বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৫

আমার দুয়া কেনো কবুল হয়না?

আমার দুয়া কেনো কবুল হয়না?
- আল্লামাহ ইবনে উসায়মিন (রহঃ) এর ফতোয়া।
_____________________________
প্রশ্নঃ কিছু কিছু মানুষ আল্লাহর কাছে দুআ করে থাকে। কিন্তু দুআ কবূল হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। তাহলে মানুষ কিভাবে আল্লাহর কাছে দুআ করলে তা কবূল হবে?
উত্তরঃ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা। দরূদ ও সালাম পেশ করছি আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর পরিবার এবং সকল সাহাবীর উপর। মুসলমান ভাইদের জন্য আল্লাহর কাছে আকীদাহ ও আমলের ক্ষেত্রে সঠিক পথের তাওফীক প্রার্থনা করছি। আল্লাহ তাআলা বলেন,

)وَقَالَ رَبُّكُمْ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ(        

তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। যারা আমার এবাদতে অহংকার করে তারা সত্বরই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে। (সূরা গাফেরঃ ৬০) প্রশ্নকারী বলেছেন যে, তিনি আল্লাহর কাছে দুআ করে থাকেন। অথচ আল্লাহ তার দুআ কবূল করেন না। ফলে তার কাছে এই অবস্থা কঠিন বলে মনে হয়। বিশেষ করে আল্লাহ তো ওয়াদা করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দুআ করে, আল্লাহ তার দুআ কবূল করেন। আল্লাহ কখনই ওয়াদা খেলাফ করেন না। উক্ত প্রশ্নের জবাবে আমরা বলব যে, দুআ কবূলের জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে। তা সর্ববস্থায় দুআর ক্ষেত্রে বর্তমান থাকতে হবে।

প্রথম শর্তঃ একাগ্রচিত্তে আল্লাহর কাছে দুআ করা। অন্তরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে, এই বিশ্বাসের সাথে আল্লাহর কাছে দুআ করা যে, আল্লাহ কবূল করতে সক্ষম। দুআ করার সময় এই আশা রাখবে যে, আল্লাহ তা কবূল করবেন।

দ্বিতীয় শর্তঃ দুআ করার সময় এই কথা অনুভব করবে যে, দুআ কবূলের দিকে সে খুবই মুখাপেক্ষী। শুধু তাই নয় বরং এ কথাও অনুভব করবে যে, একমাত্র আল্লাহই বিপদগ্রস্ত ফরিয়াদকারীর ফরিয়াদ শ্রবণ করেন এবং তিনিই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। যদি এ কথা অনুভব করে যে, সে আল্লাহর দিকে মুখাপেক্ষী নয় এবং আল্লাহর কাছে তার কোন প্রয়োজনও নেই; বরং দুআ করাটা যেন একটা অভ্যাসমাত্র তাহলে এ ধরণের দুআ কবূল না হওয়ারই উপযোগী।

তৃতীয় শর্তঃ হারাম খাওয়া থেকে দূরে থাকবে। কারণ বান্দা এবং তার দুআ কবূল হওয়ার মধ্যে হারাম রুযী প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে। ছহীহ হাদীছে প্রমাণিত আছে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ পবিত্র তিনি পবিত্র ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তাআলা রাসূলদের (আঃ) প্রতি যা নির্দেশ দিয়েছেন, মুমিনদের প্রতিও তাই নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেনঃ  

)ياَ أيُّهاَ الرُّسُلُ كُلُوْا مِنْ الطَّيِّباَتِ واعْمَلُوْا صاَلِحا(ً

হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত থেকে আহার্য গ্রহণ কর এবং সৎ কর্ম কর। (সুরা মুমিনুনঃ ৫১) আল্লাহ বলেনঃ

)ياَ أيُّهاَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَيِّباَتِ ماَ رَزَقْناَكُمْ (

হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত সামগ্রী থেকে আহার গ্রহণ কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি। (সূরা বাকারাঃ ১৭২) অতঃপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফর করে এলায়িত কেশ ও ধুলামিশ্রিত পোশাক নিয়ে অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে আকাশের দিকে দুহাত তুলে ডাকতে থাকে হে, প্রতিপালক! হে রব!! অথচ সে ব্যক্তির পানাহার সামগ্রী হারাম উপার্জনের, পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম পয়সায় সংগৃহীত, এমতাবস্থায় কি করে তার দুআ কবূল হতে পারে?

দুআ কবূলের সকল মাধ্যম অবলম্বন করা সত্বেও নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ লোকের দুআ কবূল হওয়াকে অসম্ভব মনে করলেন। দুআ কবূলের কারণগুলো নিম্নরূপঃ

১) আকাশের দিকে হাত  উত্তোলন করা। কেননা আল্লাহ তাআলা আকাশে আরশের উপরে। আল্লাহর দিকে হাত উঠানো দুআ কবূলের অন্যতম কারণ। হাদীছে এসেছে,

)إِنَّ اللَّهَ حَيِيٌّ كَرِيمٌ يَسْتَحْيِي إِذَا رَفَعَ الرَّجُلُ إِلَيْهِ يَدَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صِفْرًا(               

নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যন্ত লজ্জাশীল ও সম্মানী। বান্দা যখন তাঁর দিকে দুহাত উঠিয়ে দুআ করে, তখন তিনি হাত দুটিকে খালি অবস্থায় ফেরত দিতে লজ্জা বোধ করেন।

২) এই লোকটি আল্লাহর একটি নাম رب) পালনকর্তা উচ্চারণ করে করে দুআ করেছে। এই নামের উসীলা গ্রহণ করা দুআ কবূলের অন্যতম কারণ। কেননা রব্ব অর্থ পালনকর্তা, সমস্ত মাখলুকাতের সৃষ্টিকারী ও পরিচালনাকারী। তাঁর হাতেই আকাশ-জমিনের চাবি-কাঠি। এ জন্যই আপনি কুরআন মজীদের অধিকাংশ দুআতেই দেখতে পাবেন, রব্ব বা পালনকর্তা শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন,

)رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ رَبَّنَا وَآتِنَا مَا وَعَدْتَنَا عَلَى رُسُلِكَ وَلَا تُخْزِنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِيعَادَ فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ أَنِّي لَا أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ(            

হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিশ্চিতরূপে শুনেছি একজন আহবানকারীকে ঈমানের প্রতি আহবান করতে যে, তোমাদের পালনকর্তার প্রতি ঈমান আন। তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের পালনকর্তা! অতঃপর আমাদের সকল গুনাহ মাফ কর এবং আমাদের সকল দোষত্রুটি দূর করে দাও, আর আমাদের মৃত্যু দাও নেক লোকদের সাথে। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে দাও, যা তুমি ওয়াদা করেছ তোমার রাসূলগণের মাধ্যমে এবং কিয়ামতের দিন তুমি আমাদিগকে অপমানিত করো না। নিশ্চয় তুমি ওয়াদা খেলাফ করো না। অতঃপর তাদের পালনকর্তা তাদের দুআ এই বলে কবূল করে নিলেন যে, আমি তোমাদের কোন পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, সে পুরুষ হোক বা নারী লোক হোক। তোমরা সকল নারী-পুরুষই সমান। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৯৩-১৯৫) সুতরাং আল্লাহর এই নামের (রব্ব) মাধ্যমে উসীলা দেয়া দুআ কবূলের অন্যতম কারণ।

৩) এই লোকটি মুসাফির ছিল। সফর করাকে অধিকাংশ সময় দুআ কবূলের কারণ হিসাবে গণ্য করা হয়। কেননা সফর অবস্থায় মানুষ আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। স্বদেশে অবস্থানকারীর চেয়ে মুসাফির আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি অধিক মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। মুসাফির এলোমেলো কেশ বিশিষ্ট ও ময়লাযুক্ত কাপড় পরিধানকারী হয়। মনে হয় সে নিজের নফসের প্রতি কোন গুরুত্বই দিচ্ছে না। আল্লাহর কাছে দুআ করা ব্যতীত তার অন্য কোন উপায় নেই। সফরে থেকে এলোকেশ বিশিষ্ট হয়ে ও ময়লাযুক্ত পোশাক পরিহিত অবস্থায় দুআ করা দুআ কবূলের পক্ষে খুবই সহায়ক। হাদীছে আছে, আল্লাহ তাআলা আরাফার দিন বিকাল বেলা দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং আরাফাতে অবস্থানকারীদেরকে নিয়ে ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করে বলেন, প্রতিটি অঞ্চল হতে তারা আমার কাছে এসেছে, ধুলা-মলিন পোষাক নিয়ে এবং এলোকেশ বিশিষ্ট অবস্থায়।

যাই হোক দুআ কবূলের উপরোক্ত কারণগুলো থাকা সত্বেও কোন কাজ  হলো না। কারণ একটাই তার খাদ্য-পানীয় ছিল হারাম, পোষাক ছিল হারাম এবং হারাম খেয়ে তার দেহ গঠিত হয়েছে। এ জন্যই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, কি ভাবে তার দুআ কবূল করা হবে? দুআ কবূলের এই শর্তগুলো পাওয়া না গেলে দুআ কবূলের কোনই সম্ভাবনা নেই। শর্তগুলো বর্তমান থাকার পরও যদি দুআ কবূল না হয়, তাহলে বুঝতে হবে কি কারণে দুআ কবূল হয়নি, তা আল্লাহই ভাল জানেন। দুআকারী এ বিষয়ে জানার কোন সুযোগ নাই। দুুআ কবূলের সকল শর্ত বর্তমান থাকার পরও দুআ কবূল না হলে হতে পারে আল্লাহ তার উপর থেকে দুআ কবূলের চেয়ে বড় কোন মুসিবত দূর করবেন। অথবা এও হতে পারে যে, কিয়ামতের দিনের জন্য তার দুআকে সঞ্চয় করে রাখবেন এবং সেদিন তাকে অধিক পরিমাণে বিনিময় দান করবেন। কেননা ব্যক্তি দুআ কবূলের সকল শর্ত বাস্তবায়ন করে আল্লাহর কাছে দুআ করার পরও দুআ কবূল করা হয়নি এবং তার উপর থেকে বড় কোন মুসিবতও দূর করা হয়নি। হয়ত বান্দা দুআ কবূলের সকল শর্ত পূরণ করে দুআ করেছে। কিন্তু দ্বিগুণ পুরস্কার দেয়ার জন্য তার দুআ কবূল করা হয়নি। একটি পুরস্কার দুআ করার কারণে এবং অন্য একটি পুরস্কার মুসীবত দূর না করার কারণে। সুতরাং তার জন্য দুআ কবূলের চেয়ে মহান জিনিষ তার জন্য ক্বিয়ামতের দিন সঞ্চয় করে রাখা হবে।

মানুষের উচিৎ হল দুআর ফলাফলের জন্য তাড়াহুড়া না করা। কেননা তাড়াহুড়া করা দুআ কবূল না হওয়ার অন্যতম কারণ। হাদীছে এসেছে,

তোমাদের কেউ দুআয় তাড়াহুড়া না করলে তার দুআ কবূল হয়ে থাকে। ছাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে তাড়াহুড়া করা হয়ে থাকে? রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, বান্দা বলে থাকে কত দুআ করলাম, কত দুআ করলাম, কত দুআ করলাম, কিন্তু কবূল তো হচ্ছে না। তাই কারও জন্য দুআতে তাড়াহুড়া এবং দুআ করতে করতে ক্লান্তি বোধ করে দুআ করা ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়; বরং বেশী বেশী দুআ করা উচিৎ। কারণ দুআ একটি এবাদত। যা মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে এবং প্রতিদান বৃদ্ধি করবে। কাজেই হে দ্বীনী ভাই! ছোট-বড় এবং কঠিন ও সহজ সকল বিষয়ে আপনাকে বেশী বেশী দুআ করার উপদেশ দিচ্ছি। আল্লাহ সবাইকে তাওফীক দিন।