সংযুক্ত আরব-আমীরাত (UAE) এর প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক
পত্রিকা দেশের খবর প্রকাশ করল শায়খ আব্দুর রাক্বীব মাদানীর এই অনুদিত এই প্রবন্ধটি।
“আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি থেকে যারা বঞ্চিত থাকবে”
এমন কিছু মানুষ রয়েছে, যারা কিয়ামতের দিন দয়াময়
আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত থাকবে, তিনি তাদের দিকে তাকাবেন না, আর না তাদের
প্রতি সুনজর দেবেন। তাদের সংখ্যা অনেক। [আল্লাহর কাছে দুয়া করি, তিনি যেন আমাদের এই
বঞ্চিতের অনিষ্ট থেকে হেফাজতে রাখেন, এর কারণ থেকে দূরে রাখেন এবং সেই বঞ্চিত সম্প্রদায়
থেকেও দূরে রাখেন।]
১. যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ও শপথকে সামান্য
বিনিময়ে বিক্রয় করে। আল্লাহ তাআ’লা
বলেন, ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার এবং নিজেদের
শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে, তারা আখেরাতের কোনো অংশই পাবে না এবং আল্লাহ কিয়ামতের
দিন তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন না এবং তাদের পবিত্র করবেন
না, বস্তুত তাদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” [আলে ইমরানঃ ৭৭]
এই আয়াতে মিথ্যা কসম করা হারাম এর প্রমাণ রয়েছে,
যা মানুষ সামান্য পার্থিব লাভের জন্য করে থাকে। উলামারা এই কসমকে ‘আল্ ইয়ামীন আল্ গামূস’ বা ডুবানোর কসম আখ্যা দিয়েছেন কারণ; তা এই কসমকারীকে
পাপে ডুবায় অতঃপর জাহান্নামে ফেলে। [আল্লাহই আশ্রয়দাতা]
২. পায়ের গিঁট বা টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী
ব্যক্তি।
৩. মিথ্যা কসম দিয়ে পণ্য বিক্রয়কারী।
৪. কারো উপকার করে তাকে উপকারের খোঁটাদাতা।
আবু হুরাইরা (রাজি.) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তিন
প্রকার লোক এমন লোক রয়েছে, যাদের সাথে আল্লাহ কথা বলবেন না, আর না কেয়ামতের দিন তাদের
দিকে তাকাবেন, আর না তাদের পবিত্র করবেন বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।”
আমি (আবু হুরাইরা) বললাম, আল্লাহর রাসূল! তারা
কারা? ওরা তো ক্ষতিগ্রস্ত! তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “গিঁটের বা টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, ব্যবসার
সামগ্রী মিথ্যা কসম দিয়ে বিক্রয়কারী এবং কাউকে কিছু দান করার পর তার খোটাদাতা।” [মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, নং ২৯৪]
গিঁটের নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরিধানকারী হচ্ছে, সেই
ব্যক্তি যে তার লুঙ্গি ও কাপড় এত ঝুলিয়ে পরে যে তার দুই গিঁটের নিচে চলে যায়। যদি সে
অহঙ্কার স্বরূপ এমন করে, তাহলে তার জন্য উপরোক্ত শাস্তির ঘোষণা কারণ নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ
তার দিকে তাকাবেন না যে, তার লুঙ্গি অহঙ্কার স্বরূপ ঝুলিয়ে পরে।’ [বুখারি, নং ৫৭৮৩/ মুসলিম] আর যে অহঙ্কার স্বরূপ
নয় বরং এমনি ঝুলিয়ে পরে, তাহলে তার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই
বাণী প্রযোজ্য : ‘লুঙ্গির
যতটা গিঁটের নিচে থাকবে, ততটা জাহান্নামে যাবে’। [বুখারিঃ ৫৭৮৭ ] এভাবে হাদিসগুলোর মাঝে সমন্বয়
সাধন হবে। আল্লাহই বেশি জানেন। পর্দার উদ্দেশ্যে মহিলাদের এক গজ ঝুলিয়ে পরা বৈধ কিন্তু
এর বেশি করবে না।
আর মিথ্যা শপথ করে সামগ্রী বিক্রয়কারী হচ্ছে,
এমন ব্যক্তি যে মহান আল্লাহকে তুচ্ছকারী। তাই সে (আল্লাহর কসম দিয়ে) মিথ্যার আশ্রয়
নিয়ে লোকদের নিকট পণ্য বিক্রি করে। আর খোটাদাতা হচ্ছে, যে দান করার পর খোটা দেয়।
৫. যে মুসাফিরকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি থেকে
বাধা দেয়।
৬. যে পার্থিব লাভের আশায় কোনো মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের
হাতে বায়াত (অঙ্গীকার) করে।
আবু হুরাইরা (রাজি.) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তিন
প্রকারের লোকের সাথে মহান আল্লাহ কিয়ামত দিবসে কথা বলবেন না, না তাদের দিকে তাকাবেন
আর না তাদের পবিত্র করবেন; বরং তাদের জন্য রয়েছে শক্ত আজাব। ওই ব্যক্তি যার নিকট নির্জন
প্রান্তরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি থাকা সত্তেও মুসাফিরকে তা ব্যবহার করা থেকে নিষেধ
করে। আল্লাহ তাকে বলবেন, আজ আমি তোমাকে আমার অতিরিক্ত (রহমত) থেকে বঞ্চিত করব, যেমন
তুমি তোমার বিনা পরিশ্রমে অর্জিত অতিরিক্ত পানি থেকে বঞ্ছিত করেছ এবং সেই ব্যক্তি যে
আসরের পর কোনো ব্যক্তিকে তার সামগ্রী বিক্রয় করে। আল্লাহর কসম খেয়ে বলে আমি এটা এই
দামে ক্রয় করেছি। ক্রেতা তার কথা সত্য মনে করে তার কাছ থেকে পণ্য খরিদ করে অথচ সে সত্য
নয়। আর সেই ব্যক্তি যে কোনো মুসলিম ইমামের (রাষ্ট্রপরিচালকের) হাতে কেবল পার্থিব উদ্দেশ্যেই
বায়াত (অঙ্গীকার) করল; সে যা চায় যদি তাকে তা দেওয়া হয় তো অঙ্গীকার পূরণ করে, আর না
দিলে ভঙ্গ করে। [বুখারি, নং ৭২১২/ মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, নং২৯৭]
মরুভূমিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি থেকে মুসাফিরকে
বাধাদানকারীকে আল্লাহ তার কৃত কর্ম অনুযায়ী বদলা দিবেন। তার কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত
যা আছে তার তুলনায় আল্লাহর রহমত ও ফযলের প্রয়োজন অনেক বেশি। আর যে দুনিয়া পাওয়ার আশায়
ইমামের হাতে বায়াত করে, সে যেন এই অঙ্গীকারকে পার্থিব উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত করে
দেয়। আর ইসলামের মূল বিধান শাসকের আনুগত করা, তাকে সদুপদেশ দেওয়া, সাহায্য করা এবং
ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা, এসবের অবজ্ঞা করে। সে মুসলিম শাসক ও ইমামদের
প্রতারণাকারী স্পষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত।
৭. বৃদ্ধ ব্যভিচারী।
৮. মিথ্যুক বাদশাহ।
৯. অহংকারী দরিদ্র।
আবু হুরাইরা (রাজি.) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ
তায়ালা কেয়ামত দিবসে তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কথা বলবেন না, আর না তাদের পবিত্র করবেন,
না তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টি দিবেন, তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি : বৃদ্ধ জেনাকারী,
মিথ্যুক রাজা এবং অহংকারী দরিদ্র’।
[মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, নং২৯৬]
বিশেষ করে তাদের সম্পর্কে উক্ত শাস্তির কারণ
বর্ণনায় কাযী ইয়ায বলেন, ‘তাদের
প্রত্যেকে উক্ত পাপ থেকে দূরে থাকার পরেও তা করে। যদিও কোনো পাপীর পাপের অজুহাত গ্রহণীয়
নয়, কিন্তু একথা বলা যেতে পারে যে, উক্ত পাপ করার ক্ষেত্রে তাদের অতীব প্রয়োজন ছিল
না আর না তাদের সচরাচর স্বাভাবিক কোনো অন্য কারণ ছিল। তা সত্তে¡ও তাদের ওই পাপে লিপ্ত হওয়াটা যেন আল্লাহর অধিকারকে
তুচ্ছ মনে করা, বিরোধিতা এবং অন্য কোনো কারণ নয় বরং স্রেফ পাপ করার উদ্দেশ্যেই তা করা।’
১০. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান।
১১. নারী হয়ে পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারিনী।
১২. দাইয়ুস।
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাজিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি
বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলঅইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তিন প্রকার লোকের দিকে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের
দিনে দৃষ্টিপাত করবেন না : পিতা-মাতার অবাধ্য, পুরুষের সদৃশ অবলম্বনকারিনী মহিলা এবং
দাইয়ুস। আর তিন প্রকার লোক জান্নাতে যাবে না : পিতা-মাতার অবাধ্য, মদপানে আসক্ত এবং
অনুদানের পর খোটাদাতা’
[মুসনাদ আহমদ, নং ৬১১/নাসাঈ]
পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তানের বিষয়টি স্পষ্ট, কারণ
আল্লাহ তায়ালা পিতা-মাতার অধিকারকে মর্যাদা দিয়েছেন, তিনি নিজ অধিকারকে তাদের অধিকারের
সাথে সংযুক্ত করেন এবং তাদের উভয়ের সাথে সদ্ব্যবহার করার আদেশ করেছেন; যদিও তারা কাফের
হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ‘পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং
তাদের অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি’।
[তিরমিযী, নং ১৯৬২, আলবানী সহীহ বলেছেন]
পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারিনী বলতে সেই মহিলাকে
বোঝায় যে, পোশাক-পরিধানে, চাল-চলনে, কাজে-কর্মে এবং কথার সুরে পুরুষের অনুকরণ করে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহিলাদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী পুরুষ এবং পুরুষের
সাদৃশ্য অবলম্বনকারিনী মহিলাদের প্রতি অভিশাপ করেছেন।’ [বুখারি]
আর দাইয়ুস হচ্ছে, যে নিজ পরিবারে অশ্লীলতা প্রশ্রয়
দেয়, তাদের সম্ভ্রম রক্ষায় আত্মসম্মানী নয়, সে মানবিকতাহীন, অপুরুষত্ব, অসুস্থ মস্তিষ্ক
এবং দুর্বল ঈমানের অধিকারী। তার তুলনা অনেকটা শূকরের মতো, যে নিজ সম্ভ্রম রক্ষা করে
না। তাই ওই সব লোককে সতর্ক থাকা উচিত যারা নিজ পরিবারে এবং তার দায়িত্বে থাকা লোকদের
মাঝে অশ্লীলতা বা অশ্লীলতার উপকরণ প্রশ্রয় দেয়। যেমন বাড়িতে এমন টিভি চ্যানেল রাখা
যা যৌনতা উস্কে দেয় এবং অশ্লীলতা বৃদ্ধি করে।
১৩. যে তার স্ত্রীর পায়ুপথে সঙ্গম করে : ইবনে
আব্বাস (রাজি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
‘আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তির দিকে দৃষ্টিপাত করবেন
না যে, পুরুষের সাথে সঙ্গম করে কিংবা স্ত্রীর পায়ুপথে সঙ্গম করে।’ [তিরিমিযী, নং১১৭৬ আলবানী সহীহ বলেছেন]
আবু হুরাইরা (রাজি.) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সে অভিশপ্ত যে স্ত্রীর পায়ুপথে সঙ্গম করে।’ [আহমদ, আবু দাউদ, নং ২১৬২/ আলবানী সহীহ বলেছেন]