সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

প্রসংগঃ মুসলিম আমীর বা শাসকদের অধিকার

প্রসংগঃ মুসলিম আমীর বা শাসকদের অধিকার
_____________________________
মুসলিম আমীর বা শাসকদের ব্যপারে আমাদের দৃষ্টিভংগি কেমন হওয়া উচিত?
ইমাম তাহাবী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৩২১ হিজরী), তার বিখ্যাত আহলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেনঃ
আমীর ও শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাকে আমরা জায়েয মনে করি না, যদিও তারা যুলুম-অত্যাচার করে। আমরা তাদেরকে অভিশাপ দিব না, এবং তাদের আনুগত্য হতে হাত গুটিয়ে নিব না। তাদের আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্যের সাপেক্ষে ফরয, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর অবাধ্যচরণের আদেশ দেয়। আমরা তাদের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য দুয়া করব।
আকীদাহ আত-ত্বাহাবীয়া।
_____________________________
মুসলিম আমীর বা শাসক অত্যাচারী জালেম হলে তাদের ব্যপারে ধৈর্য ধরতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধঃ
হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান (রাঃ) বলেছেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এক সময় আমরা অকল্যাণ ও মন্দের মধ্যে (কুফরীর মধ্যে) ডুবে ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ আমাদেরকে কল্যাণের (ঈমানের) মধ্যে নিয়ে এসেছেন। এখন আমরা সেই কল্যাণের মধ্যে বহাল আছি। তবে এই কল্যাণের পরে কি আবার অকল্যাণের যুগ আসবে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। আমি আবার বললাম, সেই অকল্যানের যুগের পর কি পুনরায় কল্যানের যুগ আসবে? তিনি বললেনঃ হাঁ, আসবে। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, সেই কল্যানের পর কি আবার অকল্যানের যুগ আসবে? তিনি বললেনঃ আসবে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ তা কিভাবে? তিনি বললেনঃ আমার পরে এমন কিছু ইমামের (শাসক) আগমন ঘটবে, তারা আমার প্রদর্শিত পথে চলবে না এবং আমার সুন্নাত (জীবন বিধান) গ্রহন করবে না। (অর্থাৎ তারা নিজেদের খোয়াল-খুশী মত চলার পথ আবিষ্কার করে নেবে)। অচিরেই তাদের মধ্যে এমন কিছু লোক সমাজের নেতৃত্ব নিয়ে দাঁড়াবে যাদের মানব দেহে থাকবে শয়তানের অন্তর
আমি (হুজাইফা রাঃ) জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি সেই যুগে উপনীত হই তাহলে আমি কি করব?
তিনি (সাঃ) বললেনঃ তুমি আমীরের নির্দেশ শোন এবং তার আনুগত্য কর। যদিও সে তোমার পিঠে আঘাত (নির্যাতন) করে এবং তোমার ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয় তবুও তার কথা শোন এবং তার আনুগত্য কর
সহীহ মুসলিমঃ কিতাবুল ইমারাহ (প্রশাসন ও নেতৃত্ব) অধ্যায়, হাদীস নং- ৪৫৫৪।
এই হাদিসে রাসুল সাঃ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেনঃ
১. মুসলিমদের উপর ভবিষতে কিছু শাসক আসবে যারা ক্বুরান ও সুন্নাহ অনুযায়ী চলবেনা। উল্লেখ্য বর্তমানে বিভিন্ন মুসলিম দেশে এইরকম জালেম শাসক দেখা যাচ্ছে।
২. তাদের কাজকর্ম এতো জঘন্য হবে যে, রাসুল সাঃ তাদেরকে মানুষের ভেতরে শয়তানের অন্তর বলেছেন। আমার মনে হয়না অন্য কোন ভাষায় কোন মানুষকে এর চাইতে খারাপ বলে বর্ণনা করা যেতে পারে।
৩. সেই সময়ে আমরা কেউ যদি পৌঁছে যাই তাহলে আমরা যেন সেই শাসকের আনুগত্য করি, এমনকি সে যদি আমাদেরকে মারধর করে এবং আমাদের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়।
এখন বলতে পারেন বিদ্রোহ না করে কেন রাসুল সাঃ আমাদেরকে শাসকরা জালেম হলেও তবুও তাদের আনুগত্য করতে নির্দেশ দিয়েছেন? এর কারণ হচ্ছে, বিদ্রোহ করলে যেই ক্ষতি হয় তাঁর তুলনায় যুলুম সহ্য করা অনেক কম ক্ষতিকর, যা যুগে যুগে খারেজীদের কার্যকলাপ দ্বারা বারবার প্রমানিত হয়েছে। আপনারা বর্তমান লিবিয়া, তিউনিয়সিয়া, মিশর, সিরিয়া ইত্যাদি দেশে বিদ্রোহের দিকে লক্ষ্য করে দেখুন বিদ্রোহের পূর্বের শাসকদের জুলুম অত্যাচার ও পরে দেশে বিশৃংখলা ও ফেতনা-ফাসাদ দেখলে বুঝতে পারবেন, কেনো বিদ্রোহের ব্যপারে ইসলাম এতো সতর্কতা অবলম্বন করেছে।
_____________________________
মুসলিম আমীর বা শাসকদের প্রকাশ্যে সমালোচনা করা জায়েজ নয়ঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন,
যে ব্যক্তি সুলতানকে (শাসক/নেতাকে) উপদেশ দিতে চায়, সে যেন প্রকাশ্যে সেটা না করে। বরং তার জন্যে করণীয় হচ্ছে, সে তার সুলতানের হাত ধরে নিয়ে তাকে লোকচক্ষুর আড়ালে ব্যক্তিগতভাবে উপদেশ দেবে। যদি সেই সুলতান তার উপদেশ গ্রহণ করে, তাহলে সেটা তার (সুলতানের) জন্যে ভালো এবং এটাই তার করা উচিৎ। কিন্তু সুলতান যদি উপদেশ গ্রহণ না করে, তাহলে উপদেশদাতা তার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেলো। 
হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইবনে আবি আসিম তার আস-সুন্নাহ নামক গ্রন্থে। শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহু হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, যিলাল আল-জান্নাহ।
_____________________________
আহলে সুন্নাহর লোকেরা মুসলিম শাসকদেরকে গালি-গালাজ করেনা, বরং তাদের কল্যানের জন্যে দুয়া করে। কারণ শাসকের হেদায়েত হলে তার দ্বারা পুরো দেশবাসী উপকৃত হবে। এইজন্যে ইমাম আহলে সুন্নাহ, আহমাদ ইবনে হাম্বাল রাহিমাহুল্লাহকে (মৃত্যু ২৪১ হিজরী) যখন মুহতাজিলা কুফুরী মতবাদ মেনে নেওয়ার জন্যে জেলখানায় দিন-রাত অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন করা হতো, তবুও তিনি তৎকালীন জালেম বাদশাহর বিরুদ্ধে বদ দুয়া করতেন না, বরং তার জন্যে দুয়া করতেন। অত্যাচারী বাদশাহকে তিনি কখনো কাফের বলে ফতোয়া দিতেন না, বা তার সমালোচনা করে জনগণকে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্যে উস্কে দিতেন না। পক্ষান্তরে, মুসলমান শাসকদেরকে গালিগালাজ করা ও মিম্বারে বসে তাদের সমালোচনা করে জনগণকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে উস্কে দেওয়া মনপূজারী, বেদাতী ও খারজীদের একটা লক্ষণ। ইমাম আল-বারবাহারি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৩২৯ হিজরী) বলেন,
যদি তুমি কোন ব্যক্তিকে দেখো সে শাসকদের বদদুয়া করছে, তাহলে জেনে রাখো সে একজন মনপূজারী, বিদাতী। আর তুমি যদি কোন ব্যক্তিকে দেখো সে শাসকদের জন্য ভালো দুয়া করছে, তাহলে সে একজন আহলে সুন্নাহ, ইন শা আল্লাহ্।
শরাহুস সুন্নাহঃ পৃষ্ঠা ১১৩-১১৪।
_____________________________
মুসলিম শাসকদেরকে অন্যায়ভাবে অপমান করার পরিণামঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন,
যে ব্যক্তি যমীনে আল্লাহর নিযুক্ত সুলতানকে অপমান করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে লাঞ্চিত করবেন।
সহীহ আত্-তিরমিজিঃ ২২২৪, হাদীসটি হাসান সহীহ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
যে ব্যক্তি কোন মুমিন ব্যক্তি সম্পর্কে এমন কটূক্তি করবে, যা তার মাঝে প্রকৃতপক্ষে নেই, আল্লাহ তাকে রাদগাতুল খাবাল তথা জাহান্নামীদের গলিত রক্ত-পূজের স্তুপে বসবাস করাবেন।
আবূ দাউদ, বিচার অধ্যায়, ৩১২৩ নং হাদীস।
_____________________________
ইমাম আল-বারবাহারি রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৩২৯ হিজরী) বলেন,
যে ব্যক্তি কোন মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সে
ক খারেজীদের মধ্যে একজন
খ সে মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করলো
গ সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসের বিরোধীতা করলো এবং
ঘ তার মৃত্যু যেন জাহেলী যুগের মৃত্যুর মতো।
শরাহুস সুন্নাহঃ পৃষ্ঠা ৪২।
_____________________________
উপরের দীর্ঘ এই আলোচনার মাধ্যমে আহলে সুন্নাহর আকীদাহ অনুযায়ী মুসলিম আমীর বা শাসকদের অধিকার কেমন, সে সম্পর্কে কিছু হাদীস এবং পূর্ববর্তী বড় ওলামাদেরপ্ত কিছু কথা তুলে ধরা হলো। যারা আহলে সুন্নাহ বা সুন্নী, সালাফী বা আসারি আকীদাহর বিরোধীতা করে, তাদের ব্যপারে আমাদের দৃষ্টিভংগি কেমন হওয়া উচিত?
উত্তরঃ ইমাম আবু জাফর আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ রাহিমাহুল্লাহ (যিনি ইমাম তাহাবী নামে বেশি পরিচিত), আকীদাহর উপরে লেখা তাঁর অনন্য বইয়ে প্রায় ১০২টি পয়েন্টে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের আকীদাহ বর্ণনা করার পর ১০৩ নাম্বার পয়েন্টে উল্লেখ করেছেন:
এই হচ্ছে আমাদের দ্বীন এবং আমাদের আক্বীদাহ বা মৌলিক ধর্ম বিশ্বাস, যা প্রকাশ্যে এবং অন্তরে আমরা ধারণ করি। যারা উল্লিখিত বিষয় বস্তুর বিরোধিতা করে, তাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।
আল-আক্বীদাহ আত-তাহাবীয়া।
_____________________________
বিনীত,

আনসারুস সুন্নাহ।