রিয়াদুস সালেহীনের
ভূমিকাতে ইমাম নববী (রহঃ) এর মূল্যবান উপদেশ
বিসমিল্লাহির রাহমানির
রাহীম
যাবতীয় প্রশংসা
সেই আল্লাহর জন্য, যিনি একক, প্রতাপশালী, পরাক্রমশালী, মহা ক্ষমাশীল। যিনি রাত্রিকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা, যা হৃদয়বান জ্ঞানবান ব্যক্তিদের জন্য উপদেশস্বরূপ, বিচক্ষণ ও উপদেশগ্রহণকারীদের জর্য জ্ঞানালোক স্বরূপ। যিনি সৃষ্টিকুলের মধ্য হতে
যাদেরকে মনোনীত করেছেন তাদেরকে সচেতন করেছেন, সুতরাং তাদেরকে
এ পার্থিব সংসারের মোহমুক্ত করেছেন, তাদেরকে তার নিজের
ব্যাপারে সতর্কতা ও সতত চিন্তা-গবেষণায় ব্যাপৃত রেখেছেন, তাদেরকে প্রতিনিয়ত উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণে রত রেখেছেন। তিনি তাদেরকে নিরবধি নিজ
আনুগত্য করার, আখেরাতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার, যে বিষয় তাকে অসন্তুষ্ট করে এবং ধ্বংস অনিবার্য করে সে বিষয় হতে সতর্ক থাকার এবং
অবস্থা ও পরিস্থিতির পরিবর্তন সত্ত্বেও তাতে যত্নবান থাকার তাওফীক দিয়েছেন।
আমি তার প্রশংসা
করি, অতিশয় ও পবিত্রতম প্রশংসা, ব্যাপকতম ও অধিকতম বর্ধনশীল
প্রশংসা। আর সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য
উপাস্য নেই, যিনি কৃপানিধি ও দানশীল, চরম দয়াশীল, পরম করুনাময়। সাক্ষ্য দেই যে, আমাদের নেতা মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, তাঁর প্রিয়পাত্র ও বন্ধু, যিনি সরল পথ-প্রদর্শক ও
সঠিক দ্বীনের প্রতি আহ্বানকারী। আল্লাহর অসংখ্য দরুদ ও সালাম তাঁর উপর বর্ষিত হোক এবং
সকল নবী,
সকলের বংশধর এবং সকল নেক বান্দাদের উপরও।
অতঃপর মহান আল্লাহ
বলেছেন,
﴿ وَمَا
خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ مَآ أُرِيدُ مِنۡهُم مِّن رِّزۡقٖ
وَمَآ أُرِيدُ أَن يُطۡعِمُونِ ٥٧ ﴾ [الذاريات: ٥٦، ٥٧]
“আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন
ও মানুষকে কেবল এ জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। আমি তাদের নিকট
হতে জীবিকা চাই না এবং এও চাই না যে তারা আমার আহার্য যোগাবে। (সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬-৫৭)
এটি স্পষ্ট ঘোষণা
যে, জ্বিন-ইনসান ইবাদতের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং তাদের উচিত, সেই কর্মের প্রতি যত্ন নেওয়া, যার জন্য তারা সৃষ্ট হয়েছে
এবং বিষয়-বিতৃষ্ণার সাথে ভোগ-বিলাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। যেহেতু পার্থিব জীবন হল
ক্ষণস্থায়ী, চিরস্থায়ী নয়। তা হল পারের নাও মাত্র, আনন্দের বসত-বাড়ী নয়। অস্থায়ী পানি পানের ঘাট, চিরস্থায়ী বাসস্থান নয়। এই জন্য তার সচেতন বাসিন্দা তারাই, যারা আল্লাহর ইবাদত-গুযার এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ তারাই, যারা তার প্রতি আসক্তিহীন। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ إِنَّمَا
مَثَلُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا كَمَآءٍ أَنزَلۡنَٰهُ مِنَ ٱلسَّمَآءِ فَٱخۡتَلَطَ
بِهِۦ نَبَاتُ ٱلۡأَرۡضِ مِمَّا يَأۡكُلُ ٱلنَّاسُ وَٱلۡأَنۡعَٰمُ حَتَّىٰٓ إِذَآ
أَخَذَتِ ٱلۡأَرۡضُ زُخۡرُفَهَا وَٱزَّيَّنَتۡ وَظَنَّ أَهۡلُهَآ أَنَّهُمۡ قَٰدِرُونَ
عَلَيۡهَآ أَتَىٰهَآ أَمۡرُنَا لَيۡلًا أَوۡ نَهَارٗا فَجَعَلۡنَٰهَا حَصِيدٗا كَأَن
لَّمۡ تَغۡنَ بِٱلۡأَمۡسِۚ كَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ ٱلۡأٓيَٰتِ لِقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ
٢٤ ﴾ [يونس: ٢٤]
“দুনিয়ার জীবনের দৃষ্টান্ত
তো এরূপঃ যেমন আমরা আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি যা দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট
হয়ে উদ্গত হয়, যা থেকে মানুষ ও জীব-জন্তু খেয়ে থাকে। তারপর
যখন ভূমি তার শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয় এবং তার অধিকারিগণ মনে করে সেটা তাদের আয়ত্তাধীন, তখন দিনে বা রাতে আমাদের নির্দেশ এসে পড়ে তারপর আমরা তা এমনভাবে নির্মূল করে দেই, যেন গতকালও সেটার অস্তিত্ব ছিল না। এভাবে আমরা আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করি এমন
সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে।” (সূরা ইউনুস: ২৪ আয়াত)
আর এ মর্মে আরও
অনেক আয়াত রয়েছে। কবি কত সুন্দরই না বলেছেন,
“নিশ্চয় আল্লাহর অনেক বিচক্ষণ বান্দা আছেন,
যাঁরা দুনিয়াকে
স্থায়ীভাবে বর্জন করেছেন এবং ভয় করেছেন ফিতনাকে।
দুনিয়া নিয়ে চিন্তা-ভাবনা
করে জেনেছেন যে,
তা কোনো জীবের জন্য
(চির) বাসস্থান নয়।
তাকে তাঁরা সমুদ্র
গণ্য করেছেন
এবং তা পারাপারের
জন্য কিশতী বানিয়েছেন নেক আমলকে।”
সুতরাং এই যদি তার
অবস্থা হয়, যা বর্ণনা করলাম এবং এই যদি আমাদের ও যে
জন্য আমরা সৃষ্ট হয়েছি তার অবস্থা হয়, যা পূর্বে উল্লেখ
করলাম,
তাহলে ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তির উচিত যে, সে নিজেকে সৎলোকদের দলভুক্ত করবে, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ
ব্যক্তিবর্গের পথ অবলম্বন করবে, ইতোপূর্বে যার দিকে ইঙ্গিত
করেছি,
তার জন্য প্রস্তুত হবে এবং যার প্রতি সতর্ক করেছি, তাতে যত্নবান হবে। আর এর জন্য সবচেয়ে সঠিক পথ ও নির্ভুল পন্থা হল, আমাদের নবীর সহীহ হাদীসের সাথে আদব প্রদর্শন করা (তার আদর্শ গ্রহণ করা), যিনি পূর্বাপর সকল মানুষের নেতা এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক
সম্মানীয়। তাঁর উপর এবং সকল নবীগণের উপর আল্লাহর অসংখ্য দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক।
আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَتَعَاوَنُواْ
عَلَى ٱلۡبِرِّ وَٱلتَّقۡوَىٰۖ﴾ [المائدة: ٢]
“তোমরা সৎ ও সংযমশীলতার
কাজে পরস্পর সহযোগিতা কর”। (সূরা আল-মায়িদাহ: ২)
তাছাড়া সহীহসূত্রে
প্রমাণিত,
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“আল্লাহ বান্দার সাহায্যে
থাকেন,
যতক্ষণ বান্দাহ নিজ ভাইয়ের সাহায্যে থাকে।” (মুসলিম, ২৬৯৯)
“যে ব্যক্তি কল্যাণের প্রতি
পথনির্দেশ করে তার জন্য ঐ কল্যাণ সম্পাদনকারীর সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ হয়।” (ইবন হিব্বান)
“যে ব্যক্তি সৎপথের দিক
আহ্বান করে (দাওয়াত দেয়) সে ব্যক্তির ঐ পথের অনুসারীদের সমপরিমান সওয়াব লাভ হবে। এতে
তাদের সওয়াব থেকে কিছুমাত্র কম হবে না। আর যে ব্যক্তি অসৎ পথের দিকে আহ্বান করে সেই
ব্যক্তি ঐ পথের অনুসারীদের সমপরিমাণ গোনাহের ভাগী হবে। এতে তাদের গোনাহ থেকে কিছুমাত্র
কম হবে না।” (মুসলিম ২৬৭৪)
আলী রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম! তোমার
মাধ্যমে আল্লাহ যদি একটি লোককেও হিদায়াত করেন, তাহলে তা তোমার
জন্য লাল উটনী (আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ) অপেক্ষা উত্তম।” (বুখারী ৩৭০১, মুসলিম ২৪০৬ নং)
সুতরাং আমি মনস্থ
করলাম যে,
সহীহ হাদীস সম্বলিত একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ সঞ্চয়ন করি, যাতে এমনসব বিষয়ের সমাবেশ ঘটবে, যা পাঠকের জন্য
আখেরাতের পাথেয় হবে, বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিক আদব ও শিষ্টাচারিতা
অর্জন হবে, যাতে উৎসাহপ্রদান, ভীতিপ্রদর্শন এবং পরহেযগার মানুষদের নানা আদবসম্বলিত বিষয়, বিরাগমূলক, আত্মা-অনুশীলন ও চরিত্রগঠনমূলক, অন্তরশুদ্ধি ও হৃদরোগের চিকিৎসামূলক, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে
সংশুদ্ধি ও তার বক্রতা দূরীকরণমূলক ইত্যাদি আল্লাহ ভক্তদের উদ্দেশ্যমূলক আরও অন্যান্য
হাদীস পরিবেশিত হবে।
আর এতে আমি বাধ্যবাধকতার
সাথে স্পষ্ট সহীহ হাদীস ছাড়া অন্য হাদীস উল্লেখ করব না এবং যা উল্লেখ করব, তাতে প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থের হাওয়ালা দেব। কুরআনে আযীযের আয়াতে কারীমা
দিয়ে এর পরিচ্ছেদগুলোর সূচনা করব। শব্দের সঠিক উচ্চারণ এবং নিগুঢ় অর্থ-সম্বলিত ব্যাখ্যার
প্রয়োজনবোধে মূল্যবান টীকা-টিপ্পনী ব্যবহার করব। যখন বলব, متفق عليه তখন তার মানে হবে, হাদীসটিকে বুখারী ও মুসলিম (সহীহাইনে) বর্ণনা করেছেন।
আমি আশা করি যে, এ গ্রন্থ যদি পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করে, তাহলে তা যত্নবান
পাঠকের জন্য কল্যাণের পথ-প্রদর্শক হবে এবং সকল প্রকার মন্দ ও সর্বনাশী কর্ম থেকে বিরত
রাখবে।
আমি সেই ভাইয়ের
কাছে আবেদন রাখব, যিনি এ গ্রন্থের কিছু অংশ দ্বারাও উপকৃত
হবেন,
তিনি যেন আমার জন্য, আমার পিতা-মাতার
জন্য,
আমার উস্তাদ, সকল বন্ধু-বান্ধব
ও সমস্ত মুসলিমের জন্য দো‘আ করেন। আর আমি মহানুভব আল্লাহর উপর ভরসা
করি, তাঁকেই আমার সবকিছু সমর্পন করি, তাঁরই উপর আমি নির্ভর
করি, তিনিই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মবিধায়ক। পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহর
প্রেরণাদান ছাড়া পাপ থেকে ফেরার এবং সৎকাজ করার (নড়া-চড়ার) কোনো শক্তি নেই।