দাওয়াত নাকি ফাসাদ? (পর্ব-১)
হাদীস শাস্ত্রে মুমিনদের নেতা, মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ওরফে ‘ইমাম বুখারী’ (রহঃ) তাঁর ‘সহীহ জামি’ গ্রন্থের শুরুতে ‘কিতাবুল ইলম’ অধ্যায়ে ‘কথা ও কাজের পূর্বে জ্ঞান আবশ্যক’ নামক একটা পরিচ্ছেদ নিয়ে
এসেছেন। যেখানে তিনি দ্বীন সম্পর্কিত যেকোন কথা বলা কিংবা আমল করার পূর্বে জ্ঞান
অর্জন করার গুরুত্ব নিয়ে আল্লাহ তাআ’লার বাণী ও কিছু আসার নিয়ে এসেছেন। আজকাল
ফেইসবুক ইন্টারনেটের যুগে সালাফী,
আহলুল হাদীস, সহীহ আক্বীদাহ, অনলি ক্বুরান ও সুন্নাহর অনুসারী, মুজাহিদ...এমন
অনেক চমকপ্রদ নাম নিয়ে দ্বাইয়ী বা মুবাল্লিগ বের হয়েছে, যারা
অর্ধেক জেনেই সেই ব্যপার মানুষের মাঝে প্রচার করা শুরু করেছে। অতি উৎসাহী
দ্বাইয়ীদের অনেকেই ইসলামের অনেক জটিল বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছাড়াই বিষয়টাকে
নিজেদের মতো করে বা নিজেদের বুঝ অনুযায়ী প্রচার করছে। স্বাভাবিকভাবেই, তাদের অলংকারমন্ডিত আধা-ইসলামিক কথা-বার্তার দ্বারা অনেকেই বিভ্রান্ত
হচ্ছে, অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করছে। এমন লোকদের ব্যপারে শায়খ
মুহাম্মাদ নাসির উদ্দীন আলবানী (রহঃ) এর এই কথাটা পুরোপুরি প্রযোজ্য,
“এখনকার তরুণদের সমস্যা হচ্ছে, যখনই তারা নতুন কিছু শিখছে
তখনই তারা মনে করে তারা সব জেনে ফেলেছে।”
সিলসিলাতুল হুদ ওয়ান-নূরঃ পৃষ্ঠা ৮৬১।
নিচে আমি কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি, যা থেকে সালাফী/আহলে হাদীস
নাম নিয়ে কিভাবে ‘দাওয়াতের’ ক্ষতি করছে তার নমুনা স্পষ্ট
হবে।
১. বাংলাদেশে ‘আহলে হাদীস’ নাম নিয়ে কিছু আধা-শিক্ষিত
বা কম বয়ষ্ক লোক ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) কে পথভ্রষ্ট, হাদীস ও
সুন্নাহ বিরোধী প্রমান করার জন্যে কলম ধরেছে, এমনকি তাদের
কেউ কেউ ইমামকে তাকফীর করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে! (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)!!
একথা প্রমানিত যে, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর
২-১টা ব্যপারে ভুল ছিলো, আর তার নামে প্রচারিত কিছু
সত্য-মিথ্যা অভিযোগের উপরে ভিত্তি করে প্রাচীন আলেমদের কেউ কেউ ইমাম আবু হানীফা
(রহঃ) এর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু, পরবর্তী যুগের ইমামরা
দেখিয়েছেন, ইমাম আবু হানীফার নামে যেই অভিযোগগুলো করা হয়,
তার বেশিরভাগই ভুল। আর যে ২-১টা রয়েছে সেইগুলো তাকে আহলে সুন্নাহর
বাইরে নিয়ে যায়না।
এব্যপারে আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদীস, ইমাম ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন,
“ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) সম্পর্কে কতিপয় লোক
বিদ্বেষের আশ্রয় লইয়াছে,
আর কতকগুলো লোক মূর্খতার পথ অবলম্বন করিয়াছে।”
তাহযীবুত তাহযীব।
ইমাম আবু হানীফার উপরে আরোপিত অভিযোগগুলো
খন্ডন করে আহলে সুন্নতের কাছে এটা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয় যে, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর
২-১টা ভুল থাকা সত্ত্বেও, ফিকহের ব্যপারে তিনি আহলে সুন্নত
ওয়াল জামাতের একজন অবিস্বরণীয় ইমাম, অত্যন্ত দানশীল ও
মুত্তাক্বী একজন ব্যক্তি।
ইমাম আয-যাহাবী (রহঃ) বলেন, “ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) মুসলিম জাতির জন্যে
একজন উস্তাদ (মহান শিক্ষক),
অত্যন্ত মুত্তাক্বী (পরহেজগার ব্যক্তি), আল্লামাহ
(মহাবিদ্বান), যাহিদ (দুনিয়া বিমুখ ও পরকালমুখী), আ’রিফ
(আল্লাহর জন্যে নিজেকে একনিষ্ঠভাবে উৎসর্গীকৃত বান্দা) ছিলেন। তিনি জীবনে কোনদিন
সরকারী ভাতা বা পুরষ্কার গ্রহণ করেন নাই, ব্যবসা দ্বারা স্বীয় জীবিকা
নির্বাহ করতেন।”
তাযকিরাতুল হুফফাজঃ ১ম খন্ড, ১৫১পৃষ্ঠা
এতো গেলো পূর্ববর্তী আলেমদের মূল্যায়ন।
আধুনিক যুগের সৌদি আরবের সমস্ত সালাফী আলেমরা তাদের কিতাব কিংবা দারসে ইমাম আবু
হানীফা (রহঃ) এর নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে উচ্চারণ করেন।
শায়খ মুহাম্মাদ বিন যামিল যাইনু (রহঃ) বলেন,
“সমস্ত মুজতাহিদগণ-ই ‘ফিকহ’ এর ব্যপারে ইমাম আবু হানীফার
কাছে ঋণী।”
আরকানুল ইসলাম ওয়াল ঈমান।
আল্লামাহ সালেহ আল-ফাউজান (হাফিঃ) কে ইমাম
আবু হানীফা (রহঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, ইমাম আবু হানীফার ভুল থাকা
সত্ত্বেও অকপটে তিনি তাকে আহলে সুন্নাহর একজন ‘ইমাম’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
আমাদের দেশের সমস্ত আহলুল হাদীস দ্বাইয়ী ও
আলেম সমাজও ইমাম আবু হানীফার মর্যাদার কথা স্বীকার করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে আহলে
হাদীসদের একজন দিকপাল,
আল্লামাহ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল-কাফী আল-ক্বুরাইশী (রহঃ) উল্লেখ
করেছেন,
“আমাদের কাছে নু’মানের কথা আবার বল, কারণ তাঁহার আলোচনা মৃগনাভী
সদৃশ, যতবার ঘর্ষণ করিবে সুগন্ধি ততই বিস্তৃতি লাভ করিবে।”
ফিরকাবন্দী বনাম অনুসরণীয় ইমামগণের নীতি, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৬।
এতদ্বসত্ত্বেও একশ্রেণীর অল্প বয়ষ্ক লোক
আহলে হাদীস, সহীহ
আক্বীদাহ, ক্বুরান সুন্নাহর অনুসারী, অনলি
মুসলিম ইত্যাদি সুন্দর সুন্দর নাম নিয়ে ইমাম আবু হানীফাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অপমান
করছে। এইভাবে তারা নিজেদের আমল নামায় যেমন পাপ সঞ্চয় করছে, পাশাপাশি
হানাফীদের মাঝে সঠিক দাওয়াত সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে, তাদের সমালোচনার জন্যে সহজ টার্গেট তুলে দিচ্ছে।
আফসোসের কথা হচ্ছে, ‘জারহ ওয়া তাদীলের’ মতো জটিল বিষয় সম্পর্কে
অনেকের ধারণা না থাকায়, পূর্ববর্তী আলেমদের ২-১টা বিক্ষিপ্ত
উদ্ধৃতি তুলে ধরে তারা অনেককেই বিভ্রান্তিতে ফেলে দিচ্ছে। আল্লাহ আমাদেরকে ও
তাদেরকে হেদায়েত করুন।
(চলবে, ইন শা আল্লাহ)