“তারা মুজাহিদ, তবে শয়তানের রাস্তায়...”
আইসিস,
আল-কায়েদাহ, জেএমবি, বোকো হারামের মতো চরমপন্থী, জংগী সংগঠনগুলোর ব্যপারে মদীনার আলেমদের ফতোয়াঃ
মসজিদে নববী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইমামদের মাঝে শায়খ সালাহ আল-বুদাইর হা’ফিজাহুল্লাহ আমার খুব প্রিয় একজন ক্বারী। আজ
থেকে ৫-৬ বছর পূর্বে এই শায়খের অনেক তেলাওয়াত শুনতাম, অত্যন্ত মিষ্টি তাঁর কন্ঠ, শুনলেই
অন্তরটা নরম হয়ে আসে এমন মধুর। তাঁর ব্যক্তিগত আমল-আখলাক অত্যন্ত
সুন্দর মাশাআল্লাহ। তাঁর ব্যপারে আইসিসের অনুসারী,
অস্ট্রেলিয়ান রিভার্ট মুসা সেরান্টানিও পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলো, তিনি অত্যন্ত
ভালো একজন মানুষ।
যাই
হোক, কথিত খিলাফতের দাবীদার আইসিস বা দাইয়ি’শের উপরে মদীনার সম্মানিত এই খতিব
২০১৫ সালের ১৪-ই আগস্ট মসজিদে নববীতে গুরুত্বপূর্ণ একটি খুতবাহ দেন। তাঁর খুতবার
মূল শিরোনাম ছিলঃ
“দাইয়িশ
ইসমুন জামিউন লিল খুবুছি ওয়াল খাবাইছ।”
শায়খ
সালাহ আল-বুদাইর হা’ফিজাহুল্লাহ
সেই খুতবার মাঝে বলেন,
“পেশাব-পায়খানায়
যাওয়ার পূর্বে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে যেই দুয়াটি পড়তে
বলেছেন সেটি হচ্ছে –
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخُبْثِ وَالْخَبائِث
উচ্চারণঃ
আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ’উযুবিকা মিনাল খুবসি ওয়াল খাবা-ইসি।
অর্থঃ
হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট খবিস (অপবিত্র) পুরুষ জিন ও নারী জিন থেকে আশ্রয় চাই।
দাইয়িশ
(ইংরেজীতে আইসিস বা আইএস) এর ব্যাপারেও আমাদের এমন অবস্থান
হওয়া উচিত।”
শায়খের কথার ব্যাখ্যাঃ
বাথরুমে
খবিস জিনেরা থাকে। একারণে বাথরুমে যাওয়ার পূর্বে তাদের ক্ষতি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয়
চাইতে হয়। দাইয়িশ বা আইসিস হচ্ছে, খারেজীদের একটা দল, যাদের
প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে খুন ও মুসলিম সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করা,
যদিওবা তারা নিজেদেরকে মুজাহিদ বলে দাবী করে। এমন নিকৃষ্ট খারেজীদের ব্যপারে
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “শেষ যামানায় একদল তরুণ বয়সী, নির্বোধ লোকের আবির্ভাব
ঘটবে, যারা সবচাইতে উত্তম কথা বলবে। তারা ইসলাম থেকে এত দ্রুত গতিতে বের হয়ে যাবে, যেইভাবে তীর ধনুক থেকে বের হয়ে যায়। তাদের ঈমান তাদের কণ্ঠনালী
অতিক্রম করবে না। তোমরা তাদেরকে যেখানেই পাবে সেখানেই হত্যা করবে। কারণ যে তাদেরকে
হত্যা করবে তার জন্য ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট নেকী রয়েছে।” বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদঃ ৪৭৬৭, নাসাঈ।
শায়খ
সালাহ আল-বুদাইর হা’ফিজাহুল্লাহর
মতে, খবিস জিনের ক্ষতি থেকে যেমন আমাদের আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে হয়, ঠিক তেমনি আইসিসের
ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্যে আমাদের আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া উচিৎ। একথা কতটা সত্যি
একটা উদাহরণ দিলে আপনারা খুব সহজেই বুঝবেন।
কয়েকটি উদাহণ এবং তার উপরে মূল্যায়নঃ
(১) বিগত
৬-ই আগস্ট ২০১৫ইং তারিখ, রোজ বৃহস্পতিবার সউদি আরবের ‘আসির’ নামক এলাকায় একটি মসজিদে জোহর নামাজের জামাত
চলাকালে আইসিস খারেজীদের একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী বোমা বিষ্ফোরণ ঘটায়। এতে হামলাকারী
বাদে ১৫জন মুসল্লি নিহত হন। এদের মধ্যে চারজন বাংলাদেশী নাগরিকও
রয়েছেন, যারা ওই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণকারী ছিলেন। নিহত ১১ সউদি নাগরিকের মধ্যে পাঁচজন সউদি আরবের নিরাপত্তা বাহিনীর ‘স্পেশাল ফোর্স’ এর সদস্য ছিলেন। তাদের কাজ ছিলো, হজ্জের সময়
নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্ব পালন করা। আইসিস বা আইএস-এর খারেজীরা
জঘন্য এই কাজটি করেছে। ইতিঃপূর্বে ২০১৫ সালে রমযান মাসের প্রথম
জুমুয়াহর দিন সীমান্ত বাহিনীর লোকেরা যখন জুমুয়াহর নামায পড়তে যান, সেই সুযোগে তাদের
উপর আক্রমন চালিয়েছিলো।
(২) এই আইসিস খারেজীদের অনুসারীরা এবছর (২০১৬ সালের ১-লা জুলাই)
আমাদের দেশে গুলশানের একটি হোটেলে রমযান মাসে তারাবীর নামায না পড়ে নিরীহ কতগুলো
বিদেশি জিম্মি করে অন্যায়ভাবে তাদেরকে হত্যা করে। নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ‘মুআহিদ’
তথা চুক্তিবদ্ধভাবে মুসলিম দেশে বসবাসকারী কোন অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের
সুঘ্রাণও পাবে না (জান্নাতে যাওয়া তো দূরে থাক), অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ চল্লিশ
বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকে পাওয়া যাবে।” সহীহ বুখারীঃ ৩১৬৬।
জানিনা এরা গুলশানে কিছু নিরীহ কাফির, যাদের বেশিরভাগ ছিলো
আমাদের বন্ধুপ্রতিম জাপান বা অন্যান্য দেশের নাগরিক, তাদেরকে হত্যা করে এর উম্মতের
কি উপকার করেছে। জানিনা এদের গুলশান আক্রমন দ্বারা ফিলিস্থিন, সিরিয়া, কাশ্মীর,
ইরাক বা আফগানিস্থানের নির্যাতিত মুসলিমদের দুঃখ কতটুকু লাঘব হয়েছে? কিন্তু, এদের
আক্রমনের ফলে বাংলাদেশ সরকার, পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে ধার্মিক মুসলমানেরা
টার্গেট হচ্ছে। সরকার বা পুলিশ চিনেনা, কে জংগী আর কে মুসলমান। তাই আজকে
ইউনিভার্সিটির হলগুলোতে দাঁড়ি টুপি, হিজাব-পর্দা দেখলে, ইসলামী বই-পুস্তক দেখলেই
তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে, জংগী বলে হেনস্থা করা হচ্ছে। অনেক সময় আইন-শৃংখলা বাহিনী
কর্তৃক গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। কিন্তু তখন এই খারেজীরা
মুসলমানদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেনা। তাদের দায়িত্ব শুধু হচ্ছে, কাপুরুষের মতো
শুধুমাত্র দুই-চারটা নিরস্ত্র কাফির হত্যা করা আর নিজেরা আত্মহত্যা করা আর নয়তো
পাখির মতো গুলি খেয়ে মরা। কিন্তু তাদের এই অন্যায়, ইসলাম বিরোধী আক্রমনের ফলে
সাধারণ মুসলমানেরা যে বিপদে পড়ছে, এটা চিন্তা করার মতো মানবীয় হৃদয় বা এটা বোঝার
মতো বুদ্ধি তাদের নেই।
(৩) এই সপ্তাহেই সৌদি আরবে আইসিসের সমর্থক একজন ফিলিস্থিনী লোক
ধরা পড়েছে, যে কিনা সৌদি আরবে জনসাধারণের উপরে আক্রমন করার জন্যে পরিকল্পনা
করছিলো। চিন্তা করে দেখুন, ‘মুজাহিদ’ দাবীদার এই খারেজীরা কতটা কতটা নির্বোধ।
১৯৪৮ সাল থেকে অভিশপ্ত ইয়াহুদীরা তার জন্মভূমি ফিলিস্থিন দখল করে রেখেছে, সেখানে
কত যে মুসলমানদেরকে তারা হত্যা করেছে এবং এখনও করছে। সেই ইয়াহুদীদেরকে বাদ দিয়ে সে
সৌদি আরবের মতো নিরাপদ ভূমিতে মুসলিমদেরকে হত্যা করার জন্যে ষড়যন্ত্র করছে। এরপরেও
নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি
ওয়া সাল্লাম-এর সহীহ হাদীস অনুযায়ী এই সমস্ত “জাহান্নামের কুকুর” খারেজীদেরকে যেই সমস্ত নারী ও
পুরুষেরা ‘হক্কপন্থী’, ‘মুজাহিদ’, ‘উম্মতের জন্যে কল্যাণকামী’ বলে মনে করবে, এদেরকে ‘প্রবৃত্তি পূজারী’ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? এদের মতো
বিবেক বর্জিত লোকদের ব্যপারে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন রাহিমাহুল্লাহ
(মৃত্যু ৭৬১ খ্রীস্টাব্দ) বলেছিলেন, “আমার মনে হয় আজকে যদি
দাজ্জাল বের হয় তাহলে মনপূজারী, বিদআ’তীরা তাকেই অনুসরণ করবে।” শরাহ উসুল আল-ইতিক্বাদ
আহলে সুন্নাহঃ ১/১৩১।
এইভাবে
আইসিস, আল-কায়েদাহ, জেএমবি, বোকো হারামের মতো চরমপন্থী, জংগী সংগঠনগুলো বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মসজিদে নামাযরত অবস্থায়
অনেক মুসলমানদেরকে হত্যা করেছে, যদিও তারা মুখে দাবী করছে তারা ইসলামের পবিত্র বিধান
‘জিহাদ’ করছে, এবং এইভাবে তারা ‘দ্বীন কায়েম’ করবে। নামধারী এই সংগঠনের লোকেরা ক্বুরান হাদীস
না জেনেই নিজস্ব মনগড়া পদ্ধতিতে ইসলাম নাম দিয়ে সন্ত্রাসবাদ প্রচার করে ইসলামের দাওয়াতী
কাজে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসছে। ইসলামের বন্ধু নাম নিয়ে শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া
এই খারজীরা এটা জানেনা যে, নামাযরত অবস্থায় কোন মুসলমান মারাতো দূরের কথা, গির্জার
ভেতর উপাসনারত কোন নিরীহ খ্রীস্টানকেও হত্যা করতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন, তিনি বলেন,
“তোমরা উপাসনালয়ে উপাসনারত ব্যক্তিদেরকে হত্যা
করোনা।” মুসনাদে আহমাদ।
জিহাদ
নাম দিয়ে ফেতনা ফাসাদ সৃষ্টি করা ও মুসলমানদেরকে নির্দয়ভাবে হত্যার করার কারণে মদীনার
সবচাইতে বড় আলেম, আল্লামাহ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ হা’ফিজাহুল্লাহ আইসিসের মূল
সংগঠন ‘আল-কায়েদাহ’ এর ব্যপারে বলছিলেন, “তারা (আল-কায়েদাহ) মুজাহিদ, তবে শয়তানের রাস্তায়। নাআ’ম।”