তাবলিগ
জামাতের ফাজায়েলে হজ্জে শিরকের ভেজালঃ
“এমন
অনেক লোক আছে, স্বয়ং কাবা ঘর যাদের জিয়ারত করতে যায়!”
পোস্ট
লিখেছেনঃ Anisur Rahman.
______________________________
ফাজায়েলে
হজ্জঃ শাইখুল হাদিস যাকারিয়া সাহারনপুরি সাহেব কর্তৃক লিখিত বিখ্যাত একটি কিতাব। কিতাবটি
তাবলিগী ভাইদের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। এমনকি প্রতি বছর হজের সময় এই বইয়ের তালিম দেয়া
হয় এবং হাজীদেরকে এই বই পাঠ করার ও হৃদয়ঙ্গম করা এবং সে অনুযায়ী হজ সম্পাদন করার জন্য
উৎসাহ ও (ক্ষেত্রবিশেষে) নির্দেশ দেয়া হয়।
ক্ষুদ্র
এই কিতাবে তিনি হজের ফজিলত সম্পর্কে কুরআনের আয়াত এবং বিভিন্ন হাদীস উল্লেখ করেছেন
যার মধ্যে সহীহ হাদীসের পাশাপাশি জাল, যইফ ও বানোয়াট হাদীসেরও বিশাল সমাহার ঘটিয়েছেন।
এছাড়া অনেক আজগুবি কিসসা-কাহিনী ও ঈমান বিধ্বংসী গল্পগুজব উপস্থাপন করেছেন।
এমন
একটি ঘটনা নিয়ে আজ আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। শাইখুল হাদিস যাকারিয়া সাহারনপুরি
সাহেব তার ‘ফাজায়েলে হজ্জ’ নামক কিতাবের ১০৯ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেনঃ
“অনেক
লোক তো এমনও আছে, স্বয়ং বাইতুল্লাহ জেয়ারতের জন্য তাহাদের নিকট যায়।”
রেফারেন্সঃ
ফাজায়েলে হজ্জ, মূল লেখকঃ যাকারিয়া সাহারানপুরি। বংলা অনুবাদকঃ মাওলানা মোহাম্মদ ছাখাওয়াত
উল্লাহ; দিল্লী ও কাকরাইলের মুরুব্বিদের অনুমতিতে লিখিত। প্রকাশনীঃ তাবলীগী কুতুবখানা,
৫০ বাংলাবাজার; সংশোধিত সংস্করন, অক্টোবর ২০০২ ই; পৃষ্ঠা নঃ ১০৯ [আপনারা পোস্টে বইয়ের পৃষ্ঠার
স্ক্যান করা অংশের ছবি দেখুন]।
হয়তো
অনেক পাঠকের চোখ কপালে উঠে গেছে! এরকম আজগুবি কথা কেউ কি বলতে পারে! জ্বী হা। এরকম
আজগুবি কথা যারা বলতে পারে, তারা আমাদের উপমহাদেশে ‘শাইখুল হাদিস’ নামে পরিচিতি। এবং তাদের কিতাব সমগ্র উপমহাদেশে
ওয়াহীর মতো পাঠ করা হয়, যেন এর মধ্যে কোনো ভুল থাকতেই পারে না।
মহান
আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “আল্লাহ্র
জন্য উক্ত ঘরের হাজ্জ করা লোকদের উপর অবশ্য কর্তব্য। যার সে পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য
আছে অতঃপর যে ব্যাক্তি তা অস্বীকার করবে, সে জেনে রাখুক! নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ বিশ্ব
জাহানের মুখাপেক্ষী নন।’’ [আলে
ইমরানঃ ৯৭]
হে
সম্মানিত মুসলিম ভাই ও বোনেরা!
চিন্তা
করে দেখুন, কি বলা হয়েছে এখানে! যে কাবা ঘর পর্যন্ত পৌঁছা, তাওয়াফ করা, জিয়ারত করা
যাদের সামর্থ্য আছে তাদের জন্য আল্লাহ ‘ফরয’ করে দিয়েছেন। আর যে ঘরে পৌঁছা ইসলামের অন্যতম
রুকন, সেই কাবা ঘর নাকি নিজেই অনেক লোকের জিয়ারত করতে যায়! (নাউজুবিল্লাহ)
হাস্যকর,
বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বর্ণনারও একটা সীমা থাকা দরকার! আমাদের মনে হয় ‘শাইখুল হাদীস’ জাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেব সেগুলোরও সীমা অতিক্রম
করে ফেলেছেন! যাই হোক, আমাদের মানদণ্ড কুরআন ও সুন্নাহ। আমরা চেষ্টা করবো কুরআন ও হাদিসের
কষ্টিপাথরে উপরোক্ত বক্তব্য যাচাই করতে ইন শা আল্লাহ।
রাসুল
(সাঃ) ও সাহাবীরা হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় কাফের ও মুশরিকদের বাধার কারনে বাইতুল্লাহ
জিয়ারত করতে পারেননিঃ
হুদায়বিয়ার
সন্ধিকে ‘গাযওয়া’ বা যুদ্ধ বলা হয় এ কারনে যে, কুরাইশগন রাসুল
(সাঃ)-কে এখানে উমরার জন্য মক্কায় প্রবেশে বাধা দিয়েছিল। রাসুল (সাঃ) ষষ্ঠ হিজরীর ১লা
যুলকাদাহ সোমবার স্ত্রী উম্মে সালামাহ সহ প্রায় ১৫০০ শত সাথীদেরকে নিয়ে উমরার উদ্দেশ্যে
মদীনা থেকে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। এই সময় কোষবদ্ধ তরবারি ছাড়া তাদের সাথে অন্য কোনো
অস্ত্র ছিল না। কিন্তু মক্কার অদূরবর্তী হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌছলে তাঁরা কুরাইশ
নেতাদের বাধার সম্মুখিন হন। অবশেষে তাদের সঙ্গে দশ বছরের চুক্তি সাক্ষরিত হয়। ফলে চুক্তির
শর্তানুযায়ী রাসুল (সাঃ) মদীনায় ফিরে আসেন এবং পরের বছর উমরা করেন।
এই
সন্ধির অন্যতম শর্ত ছিল ‘’রাসুল
(সাঃ) এবছর মক্কায় প্রবেশ না করেই সঙ্গী সাথীগনসহ মদিনায় ফিরে যাবেন। মুসলিমগণ আগামী
বছর মক্কায় আগমন করবেন এবং সেখানে তিনদিন অবস্থান করবেন’’ আর রাহীকুল মাখতুম-সফিউর রহমান মুবারকপুরী;
পৃষ্ঠা নঃ ৩৮৯; যাদ আল মা’আদ-
ইবনুল কাইয়িম; পৃষ্ঠা নঃ ২৫৬; সীরাত ইবন হিশাম; পৃষ্ঠা নঃ ২৪৯-২৫০; সীরাতুর রাসুল
(সাঃ), আসাদুল্লাহ আল গালীব পৃষ্ঠা নঃ ৪১২
বারা
(রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী (সাঃ) যখন বাইতুল্লাহ শরীফের নিকট বাধাগ্রস্ত হলেন,
তখন মক্কাবাসীরা এ মর্মে তাঁর সঙ্গে সন্ধি করলো যে, (পরবর্তী বছর) তিনি মক্কায় প্রবেশ
করবেন এবং তিনদিন সেখানে অবস্থান করতে পারবেন। তারপর (পরের বছর তিনি সাহাবাদের নিয়ে
তাশরীফ আনলেন) সেখানে তিনি তিনদিন অবস্থান করলেন। যখন তৃতীয়দিন সমাগত হল, তখন তারা
আলী (রাঃ)-কে বলল, এটা হচ্ছে তোমার সাথীর শর্তের স্থিরকৃত শেষ দিবস। তাঁকে বেরিয়ে যেতে
বলে দাও। তখন তিনি তাঁকে এ সম্পর্কে অবহিত করলেন। তিনি বললেন, হাঁ। এরপর তিনি বেরিয়ে
গেলেন। মুসলিম ৪৫২৩
এরকম
একটা সন্ধির পর উমার ইবন খাত্তাব (রাঃ) ক্রোধান্বিত হয়ে পরলেনঃ
হুদায়বিয়ার
সন্ধিচুক্তির পর দু'টি বিষয় দুটি বিষয় মুসলিম কাফেলার অন্তরে দারুণভাবে প্রতিক্রিয়া
সৃষ্টি করেছিল, যা তাদের হৃদয়কে দুঃখে ও বেদনায় ভারাক্রান্ত করে ফেলেছিল।
১)
রওয়ানা হবার সময় রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেন যে, আমরা বাইতুল্লাহ জিয়ারত করবো ও তাওয়াফ
করবো। অথচ এখন তা না করেই মদীনায় ফিরে যেতে হচ্ছে।
২)
মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল এবং তিনি সত্যের উপর আছেন। উপরন্ত আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে
বিজয়ী করার ওয়াদা করেছেন। তাহলে কুরাইশদের চাপে তিনি কেন এরুপ হীন শর্তে সন্ধি করলেন।
উসায়েদ
বিন হুযায়ের, সাদ বিন উয়াবাদাহ, সাহল বিন হুনাইফ এবং অন্যান্য সকলের অনুভূতির মুখপাত্র
স্বরূপ উমার (রাঃ) রাসুল (সাঃ)-এর সাথে বাদানুবাদ করেনঃ
আবুল
ওয়ায়িল (রাঃ) হতে বর্ণিত। উমার (রাঃ) রাসুল (সাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, ''হে আল্লাহর
রাসুল! আমরা কি সত্যের উপর নই, আর তারা বাতিলের উপর নয়?
তিনি
বললেন, হাঁ, তাই।
তিনি
আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের নিহতরা কি জান্নাতি এবং তাদের নিহতরা কি জাহান্নামি নয়?
তিনি
বললেন, হাঁ।
তখন
তিনি বললেন, তাহলে কি কারনে আমরা দ্বীনের ব্যাপারে লাঞ্ছনা মেনে নিয়ে ফিরে যাবো, অথচ
এখনো এ ব্যাপারে তাদের ও আমাদের মধ্যে আল্লাহর কোন ফয়সালা আসেনি?
তখন
রাসুল (সাঃ) বললেন, হে খাত্তাব পুত্র! নিঃসন্দেহে আমি আল্লাহর রাসুল। আর তিনি অবশ্যই
কখনো আমাকে ধ্বংস করবেন না।
রাবী
বলেন, তখন উমার (রাঃ) চলে গেলেন। তিনি ক্রোধে ধৈর্যধারণ করতে পারছিলেন না। তাই তিনি
আবু বকর (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং তাঁকে বললেন, হে আবু বকর! আমরা কি হকের উপর এবং তারা
কি বাতিলের উপর নয়?
তিনি
বললেন, অবশ্যই।
আবার
তিনি বললেন, আমাদের নিহতরা কি জান্নাতি এবং তাদের নিহতরা কি জাহান্নামি নয়?
তিনি
বললেন, নিশ্চয়ই। তখন তিনি বললেন, তাহলে কি কারনে আমরা দ্বীনের ব্যাপারে লাঞ্ছনা মেনে
নিয়ে ফিরে যাবো, অথচ এখনো এ ব্যাপারে আমাদের এবং তাদের মধ্যে আল্লাহ কোন ফয়সালা দেননি?
তখন
তিনি বললেন, হে খাত্তাব তনয়! নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসুল, আল্লাহ কখনো তাঁর বিনাশ করবেন
না।
রাবী
বললেন, এরপর রাসুল (সাঃ)-এর প্রতি বিজয়ের সুসংবাদ নিয়ে কুরআন অবতীর্ণ হল (আমি তোমাকে
দিয়েছি স্পষ্ট বিজয় সুরা ফাতহ (৪৮/১) তখন তিনি উমারকে ডেকে পাঠালেন এবং তাঁর সম্মুখে
পাঠ তা পাঠ করলে তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! এটা কি বিজয়? তিনি বললেন, হাঁ।
তখন তাঁর অন্তর শান্ত হল এবং তিনি ফিরে গেলেন। বুখারী ৩১৮২; মুসলিম ৪৫২৫
অন্য
একটি বর্ণনায় আছে, উমার (রাঃ) রাসুল (সাঃ)-কে বললেনঃ ''আপনি কি আমাদের বলেননি যে, আল্লাহর
ঘরের নিকট গমন করবেন এবং তাওয়াফ করবেন?
রাসুল
(সাঃ) বললেন, অবশ্যই, কিন্তু আমি আমি কি একথা বলেছিলাম যে, আমরা এ বছরই আসবো?’’
সহীহ
ইবন হিব্বান ৪৮৭২; আর রাহীকুল মাখতুম-সফিউর রহমান মুবারকপুরী; পৃষ্ঠা নঃ ৩৮৯; সীরাতুর
রাসুল (সাঃ), আসাদুল্লাহ আল গালীব পৃষ্ঠা নঃ ৪২০
হে
আমার মুসলিম ভাই! আপনি এখন চিন্তা করে দেখুন, সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসুল (সাঃ) এবং উম্মাতের
মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাত সাহাবীরা কাফেরদের বাধা দেয়ার কারনে বাইতুল্লাহ জিয়ারত করতে
না পেরে মদিনায় ফেরত চলে গেলেন। কই তাদের জন্য তো কাবা স্বয়ং তাদের কাছে উপস্থিত হয়
নাই! অথচ এমন অনেক লোক আছে, স্বয়ং কাবা ঘর যাদের জিয়ারত করতে যায়!!! মহান আল্লাহ আপনাকে
হক বুঝার, জানার ও মানার তৌফীক দান করুন।