জান্নাতীদের
বৈশিষ্ট্যাবলি
মূল
গ্রন্থঃ “রমযান মাসের ৩০ আসর”
লেখকঃ
আল্লামাহ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমিন (রহঃ)
______________________________________
আল্লাহ
তাঁর বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহে আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন
সকল
প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সকল প্রাণবানকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার গঠন সুনিপুণ বানিয়েছেন।
আসমানসমূহ ও যমীনকে পৃথক করে দিয়েছেন ইতোপূর্বে উভয়ে ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল। আপন প্রজ্ঞানুযায়ী
বান্দাদের ভাগ্যবান ও হতভাগার শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। ভাগ্যবানদের কিছু কারণ নির্ধারণ
করেছেন যা মুত্তাকী অবলম্বন করে। তারা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পরিণামের প্রতি লক্ষ্য করে
যা অনন্তকালের তাই পছন্দ করে। আমি প্রশংসা করি তাঁর, আর এ স্বীকৃতি প্রদান করছি যে
আমি তার প্রশংসার হক আদায় করতে সমর্থ নই। আমি তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি আর তিনি অনন্ত
কৃতজ্ঞতা পাবার যোগ্য।
আমি
সাক্ষ্য দেই যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই; তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনি
সকল সৃষ্টিকুলের সত্যিকারের মালিক; তারা সবাই তার দাস। আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ
তাঁর বান্দা ও রাসূল। যিনি সুরত ও সীরাতে তথা চেহারা ও চরিত্রে পূর্ণতর ও সুন্দরতম
ব্যক্তি।
আল্লাহ
সালাত ও সালাম বর্ষিত করুন তাঁর ওপর, তাঁর সাহাবী আবূ বকরের ওপর যিনি অনুসারীদের মধ্যে
মর্যাদায় ছিনিয়ে নেয়ায় বিজয়ী প্রতিযোগী, উমরের ওপর যিনি ছিলেন ন্যায়বিচারক যার তুলনা
নয় কোনো মানুষ, উসমানের ওপর যিনি প্রত্যশা মাফিক শাহাদাতের জন্য নিজেকে সমর্পণ করেছেন,
আলীর ওপর যিনি ক্ষণিকের বিষয়াবলি বিকিয়েছেন এবং অনন্তের বিষয়াদি খরিদ করেছেন এবং তাঁর
পরিবার-পরিজন আর আল্লাহর দীনের যথার্থ সাহায্যকারী তাঁর সাহাবীগণের ওপর।
o মুসলিম ভাইয়েরা! আপনারা জান্নাতের নিয়ামতসমূহ ও
তাতে বিভিন্ন প্রকারের খুশি ও আনন্দের বস্তু সম্পর্কে শুনেছেন। আল্লাহর শপথ, জান্নাত
এতই উপযুক্ত যে এর জন্য প্রত্যেক আমলকারী আমল করবে এবং প্রতিযোগীরা এতে প্রতিযযোগিতা
করবে। আর মানুষ এর অন্বেষণে জীবন বিসর্জন করবে; এর চেয়ে নিম্নমানের বস্তু থেকে বিমুখ
হবে।
o যদি তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস কর যে, এর জন্য কী আমল
করতে হবে এবং তা লাভের পথ কী?
তাহলে
বলব যে, এর উত্তর আল্লাহ তা‘আলা
স্বীয় কালামে ওহীর মাধ্যমে সর্বোত্তম সৃষ্টি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
যবানীতে বর্ণনা করেছেন।
*
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর
তোমরা নিজ রবের ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে দ্রুত অগ্রসর হও, যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন
সমপরিমাণ, যা মুত্তাকীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় (আল্লাহর
পথে) ব্যয় করে, নিজেদের গোস্বা সংবরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রর্দশন করে আল্লাহ
সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন। তারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোনো মন্দ কাজে
জড়িত হয়ে) নিজের ওপর জুলুম করে ফেললে, আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা
প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করতে পারে? তারা নিজের কৃতকর্মের জন্য
হঠকারিতা প্রদর্শন করে না এবং জেনে শুনে (ওই পাপ) একধিকবার করে না।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৩-১৩৫}
উল্লিখিত
আয়াতসমূহে জান্নাতীদের গুণাবলি বর্ণনা করা হয়েছে:
১ম
গুণ: তারা মুত্তাকী
তারা
হচ্ছে ঐসব ব্যক্তিবর্গ, যারা তাদের রবের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রতিরোধ
ব্যবস্থা হিসেবে তাঁর আনুগত্য ও সওয়াবের আশায় যাবতীয় নির্দেশের বাস্তবায়ন করেছে এবং
তার আনুগত্য ও শাস্তির ভয়ে যাবতীয় নিষিদ্ধ বস্তু পরিত্যাগ করেছে।
২য়
গুণ: তারা স্বচ্ছলতা ও অভাবের সময় ব্যয় করে
তারা
আল্লাহর আদিষ্ট স্থানে ব্যয় করে যেমন-যাকাত, সাদকা, প্রত্যেক পূণ্যের স্থান ও আল্লাহর
পথে তথা-জিহাদ ও অন্যান্য ভালো কাজে প্রকাশ্যে ও গোপনে ব্যয় করে।
স্বচ্ছলতার
কারণে অর্থের প্রতি তাদের মহব্বত বৃদ্ধি পায় না আর অর্থের লোভে কৃপণতা তাদেরকে স্পর্শ
করে না। অনুরূপভাবে অভাব-অনটন বা দারিদ্র্য তাদেরকে প্রয়োজন পড়তে পারে এ আশংকায় সম্পদ
ব্যয় করা থেকে বিরত রাখে না।
৩য়
গুণ: তারা গোস্বা সংবরণ করে
তারা
যখন ক্রোধান্বিত হয় তখন নিজেদের ক্রোধ হজম করে, ফলে তারা সীমালঙ্ঘন করে না এবং এর কারণে
অন্যের ওপর হিংসা-দ্বেষে জড়িত হয়ে পড়ে না।
৪র্থ
গুণ: তারা মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে
অর্থাৎ
যারা তাদের ওপর জুলুম করে ও সীমালঙ্ঘন করে, তাদের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও
নিজেদের জন্য প্রতিশোধ নেয় না।
*
এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা
বলেন:
﴿ وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ١٣٤ ﴾ [ال عمران: ٣٤]
‘আল্লাহ
সৎ কর্মশীলদের ভালোবাসেন।’
{সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৪} এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ক্ষমা করা সেখানেই প্রশংসনীয়,
যেখানে সেটা ইহসান তথা অনুগ্রহের মধ্যে পড়বে, যখন সেটা ক্ষমার স্থানে হয়, অর্থাৎ এর
মাধ্যমে অপরাধীর সংশোধনের আশা করা যায়। কিন্তু যদি ক্ষমার কারণে সে ব্যক্তির অপরাধ
বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে সেখানে তাকে ক্ষমা করা যেমন প্রশংসনীয় কাজ নয় তেমনি
তার দ্বারা সাওয়াবেরও আশা করা যায় না।
*
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ فَمَنۡ عَفَا وَأَصۡلَحَ فَأَجۡرُهُۥ عَلَى ٱللَّهِۚ﴾ [الشورى: ٤٠]
‘যে
ক্ষমা করে ও সংশোধন করে, তার প্রতিদান তো রয়েছে আল্লাহর কাছে।’ {সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ৪০}
৫ম
গুণ: তারা অশ্লীল কাজ হয় গেলে কিংবা নিজেদের উপর যুলুম করলে নিজেদের অপরাধের জন্য ক্ষমা
প্রার্থনা করে
‘ফাহেশা’ বা অশ্লীলতা ওই জাতীয় পাপকে বলে: যে পাপ মানুষ
ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট মনে করে। আর তা হচ্ছে কবীরা গুনাহ। যেমন, ১. মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা
করা, ২. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, ৩. সুদ খাওয়া, ৪. ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ করা, ৫. যুদ্ধের
ময়দান থেকে পলায়ন করা, ৬. যিনা করা, ৭. চুরি করা ইত্যাদি।
আর
মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের ওপর জুলুম করা: এটা ব্যাপক বিষয়, যা সগীরা ও কবীরা উভয় গুনাহকে
অন্তর্ভুক্ত করে।
সুতরাং
যখন তারা কোনো দোষ বা গুনাহ করে বসে তখনই সে বিরাট সত্ত্বার কথা স্মরণ করে যার অবাধ্যতা
তারা করছে; ফলে তারা তাঁকে ভয় পায়; কিন্তু সাথে সাথে তারা ক্ষমা ও দয়াকেও স্মরণ করে
এবং সে ক্ষমা পাওয়ার উপায়সমূহ অবলম্বনে সচেষ্ট হয় আর তাঁর কাছে তাদের গুনাহের জন্য
ক্ষমা প্রার্থনা করে; আর তাঁর কাছে চায় তিনি যেন এ গুনাহগুলোকে তাঁর ক্ষমা দিয়ে ঢেকে
দেন, সেগুলোর উপর শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
আর
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “আল্লাহ ছাড়া আর পাপ মার্জনাকারী কী কেউ আছে?” এর দ্বারা ইঙ্গিত রয়েছে যে, তারা আল্লাহ ছাড়া
আর কারও কাছে ক্ষমা চায় না; কারণ, তিনি ব্যতীত কেউই ক্ষমা করতে পারে না।
৬ষ্ঠ
গুণ: তারা জ্ঞাতসারে পাপ কাজ বারবার করে না:
অর্থাৎ
তারা যে কাজটি করেছে সেটাকে পাপ জেনে, যাঁর অবাধ্য হয়েছে সে বিরাট সত্ত্বার কথা জেনে,
তাঁর ক্ষমার বিষয়টি নিকটে মনে করে বারবার সে পাপটি করে না; বরং তারা সে পাপ দ্রুত বর্জন
করে ও তাওবা করে; কারণ জেনে-বুঝে ছোট গুনাহ বারবার করার ফলে তা কবীরা গুনাহে রুপান্তরিত
হয়ে যায়। আর তা ধীরে ধীরে গুনাহগারকে কঠিন পরিণতির দিকে ধাবিত করবে।
*
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
১.
মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে।
২.
যারা নিজের সালাত বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে আদায় করে।
৩.
যারা অনর্থক কথাবার্তায় লিপ্ত হয় না।
৪.
যারা যাকাত প্রদান করে।
৫.
যারা নিজ যৌনাঙ্গ সংযত রাখে।
৬.
তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তিরস্কৃত হবে না।
৭.
অতঃপর কেউ এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা সীমালঙ্ঘনকারী হবে।
৮.
এবং যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুশিয়ার থাকে।
৯.
এবং যারা তাদের সালাতসমূহের হিফাযত করে।
১০.
তারাই উত্তরাধিকারী।
১১.
যারা জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকার লাভ করবে, তারা তাতে চিরকাল থাকবে।’ [সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত : ১-১১]
উল্লিখিত
আয়াতসমূহে জান্নাতীদের আরো কিছু গুণাবলি বর্ণনা করা হয়েছে:
১ম
গুণ: যারা ঈমান এনেছে
যারা
আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে এবং প্রত্যেক ওই সকল বস্তুর ওপর ঈমান আনে, যার প্রতি ঈমান আনা
আবশ্যক। যেমন-ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ ও আখেরাতের ওপর। তেমনি তাকদীরের ভালো-মন্দের
উপর বিশ্বাস রাখে। তারা সেই বিশ্বাস এমন দৃঢ়তার সঙ্গে রাখে যে, তা তাদেরকে সেগুলো সম্পূর্ণভাবে
গ্রহণ করে নিতে, স্বীকৃতি দিতে, কথা ও কাজে পরিণত করতে বাধ্য করে।
২য়
গুণ : যারা বিনয়াবনত হয়ে সালাত আদায় করে
সালাতে
তারা তাদের অন্তরকে হাযির রাখে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে স্থির রাখে, এটা মনের মধ্যে আনয়ন
করে যে, তারা তাদের সালাতে মহান আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান। আল্লাহর সঙ্গে তাঁর কথা দিয়ে
কথপোকথন করছে, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করছে তাঁর জিকিরের মাধ্যমে, আল্লাহর কাছে আশ্রয়
নিচ্ছে তার দু‘আর মাধ্যমে। সুতরাং তারা বাহ্যিক ও আন্তরিক সার্বিকভাবে
প্রকৃত বিনয়াবনত।
৩য়
গুণ: যারা অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে
আয়াতে
বর্ণিত ‘লাগও’ বা অযথা বলতে এমন কথা ও কাজকে বুঝায় যাতে কোনো
ফায়দা নেই, নেই কোনো কল্যাণ। সুতরাং তারা এসব বেহুদা কথা ও কাজ থেকে বিমুখ থাকে তাদের
দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, কঠিন হুশিয়ারী কারণে। তারা তাদের মূল্যবান সময়কে উপকারহীন কাজে নষ্ট
করে না। সুতরাং যেরূপে তারা নিজ সালাতকে খুশু‘ বা বিনয়াবনত হওয়ার মাধ্যমে সংরক্ষণ করে, তেমনি
তারা তাদের মূল্যবান সময়কে নষ্ট না করার মাধ্যমে হেফাযত করে। আর যখন তাদের বৈশিষ্ট্যই
হচ্ছে যে, তারা অযথা ও উপকারহীন কাজে তাদের সময়কে নষ্ট করে না, তখন যে সকল কাজ তাদের
জন্য ক্ষতির কারণ হবে তারা তা থেকে দূরে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
৪র্থ
গুণ: যারা তাদের যাকাতকে পালন করে থাকে
এখান
যাকাত শব্দ দ্বারা সে সম্পদ উদ্দেশ্য হতে পারে যা ফরয হিসেবে প্রদান করতে হয়। আবার
হতে পারে তা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন সকল কথা ও কাজ যা দ্বারা অন্তর পবিত্র ও স্বচ্ছ
হয়।
৫ম
গুণ: যারা তাদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে
তারা
নিজেদের লজ্জাস্থান যিনা-ব্যভিচার ও সমকামিতা তথা যৌনাঙ্গ দ্বারা যত প্রকার চারিত্রিক
অঘটন হওয়া সম্ভব তা তেকে মুক্ত রাখে; কারণ এতে রয়েছে আল্লাহর অবাধ্যতা, সামাজিক ও চারিত্রিক
অধঃপতন। এখানে লজ্জাস্থানের হিফাযত দ্বারা ব্যাপকভাবে এসব ছাড়াও অন্যান্য কিছুও অন্তর্ভুক্ত
হবে। যেমন- পর নারীর প্রতি কৃদৃষ্টি দেয়া বা কাউকে অবৈধভাবে স্পর্শ করা।
*
আল্লাহর বাণী “তারা তিরস্কৃত হবে না” এর দ্বারা ইঙ্গিত রয়েছে যে, মূল হচ্ছে একজন
মানুষ এসব কাজ দ্বারা তিরস্কৃত হবে; কেবলমাত্র স্ত্রী ও নিজের কৃতদাসী এর ব্যতিক্রম।
কারণ মানুষের এর প্রয়োজন রয়েছে; এর মাধ্যমে সে প্রাকৃতিক চাহিদা মেটাতে পারে এবং সন্তান-সন্ততি
লাভ করতে পারে।
*
আর আল্লাহর বাণী “অতঃপর
কেউ এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা সীমালঙ্ঘনকারী হবে” এর ব্যাপকতা প্রমাণ করে যে, অন্য যে কোনো পন্থায়
যৌনক্ষুধা মিটালে সে তিরস্কৃত হবে; সুতরাং হস্ত মৈথুন (যাকে খারাপ অভ্যাসও বলা হয়)
তা হারাম হবে। যেহেতু এর দ্বারা স্ত্রী ও কৃতদাসী ছাড়া অপাত্রে বীর্যপাত করা হয়।
৬ষ্ঠ
গুণ: যারা আমানত ও অঙ্গীকার রক্ষা করে
আমানত
অর্থ অন্যের কাছে কোনো কথা, কাজ ও সম্পদকে নিঃশঙ্কচিত্তে গচ্ছিত রাখা। সুতরাং কেউ যদি
তোমার কাছে গোপন কথা বলে, তাহলে সে তাকে কথাটি তোমার কাছে আমানত হিসেবে রেখেছে। অনুরূপভাবে
যদি কোনো ব্যক্তি তোমার নিকট এমন কাজ করে যা সে অন্যের কাছে প্রকাশ করা অপছন্দ করে,
তাহলে সে ওই কাজটি তোমার কাছে আমানত হিসেবে রেখেছে। তদ্রূপ যদি কেউ কোনো সম্পদ তোমার
কাছে সংরক্ষনের জন্য সোপর্দ করে তাহলে ওই সম্পদ সে তোমার কাছে আমানত রেখেছে।
আর
অঙ্গীকার হচ্ছে: মানুষ নিজের উপর অন্যের জন্য যা বাধ্য করে নেয়। যেমন আল্লাহর জন্য
কোনো কিছু মানত করা এবং মানুষের মধ্যে প্রচলিত ওয়াদা-অঙ্গীকার বা চুক্তি।
সুতরাং
জান্নাতিরা তাদের মধ্যকার আমানত এবং তাদের মধ্যকার পরস্পর কৃত অঙ্গীকার ও আল্লাহর সাথে
কৃত অঙ্গীকার পূরণের উপর সদা প্রতিষ্ঠিত থাকে।
তাছাড়া
ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অথবা কোনো বৈধ শর্ত পূরণের বিষয়টিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
৭ম
গুণ: যারা সালাত আদায়ের প্রতি যত্নবান থাকে
তারা
সালাতকে নষ্ট করা থেকে হেফাযত করার ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। তাই তারা সেটার সময়ের
প্রতি লক্ষ্য শর্ত, রুকন ও ওয়াজিবসমূহ যথাযথভাবে আদায় করে থাকে।
o উপরে বর্ণিত জান্নাতিদের গুণাবলী ছাড়াও কুরআনুল
কারীমে আল্লাহ তা‘আলা
জান্নাতিদের আরও বহু গুণ বর্ণনা করেছেন; যাতে করে যারা জান্নাতে যেতে চায় তারা এসব
গুণে গুণান্বিত হতে পারে।
এ
ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদীসে জান্নাতী হওয়ার
পদ্ধতি বলা হয়েছে: যেমন,
*
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু
থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«َمَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ »
‘আর
যে ব্যক্তি ইলমে দ্বীন অর্জনের জন্য কোনো পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের একটি রাস্তা সহজ করে
দেন।’
*
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরও বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন,
‘আমি
কি তোমাদের বলব না কোন জিনিস গুনাহকে বিলুপ্ত করে ও মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করে? সাহাবীগণ
বললেন, বলুন হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, শীতকালে ঠান্ডার মধ্যে উত্তমরূপে ওযু করা,
বেশি বেশি মসজিদের দিকে পদক্ষেপ এবং এক সালাতের পর অন্য সালাতের অপেক্ষা করা।’
*
সহীহ মুসলিমে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
‘তোমাদের
মধ্যকার যে কেউ উত্তমরূপে সব স্থানে পানি পৌঁছিয়ে ওযু করে, অতঃপর কালেমা শাহাদাত তথা
‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক
ইলাহ নেই, আর মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’ এটা পাঠ করে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের ৮টি দরজা খুলে দেন। সে
যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
*
অনুরূপভাবে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে আরও বর্ণিত আছে, দীর্ঘ হাদীসে তিনি
বলেন, যে ব্যক্তি অন্তর দিয়ে মুয়াজ্জিনের আহ্বানে আন্তরিকভাবে সাড়া দেয় তথা প্রতিটি
বাক্যের উত্তর দেয় এবং সালাতে শরীক হয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (হাদীসের সারাংশ)
*
উসমান ইবন আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু
হতে আরও বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« مَنْ بَنَى مَسْجِدًا يَبْتَغِي بِهِ وَجْهَ اللهِ بَنَى اللهُ لَهُ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ»
‘যে
ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার
সন্তষ্টির জন্য মসজিদ বানায়, আল্লাহ তা‘আলা
তার জন্য জান্নাতে ঘর নির্মাণ করেন।’
*
উবাদা ইবন সামিত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু
হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ওপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন।
যে ব্যক্তি ওই সালাতসমূহ উত্তমরূপে আদায় করে এবং তা আদায়ের ব্যাপারে কোনো প্রকার শৈথিল্য
প্রদর্শন না করে, আল্লাহ তা‘আলা
তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’
*
সাওবান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু
থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন আমল
দ্বারা জান্নাতী হওয়া যায়? উত্তরে তিনি বললেন, ‘তুমি অধিক পরিমাণে সিজদা কর। যত বেশি সিজদা করবে
আল্লাহ তোমার মর্যাদা ততখানি বৃদ্ধি করে দেবেন এবং গুনাহ মাফ করে দেবেন।’
*
উম্মে হাবীবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা
হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘যদি কোনো মুসলিম আল্লাহ তা‘আলার সন্তষ্টির জন্য ফরয ছাড়াও দিবারাতে বারো
রাকাত সুন্নত সালাত আদায় করে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করেন।
আর
সেগুলো হচ্ছে: চার রাকাআত জোহরের পূর্বে, দু রাকাআত জোহরের পর, দু রাকাআত মাগরিবের
পর, দু রাকাআত ইশার পর ও দু রাকাআত ফজরের ফরযের পূর্বে।
*
মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
‘রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি আমাকে
এমন আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে।
উত্তরে তিনি বললেন, তুমি বড় এক বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছ। তবে তা ওই ব্যক্তির জন্য সহজ,
যার জন্য আল্লাহ সহজ করে দিয়েছেন। তা হলো: ১। তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সঙ্গে
কাউকে শরীক করবে না, ২. সালাত কায়েম করবে, ৩. যাকাত প্রদান করবে, ৪. রমযান মাসে সিয়াম
পালন করবে এবং ৫. বাইতুল্লাহর হজ পালন করবে।’
*
সাহাল ইবন সা‘দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« إِنَّ فِى الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ يَدْخُلُ مَعَهُمْ أَحَدٌ ».
‘নিশ্চয়ই
জান্নাতে একটি দরজা আছে যার নাম রাইয়্যান। ওই দরজা দিয়ে শুধুমাত্র সিয়াম পালনকারীগণ
প্রবেশ করবেন। তাদের সঙ্গে অন্য কেউ প্রবেশ করবে না।’
*
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু
হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ ».
‘এক
উমরা হতে দ্বিতীয় উমরা উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য কাফফারাস্বরূপ। আর হজ্জে মাবরুর
বা কবূল হজ্জের সাওয়াব জান্নাত ছাড়া অন্য কিছু নয়।’ অর্থাৎ
যে বক্তি কবূল হজ করল, সে জান্নাতী।’
*
জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু
হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘যে
ব্যক্তি নিজ ৩টি কন্যা সন্তানকে লালন-পালন করে এবং তাদের আদর যত্ন করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত
করে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হলো, যদি দু’টি কন্যা সন্তান হয়? তিনি উত্তর দিলেন, তবুও
ওয়াজিব। সাহাবীগণ কেউ কেউ বলেন, যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ১টি কন্যা সন্তান সম্পর্কে
জিজ্ঞাসা করা হত, তাহলে তিনি অবশ্যই একই উত্তর দিতেন।’
*
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু
হতে বর্ণিত,
‘রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন জিনিস
মানুষকে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করায়? তিনি উত্তর দিলেন, আল্লাহর ভয় ও উত্তম চরিত্র।’
*
‘ইয়াদ ইবন হিমার আল-মুজাশে‘য়ী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন,
“জান্নাতী
তিন প্রকার:
১.
ন্যায়-বিচারক, সদকাদানকারী, তৌফিকপ্রাপ্ত বাদশাহ,
২.
দয়াবান, কোমল হৃদয়ের অধিকারী, আত্মীয়-স্বজন ও প্রত্যেক মুসলিমের সঙ্গে নম্র ব্যবহারকারী
ও
৩.
সচ্চরিত্র ও যাচ্ঞা করা থেকে পবিত্র ব্যক্তি অথচ সে বড় পরিবারের অধিকারী অভাবী।’
হে
ভ্রাতাগণ! এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন কিছু হাদীস বর্ণনা
করা হলো, যাতে জান্নাতী ব্যক্তিগণের গুণাবলি উল্লেখ করা হয়েছে। যে ব্যক্তি জান্নাতে
যাওয়ার ইচ্ছা করে এটা শুধু তার জন্য।
আল্লাহর
কাছে তাওফীক চাই যেন তিনি আমাদের ও আপনাদের সে পথের অনুসারী করেন এবং আমাদের জান্নাতের
পথে অটল রাখেন। নিশ্চয় তিনি দাতা ও দয়ালু।
আর
আল্লাহ সালাত পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।