প্রশ্নঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নিকট
ঈমান অর্থ কি? ঈমান কি বাড়ে এবং কমে?
প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ইমাআম মুহাম্মাদ
বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ)
উৎস গ্রন্থঃ ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম। ঈমান
অধ্যায়, প্রশ্ন নং-৮।
উত্তরঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে
ঈমানের অর্থ হল অন্তরের বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকারোক্তি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল- এই
তিনটি বিষয়ের সমষ্টির নাম।
যেহেতু উক্ত বিষয় সমূহের সমষ্টির নাম
ঈমান সে হিসাবে, তা বাড়বে এবং কমবে এটিই স্বাভাবিক। কারণ অন্তরের বিশ্বাসেরও তারতম্য
হয়ে থাকে। অতএব সংবাদ শুনে কোন কিছু বিশ্বাস করা আর আপন চোখে দেখে বিশ্বাস করা এক কথা
নয়। অনুরূপভাবে একজনের দেয়া সংবাদ বিশ্বাস করা আর দু’জনের সংবাদ বিশ্বাস
করা এক কথা নয়। এ জন্যই ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন,
)وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِ الْمَوْتَى قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنْ قَالَ بَلَى وَلَكِنْ لِيَطْمَئِنَّ قَلْبِى(
“হে আমার প্রতিপালক!
আমাকে দেখান আপনি কিভাবে মৃতকে জীবিত করেন। আল্লাহ বললেন, তুমি কি বিশ্বাস কর না? ইবরাহীম
(আঃ) বললেন, বিশ্বাস তো অবশ্যই করি, কিন্তু আমার অন্তর যাতে পরিতৃপ্ত হয় এজন্য আমি
স্বচক্ষে দেখতে চাই।” (সূরা বাকারাঃ ২৬০) কাজেই অন্তরের বিশ্বাস এবং তার স্তীরতা ও প্রশান্তির
দিক থেকেও ঈমান বৃদ্ধি পায়। মানুষ তার অন্তরে ইহা সহজেই অনুভব করে থাকে। সে যখন ইসলামী
অনুষ্ঠান বা ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত হয়ে জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনা শুনে, তখন তার
ঈমান বৃদ্ধি পায়। এমন কি সে যেন জান্নাত- জাহান্নাম স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। সে যখন
মজলিস থেকে উঠে যায়, তখন গাফলতি চলে আসে এবং এই বিশ্বাস কমতে থাকে।
এমনিভাবে মুখের আমলের (যিকর্) কারণেও
ঈমান বৃদ্ধি পায়। কেননা যে ব্যক্তি দশবার আল্লাহর যিক্র করল, সে একশতবার যিক্র্কারীর
সমান নয়। দ্বিতীয় ব্যক্তির আমল প্রথম ব্যক্তির আমলের চেয়ে অনেক বেশী। তাই তার ঈমান
বেশী হওয়াই স্বাভাবিক।
এমনিভাবে যে ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে এবাদত
সম্পন্ন করবে আর যে ব্যক্তি ত্রুটিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করবে- উভয়ে সমান নয়।
এমনিভাবে আমলের মাধ্যমেও ঈমান বাড়ে। যে
ব্যক্তি বেশী আমল করে তার ঈমান কম আমলকারীর চেয়ে বেশী। ঈমানের বেশী-কম হওয়ার ব্যাপারে
যথেষ্ট দলীল-প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ إِلَّا مَلَائِكَةً وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلَّا فِتْنَةً لِلَّذِينَ كَفَرُوا لِيَسْتَيْقِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَيَزْدَادَ الَّذِينَ آمَنُوا إِيمَانًا(
“আমি জাহান্নামের তত্বাবধায়ক
হিসেবে ফেরেশতাকেই রেখেছি। আমি কাফেরদেরকে পরীক্ষা করার জন্যই তাদের এই সংখ্যা নির্ধারণ
করেছি, যাতে কিতাবধারীরা দৃঢ় বিশ্বাসী হয় এবং মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায়।” (সূরা মুদ্দাস্ছিরঃ
৩১)
আল্লাহ তাআ’লা আরো বলেন,
)وَإِذَا مَا أُنزِلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَذِهِ إِيمَانًا فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا فَزَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ وَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ فَزَادَتْهُمْ رِجْسًا إِلَى رِجْسِهِمْ وَمَاتُوا وَهُمْ كَافِرُونَ(
“আর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ
হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, এ সূরা তোমাদের মধ্যে কার ঈমান কতটা বৃদ্ধি করল? তবে যারা
ঈমানদার, এ সূরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে। বস্তুতঃ যাদের অন্তরে
ব্যাধি রয়েছে এটি তাদের অন্তরে কলুষের সাথে আরো কলুষ বৃদ্ধি করেছে এবং তারা কাফের অবস্থায়ই
মৃত্যু করল।” (সূরা তাওবাঃ ১২৪-২৫) ছহীহ হাদীছে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) হতে বর্ণিত আছে,
“দ্বীন ও জ্ঞানে অপূর্ণ
হওয়া সত্বেও জ্ঞানী পুরুষদের জ্ঞানকে তোমাদের (নারীদের) চেয়ে অধিক হরণকারী আর কাউকে
দেখিনি।”
সুতরাং ঈমান বাড়ে এবং কমে। প্রশ্ন হল
ঈমান বাড়ার কারণ কি?
__________________________
ঈমান বৃদ্ধি হওয়ার উপায় সমূহঃ
প্রথম উপায়ঃ আল্লাহর সমস্ত নাম ও গুণাবলীসহ
আল্লাহ তাআ’লার পরিচয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। আল্লাহ তাআ’লা এবং তাঁর নাম ও গুণাবলী
সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যতই বৃদ্ধি পাবে, নিঃসন্দেহে তার ঈমানও তত বৃদ্ধি পাবে। এ জন্যই
যে সমস্ত আলেম আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তারা এ সম্পর্কে জ্ঞানহীন
আলেমদের চেয়ে ঈমানের দিক থেকে অধিক শক্তিশালী।
দ্বিতীয় উপায়ঃ সৃষ্টির ভিতরে আল্লাহর
নিদর্শন সমূহ সম্পর্কে গবেষণা করা এবং আল্লাহ মানব জাতিকে যে জীবন বিধান দিয়েছেন, তার
ভিতরে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা। মানুষ আল্লাহর সৃষ্টিরাজি নিয়ে যতই চিন্তা করবে,
ততই তার ঈমান বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
)وَفِي الْأَرْضِ آيَاتٌ لِلْمُوقِنِينَ وَفِي أَنفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ(
“বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে
নিদর্শনাবলী রয়েছে। এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও, তোমরা কি অনুধাবন করবে না?” (সূরা যারিয়াতঃ ২০)
আল্লাহর সৃষ্টিরাজির মধ্যে চিন্তা-ভাবনা
ও গবেষণা করলে যে ঈমান বৃদ্ধি পায়, এ মর্মে অনেক দলীল-প্রমাণ রয়েছে।
তৃতীয় উপায়ঃ বেশী বেশী সৎ কাজ সম্পাদন
করা। সৎ আমল যতই বৃদ্ধি পাবে, ঈমান ততই বৃদ্ধি পাবে। এই সৎ আমল মুখের কথার মাধ্যমে হোক, কিংবা কাজের মাধ্যমে হোক যেমন যিক্র-আযকার,
নামায, রোযা এবং হজ্জ। এসব কিছুই ঈমান বৃদ্ধির মাধ্যম।
__________________________
ঈমান কমে যাওয়ার কারণ সমূহঃ
প্রথম কারণঃ আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে
অজ্ঞ থাকা ঈমান কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কেননা আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে মানুষের
জ্ঞান যতই কমবে, ঈমানও তত কমতে থাকবে।
দ্বিতীয় কারণঃ সৃষ্টিতে ও শরীয়তে আল্লাহর
আয়াত সম্পর্কে গবেষণা করা থেকে বিরত থাকা। কেননা আল্লাহর সৃষ্টিতে চিন্তা-ভাবনা না
করা ঈমানের ঘাটতি হওয়ার অন্যতম কারণ।
তৃতীয় কারণঃ গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া।
কেননা গুনাহের কাজ করলে অন্তরে এবং ঈমানের উপর বিরাট প্রভাব পড়ে। এই জন্যই নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ব্যভিচারী ঈমান থাকা অবস্থায় ব্যভিচারে
লিপ্ত হতে পারে না।”
চতুর্থ কারণঃ সৎ আমল না করা ঈমান হরাস
পাওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু যদি বিনা কারণে কোন ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে ঈমান কমার
সাথে সাথে সে শাস্তির সম্মুখীন হবে। অবশ্য গ্রহণযোগ্য কারণে ওয়াজিব ছেড়ে দিলে অথবা
ওয়াজিব নয় এমন কাজ ছেড়ে দিলে ঈমানের ঘাটতি হবে, কিন্তু শাস্তির সম্মুখীন হবে না। এই
জন্যই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহিলাদেরকে জ্ঞান ও দ্বীনের ক্ষেত্রে
অপূর্ণ বলেছেন। এর কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তাদের যখন মাসিকের রক্ত বের
হয়, তখন তারা নামায-রোযা থেকে বিরত থাকে। অথচ মাসিক অবস্থায় নামায-রোযা থেকে বিরত থাকার
কারণে তাদেরকে দোষারূপ করা হয় না। বরং তা থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু
যেহেতু পুরুষদের তুলনায় তাদের আমল কম হয়ে গেল, সে হিসাবে তারা পুরুষেরে চেয়ে কম ঈমানের
অধিকারী।