‘আসহাবে কাহাফ’ বা গুহাবাসী যুবকদের কাহিনী
- আনসারুস
সুন্নাহ
_______________________
বিসমিল্লাহ। আলহা’মদুলিল্লাহ। ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আ’লা রাসুলিল্লাহ। আম্মা বাআ’দ।
‘কাহাফ’ বলা হয় পাহাড়ের
গর্ত বা গুহাকে। পূর্বযুগে কয়েকজন যুবক যারা নিজেদের ‘ঈমান’ রক্ষার জন্যে একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদেরকে
‘আসহাবে কাহাফ’ বা গুহাবাসী যুবক বলা হয়। সুরা কাহাফের
শুরুর দিকে তাদের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, এবং এই ঘটনা থেকেই সুরাটির নামকরণ করা হয়েছে
সুরা কাহাফ।
_______________________
সাইয়্যিদিনা
ঈসা ইবনে মারইয়াম আ’লাইহিস সালাতু আস-সালাম কে নবী ও রাসূল হিসেবে পাঠানোর অনেক পূর্বে, মধ্যপ্রাচ্যের
দেশ জর্ডান সীমান্ত অঞ্চলের দিকে ‘দাকিয়ানুস’ নামে একজন উদ্ধত ও কঠোর প্রকৃতির অত্যাচারী বাদশাহ ছিলো। সে তার জাতির
লোকদেরকে শিরকের শিক্ষা দিতো এবং সকলকে ‘মূর্তিপূজা’ করতে বাধ্য করতো। এ উপলক্ষ্যে দাকিয়ানুস প্রতিবছর
একটা মেলা বা উৎসবের আয়োজন করতো, যেখানে সবাই মূর্তিপূজা করতো এবং তাদের দেব-দেবীর
উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করতো। এক বছর এমনই এক মেলায় কয়েজন যুবক শরীক হয়েছিলো, যারা
তাদের জাতির লোকদের মূর্তিপূজা এবং জাহেলিয়াতের তামাশা দেখে তাদের মনে এই ধারণা
জন্ম নেয় যে, মূর্তিপূজা নিছক বাজে কাজ। মহান আল্লাহ এই যুবকদেরকে সঠিক পথ দেখানোর
ইচ্ছা করেন এবং তাদের অন্তরে এই কথাগুলো প্রক্ষিপ্ত করলেনঃ ইবাদত বা উপাসনার
একমাত্র যোগ্য সত্ত্বাতো সেই মহান আল্লাহ, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং
যিনি সারা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক। যুবকেরা মূর্তিপূজাকে ঘৃণা করে সেই মেলা থেকে
সরে পড়েন। এক এক করে তারা কয়েকজন একটি গাছের নিচে একত্রিত হন এবং একজন আরেকজনকে
মেলা থেকে চলে আসার কারণ জিজ্ঞেস করেন। তখন একজন বলেন, আমার জাতির প্রথা, চাল-চলন
ও রীতি-নীতি আমার মোটেও ভালো লাগেনা। আসমান ও জমীনের এবং আমাদের এবং আপনাদের
সৃষ্টিকর্তা যখন একমাত্র আল্লাহ, তখন আমরা তাঁকে ছাড়া অন্যের উপাসনা কেনো করবো?
তার একথা শুনে দ্বিতীয়জন বললো, আল্লাহর কসম! আমার জাতির লোকদের প্রতি এই ঘৃণাই
আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তৃতীয়জনও একই কথা বললেন। যখন সবাই একই কারণ বললেন, তখন
সবার অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার ঢেউ খেলে গেল। ‘তাওহীদ’ বা একত্ববাদের আলোকে আলোকিত এই
যুবকেরা পরস্পর সত্য ও খাঁটি দ্বীনি ভাইয়ে পরিণত হল। তারা লোকালয়ের বাইরে একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে নেন, যেখানে তারা একত্রিত হয়ে গোপনে আল্লাহর
ইবাদত করতেন এবং সমস্ত মূর্তিপূজার শিরক থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখতেন।
আস্তে আস্তে জাতির লোকেরা তাদের কথা জেনে যায় এবং তাদেরকে ধরে ঐ অত্যাচারী বাদশাহর
কাছে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করে। বাদশাহ দাকিয়ানুস তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে,
যুবকেরা অত্যন্ত সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে তাদের তাওহীদের প্রতি বিশ্বাস এর কথা জানিয়ে
দেন। এমনকি স্বয়ং বাদশাহ, তার সভার লোকদের এবং জাতির সকলকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করে এক
আল্লাহর উপাসনা করার জন্যে দাওয়াত দেন। তারা মন শক্ত করে নেন এবং পরিষ্কারভাবে বলেন,
“আমাদের রব্ব তিনিই, যিনি আসমান ও যমীনের
সৃষ্টিকর্তা। তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে মাবূদ বানিয়ে নেওয়া আমাদের জন্যে অসম্ভব। আমাদের দ্বারা এটা কখনো হতে
পারেনা যে, আমরা তাঁকে ছেড়ে অন্য কারো কাছে দুয়া করবো বা ডাকবো। কেননা আল্লাহ ছাড়া
অন্য কাউকে আহবান করা শিরক। এটা অত্যন্ত বাজে ব্যপার, অনর্থক কাজ ও বক্র পথ বা
গোমরাহী। আমার জাতির লোকেরা মুশরিক, তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দুয়া করে বা
অন্যদেরকে আহবান করে তাদের ইবাদতে মগ্ন হয়ে রয়েছে। এর কোন দলিল-প্রমান তারা পেশ
করতে পারবেনা, সুতরাং তারা মিথ্যাবাদী ও অত্যাচারী।”
বর্ণিত আছে যে,
যুবকদের এই স্পষ্টবাদীতায় বাদশাহ অত্যন্ত রাগান্বিত হয় এবং তাদেরকে শাসন-গর্জন ও
ভয় প্রদর্শন করে। সে তাদের পোশাক খুলে নেওয়ার জন্যে আদেশ দেয় এবং তাদেরকে তাদের
বক্তব্য প্রত্যাহার করার জন্যে সুযোগ দেয়।
বাদশাহ মনে
করেছিলো যে, তারা হয়তো ভয় পেয়ে আবার বাতিল ধর্মে ফিরে আসবে। আসলে এটা ছিলো আল্লাহ
সুবহা’নাহু তাআ’লার পক্ষ থেকে বাদশাহর অবচেতন মনে তাদেরকে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার একটা
সুযোগ দান। যুবকেরা যখন বুঝতে পারলো যে, সেখানে থেকে তারা দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত
থাকতে পারবে না, তখন তারা তাদের জাতি, দেশ ও আত্মীয় স্বজন ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্যে
দৃঢ় সংকল্প করেন। যখন এই যুবকেরা দ্বীন রক্ষা করার জন্যে এত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে
উদ্যত হন, তখন তাদের উপর আলাহর রহমত বর্ষিত হয়। আল্লাহ বলেন,
“ঠিক আছে, তোমরা যখন তাদের দ্বীন থেকে পৃথক হয়ে গেছে
তাহলে তাদের দেহ থেকেও পৃথক হয়ে পড়। যাও, তোমরা কোন পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ
করো। তোমাদের উপর তোমাদের রব্বের করুণা বর্ষিত হবে। তিনি তোমাদেরকে তোমাদের
শত্রুদের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখবেন, তোমাদের কাজ তিনি সহজ করে দেবেন এবং তোমাদের
শান্তির ব্যবস্থা করে দিবেন।”
সুতরাং ঐ
যুবকেরা সুযোগ বুঝে সেখান থেকে পালিয়ে যায় এবং একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেন।
তাদের প্রতিবেশীরা এবং বাদশাহ লক্ষ্য করলো যে তাদেরকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছেনা।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও তাদেরকে না পেয়ে তারা ধরে নিলো যে, তারা হয়তোবা হারিয়ে
গেছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আ’নহুমার মতে, আসহাবে কাহাফের যুবকদের সংখ্যা
ছিলো ৭ জন, অবশ্য এব্যপারে ক্বুরান ও সহীহ হাদীস থেকে নিশ্চিত কিছু জানা যায়না। তাদের
মধ্যে একজনের একটা পোষা কুকুর ছিলো, যে কিনা হিজরতের সময় তাদের পিছু পিছু চলে এসেছিলো।
যুবকেরা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেওয়ার পরে তারা সকলেই সেখানে ঘুমিয়ে পড়েন। যুবকেরা এমনভাবে
ঘুমাচ্ছিলো যে, তাদের চোখগুলো খোলা আর দেখে মনে হবে যেন তারা জেগেই আছে। আর কুকুরটি
গুহার বাইরে দুই পা প্রসারিত করে বসে থেকে তাদেরকে পাহাড়া দিচ্ছিলো। এমন অবস্থায় যে
কেউ তাদেরকে দেখলে হিংস্র শিকারীর দল মনে করে তাদের ভয়ে পালিয়ে যাবে। তাদের ঘুমের মাঝেই
আল্লাহ তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতেন, যাতে করে মাটি তাদেরকে খেয়ে না ফেলে। আর আল্লাহ
সকালে সূর্যকে উদয়ের সময় ডানদিকে এবং অস্ত যাওয়ার সময় বাম দিকে হেলে যাওয়ার জন্যে আদেশ
দেন। যেন গুহাবাসীরা ঐ সময় পর্যন্ত আরাম ও শান্তিতে ঘুমাতে পারে, যতদিন পর্যন্ত তাদের
ঘুমানো আল্লাহ ইচ্ছা করেন। এর মাধ্যমে আল্লাহর হিকমত, তাঁর নিদর্শন ও মহানুভবতা প্রকাশ
পায়।
আল্লাহর
আশ্চর্য একটি নিদর্শন এই যে, এইভাবে তারা সৌর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩০০ বছর এবং
চন্দ্র হিসাব অনুযায়ী ৩০৯ বছর পর্যন্ত একটানা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন। কিন্তু যখন তারা
জেগে উঠে, তখন ঠিক তেমনি ছিলো যেমন তারা ঘুমানোর সময় ছিলো। তাদের দেহ, চুল, চামড়া
সবই ঐ আগের অবস্থাতেই ছিলো, যেমন তারা শোয়ার সময় ছিলো। ঘুম থেকে উঠে তারা পরস্পর
বলাবলি শুরু করলো, আচ্ছা বলোতো, আমরা কতদিন ঘুমিয়েছিলাম? তাদের কেউ বললো একদিন
অথবা একদিনের কম সময়। কেননা তারা সকাল বেলা ঘুমিয়েছিলো আর যখন জেগে উঠে তখন ছিলো সন্ধ্যাবেলা। এজন্যেই
তাদের মনে এমন ধারণা হয়েছিলো। যদিও তাদের নিজেদের মন বলছিলো, এতো কম সময় হতে
পারেনা।
যাই হোক তারা বুঝতে
পারলো আসলে তারা কতদিন ঘুমিয়েছিলো সেটা আল্লাহ
ছাড়া কেউ জানে না। সেজন্যে এনিয়ে কথা না বাড়িয়ে তাদের কাছে কিছু দিরহাম ছিলো,
সেইগুলো দিয়ে নিজের পরিচয় গোপন রেখে একজনকে কিছু পবিত্র (হালাল) খাবার কিনে আনতে
শহরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলো। তারা ভয় পাচ্ছিলো যে, তাদের জাতির লোকেরা তাদের কথা জেনে
গেলে পুনরায় তাদেরকে জোর করে শিরকের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে, অথবা তাদেরকে হত্যা করে
ফেলবে।
বর্ণিত আছে যে,
তারা তাদের মধ্য থেকে একজনকে ছদ্মবেশে এবং ভিন্ন একটা পথে শহরে পাঠায় কিছু খাবার
কিনে আনার জন্যে। ঐ গুহাবাসী লোকটি দেখেন যে, শহরের কোন জিনিসই আগের মতো নেই, আর
শহরের সব লোক তার অপরিচিত। তাকে কেউ চিনতে পারছেনা, তিনিও কাউকে চিনতে পারছেন না। তিনি খুব পেরেশানি বোধ করলেন এবং তার মাথা ঘুরে গেলো। কারণ তিনি
ভাবছিলেন, এইতো কাল সন্ধ্যায় আমি এই শহর ছেড়ে গেলাম আর আজকে হঠাত কি হলো? গুহাবাসী
লোকেরা এটা কল্পনাও করতে পারেন নি, তাদের ঘুমের মাঝে শত শত বছর পার হয়ে যেতে পারে।
তিনি ভাবলেন, তিনি হয়তোবা পাগলই হয়ে গেছেননা, অথবা তাকে কোন রোগে ধরেছে অথবা তিনি স্বপ্ন
দেখছেন। একারণে তিনি ভাবলেন তার এই শহর ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াই ভালো। অতঃপর তিনি
একটি দোকানে গিয়ে কিছু মুদ্রা দেন ও এর বিনিময়ে খাবার চান। দোকানদার ঐ মুদ্রা দেখে
কঠিন বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং তার প্রতিবেশী অন্য দোকানদারকে সেইগুলো দেখতে দেন। এইভাবে
তারা সকলেই অনেক পুরোনো এই মুদ্রাগুলো দেখে আশ্চার্যান্বিত হন এবং গুহাবাসী লোকটি এনিয়ে
সবার তামাশার পাত্রে পরিণত হন। সবাই ভাবতে থাকে, লোকটি হয়তো পুরনো দিনের কোন গুপ্তধন
পেয়েছে। সুতরাং, তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, সে কোথাকার, এই মুদ্রা সে কোথায় পেলো? তখন
সে বললো, ভাই আমিতো এই শহরের লোক, গতকাল সন্ধ্যায় আমি এই শহর থেকে গেছি। এখানকার বাদশাহ
হচ্ছে দাকিয়ানুস। তার একথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ফেললো এবং বললো, এ তো এক পাগল
লোক! অবশেষে তাকে তখনকার যুগের বাদশাহর কাছে নেওয়া হলো। বাদশাহ তাকে আসল ঘটনা জিজ্ঞেস
করলে তিনি তাকে সব খুলে বললেন। সব শুনে বাদশাহ এবং সমস্ত জনতা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো!
অবশেষ সমস্ত লোক তার সংগী হয়ে বললো, আচ্ছা আমাদেরকে তোমরা গুহাবাসী বাকি সংগীদের কাছে
নিয়ে চলো এবং তোমাদের গুহাটি দেখিয়ে দাও। গুহাবাসী লোকটি তাদেরকে সাথে নিয়ে চললেন।
গুহার কাছে পৌঁছে তিনি তাদেরকে বললেন, আপনারা বাইরে অপেক্ষা করুন, আমি আমার সংগীদের খবর দিয়ে আসি। গুহাবাসী লোকটি জনতা থেকে পৃথক হওয়া মাত্রই আল্লাহ তাদের ও
গুহাবাসীর মাঝে একটি ‘গায়েবী’ বা অদৃশ্য পর্দা নিক্ষেপ করলেন। লোকেরা আর জানতেই পারলোনা যে, তিনি কোথায়
গেলেন।
এভাবে আল্লাহ
তাআ’লা আসহাবে কাহাফের রহস্য মানুষের কাছ থেকে গোপন করলেন। অতঃপর আল্লাহ আসহাবে কাহাফের লোকদের গুহার ভেতরে স্বাভাবিক মৃত্যু দান করেন।
গুহাবাসীরা অদৃশ্য হয়ে গেলে লোকদের মাঝে কেউ বললো, সেই গুহার দরজা বন্ধ করে তাদেরকে
এইভাবেই ছেড়ে দেওয়া হোক। আবার কেউ বলে, তাদের স্মৃতি রক্ষার জন্যে তাদের উপরে সৌধ নির্মান
করা হোক। কিন্তু যারা ক্ষমতাশালী লোক ছিলো তারা তাদের উপরে মসজিদ নির্মান করেছিলো।
_______________________
‘আসহাবে কাহাফ’ বা গুহাবাসী যুবকদের কাহিনী থেকে কিছু শিক্ষাঃ
১. “তাওহীদ বা এক আল্লাহর উপাসনা করা
এবং শিরককে ঘৃণা করা” - এটা মানুষের ‘ফিতরাৎ’, বা ‘মৌলিক মানবীয় একটি গুণ’ যা দিয়ে আল্লাহ প্রত্যেকটি মানুষকেই সৃষ্টি করেছেন। যাতে করে তাঁর বান্দারা
সহজেই তাঁকে চিনতে পারে এবং তাঁর ইবাদতে আগ্রহী হয়। এই গুণটি ‘আসহাবে কাহাফ’ এর যুবকদের মাঝে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়েছিলো।
২. তাগুত
(আল্লাহদ্রোহী), শিরক এবং মূর্তিপূজার অনুসরণকারী জাতির লোকেরা যুগে যুগে
তাওহীদবাদী লোকদের বড় শত্রু এবং সর্বদাই তাদের ক্ষতি করার জন্যে চেষ্টা করে। ‘আসহাবে কাহাফ’ এর জাতির লোকেরা তাদেরকে ধরে নিয়ে অত্যাচারী
বাদশাহর কাছে পেশ করার মাধ্যমে মুশরেকদের এই খারাপ চরিত্র ফুটে উঠে।
৩. তাগুত (আল্লাহদ্রোহী), অত্যাচারী মুশরেক বাদশাহ, এই ধরণের নেতারা
যারা মানুষকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুকে পূজা করতে আহবান করে তারা ইসলাম এবং
মুসলমানদের সবচাইতে বড় শত্রু। তারা শক্তি ও ক্ষমতা দিয়ে মুসলিমদেরকে ঈমানের থেকে
বিচ্যুত করে তাদের বাতিল ধর্মে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। সুতরাং, আমাদেরকে এই ধরণের নেতাদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
৪. হক্কপন্থী
লোকের সংখ্যা সবসময় অল্পই হয়ে থাকে। লোক অল্প হলেও ঈমান ও যেই জ্ঞান আল্লাহ
তাদেরকে দান করেন, তার কারণে তারা তাদের পুরো জাতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী এবং
আপোষহীন অবস্থান গ্রহণ করে। সাইয়্যিদিনা ইব্রাহীম আ’লাইহিস সালাতু আস-সালাম একাই তাঁর জাতির
বিরুদ্ধে দাওয়াতের জন্যে যথেষ্ঠ ছিলেন এমনিভাবে। আসহাবে কাহাফের
মাত্র অল্প কয়েকজন যুবক অত্যাচারী বাদশাহ এবং বিভ্রান্ত গোটা জাতির বিরুদ্ধে
তাওহীদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্যে যথেষ্ঠ ছিলো।
৫. শয়তান
যাদেরকে অন্ধ করে দেয় তারা ওয়াহী, আল্লাহর বিধান বা সাধারণ যুক্তি শুনতেও প্রস্তুত
নয়, কারণ তারা তাদের বাপ-দাদাদের অনুসৃত পথ কিংবা তাদের নেতাদের চাপিয়ে দেওয়া
ধর্মের প্রতি অন্ধভাবে অনুগত থাকে। একারণে তাদেরকে দলিল-প্রমান বা যুক্তি উপস্থাপন
করলে তারা বধিরের মতো আচরণ করে। বাদশাহর সামনে আসহাবে কাহাফের যুবকেরা এক আল্লাহকে উপাসনা করার অকাট্য যুক্তি তুলে ধরলেও তাদের জাতি
সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে।
৬. আসহাবে
কাহাফের লোক আসলে কতজন ছিলো, তারা কোথায়, কত সালে বসবাস করতো এইগুলো জানা আমাদের
ঈমান ও আমলের জন্যে জরুরী নয়, সেইজন্য আল্লাহ এর বিস্তারিত বর্ণনা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম জানানোর প্রয়োজন মনে করেন নি, এবং এনিয়ে আহলে কিতাবীদের কাউকে
প্রশ্ন করতেও তিনি নিষেধ করে দিয়েছেন। তবে তাদের ঘটনা থেকে আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ
শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা রয়েছে, সেজন্যে সেই ঘটনা সাধারণভাবে আলোচনা করেছেন। এ আলোকে বলা
যেতে পারে, আমাদের উচিৎ আমাদের জন্যে যেই জিনিসটা জানা জরুরী, শুধুমাত্র সেই ব্যপারেই
প্রশ্ন করা। দ্বীন শিক্ষার্থীদের জন্যে জানা জরুরী নয়, এমন অহেতুক প্রশ্ন
করার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। এনিয়ে হাদীসেও সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে।
৭. আসহাবে কাহাফের লোকেরা একটানা ৩০৯ বছর ঘুমিয়ে ছিলেন, এরপর আল্লাহ তাদেরকে জাগ্রত
করেন। এটা আল্লাহর একটা ক্ষমতার নিদর্শন। এর দ্বারা কাফের মুশরেকদের এই সন্দেহ দূর
করা হয়েছে যে, এমনিভাবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ সমস্ত মানুষকে পুনরায় সমবেত করতে পারবেন,
এনিয়ে সংশয়ের কিছু নেই।
৮. আসহাবে কাহাফের লোকদের সাথে একটা কুকুর সংগী হয়েছিলো। নেককার
মানুষদের সংগী হওয়ার জন্যে একটা সাধারণ কুকুরের কথা ক্বুরান মাজীদের মতো শ্রেষ্ঠ
আসমানী কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা প্রমানিত হয় যে, নেককার লোকদের
সংস্পর্শ ও তাদের অনুসরণের দ্বারা একজন পাপী লোকও অনেক বড় মর্যাদার অধিকারী হতে
পারে। সেইজন্যে আমাদেরকে মুত্তাক্বী লোকদের সাহচর্য ও বন্ধুত্বের জন্যে চেষ্টা
করতে হবে। মানুষের জীবনে বড় সংগী হচ্ছে তার স্বামী বা স্ত্রী। সে হিসেবে, বিয়ের
জন্যে সৌন্দর্য, সম্পদ, বংশ মর্যাদা, দুনিয়াবী শিক্ষা-দীক্ষা থেকে তাক্বওয়া, সৎচরিত্র,
দ্বীনি জ্ঞানকে প্রাধান্য দিতে হবে।
৯. সাধারণত
ক্ষমতাসীন মূর্খ লোকেরাই নেককার লোকদের কবরের উপরে স্মৃতিসৌধ, মাযার বা মসজিদ
নির্মান করে। অথচ ইসলামে এই কাজগুলো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে, কারণ এটা নেককার
লোকদেরকে পূজা করার দরজা উন্মুক্ত করে দেয়। এ ধরণের কাজ যারা করে, তাদের উপর
আল্লাহর লানত বা অভিশম্পাত বর্ষিত হয়, যদিও তারা নেক উদ্দেশ্যে নিয়ে এটা করে থাকুক
না কেনো। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“ইয়াহুদী ও খ্রীস্টানদের উপরে আল্লাহ তাআ’লা লানত বর্ষণ করুন, কারণ তারা তাদের নবী ও ওলীদের কবরগুলিকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে,”
ফাতহুল বারীঃ ১/৬৩৪।
১০. বর্তমান
যুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলিম নামধারী অনেক দেশের সরকার দেশের জনগণকে সরাসরি
বা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মূর্তি, মাযার, সৌধ ইত্যাদি জিনিসকে সম্মান, শ্রদ্ধার নামে আস্তে
আস্তে সেইগুলোকে পূজা করনোর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকে বিভিন্ন শিরক, বিদাত ও কবীরাহ
গুনাহ ও বিজাতীয় মতবাদ গ্রহণ করতে বাধ্য করছে। আমাদেরকে এমন পথভ্রষ্ট
নেতা-নেত্রীদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে, এবং তারা যেন জাতিকে পথভ্রষ্ট করতে না
সেইজন্য সজাগ থাকতে হবে। তাদের বিভ্রান্তিত ব্যপারে দাওয়াত ও তাবলীগ এর মাধ্যমে
মুসলিম সমাজকে জ্ঞানের আলো দিয়ে জাহেলিয়াতের অন্ধকারকে পরাজিত করতে হবে।
১১. পূর্ববর্তী
জাতির লোকদেকে ঈমান আনার কারণে অনেক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমনকি আমাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদেরকেও ইসলাম এর জন্যে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিলো।
সেই তুলনায় আল্লাহ আমাদেরকে অনেক সহজতা ও নিরাপত্তা দিয়েছেন। এরজন্যে আমাদের আল্লাহর
প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিৎ এবং এই নিরাপত্তাকে কাজে লাগিয়ে ইসলাম এর জন্যে কাজ
করা উচিৎ।
_______________________
উৎস গ্রন্থঃ
১.
ক্বুরানুল কারীম। সুরা কাহাফঃ আয়াত
২. তাফসীর ইবনে কাসীর।
৩. তাফসীর আহসানুল
বায়ান।
৪. তারিখ আত-তাবারী।
_______________________
সর্বশেষঃ আসহাবে কাহাফের লোকদের কথা আল-ক্বুরানে বর্ণিত ঘটনাগুলোর মাঝে
অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ও খুবই হৃদয়গ্রাহী। এনিয়ে আসলে আরো অনেক কথাই বাকী রয়ে গেছে।
আপনারা নির্ভরযোগ্য তাফসীরের গ্রন্থগুলোতে ও আলেমদের ওয়াজ-লেকচার থেকে আরো অনেক
বেশি জানতে পারবেন, যা আপনাদের ঈমান মজবুত করবে এবং দ্বীনের ব্যপারে ইস্তিকামাহ
(দৃঢ়তা) দান করবে। যারা কষ্ট করে পুরো লেখাটা পড়েছেন, আমি দুয়া করি এরজন্যে আল্লাহ
আপনাদেরকে সওয়াব দান করুন এবং আপনাদেরকে সফলতা দান করুন, আমিন।
_______________________
বিঃদ্রঃ এনিয়ে কেউ কোন
মিথ্যা, বানোয়াট সংবাদ, ভিডিও, ছবি বা লিংক শেয়ার করবেন না। আমাদের যেকোন পোস্টে কেউ
কোন ধরণের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। আপনি যেই হয়ে থাকুন না কেনো, আমাদের
পেইজের নিয়ম ভংগকারীদেরকে ব্যন করা হয়।