“৭০ হাজার মানুষ বিনা
বিচারে জান্নাতী”
- আনসারুস সুন্নাহ
______________________________
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু
আ’নহু থেকে বর্ণিত। একিদন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বললেন, ‘‘আমার কাছে সকল উম্মতের লোকদেরকে পেশ করা হল। আমি দেখলাম, কোন নবীর
সাথে মাত্র সামান্য কয়জন (৩ থেকে ৭ জন অনুসারী) লোক রয়েছে। কোন নবীর সাথে একজন অথবা
দুইজন লোক রয়েছে। কোন নবীকে দেখলাম তাঁর সাথে কেউই নেই! ইতোমধ্যে বিরাট একটি জামাআ’ত আমার সামনে পেশ করা
হল। আমি মনে করলাম, এটাই বুঝি আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হল যে, এটা হল মুসা আ’লাইহি হিস সালাম ও তাঁর
উম্মতের জামাআ’ত। কিন্তু আপনি অন্য দিগন্তে তাকান। অতঃপর আমি সেইদিকে তাকাতেই আরও
একটি বিরাট জামাআ’ত দেখতে পেলাম। আমাকে বলা হল যে,
‘‘এটি হল আপনার উম্মত।
আর তাদের সঙ্গে এমন ৭০ হাজার লোক রয়েছে, যারা বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে সরাসরি জান্নাতে
প্রবেশ করবে।’’
এ কথা বলে তিনি (আল্লাহর রাসুল) উঠে নিজ
ঘরে প্রবেশ করলেন। এদিকে লোকেরা (উপস্থিত সাহাবীরা) ঐ সমস্ত জান্নাতী লোকদের ব্যাপারে
বিভিন্ন আলোচনা শুরু করে দিল, (কারা হবে সেই লোক) যারা বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে
প্রবেশ করবে?
কেউ কেউ বলল, “সম্ভবতঃ ঐ লোকেরা হল
তারা, যারা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-এর
সাহাবা তারা।”
কিছু লোক বলল, “বরং সম্ভবতঃ ওরা হল
তারা, যারা ইসলামে জন্মগ্রহণ করেছে এবং আল্লাহর সাথে কখনো কাউকে শরীক করেনি।”
আরো অনেকে অনেক কিছু বলল। কিছুক্ষণ পরে
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নিকট বের হয়ে
এসে বললেন,
‘‘তোমরা কি ব্যাপারে আলোচনা
করছ?’’
তারা ব্যাপার খুলে বললে, আল্লাহর রাসুল
সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
“(বিনা বিচাসে জান্নাতী
লোক) হলো তারা, যারা
(ক) দাগ কেটে রোগের চিকিৎসা করায় না,
(খ) অন্যের কাছে রুকইয়া বা ঝাড়ফুঁক করে
দিতে বলেনা এবং
(গ) কোন জিনিসকে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করে
না,
(ঘ) বরং তারা কেবল আল্লাহর প্রতি ভরসা
রাখে।”
এ কথা শুনে উক্কাশাহ ইবনু মিহসান নামক
একজন সাহাবী উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “(হে আল্লাহর রাসূল!)
আপনি আমার জন্য দুয়া করুন, আল্লাহ যেন আমাকে তাদের দলভুক্ত করে দেন!”
তিনি বললেন, ‘‘তুমি তাদের মধ্যে একজন।’’
অতঃপর আর এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনি আমার জন্যও দুয়া করুন, যেন আল্লাহ আমাকেও তাদের দলভুক্ত করে
দেন।”
তিনি বললেন, “উক্কাশাহ (এ ব্যাপারে)
তোমার অগ্রগামী হয়ে গেছে।”
রিয়াদুস স্বা-লিহীনঃ ৭৫; সহীহ বুখারীঃ
৫৭০৫, ৩৪১০; তিরমিযীঃ ২৪৪৬, মুসনাদে আহমাদঃ ২৪৪৪।
______________________________
হাদীসটির উপরে প্রসংগিক কিছু আলোচনাঃ
(১) কিছু নবীদের অনুসারী অনেক কম হবে,
মাত্র ৩ বা ৭ জন, এমনকি বিচারের দিনে এমনও নবী থাকবেন যার সাথে তাঁর অনুসারী একজন লোকও
থাকবেনা। তাঁদেরকে তাদের জাতির লোকেরা প্রত্যাখ্যান করেছিলো। সুতরাং, এখান থেকে আমরা
শিক্ষা পাই যে, মানুষ খুশী হোক কিংবা অখুশী হোক, হক্ক এর দাওয়াত দিতে আমাদের দ্বিধা
করা উচিৎ নয়। সত্যি কথা বললে মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাগ করে, কাছের মানুষ দূরে চলে
যায়, প্রিয়জনেরাই ভুল বুঝে...তবুও হক্কের দাওয়াতের ব্যপারে আমাদের স্যাক্রিফাইস করার
কোন সুযোগ নেই। তবে পরিবেশের অনুশারে কৌশল বা হিকমত অবলম্বন করা যেতে পারে। এটা সুন্নাহ,
কিন্তু তাই বলে বাতিলের সাথে আপোষ করা যাবেনা।
(২) যে সমস্ত নবীদের অনুসারী কম হবে,
তাঁদের সম্পর্কে এই ধারণা করা যাবেনা যে তাঁদের মাঝে কোন ত্রুটি ছিলো, বা তারা ইসলামিক
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি দেখে তারা ‘দ্বীন কায়েম’ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বরং, সকল নবীই তাঁদের দায়িত্ব পালনে সফল হয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে আকারে-ইংগিতেও সামান্যতম
অসৌজন্যমূলক কথা বলা বড় কুফুরী। আর নবী-রাসুলরা মানুষকে সমস্ত তাগুত বর্জন করে এক আল্লাহর
দিকে দাওয়াত দিতেন, লোকদেরকে সালাত আদায় করা ও যাকাত দেওয়ার জন্য আদেশ দিতেন – এটাই হচ্ছে দ্বীন কায়েম।
‘দ্বীন কায়েম করা’ মানে ইসলামিক রাষ্ট্র
প্রতিষ্ঠা করা নয়, যেমন অর্থ আধুনিক যুগের অনেক আধা-মুফাসসির সাহেবরা করে তাদের অনুসারীদেরকে
বিভ্রান্ত করেছেন। হাতে গোনা ২-৪ জন নবী ছাড়া প্রায় সকল নবী-রাসুলরাই ইসলামিক রাষ্ট্র
প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। তাই বলে, এটা চিন্তা করার কোন সুযোগ নেই যে, তারা দ্বীন কায়েম
করতে পারেন নি।
(৩) রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর
উম্মতের মাঝে ৭০ হাজার লোক থাকবে, তারা কোন হিসাব-নিকাশ ছাড়াই সরাসরি জান্নাতে যাবে।
তাঁর মানে এই না যে, এই উম্মতের মাঝে মোট ৭০ হাজার লোক জান্নাতে যাবে। এই ৭০ হাজার
লোক ঈমান, তাক্বওয়া এবং তাওয়াক্কুল এর দিক থেকে এতো উর্ধে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের
জন্যে এই বিশেষ মর্যাদা – তারা কোন বিচার বা প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া ছাড়াই সরাসরি জান্নাতে
যাবে। এরপরে সাধারণ মুসলিমদের মাঝে যারা নেককার, তাদের হিসাব সহজ করে নেওয়া হবে যার
ফলে তাদের ডান পাল্লা ভারী হবে। এই লোকেরা কোন প্রকার আজাব ছাড়াই জান্নাতে যাবে। তবে
তারা প্রথম প্রকারের লোকদের পরে জান্নাতে যাবে, আর পার্থক্য হচ্ছে তাদের হিসাব নেওয়ার
পর তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যারা পাপী কিন্তু ঈমানদার মুসলিম, তাদের ঈমান ও নেক
আমলের কারণে অনেককে আল্লাহ মাফ করে জান্নাতে দেবেন, আবার অনেককে জাহান্নামে শাস্তি
দেওয়ার পরে জান্নাতে দেবেন। সেটা আল্লাহর ইচ্ছার অধীন থাকবে।
(৪)
৭০ হাজার লোক যারা কোন হিসাব-নিকাশ ছাড়াই সরাসরি জান্নাতে যাবে, আল্লাহর রাসুল
সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ৪টি প্রধান গুণ উল্লেখ করেছেন।
(ক) দাগ কেটে রোগের চিকিৎসা না করানো
– ততকালীন যুগে আরবদের মাঝে কিছু রোগের জন্যে একটা চিকিৎসা ব্যবস্থা
চালু ছিলো আর তা হচ্ছে, লোহা দিয়ে পুড়িয়ে ক্ষত বা ব্যথার স্থানে দাগ দেওয়া। রাসুল সাল্লাল্লাহু
আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এই চিকিৎসাটাকে অপছন্দ করেছেন এবং দেখা যায় কিছু
হাদীসে তিনি সেটা করতে নিষেধ করেছেন। এজন্য কিছু আলেম এটাকে ‘হারাম’ মনে করেন, আবার কিছু
আলেম এটাকে ‘মাকরুহ’ মনে করেন। যাই হোক, যারা সৌভাগ্যবান ৭০ হাজার লোকের অন্তর্ভুক্ত
হবে তারা এমন ‘মাকরুহ’ বা অপছন্দনীয় কাজটা করবেনা।
(খ) অন্যের কাছে ঝাড়ফুঁক করে দিতে বলবেনাঃ
‘রুকইয়া’ বা শরিয়াত সম্মত ঝাড়ফুঁক
অন্যের কাছ থেকে নেওয়া জায়েজ আছে। তবে অন্যকে রুকইয়া করে দিতে বলার অর্থ হচ্ছে একজন
ব্যক্তির উপরে নির্ভর করা। এইজন্যে এই কাজটা জায়েজ হলেও, উত্তম হচ্ছে আল্লাহর প্রতি
দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে নিজের রুকইয়া নিজে করার মতো ঈমান ও তাওয়্যাক্কুল গড়ে তোলা।
(গ) কোন জিনিসকে অশুভ লক্ষণ বলে মনে না
করাঃ
যে কোন ধরণের কুলক্ষণ মানা বা বিশ্বাস
করা শিরক। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লহু তাআলা আ’নহু হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ
সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কুলক্ষণ বা অশুভ লক্ষণ
মানা শিরক।”
একথা নবীজী তিনবার উচ্চারণ করেন।
সুনানে আবু দাউদ, মিশকাতঃ৪৫৮৪।
*তিনবার বলে নবী কুলক্ষণ মানা যে স্পষ্ট
শিরক, তার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তবে আলেমদের তে কুলক্ষণে বিশ্বাস করা ছোট শিরক এর
অন্তর্ভুক্ত।
(ঘ) ‘তাওয়্যাক্কুল’ - তারা কেবল আল্লাহর
প্রতি ভরসা রাখে।
এনিয়ে ক্বুরান ও হাদীসে আসলে অনেক দীর্ঘ
আলোচনা রয়েছে, যা প্রতিটি মুসলিমেরই নিজের ঈমান সুন্দর ও মজবুত করার জন্যে জানা জরুরী।
তবে আমি তিনটি হাদীস তুলে ধরছি,
(i) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বলেছেন, যখন তুমি কিছু চাইবে, তখন শুধুমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইবে; যখন সাহায্য
চাইবে শুধুমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে।
তিরমিযী: ২৫১৬, হাদীসটি সহীহ্ (হাসান)
(ii) সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি
বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার সাথে এই
অঙ্গীকার করবে যে, সে কারো কাছ থেকে কোন কিছুই চাইবে না, আমি তার জন্যে জান্নাতের জামিন
হবো। আমি (সাওবান রাঃ) বললাম, আমি অঙ্গীকার করছি।
এই হাদিসটির বর্ণনাকারী একজন রাবী বলেন,
এরপর থেকে তিনি (সাওবান রাঃ) কারো কাছ থেকে জীবনে কিছু চাননি। এমনকি তিনি ঘোড়ার পিঠে
চড়া অবস্থায় তার হাত থেকে চাবুক পড়ে গেলেও নিচে থাকা লোকটিকে তা উঠিয়ে দিতে বলতেন না,
নিজেই নেমে তা উঠিয়ে নিতেন।
সুনানে আবু দাউদ।
(iii) জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে
বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, “ইসলাম গ্রহণের পর আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে কিছু চাইনি। সকল
কিছুই আমরা আল্লাহর কাছেই চাইতাম। এমনকি আমাদের কারো জুতার ফিতাটিও যদি খুঁজে না পেতাম
তাও আমরা আল্লাহকে বলতাম।”
সহিহ বুখারি।