নবীদের কাহিনী
- ডা আসাদুল্ললাহ
গালিব।
সূচী
ক. আইয়ূব (আলাইহিস
সালাম) এর পরিচয়
খ. আইয়ূব (আলাইহিস
সালাম) এর ঘটনাবলী
গ. শিক্ষণীয় বিষয়
সমূহ
আপনারা এই বই পুরোটা অনলাইনে ফ্রী পড়তে পারেন এই
লিংকে, বা কিনতে পারেন।
http://www.nobiderkahini.at-tahreek.com/index.html
___________________________
ক. আইয়ূব (আলাইহিস
সালাম) এর পরিচয়
হযরত আইয়ূব (আঃ)
ছবরকারী নবীগণের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় এবং অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলেন। ইবনু কাছীরের বর্ণনা
অনুযায়ী তিনি ইসহাক (আঃ)-এর দুই যমজ পুত্র ঈছ ও ইয়াকূবের মধ্যেকার প্রথম পুত্র ঈছ-এর
প্রপৌত্র ছিলেন। আর তাঁর স্ত্রী ছিলেন ইয়াকূব-পুত্র ইউসুফ (আঃ)-এর পৌত্রী ‘লাইয়া’ বিনতে ইফরাঈম বিন ইউসুফ। কেউ বলেছেন, ‘রাহমাহ’। তিনি ছিলেন স্বামী
ভক্তি ও পতিপরায়ণতায় বিশ্বের এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে তিনি ‘বিবি রহীমা’ নামে পরিচিত। তাঁর পতিভক্তি বিষয়ে উক্ত নামে জনপ্রিয় উপন্যাস সমূহ বাজারে চালু
রয়েছে। অথচ এ নামটির উৎপত্তি কাহিনী নিতান্তই হাস্যকর। পবিত্র কুরআনে সূরা আম্বিয়া
৮৪ আয়াতে رَحْمَةً مِّنْ عِنْدِنَا (‘আমরা আইয়ূবকে.... আরও দিলাম আমার পক্ষ হ’তে দয়া পরবশে’) বাক্যাংশের ‘রাহমাতান’ বা ‘রাহ্মাহ’ (رَحْمَةً) শব্দটিকে ‘রহীমা’ করে এটিকে আইয়ূবের
স্ত্রীর নাম হিসাবে একদল লোক সমাজে চালু করে দিয়েছে। ইহুদী-নাছারাগণ যেমন তাদের ধর্মগ্রন্থের
শাব্দিক পরিবর্তন ঘটাতো, এখানেও ঠিক ঐরূপ করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ যেন বলছেন যে, আইয়ূবের
স্ত্রী রহীমা তার স্বামীকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। পরে আমরা তাকে আইয়ূবের কাছে ফিরিয়ে দিলাম’। বস্ত্ততঃ এটি
একটি উদ্ভট ব্যাখ্যা বৈ কিছু নয়। মূলতঃ আইয়ূবের স্ত্রীর নাম কি ছিল, সে বিষয়ে সঠিক
তথ্য কুরআন বা হাদীছে নেই। এ বিষয়ের ভিত্তি হ’ল ইহুদী ধর্মনেতাদের রচিত কাহিনী সমূহ। যার উপরে পুরোপুরি
বিশ্বাস স্থাপন করাটা নিতান্তই ভুল। তাফসীরবিদ ও ঐতিহাসিকগণ আইয়ূবের জনপদের নাম বলেছেন
‘হূরান’ অঞ্চলের ‘বাছানিয়াহ’ এলাকা। যা ফিলিস্তীনের দক্ষিণ সীমান্ত বরাবর দামেষ্ক ও আযরূ‘আত-এর মধ্যবর্তী
এলাকায় অবস্থিত।[1]
পবিত্র কুরআনে ৪টি
সূরার ৮টি আয়াতে আইয়ূব (আঃ)-এর কথা এসেছে। যথা- নিসা ১৬৩, আন‘আম ৮৪, আম্বিয়া
৮৩-৮৪ এবং ছোয়াদ ৪১-৪৪।
আল্লাহ বলেন,
‘আর স্মরণ কর আইয়ূবের
কথা, যখন তিনি তার পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেন, আমি কষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি
সর্বোচ্চ দয়াশীল’। ‘অতঃপর আমরা তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তার দুঃখ-কষ্ট দূর করে
দিলাম। তার পরিবারবর্গকে ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সাথে তাদের সমপরিমাণ আরও দিলাম আমাদের
পক্ষ হ’তে দয়া পরবশে। আর এটা হ’ল ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশ স্বরূপ’ (আম্বিয়া ২১/৮৩-৮৪)।
অন্যত্র আল্লাহ
বলেন,
‘আর তুমি বর্ণনা
কর আমাদের বান্দা আইয়ূবের কথা। যখন সে তার পালনকর্তাকে আহবান করে বলল, শয়তান আমাকে
(রোগের) কষ্ট এবং (সম্পদ ও সন্তান হারানোর) যন্ত্রণা পৌঁছিয়েছে’ (ছোয়াদ ৩৮/৪১)।
‘(আমরা তাকে বললাম,) তুমি তোমার পা দিয়ে (ভূমিতে) আঘাত কর। (ফলে
পানি নির্গত হ’ল এবং দেখা গেল যে,) এটি গোসলের জন্য ঠান্ডা পানি ও (পানের জন্য উত্তম) পানীয়’ (৪২)। ‘আর আমরা তাকে দিয়ে দিলাম তার পরিবারবর্গ এবং তাদের সাথে তাদের সমপরিমাণ আমাদের
পক্ষ হ’তে রহমত স্বরূপ এবং জ্ঞানীদের জন্য উপদেশ স্বরূপ’ (৪৩)। ‘(আমরা তাকে বললাম,) তুমি তোমার হাতে একমুঠো তৃণশলা নাও। অতঃপর তা দিয়ে (স্ত্রীকে)
আঘাত কর এবং শপথ ভঙ্গ করো না (বরং শপথ পূর্ণ কর)। এভাবে আমরা তাকে পেলাম ধৈর্যশীল রূপে।
কতই না চমৎকার বানদা সে। নিশ্চয়ই সে ছিল (আমার দিকে) অধিক প্রত্যাবর্তনশীল’ (ছোয়াদ ৩৮/৪১-৪৪)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ ‘আর এভাবেই আমরা সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি’ (আন‘আম ৬/৮৪)।
অতঃপর আবু হুরায়রা
(রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আইয়ূব একদিন নগ্নাবস্থায় গোসল
করছিলেন (অর্থাৎ বাথরুম ছাড়াই খোলা স্থানে)। এমন সময় তাঁর উপরে সোনার টিড্ডি পাখি সমূহ
এসে পড়ে। তখন আইয়ূব সেগুলিকে ধরে কাপড়ে ভরতে থাকেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাকে ডেকে বলেন,
হে আইয়ূব! أَلَمْ اَكُنْ أُغْنِيَنَّكَ عَمَّا تَرَى؟ আমি কি তোমাকে
এসব থেকে মুখাপেক্ষীহীন করিনি? আইয়ূব বললেন, بَلَى وَعِزَّتِكَ ولكن لاغِنَى بِى عَنْ بَرَكَتِكَ তোমার ইযযতের কসম!
অবশ্যই তুমি আমাকে তা দিয়েছ। কিন্তু তোমার বরকত থেকে আমি মুখাপেক্ষীহীন নই’।[2]
___________________________
খ. আইয়ূব (আলাইহিস
সালাম) এর ঘটনাবলী
আইয়ূব (আঃ) সম্পর্কে
কুরআনে ও হাদীছে উপরোক্ত বক্তব্যগুলির বাইরে আর কোন বক্তব্য বা ইঙ্গিত নেই। কুরআন থেকে
মূল যে বিষয়টি প্রতিভাত হয়, তা এই যে, আল্লাহ আইয়ূবকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলেন। সে
পরীক্ষায় আইয়ূব উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। যার পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহ তাকে হারানো নে‘মত সমূহের দ্বিগুণ
ফেরৎ দিয়েছিলেন। আল্লাহ এখানে ইবরাহীম, মূসা, দাঊদ, সুলায়মান, আইয়ূব, ইউনুস প্রমুখ
নবীগণের কষ্ট ভোগের কাহিনী শুনিয়ে শেষনবীকে সান্ত্বনা দিয়েছেন এবং সেই সাথে উম্মতে
মুহাম্মাদীকে যেকোন বিপাদপদে দ্বীনের উপর দৃঢ় থাকার উপদেশ দিয়েছেন।
বিপদে ধৈর্য ধারণ
করায় এবং আল্লাহর পরীক্ষাকে হাসিমুখে বরণ করে নেওয়ায় আল্লাহ আইয়ূবকে ‘ছবরকারী’ হিসাবে ও ‘সুন্দর বান্দা’ হিসাবে প্রশংসা করেছেন (ছোয়াদ ৪৪)। প্রত্যেক নবীকেই
কঠিন পরীক্ষাসমূহ দিতে হয়েছে। তারা সকলেই সে সব পরীক্ষায় ধৈর্যধারণ করেছেন ও উত্তীর্ণ
হয়েছেন। কিন্তু আইয়ূবের আলোচনায় বিশেষ ভাবে إِنَّا وَجَدْنَاهُ صَابِراً ‘আমরা তাকে ধৈর্যশীল হিসাবে পেলাম’ (ছোয়াদ ৪৪) বলার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ তাঁকে
কঠিনতম কোন পরীক্ষায় ফেলেছিলেন। তবে সে পরীক্ষা এমন হ’তে পারে না, যা
নবীর মর্যাদার খেলাফ ও স্বাভাবিক ভদ্রতার বিপরীত এবং যা ফাসেকদের হাসি-ঠাট্টার খোরাক
হয়। যেমন তাকে কঠিন রোগে ফেলে দেহে পোকা ধরানো, দেহের সব মাংস খসে পড়া, পচে-গলে দুর্গন্ধময়
হয়ে যাওয়ায় ঘর থেকে বের করে জঙ্গলে ফেলে আসা, ১৮ বা ৩০ বছর ধরে রোগ ভোগ করা, আত্মীয়-স্বজন
সবাই তাকে ঘৃণাভরে ছেড়ে চলে যাওয়া ইত্যাদি সবই নবীবিদ্বেষী ও নবী হত্যাকারী ইহুদী গল্পকারদের
বানোয়াট মিথ্যাচার বৈ কিছুই নয়। ইহুদী নেতাদের কুকীর্তির বিরুদ্ধে যখনই নবীগণ কথা বলেছেন,
তখনই তারা তাদের বিরুদ্ধে খÿহস্ত হয়েছে এবং যা খুশী তাই লিখে
কেতাব ভরেছে। ধর্ম ও সমাজ নেতারা তাদের অনুসারীদের বুঝাতে চেয়েছে যে, নবীরা সব পথভ্রষ্ট।
সেজন্য তাদের উপর আল্লাহর গযব এসেছে। তোমরা যদি তাদের অনুসারী হও, তাহ’লে তোমরাও অনুরূপ
গযবে পড়বে। এ ব্যাপারে মুসলিম মুফাসসিরগণও ধোঁকায় পড়েছেন এবং ঐসব ভিত্তিহীন কাল্পনিক
গল্প ছাহাবী ও তাবেঈগণের নামে নিজেদের তাফসীরের কেতাবে জমা করেছেন। এ ব্যাপারে ছাহাবী
ইবনু আববাস ও তাবেঈ ইবনু শিহাব যুহরীর নামেই বেশী বর্ণনা করা হয়েছে। যে সবের কোন ছহীহ
ভিত্তি নেই।
এক্ষণে আমরা আইয়ূব
(আঃ)-এর বিষয়ে কুরআনী বক্তব্যগুলির ব্যাখ্যায় মনোনিবেশ করব। (১) সূরা আম্বিয়া ও সূরা
ছোয়াদের দু’স্থানেই আইয়ূবের আলোচনার শুরুতে আল্লাহর নিকটে আইয়ূবের আহবানের ( إِذْ نَادَى) কথা আনা হয়েছে। তাতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আইয়ূব নিঃসন্দেহে
কঠিন বিপদে পড়েছিলেন। যেজন্য তিনি আকুতিভরে আল্লাহকে ডেকেছিলেন। আর বিপদে পড়ে আল্লাহকে
ডাকা ও তার নিকটে বিপদ মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা নবুঅতের শানের খেলাফ নয়। বরং এটাই
যেকোন অনুগত বান্দার কর্তব্য। তিনি বিপদে ধৈর্য হারিয়ে এটা করেননি, বরং বিপদ দূর করে
দেবার জন্য আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেছিলেন। তবে সেই বিপদ কি ধরনের ছিল, সে বিষয়ে
কিছুই উল্লেখিত হয়নি। অতএব আল্লাহ এ বিষয়ে সর্বাধিক অবগত।
(২) কষ্টে পড়ার
বিষয়টিকে তিনি শয়তানের দিকে সম্বন্ধ করেছেন (مَسَّنِيَ الشَّيْطَانُ بِنُصْبٍ) ( ছোয়াদ ৪১), আল্লাহর দিকে নয়। এটা তিনি করেছেন আল্লাহর
প্রতি শিষ্টাচারের দিকে লক্ষ্য রেখে। কেননা শয়তান নবীদের উপর কোন ক্ষমতা রাখে না। এমনকি
কোন নেককার বান্দাকেও শয়তান পথভ্রষ্ট করতে পারে না। তবে সে ধোঁকা দিতে পারে, বিপদে
ফেলতে পারে, যা আল্লাহর হুকুম ব্যতীত কার্যকর হয় না। যেমন মূসা (আঃ)-এর সাথী যুবক থলে
থেকে মাছ বেরিয়ে যাবার কথা মূসাকে বলতে ভুলে গিয়েছিল। সে কথাটি মূসাকে বলার সময় তিনি
বলেছিলেন, وَمَا أَنْسَانِيْهُ إِلاَّ الشَّيْطَانُ
‘আমাকে ওটা শয়তান ভুলিয়ে দিয়েছিল’ (কাহফ ৬৩)। আসলে
শয়তানের ধোঁকা আল্লাহ কার্যকর হ’তে দিয়ে ছিলেন বিশেষ উদ্দেশ্যে, যা মূসা ও খিযিরের কাহিনীতে বর্ণিত হয়েছে। এখানেও
তেমনি শয়তানের ধোঁকার কারণে আইয়ূব তাকেই দায়ী করেছেন। কিন্তু ঐ ধোঁকা কার্যকর করা এবং
তা থেকে মুক্তি দানের ক্ষমতা যেহেতু আল্লাহর হাতে, সেকারণ তিনি আল্লাহর নিকটেই প্রার্থনা
করেছেন।
এক্ষণে শয়তান তাকে
কী ধরনের বিপদে ফেলেছিল, কেমন রোগে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন, দেহের সর্বত্র কেমন পোকা
ধরেছিল, জিহবা ও কলিজা ব্যতীত দেহের সব মাংস তার খসে পড়েছিল, পচা দুর্গন্ধে সবাই তাকে
নির্জন স্থানে ফেলে পালিয়েছিল, ইত্যাকার ১৭ রকমের কাল্পনিক কাহিনী যা কুরতুবী স্বীয়
তাফসীরে জমা করেছেন (কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৪) এবং অন্যান্য মুফাসসিরগণ আরও যেসব কাহিনী
বর্ণনা করেছেন, সে সবের কোন ভিত্তি নেই। বরং স্রেফ ইস্রাঈলী উপকথা মাত্র।
(৩) আল্লাহ বলেন,
‘আমরা তার দো‘আ কবুল করেছিলাম এবং তার দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিয়েছিলাম’ (আম্বিয়া ৮৪)।
কীভাবে দূর করা হয়েছিল, সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন যে, তিনি তাকে ভূমিতে পদাঘাত করতে বলেন।
অতঃপর সেখান থেকে স্বচ্ছ পানির ঝর্ণা ধারা বেরিয়ে আসে। যাতে গোসল করায় তার দেহের উপরের
কষ্ট দূর হয় এবং উক্ত পানি পান করায় তার ভিতরের কষ্ট দূর হয়ে যায় (ছোয়াদ ৪২)। এটি অলৌকিক
মনে হলেও বিষ্ময়কর নয়। ইতিপূর্বে শিশু ইসমাঈলের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে। পরবর্তীকালে হোদায়বিয়ার
সফরে রাসূলের হাতের বরকতে সেখানকার শুষ্ক পুকুরে পানির ফোয়ারা ছুটেছিল, যা তাঁর সাথী
১৪০০ ছাহাবীর পানির কষ্ট নিবারণে যথেষ্ট হয়। বস্ত্ততঃ এগুলি নবীগণের মু‘জেযা। নবী আইয়ূবের
জন্য তাই এটা হতেই পারে আল্লাহর হুকুমে।
এক্ষণে কতদিন তিনি
রোগভোগ করেন সে বিষয়ে ৩ বছর, ৭ বছর, সাড়ে ৭
বছর, ৭ বছর ৭ মাস ৭ দিন ৭ রাত, ১৮ বছর, ৩০ বছর, ৪০ বছর ইত্যাদি যা কিছু বর্ণিত হয়েছে[3],
সবই ইস্রাঈলী উপকথা মাত্র। যার কোন ভিত্তি নেই। বরং নবীগণের প্রতি ইহুদী নেতাদের বিদ্বেষ
থেকে কল্পিত।
(৪) আল্লাহ বলেন,
‘আমরা তার পরিবার বর্গকে ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সাথে সমপরিমাণ
আরও দিলাম আমাদের পক্ষ হ’তে দয়া পরবশে (আম্বিয়া ৮৪; ছোয়াদ ৪৩)। এখানে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি
তার বিপদে ধৈর্য ধারণের পুরস্কার দ্বিগুণভাবে পেয়েছিলেন দুনিয়াতে এবং আখেরাতে। বিপদে
পড়ে যা কিছু তিনি হারিয়েছিলেন, সবকিছুই তিনি বিপুলভাবে ফেরত পেয়েছিলেন। অন্যত্র আল্লাহ
বলেছেন, وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ ‘এভাবেই আমরা আমাদের সৎকর্মশীল বান্দাদের পুরস্কৃত করে থাকি’ (আন‘আম ৮৪)। এক্ষণে
তাঁর মৃত সন্তানাদি পুনর্জীবিত হয়েছিল, না-কি হারানো গবাদি পশু সব ফেরৎ এসেছিল, এসব
কষ্ট কল্পনার কোন প্রয়োজন নেই। এতটুকুই বিশ্বাস রাখা যথেষ্ট যে, তিনি তাঁর ধৈর্য ধারণের
পুরস্কার ইহকালে ও পরকালে বহুগুণ বেশী পরিমাণে পেয়েছিলেন। যুগে যুগে সকল ধৈর্যশীল ঈমানদার
নর-নারীকে আল্লাহ এভাবে পুরস্কৃত করে থাকেন। তাঁর রহমতের দরিয়া কখনো খালি হয় না।
(৫) উপরোক্ত পুরস্কার
দানের পর আল্লাহ বলেন, رَحْمَةً مِّنْ عِنْدِنَا ‘আমাদের পক্ষ হতে দয়া পরবশে’ (আম্বিয়া ৮৪)। এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ
কারু প্রতি অনুগ্রহ করতে বাধ্য নয়। তিনি যা খুশী তাই করেন, যাকে খুশী যথেচ্ছ দান করেন।
তিনি সবকিছুতে একক কর্তৃত্বশীল। কেউ কেউ অত্র আয়াতে বর্ণিত ‘রাহমাতান’ (رَحْمَةً) থেকে আইয়ূব (আঃ)-এর স্ত্রীর নাম ‘রহীমা’ কল্পনা করেছেন। যা নিতান্তই মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়’।[4]
(৬) ছহীহ বুখারীতে
আইয়ূবের উপর এক ঝাঁক সোনার টিড্ডি পাখি এসে পড়ার যে কথা বর্ণিত হয়েছে, সেটা হ’ল আউয়ূবের সুস্থতা
লাভের পরের ঘটনা। এর দ্বারা আল্লাহ বিপদমুক্ত আইয়ূবের উচ্ছ্বল আনন্দ পরখ করতে চেয়েছেন।
আল্লাহর অনুগ্রহ পেয়ে বান্দা কত খুশী হ’তে পারে, তা দেখে যেন আল্লাহ নিজেই খুশী হন। এজন্য আইয়ূবকে
খোঁচা দিয়ে কথা বললে অনুগ্রহ বিগলিত আইয়ূব বলে ওঠেন, ‘আল্লাহর বরকত থেকে আমি মুখাপেক্ষীহীন নই’। অর্থাৎ বান্দা সর্বদা সর্বাবস্থায় আল্লাহর রহমত ও বরকতের
মুখাপেক্ষী। নিঃসন্দেহে উক্ত ঘটনাটিও একটি মু‘জেযা। কেননা কোন প্রাণীই স্বর্ণ নির্মিত হয় না।
(৭) আল্লাহ আইয়ূবকে
বলেন, وَخُذْ بِيَدِكَ ضِغْثاً فَاضْرِبْ بِّهِ وَلاَ تَحْنَثْ ‘আর তুমি তোমার হাতে এক মুঠো তৃণশলা নাও। অতঃপর তা দিয়ে (স্ত্রীকে) আঘাত কর এবং
তোমার শপথ ভঙ্গ করো না’ (ছোয়াদ ৪৪)। অত্র আয়াতে আরেকটি ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, রোগ অবস্থায় আইয়ূব
শপথ করেছিলেন যে, সুস্থ হ’লে তিনি স্ত্রীকে একশ’ বেত্রাঘাত করবেন। রোগ তাড়িত স্বামী কোন কারণে স্ত্রীর উপর ক্রোধবশে এরূপ শপথ করেও
থাকতে পারেন। কিন্তু কেন তিনি এ শপথ করলেন, তার স্পষ্ট কোন কারণ কুরআন বা হাদীছে বলা
হয়নি। ফলে তাফসীরের কেতাব সমূহে নানা কল্পনার ফানুস উড়ানো হয়েছে, যা আইয়ূব নবীর পুণ্যশীলা
স্ত্রীর উচ্চ মর্যাদার একেবারেই বিপরীত। নবী আইয়ূবের স্ত্রী ছিলেন আল্লাহর প্রিয় বান্দীদের
অন্যতম। তাকে কোনরূপ কষ্টদান আল্লাহ পসন্দ করেননি। অন্য দিকে শপথ ভঙ্গ করাটাও ছিল নবীর
মর্যাদার খেলাফ। তাই আল্লাহ একটি সুন্দর পথ বাৎলে দিলেন, যাতে উভয়ের সম্মান বজায় থাকে
এবং যা যুগে যুগে সকল নেককার নর-নারীর জন্য
অনুসরণীয় হয়। তা এই যে, স্ত্রীকে শিষ্টাচারের নিরিখে প্রহার করা যাবে। কিন্তু তা কোন
অবস্থায় শিষ্টাচারের সীমা লংঘন করবে না। আর সেকারণেই এখানে বেত্রাঘাতের বদলে তৃণশলা
নিতে বলা হয়েছে, যার আঘাত মোটেই কষ্টদায়ক নয়’ (কুরতুবী, ছোয়াদ ৪৪)।
(৮) আইয়ূবের ঘটনা
বর্ণনার পর সূরা আম্বিয়া ও সূরা ছোয়াদে আল্লাহ কাছাকাছি একইরূপ বক্তব্য রেখেছেন যে,
এটা হ’ল وَذِكْرَى لِلْعَابِدِيْنَ ‘ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশ স্বরূপ’ (আম্বিয়া ৮৪) এবং وَذِكْرَى لِأُوْلِي الْأَلْبَابِ ‘জ্ঞানীদের জন্য
উপদেশ স্বরূপ’ (ছোয়াদ ৪৪)। এতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহর দাসত্বকারী ব্যক্তিই প্রকৃত জ্ঞানী
এবং প্রকৃত জ্ঞানী তিনিই যিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর দাসত্বকারী। অবিশ্বাসী কাফের-নাস্তিক এবং আল্লাহর অবাধ্যতাকারী ফাসেক-মুনাফিক
কখনোই জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান নয়। যদিও তারা সর্বদা জ্ঞানের বড়াই করে থাকে।
ক্বাযী আবুবকর ইবনুল
‘আরাবী বলেন, আইয়ূব সম্পর্কে অত্র দু’টি আয়াতে (আম্বিয়া
৮৩ ও ছোয়াদ ৪১) আল্লাহ আমাদেরকে যা খবর দিয়েছেন,
তার বাইরে কিছুই বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। অনুরূপভাবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) হ’তে (উপরে বর্ণিত)
হাদীছটি ব্যতীত একটি হরফও বিশুদ্ধভাবে জানা যায়নি। তাহ’লে কে আমাদেরকে
আইয়ূব সম্পর্কে খবর দিবে? অন্য আর কার যবানে আমরা এগুলো শ্রবণ করব? আর বিদ্বানগণের
নিকটে ইস্রাঈলী উপকথা সমূহ একেবারেই পরিত্যক্ত। অতএব তাদের লেখা পাঠ করা থেকে তোমার
চোখ বন্ধ রাখো। তাদের কথা শোনা থেকে তোমার কানকে বধির করো’ (কুরতুবী, ছোয়াদ
৪১-৪২)।
আইয়ূব (আঃ) ৭০ বছর
বয়সে পরীক্ষায় পতিত হন। পরীক্ষা থেকে মুক্ত হবার অনেক পরে ৯৩ বছর বা তার কিছু বেশী
বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তাবেঈ বিদ্বান মুজাহিদ
হ’তে বর্ণিত হয়েছে
যে, ক্বিয়ামতের দিন ধনীদের সম্মুখে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করা হবে হযরত সুলায়মান (আঃ)-কে
(২) ক্রীতদাসদের সামনে পেশ করা হবে হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে এবং (৩) বিপদগ্রস্তদের সামনে
পেশ করা হবে হযরত আইয়ূব (আঃ)-কে।[5]
___________________________
(গ) শিক্ষণীয় বিষয়
সমূহ :
(১) বড় পরীক্ষায়
বড় পুরস্কার লাভ হয়। ধন-সম্পদ ও পুত্র-কন্যা হারিয়ে অবশেষে রোগ জর্জরিত দেহে পতিত হয়েও
আইয়ূব (আঃ) আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুত হননি এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হননি। এরূপ
কঠিন পরীক্ষা বিশ্ব ইতিহাসে আর কারো হয়েছে বলে জানা যায় না। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)
তাই বলেন, إنَّ عِظَمِ الجزاءِ مع عظَمِ البلاء ... ‘নিশ্চয়ই বড় পরীক্ষায় বড় পুরস্কার লাভ হয়ে থাকে’।[6] আর দুনিয়াতে দ্বীনদারীর কঠোরতা ও শিথিলতার তারতম্যের
অনুপাতে পরীক্ষায় কমবেশী হয়ে থাকে। আর সেকারণে নবীগণ হ’লেন সবচেয়ে বেশী
বিপদগ্রস্ত।[7]
(২) প্রকৃত মুমিনগণ
আনন্দে ও বিষাদে সর্বাবস্থায় আল্লাহর রহমতের আকাংখী থাকেন। বরং বিপদে পড়লে তারা আরও
বেশী আল্লাহর নিকটবর্তী হন। কোন অবস্থাতেই নিরাশ হন না।
(৩) প্রকৃত স্ত্রী
তিনিই, যিনি সর্বাবস্থায় নেককার স্বামীর সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেন। আইয়ূবের স্ত্রী ছিলেন
বিশ্বের পুণ্যবতী মহিলাদের শীর্ষস্থানীয় দৃষ্টান্ত।
(৪) প্রকৃত ছবরকারীর
জন্যই দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা। আইয়ূব দম্পতি ছিলেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
(৫) শয়তান প্রতি
মুহূর্তে নেককার মানুষের দুশমন। শিরকী চিন্তাধরার জাল বিস্তার করে সে সর্বদা মুমিনকে
আল্লাহর পথ হ’তে সরিয়ে নিতে চায়। একমাত্র আল্লাহ নির্ভরতা এবং দৃঢ় তাওহীদ বিশ্বাসই মুমিনকে শয়তানের
প্রতারণা হ’তে রক্ষা করতে পারে।
___________________________
[1] ইবনু কাছীর,
আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ১/২০৬-১০ পৃঃ; কুরতুবী, ছোয়াদ ৪১।
[2] বুখারী, মিশকাত
হা/৫৭০৭ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায় ‘সৃষ্টির সূচনা ও
নবীগণের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ।
[3] কুরতুবী, আম্বিয়া
৮৪; ছোয়াদ ৪২; ইবনু কাছীর, আম্বিয়া ৮৩-৮৪।
[4] আল-বিদায়াহ
ওয়ান-নিহায়াহ ১/২০৯ পৃঃ।
[5] আল-বিদায়াহ
ওয়ান নিহায়াহ ১/২০৭, ২১০ পৃঃ।
[6] তিরমিযী, ইবনু
মাজাহ, মিশকাত হা/১৫৬৬ সনদ হাসান, ‘জানায়েয’ অধ্যায় ‘রোগীর সেবা ও রোগের ছওয়াব’ অনুচ্ছেদ।
[7] তিরমিযী, ইবনু
মাজাহ, দারেমী, মিশকাত হা/১৫৬২, সনদ হাসান, ‘জানায়েয’ অধ্যায় ‘রোগীর সেবা ও রোগের ছওয়াব’ অনুচ্ছেদ।