষা পর্যন্ত তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর সেটা হলো তাবা-রাকাল্লাযী বিইয়াদিহিল মুলক (সুরাহ মুলক)। তিরমিযীঃ ২৮৯১, আবু দাউদঃ ১৪০০, ইবনে মাজাহঃ ৩৭৮৬, হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী।

(১৩) অহংকার, গুলুল ও ঋণ থেকে মুক্ত থাকাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি অহংকার, গুলুল ও ঋণ; এই তিনটি জিনিস থেকে মুক্ত থাকা অবস্থায় মারা যাবে, সে ব্যক্তি জান্নাতে যাবে। ইবনে মাজাহঃ ২৪০৩, তিরমিযীঃ ১৫৭২, হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী, সহীহ তিরমিযী।
গুলুল হচ্ছে জিহাদে প্রাপ্ত গনীমতের সম্পদ বন্টন করার পূর্বেই লুকিয়ে রেখে বা চুরি করে আত্মসাৎ করা।

(১৪) মনোযোগী হয়ে, আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে আযানের উত্তর দেওয়াঃ
আযানের সময় মুয়াজ্জিন যা যা বলে, তার সাথে তাই বলতে হবে। শুধুমাত্র মুয়াজ্জিন যখন হাইয়্যা আলাস সালাহ হাইয়্যা আলাল ফালাহ বলবে, তখন তার উত্তরে সেটা না বলে বলতে হবে লা হাউলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে আযানের উত্তর দেয়, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। সহীহ মুসলিমঃ ৩৮৫।

(১৫) আযানের দুয়া পড়াঃ
মুয়াজ্জিনের সাথে আযানের জবাব দেওয়ার পর, যেকোন সহীহ একটা দুরুদ পাঠ করে, অতঃপর আযানের যেই দুয়া রয়েছে সেটা পড়তে হয়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আযান শুনে কেউ যদি আযানের দুয়া পড়ে, কিয়ামতের দিন ঐ ব্যাক্তির জন্য সুপারিশ করা আমার জন্য অনিবার্য হয়ে যাবে। সহীহ বুখারীঃ ৬১৪, তিরমিযীঃ ২১১১।

(১৬) সুরা ইখলাসকে ভালোবাসাঃ
একদিন এক সাহাবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন হে আল্লাহর রাসুল! আমি এই (সুরা) ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদকে ভালবাসি। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই (সুরার প্রতি) ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। সহীহ বুখারী, তিরমিযী ২৯০১, আহমাদ ১২০২৪।
সুরা ইখলাসকে ভালোবাসার উপায় হচ্ছে এটা অধিক পরিমানে তেলাওয়াত করা, এর অর্থ ও তাফসীর জানা, এর শিক্ষা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা, মানুষকে তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেওয়া। আর বিশেষ করে ফযর, মাগরিবের সুন্নত সালাতের দ্বিতীয় রাকাতে, এবং বিতির সালাত তিন রাকাত পড়লে, তৃতীয় রাকাতে সুরা ইখলাস পাঠ করা। এছাড়া প্রত্যেক ফরয সালাতের পরে তিন ক্বুল সুরা পড়া ইত্যাদি।

(১৭) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ-নিষেধ মেনে চলা, তাঁর সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের সকলেই জান্নাতে যাবে, শুধুমাত্র যারা জান্নাতে যেতে অস্বীকার করবে তারা ছাড়া। সাহাবীগণ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এমন কে আছে যে, জান্নাতে যেতে অস্বীকার করবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করবে সে জান্নাতে যাবে, আর যে আমার নাফরমানী করবে ও অবাধ্য হবে, সে ব্যক্তি জান্নাতে যেতে অস্বীকার করে। সহীহুল বুখারীঃ ৭২৮০।

(১৮) জিহাদকারী ব্যক্তির জন্য জান্নাত নিশ্চিতঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর দায়িত্ব নিয়েছেন, যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আল্লাহর পথে জিহাদ করা এবং তাঁর কালিমাকে সত্য বলে প্রমাণিত করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়। আল্লাহ তাকে শহীদের সাওয়াব করেন অথবা, গণীমত লাভে ধন্য করে গাজী হিসাবে ঘরে ফিরিয়ে আনেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি উটের দুধ দোহনের মধ্যবর্তী সময়টুকু (অর্থাৎ, সামান্য সময়) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব। নাসায়ীঃ ৩১৪১, আবু দাউদঃ ২৫৪১, তিরমিযীঃ ১৬৫৭, হাদীসটি সহীহ।

(১৯) শান্তির সাথে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য
হে মানব সকল! তোমরা সালামের প্রসার কর, মানুষকে খাদ্য দান কর, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ, আর রাতের বেলা লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন তোমরা নফল সালাত আদায় কর। তাহলে তোমরা শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। সুনানে তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও আহমাদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

(২০) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বৈধ উপার্জন দ্বারা সঠিক নিয়মে হজ্জ করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এক উমরাহ থেকে আরেক উমরাহ মধ্যবর্তী সকল গুনাহের জন্য কাফফার স্বরূপ। আর হজ্জে মাবরুর (যেই হজ্জ কবুল হয়েছে বলে আশা করা যায়), তার প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়।’’ সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম।

(২১) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান-সাদাকাহ করাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান-খয়রাত করে, এর প্রতিদান হিসাবে তাকে জান্নাতে দেওয়া হবে। ইমাম আহমাদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

(২২) বিপদগ্রস্থ ঋণ গ্রহীতাকে সময় দেওয়া বা ছাড় দেওয়াঃ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এক ব্যক্তি মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার পর তাকে জান্নাতে প্রবেশ করা নো হলো। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে লোকটি বললো, আমি মানুষের সাথে কেনাবেচা করতাম। বিপদগ্রস্ত দরিদ্রদেরকে ঋণ পরিশোধের সময় দিতাম এবং কিছু টাকা পয়সা মাফ করে দিতাম। ফলে আল্লাহ আমাকেও মাফ করে দিয়েছেন। সহীহ মুসলিম।