শুক্রবার, ২০ জুন, ২০১৪

জিনদের নাম, পরিচয় ও তাদের কাজঃ


জিনদের নাম, পরিচয় ও তাদের কাজ
মানুষ যেই জিনিস সম্পর্কে জানেনা, সেটাকে বেশি ভয় করে, কারণ অজানা জিনিস দ্বারা ক্ষতির আশংকা থাকে সেজন্য অজানা, অন্ধকার জিনিসের ব্যপারে মানুষ ভয় পায়অনেকে জিন ভয় পায়, অথচ একে ভয় পাওয়ার কিছু নেইআমরা যেমন একটা সৃষ্ট জীব, জিনেরাও আল্লাহর একটা বিশেষ সৃষ্ট জীবতবে সাপের গায়ে পা দিলে যেমন আমাদের ক্ষতি হতে পারে, ঠিক তেমনি জিন সম্পর্কে না জানলে তাদের থেকে আমাদের বিভিন্ন ধরণের ক্ষতি হতে পারেতাই জিন সম্পর্কে যারা ভয় পান, তাদের উচিৎ জিন জগত সম্পর্কে ভালো করে জানাআর তাদের ক্ষতি বা ফিতনাহ থেকে বাঁচার জন্য ক্বুরআন ও হাদিসে যেই নিয়ম ও আমল দেওয়া আছে সেইগুলো নিয়মিত করা, তাহলে জিন সম্পর্কে ভয় আস্তে আস্তে ইং শাআল্লাহ্‌ চলে যাবে আর তাদের থেকে সম্ভাব্য যেই ক্ষতি তা থেকে বেঁচে থাকা যাবে। যাই হোক, কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত কিছু শয়তানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় বর্ণনা করা হলো।
(১) ইবলিস আদম লাইহিস সালাম-কে ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রনা দিয়ে যেই জিন আল্লাহর আনুগত্য থেকে বিচ্যুত করেছিল, তার নাম হচ্ছে ইবলিসআল্লাহ ইবলিসকে সরাসরি আগুন থেকে সৃষ্টি করেছিলেন, সে হচ্ছে প্রথম জিন, যেমন আদম হচ্ছেন প্রথম মানুষইবলীস যে প্রথম জিন ছিলো, ক্বুরানের এই আয়াত থেকে দলীল নেওয়া হয়েছে, আল্লাহ বললেন, আমি যখন নির্দেশ দিয়েছি, তখন (হে ইবলীস) তোকে আদমকে সেজদা করতে কে বারণ করল? সে (ইবলীস) বলল, আমি তার (আদমের) চাইতে শ্রেষ্ট। আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা সুরা আরাফঃ ১২
হাসান আল-বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবলীস কোন ফেরেশতা ছিলোনা, এমনকি এক মুহূর্তের জন্যেও নয়। সে হচ্ছে জিন জাতির পিতা, যেমন আদম আলাইহিস সালাম হচ্ছেন মানব জাতির পিতা সনদ সহীহ, তাফসীর ইবনে কাসীরঃ ৩/৮৯।  
আদম লাইহিস সালাম-কে সিজদা করতে অস্বীকার করে সে আল্লাহর সামনে অহংকার প্রদর্শন করে, এই কারণে সে কাফের হয়ে চির জাহান্নামী ও আল্লাহর লানতপ্রাপ্ত হয়েছে তার সন্তানদের কেউ ঈমানদার মুসলিম, আবার কেউবা কাফের, তাদের পিতা ইবলিসের অনুসারী যারা কাফের জিন, তাদেরকে সাধারণভাবে শয়তান বলা হয় আদম লাইহিস সালাম ও ইবলিসের কাহিনী সংক্ষেপে জানার জন্য আপনারা সুরা ত্বোয়া-হা এর ১১৫-১৩৫ নাম্বার আয়াতের তর্জমা ও তাফসীর পড়ুন
(২) খানজাব খানজাব হচ্ছে বিশেষ একপ্রকার জিন, যারা মানুষ যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন তাদেরকে নানান রকম চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে সালাত থেকে অমনোযোগী ও উদাসীন করে তোলে এর ফলে তারা সালাতে ভুল করে, কত রাকাত পড়েছে মনে থাকেনা, কোনটা কি করছে সন্দেহে পড়ে যায়, সুরা-ক্বিরাতে উল্টা-পাল্টা করে। একারণে তাদের সালাতে সওয়াবও কমে যায় তাই আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে যথাযথ খুশু (ভয়) ও খুজু (বিনয়, স্থিরতা) সহকারে মনোযোগী হয়ে সালাত আদায় করার জন্য
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নামাযের জন্য যখন আযান দেওয়া হয় তখন শয়তান সশব্দে বায়ু ছাড়তে ছাড়তে পলায়ন করে, যেন সে আযানের শব্দ না শুনতে পারে আযান শেষ হলে সে আবার ফিরে আসে ইকামত আরম্ভ হলে আবার পলায়ন করে ইকামত বলা শেষ হলে পুনরায় উপস্থিত হয় এবং ওয়াসওয়াসা ঢেলে দিয়ে নামাযী ব্যক্তি ও তার অভীষ্ট লক্ষ্যের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যে সকল বিষয় তার স্বরণ ছিল না, সেই সব জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট করে সে বলতে থাকেঃ অমুক বিষয় স্বরণ কর, অমুক বিষয় স্বরণ কর ফলে সেই ব্যাক্তি কত রাকাত নামায পড়েছে, এমনকি সেটাও ভুলে যায় মুয়াত্তা মালিকঃ সালাত অধ্যায় ৩, হাদিসঃ ১৫২
বিঃ দ্রঃ সালাতে ওয়াসওয়াসা প্রদানকারী এই শয়তানের নাম হচ্ছে খানজাব
সালাতে শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে বাঁচার উপায়
সালাতে প্রথম রাকাতে কিরাত পড়ার পূর্বে উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম পড়বেন উযুবিল্ললাহদুয়া শুধু প্রথম রাকাতেই পড়া সুন্নত, এর পরের রাকাতগুলোর শুরুতে না পড়লেও হবে, তবে কেউ যদি চায় পড়তে পারবে এই দুয়া পড়ে শয়তান থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়, কারণ সালাতে দাড়ালে খানজাব নামের শয়তান কুমন্ত্রনা দিয়ে সালাত নষ্ট বা ক্ষতি করতে চায় সালাতের মাঝখানে সুরা-কেরাতে বা কত রাকাত, রুকু সেজদা নিয়ে শয়তান খুব বেশি ওয়াসওয়াসা দেয়/সন্দেহে ফেলে দেয় তাহলে কি করতে হবে?
সালাতে ও কেরাতের মাঝে শয়তানের কুমন্ত্রণায় পতিত ব্যক্তি যেই দুয়া করবেঃ ঊযু বিল্লাহি মিনাশ শাইত্বানির রাজীম, এই দুয়া বলে তারপর বাম দিকে তিনবার থুতু ফেলবে (থুতু ফেলার মতো করে নিঃশব্দে ফুঁ দিবে, কিন্তু থুতু ফেলবেনা)
উসমান ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! শয়তান আমার ও আমার সালাতের মাঝে অনুপ্রবেশ করে এবং কিরাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সেটা (উপরে যা বলা হয়েছে) বলার নির্দেশ দেন, তিনি সেটা করার পর আল্লাহ তাঁকে সেটা থেকে মুক্ত করেন মুসলিমঃ ৪/১৭২৯, ২২০৩
() ওলহান এরা হচ্ছে একপ্রকার শয়তান জিন, যারা মানুষকে ওযুর সময় ওয়াসওয়াসা দেয় ওয়াসওয়াসাগ্রস্ত মানুষেরা ওযুতে ভুল বেশি করে, সন্দেহ পড়ে এক কাজ কয়েকবার করে, তবুও মনে সন্দেহ থেকে যায় ওযুর অংগ ধোয়া হয়েছে কিনা? এভাবে তারা পানি ও সময় বেশি অপচয় করে
কি করতে হবে? এই ওয়াসওয়াসায় যারা আক্রান্ত তারা মনোযোগের সাথে কোন পাত্রে নির্দিষ্ট পরিমান পানি নিয়ে ওযু করবেন, টেপ ছেড়ে দিয়ে অমনোযোগী হলে শয়তান সহজেই ওয়াসওয়াসা দিবে অবশ্যই আল্লাহর নাম বিসমিল্লাহ বলে আস্তে ধীরে ওযু করা শুরু করবেন, অবশ্যই তাড়াহুড়া করবেন না প্রতিটা অংগ মনোযোগের সাথে উত্তমরুপে ধৌত হচ্ছে কিনা সেই দিকে খেয়াল রাখবেন আর কোন অংগ ধৌত করতে ভুলে গেলে নিশ্চিত হলে মেজাজ খারাপ না করে প্রথম থেকে ওযু শুরু না করে যেই অংগ থেকে ভুলে গেছে সেই অংগ থেকে আবার ধোয়া শুরু করবনে আর ওয়াসওয়াসা পড়লে এই দুয়া পড়বেনঃ উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম, এই দুয়া পড়ে শয়তান মনে কি ওয়াসওয়াসা দিচ্ছে সেইদিকে কোন লক্ষ্য করবেন না যেই অংগ থেকে ভুল করেছেন সেখান থেকে ওযু করবেন আস্তে আস্তে মনোযোগী হয়ে ওযু করার অভ্যাস গড়ে তুললে আস্তে আস্তে শয়তানের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবেন ইন শাআলাহ। মনে রাখবেন, এটা একটা মানসিক ব্যপার, আস্তে আস্তে মন ধীর-স্থির করার অভ্যাস করে এই ব্যধি থেকে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে, আর তার জন্য আল্লাহর কাছে দুয়া করতে হবে।
() ক্বারীন ক্বারিন অর্থ হচ্ছে সংগী, প্রত্যেক মানুষের সাথেই শয়তান জিন লেগে থাকে, সংগী হিসেবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন তোমাদের প্রত্যেককে জিনদের মধ্য হতে একজন ক্বারিন (সঙ্গী) দেয়া হয়েছে। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, এমনকি আপনাকেও ইয়া আল্লাহর রাসুল? তিনি বললেন, হ্যা, কিন্তু এখন সে আমাকে শুধু ভাল কাজ করতে বলে। সহীহ মুসলিমঃ ৭১৩৪।
এরা সবসময় বান্দার অন্তরে খারাপ চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়ে পাপ কাজ করতে উতসাহিত করে। এর অন্তরে খারাপ কথাটা নিক্ষিপ্ত করতে পারে, কিন্তু কাউকে কোন কাজ করতে বাধ্য করতে পারেনা। এজন্যে ওয়াসওয়াসার শিকার হয়ে যে পাপ কাজে লিপ্ত হবে, তাকে তার শাস্তি ভোগ করতে হবে, কারণ সে লোভে পড়ে স্বেচ্ছায় খারাপ কাজে লিপ্ত হয়েছিলো। ক্বুরআনে আল্লাহ এদের কথা উল্লেখ করেছেন সুরা ক্বাফে
উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম মৃত্যুযন্ত্রণা নিশ্চিত আসবে এ থেকেইতো তুমি টালবাহানা করতে এবং শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে, এটা হবে সেই ভয় প্রদর্শনের দিন প্রত্যেক ব্যক্তি আগমন করবে, তার সাথে থাকবে চালক ও কর্মের সাক্ষী। (তাকে বলা হবে), তুমি তো এই দিন সম্পর্কে উদাসীন ছিলে এখন তোমার কাছ থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছি ফলে আজ তোমার দৃষ্টি সুতীক্ষ্ণ তার সঙ্গী (আমলনামা লিপিবদ্ধকারী) ফেরেশতা বলবেঃ আমার কাছে যে, আমলনামা ছিল, তা এই তোমরা উভয়েই নিক্ষেপ কর জাহান্নামে প্রত্যেক অকৃতজ্ঞ বিরুদ্ধবাদীকে, যে বাধা দিত মঙ্গলজনক কাজে, সীমালঙ্ঘনকারী, সন্দেহ পোষণকারীকে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্য গ্রহণ করত, তাকে তোমরা কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ কর ক্বারীন (তার সঙ্গী শয়তান) বলবেঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমি তাকে অবাধ্যতায় লিপ্ত করিনি বস্তুতঃ সে নিজেই ছিল সুদূর পথভ্রান্তিতে লিপ্ত আল্লাহ বলবেনঃ আমার সামনে তোমরা বাকবিতন্ডা করো না, আমিতো পূর্বেই তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ভয় প্রদর্শন করেছিলাম আমার কাছে কথা রদবদল হয় না এবং আমি বান্দাদের প্রতি জুলুমকারী নই সুরা ক্বাফঃ ১৯-২৯
(৫) শয়তানের সাংগ-পাংগ উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, শয়তানের চেলা হচ্ছে নয়টি। (১) যালিতুন, (২) অসাইন, (৩) লাকুস, (৪) আওয়ান, (৫) হাফফাফ, (৬) মুররাত, (৭) মুসাইবিত, (৮) দাসিম, (৯) ওলহান।
যালিয়াতুন বাজারে থাকে। বাজারে থেকে সে তার পতাকা উড্ডয়ন করে। অসাইন মসিবত বা বিপদের মধ্যে থাকে। আওয়ান রাজা-বাদশাহদের সংগে থাকে। হাফফাফ মদের সংগে থাকে। মুররাহ গান-বাজনার সাথে থাকে। লাকুস মাজুসী বা অগ্নি পূজারীদের সাথে থাকে। মুসাইবিত, সে এমন সংবাদ দেয় যা ভিত্তিহীন। দাসিম ঘর-বাড়িতে থাকে। বাড়িতে প্রবেশের সময় কোন ব্যক্তি যদি বাড়ির লোকদেরকে সালাম না দেয়, তাহলে দাসিম নামক শয়তানের চেলা বাড়ির লোকদেরকে মধ্যে ঝগড়া সৃষ্টি করে দেয়, শেষ পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেয়, স্ত্রী খুলা করে স্বামী থেকে পৃথক হয়ে যায়, মারধর করে। ওলহান অযু, নামায ও ইবাদতে ওয়াসওয়াসা দেয়।

উৎসঃ ইবনে হাজার আসকালানী, আল-ইসতিদাদ লি-ইয়াওমিল মাআ (পরকালের পাথেয়)।