বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সউদী সরকার নাকি রাসুল সাঃ এর দেহবাশেষ তাঁর কবর থেকে উঠিয়ে অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে ফেলছে?

সউদী সরকার নাকি রাসুল সাঃ এর দেহবাশেষ তাঁর কবর থেকে উঠিয়ে অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে ফেলছে? নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক !!

গতকাল রাত থেকে একটা নিউজ দেখলাম যা বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সাইটে প্রচার করে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে ইসলামের দুশমন ও বেদাতপন্থী লোকেরা।

ইহুদীদের দোসর, খ্রীস্টানদের মিডিয়া, লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট নামক ইসলাম বিদ্বেষী পত্রিকা থেকে একটা নিউজ প্রচার করা হচ্ছে, সউদী সরকার নাকি রাসুল (সাঃ) এর দেহবাশেষ তাঁর কবর থেকে উঠিয়ে অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করছে লা হাউলা ওয়ালা ক্ব্যুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।

এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট ও ইসলামের দুশমনদের ষড়যন্ত্রমূলক একটা প্রোপাগান্ডা।

আল্লাহর দুশমনদের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের ইসলামবিরোধী নাস্তিক টিভি-পত্রিকা ইত্যাদি প্রচার মাধ্যমগুলো এবং কবর মাযার ও পীর পূজারী সূফী, দেওবন্দি ও বেরেলুবী মতবাদের অনুসারী লোকেরা অথবা ইসলামি গণতন্ত্রের অনুসারী কি-বোর্ড মুজাহিদিনরা, খারেজী আকীদার নানারকম বেদাতী লোকেরা কোনরকম যাচাই-বাছাই করা ছাড়াই ইসলামের দুশমনদের কথা বিশ্বাস করে সউদী বিরোধী মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সরলমনা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করছে। অথচ ইসলামের দুশমন কাফেরদের দেওয়া কোন নিউজ বিশ্বাস করাতো দূরের কথা, কোন ফাসেকের দেওয়া নিউজই যাচাই-বাছাই করা ছাড়া বিশ্বাস করতে কুরানুল কারীমে আল্লাহ নিষেধ করে দিয়েছেনঃ  

হে ইমানদারগণ! যদি কোন ফাসেক (পাপাচারী ব্যক্তি) তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তোমরা সেটা যাচাই-বাছাই করে দেখবে, যাতে (মিথ্যা তথ্য বিশ্বাস করে) অজ্ঞতাবশত তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধন করে না করো এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও।
সুরা হুজুরাতঃ ৬। 

যাছাই বাছাই ছাড়া কোন কথা বা নিউজ যে শুনে বিশ্বাস করে ও প্রচার করে সে একজন মিথ্যাবাদীঃ
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, একজন মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতোটুকইু যথেষ্ঠ যে, সে যাই শুনে তাই প্রচার করে বেড়ায়।

এবার আসি মূল প্রসংগে, আসলেই কি সউদী সরকার রাসুল সাঃ এর দেহবাশেষ সরিয়ে ফেলছে?

সাহাবারা রাসুল সাঃ এর কবরকে মসজিদে নববীর বাইরে মা আয়িশাহ রাঃ এর ঘরেই দিয়েছিলেন। পরে উমাইয়া একজন রাজা আব্দুল মালেক, যে কুরান হাদীস ভালো জানতোনা মসজিদে নববীকে যখন বাড়ানো হচ্ছিলো তখন সেই প্রথম রাসুল (সাঃ) এর কবরকে মসজিদের ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আদেশ দেন। তখন মদীনার গভর্নর ছিলেন দ্বিতীয় উমার নামে পরিচিত, ন্যায়পরায়ণ শাসক ও আলেমে দ্বীন - উমার বিন আব্দুল আজীজ রহঃ (পরবর্তীতে যিনি মুসলমানদের খলিফা নিযুক্ত হন)।

মসজিদের ভেতরে কবর রাখা জায়েজ নয় কারণ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদে দাফন করতে এবং কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করতে নিষেধ করেছেন। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তেও কবরকে মসজিদে পরিণতকারীদের উপর লানত করেছেন এবং তাঁর উম্মতকে সতর্ক করেছেন। তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন যে, কবরকে মসজিদে পরিণত করা ইহুদী-খৃষ্টানাদের কাজ।
সহীহ বুখারীঃ জানাজা অধ্যায় হাদীস নং ১৩৯০।

কবরকে মসজিদ বানানো নিষিদ্ধ কারণ মসজিদে দাফন করা এবং কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা শির্কের মাধ্যম ও বাহন।

সেইজন্য উমার বিন আব্দুল আজীজ রহঃ রাজার দেওয়া আদেশ যা ইসলাম সম্মত নয়, সে ব্যাপারে ততকালীন সবচাইতে বড় তাবেয়ীদের সাথে পরামর্শ করেন, যাদের মধ্যে ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ তাবেয়ী ইমাম সাঈদ ইবনে মুসায়্যাব (রহঃ), তিনিসহ সমস্ত বিজ্ঞ তাবেয়ী আলেমরা একমত হন যে, কুরান ও সুন্নাহ অনুযায়ী রাসুল (সাঃ) এর কবর মসজিদের ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করা সঠিক নয় এবং রাজা যেই আদেশ করেছেন সেটা ইসলাম সম্মত নয়।

যাইহোক, ওলামাদের বিরোধীতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত রাজার আদেশ অনুযায়ী রাসুল (সাঃ) এর কবরকে মসজিদে নববী সম্প্রসারণের সময় মসজিদের ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফেতনা এড়ানোর জন্য এবং সাধারণ মুসলমানেরা যাতে বিভ্রান্ত না হন, সেইজন্য নবী সাঃ এর কবর আজ পর্যন্ত মসজিদের ভেতরেই বস্থিত। যদিও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাসুল সাঃ এর কবর ও মসজিদ দুইটিকে পৃথক রাখা জরুরী ছিলো।

বিভিন্ন যুগে মুহাক্কিক ওলামারা রাসুল সাঃ এর কবর ও মসজিদকে পৃথক রাখার জন্য ফতোয়া দিয়েছেন। কিন্তু ওলামাতো দূরের কথা, একেবারে সাধারণ কোন ঈমানদার পর্যন্ত রাসুল (সাঃ) এর কবরকে তুলে অন্যত্র সরানোর মতো জঘন্য বেয়াদবীমূলক কথাবার্তা কোনদিন বলেন নি।

যাই হোক রাসুল (সাঃ) এর কবর স্থানান্তরের কথিত পরিকল্পনাটি আসলে সউদী সরকারী কমিটির নিকট দেয়া একটি একাডেমিক পেপার। যারা এ সমস্ত একাডেমিক পেপার সম্পর্কে জানেন, তারা বুঝতেই পারছেন যে এরকম একটি পেপার সাবমিট করাটা কিছুতেই কমিটির প্রকৃত পরিকল্পনাপত্রের প্রকার ও প্রকৃতির মধ্যে পড়ে না। আরো লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই পেপারে কোথাও রাসুল (সাঃ) এর কবরকে স্পর্শ করার কথা বলা হয়নি। কোনও সুস্থ মুসলমান এটা প্রস্তাব করতে পারেনা। বরং, এই পেপারটিতে যা প্রস্তাব করা হয়েছে তা হল - পুরো মসজিদটাকেই আবার পুনর্নির্মাণ পরিকল্পনার আওতায় আনা উচিত, যাতে করে কবরটি মসজিদের সীমানার বাইরে পড়ে।

=> প্রস্তাব প্রণয়নকারী যা প্রস্তাব করেছে সেটা হল মসজিদের সীমানাটাকে পরিবর্তন করতে, কবরকে স্থানান্তর করতে বলা হয়নি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য আসলে সৎ, মসজিদ এমন ভাবে পুনর্নির্মান করা, যাতে করে রাসুল (সাঃ) এর কবর অক্ষতই থাকবে কিন্তু নতুন ডিজাইনের মাধ্যমে রাসুল সাঃ এর আদেশ অনুযায়ী কবর ও মসজিদ আলাদা হয়ে যাবে। যাই হোক, রাসুল সাঃ এর মসজিদ ও কবর নিয়ে আল্লামাহ শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমিনের ফতোয়া দেখুন ফতওয়া আরকানুল ইসলাম থেকে নেওয়াঃ
প্রশ্নঃ (৮০) যে সমস্ত কবর পূজারী নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কবর মসজিদের ভিতরে হওয়াকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে, আমরা কিভাবে তাদের উত্তর দিব?
উক্ত প্রশ্নের উত্তর আমরা কয়েকভাবে দিতে পারিঃ-
১) মসজিদটি মূলতঃ কবরের উপর নির্মাণ করা হয়নি; বরং এ মসজিদ নির্মিত হয়েছে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবদ্দশায়।

২) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে মসজিদে দাফন করা হয়নি। কাজেই একথা বলার অবকাশ নেই যে ইহাও সৎ ব্যক্তিদেরকে মসজিদে দাফন করার কুপ্রথার অন্তর্ভুক্ত। বরং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে তাঁর নিজ ঘরে দাফন করা হয়েছে।

৩) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ঘরগুলোকে মসজিদে প্রবেশ করানো সাহাবীদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে নেওয়া হয়নি বরং তাদের অধিকাংশের মৃত্যুর পর হয়েছে। তখন তাঁদের অল্প কয়েকজন মাত্র বেঁচে ছিলেন। উহা ঘটেছিল ৯৪ হিজরী সনে মসজিদ সম্প্রসারণ কালে। এই কাজটি সাহাবীদের অনুমতি বা তাদের যৌথ সিদ্ধানে- হয়নি। তাদের কেউ কেউ এই কাজে বিরোধীতাও করেছিলেন। তাবেয়ীদের মধ্যে সাঈদ বিন মুসাইয়্যেব তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

৪) কবরটি মূলতঃ মসজিদের ভিতরে নয়। কারণ উহা মসজিদ হতে সমপূর্ণ পৃথক কক্ষে রয়েছে। আর মসজিদকে ওর উপর বানানো হয়নি। এজন্যই এই স্থানটিকে তিনটি প্রাচীর দ্বারা সংরক্ষিত ও বেষ্টিত করা হয়েছে। আর উত্তর দিকের প্রাচীরটি ত্রিভুজের মত করে রাখা হয়েছে। এতে করে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কবরটি সরাসরি মুছল্লীর সামনে পড়ে না। আশা করি কবর পূজারীদের দলীল খন্ডনে উপরোক্ত উত্তরগুলোই যথেষ্ট হবে।

আরো বিস্তারিত দেখুনঃ-
http://islamqa.info/en/65944


সর্বশেষঃ মিডিয়ার অধিকাংশই হচ্ছে সরাসরি বা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইসলাম বিরোধী। ক্বুরান, সুন্নাহ ও সাহাবাদের আদর্শ শিক্ষা করুন যাতে করে ফেতনার যামানায় হক্কের উপরে টিকে থাকতে পারেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে তোওফিক দান করুন আমিন।