মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০১৫

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা বিজয়


রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা বিজয় (আল্লাহ এ নগরকে সম্মানিত করুন)
সংকলনঃ আল্লামাহ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ
উৎস গ্রন্থঃ রমযান মাসের ৩০ আসর।
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তা পরিমিত করেছেন। প্রতিটি সৃষ্টির অবতরণস্থল ও বের হওয়ার স্থান জেনেছেন, তিনি যা চেয়েছেন তা লাওহে মাহফুজে সন্নিবেশিত করেছেন এবং লিখে রেখেছেন। সুতরাং, তিনি যা সামনে নিতে চাইবেন তা কেউ পেছাতে সক্ষম হবে না, আর তিনি যা পিছনে ফেলবেন তা কেউ এগিয়ে দিতে পারবে না। তিনি যাকে অপমান করবেন তার কোনো সাহায্যকারী নেই, আর তিনি যার সাহায্য করবেন তার কোনো অপমানকারী নেই। রাজত্ব, স্থায়ী অস্তিত্ব, সম্মান ও প্রতিপত্তিতে তিনি একক, সুতরাং যে কেউ এগুলোতে তার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে তাকে তিনি তুচ্ছ বানিয়ে ছাড়বেন। সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত সুতরাং তাঁর কাছে বান্দা যা গোপন বা লুকিয়ে রাখবে তা কোনোভাবেই গোপন থাকবে না। আমি তাঁর প্রশংসা করছি, তাঁর সকল নেয়ামতের উপর যা তিনি আমাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রদান করেছেন এবং সহজলভ্য করে দিয়েছেন।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, অপরাধীর তাওবা কবুল করেছেন, তাকে তার গুনাহ থেকে মুক্ত করেছেন এবং তাকে ক্ষমা করেছেন। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসুল; যার মাধ্যমে তিনি হেদায়াতের পথ স্পষ্ট করে দিয়েছেন এবং আলোকিত করেছেন। আর তার মাধ্যমে শির্কের অন্ধকার ও তমাসা দূর করেছেন। আর তিনি তাঁর হাতে মক্কা বিজয়ের গৌরব তুলে দিয়েছেন, ফলে আল্লাহর ঘর থেকে মূর্তি দূর করেছেন এবং ঘরকে পবিত্র করেছেন।
আল্লাহ তাআলা তার উপর সালাত পেশ করুন, তাঁর পরিবার-পরিজনের উপর, অনুরূপ তাঁর সৎকর্মশীল সম্মানিত সাহাবীগণের উপর, আর নিষ্ঠার সাথে তাঁদের অনুসরণকারীদের উপর, যতদিন চাঁদের পূর্ণতা ও সূক্ষ্মতা চলবে ততদিন পর্যন্ত। আর আল্লাহ তাদের উপর যথাযথ সালামও প্রদান করুন। 
প্রিয় ভাইয়েরা! যেমনিভাবে ১৭-ই রমযান বদর প্রান্তে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে; যাতে ইসলামকে বিজয়ী করা হয়েছে এবং তার মিনার বুলন্দ হয়েছে, তেমনিভাবে অষ্টম হিজরীর সেই রমযান মাসের ২০ তারিখে নিরাপদ নগরী মক্কা বিজয়ের যুদ্ধও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মক্কা নগরীকে শির্কমুক্ত ইসলামী শহরে পরিণত করেন। যেখানে শির্কের পরিবর্তে তাওহদী বা একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কুফরীর পরিবর্তে ঈমান, অহংকারের পরিবর্তে ইসলাম তথা আত্মসমর্পন প্রতিষ্ঠিত হয়। এক মহাপ্রতাপশীল আল্লাহর ইবাদত ঘোষিত হলো, শির্কী মুর্তিগুলো এমনভাবে ভেঙে ফেলা হলো যে, সেগুলো আর কোনোদিন জোড়া লাগেনি।
এ মহান বিজয়ের কারণ সম্পর্কে বলা হয়, যখন ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়া প্রান্তরে কুরাইশ ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাঝে সন্ধি হয়, তখন কেউ স্বেচ্ছায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দলভুক্ত হল, আবার কেউ মুশরিক কুরাইশদের দলভুক্ত হল। খুযাআ গোত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দলে যোগ দিল এবং বনু বকর কুরাইশদের দলে যোগ দিল। 
এ গোত্র দুইটির মাঝে ইসলামপূর্ব জাহেলিয়্যাতের যুগে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল। বনু বকর এ সন্ধির সুযোগকে কাজে লাগাল এবং খুযাআর উপর নিরাপদ অবস্থায় হামলা করে বসল। কুরাইশরা গোপনে তাদের দলভুক্ত বনু বকরকে জনশক্তি ও অস্ত্র দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দলভুক্ত খুযাআ গোত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণে সাহায্য বনু বকর গোত্রকে করল। অতঃপর খুযাআ গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বনু বকরের কার্যক্রম ও কুরাইশদের সাহায্য সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি অবশ্যই তোমাদের পক্ষ হয়ে তোমাদের থেকে প্রতিরোধ করব যেভাবে আমি নিজের ব্যাপারে প্রতিরোধ করে থাকি।
কিন্তু কুরাইশ; তারা বিপদ আঁচ করতে পারল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো, তারা বুঝতে পারল যে, তারা তাদের এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হুদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে ফেলেছে। তাই তারা তাদের আবু সুফিয়ানকে সন্ধি পুনর্বহাল ও মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পাঠালো। আবু সুফিয়ান রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলল। কিন্তু রাসুল তার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। এরপর সে আবু বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সাথে কথা বলল; যাতে তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সুপারিশ করে, কিন্তু তাতেও সে সফল হতে পারলো না, তারপর সে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সুপারিশ চেয়েও কাজ হল না। তখন আবু সুফিয়ান আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলল, হে হাসানের পিতা! তোমার কী অভিমত? তখন তিনি বললেন, আমি এমন কিছু দেখি না যা তোমার কাজে আসবে। কিন্তু তুমি বনী কেনানার সর্দার। তুমি যাও আর লোকদেরকে নিরাপত্তা ও আশ্রয় দাও। আবু সুফিয়ান বলল, আপনি কি মনে করেন এটা আমার কোনো কাজে আসবে? উত্তরে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ না, আল্লাহর শপথ! কিন্তু এ-ছাড়া অন্য কিছু তোমার জন্য আমি পাচ্ছি না। অতঃপর আবু সুফিয়ান তা-ই করল এবং কুরাইশদের কাছে ফিরে গেল। তখন কুরাইশের লোকেরা বলল, তোমার অভিযানের সংবাদ কী? আবু সুফিয়ান বলল, আমি মুহাম্মাদের কাছে গিয়েছি এবং কথাবার্তা বলেছি। আল্লাহর কসম! তিনি কোনো উত্তর দেন নি। অতঃপর আমি ইবন আবি কুহাফা (আবু বকর) ও ইবনুল খাত্তাব (উমারের) কাছে গিয়েছি, তার থেকেও কোনো ভালো কিছু পাইনি। অতঃপর আমি আলীর কাছে গিয়েছি, তিনি আমাকে একটি বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন; যা আমি করেছি। আমি মানুষদেরকে পরস্পরের থেকে নিরাপত্তা ও আশ্রয় দিয়েছি। তখন তারা বলল, মুহাম্মদ কী এ ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন? সে বলল, না। তখন তারা বলল, তুমি ধ্বংস হও, তুমি কোনো কাজ করতে পারো নি। বরং সে (আলী) তোমার সঙ্গে তামাশা করেছে।
এদিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার হুকুম দিলেন। তাদেরকে তাঁর ইচ্ছা সম্পর্কে অবহিত করলেন। আর তিনি তাঁর চারপাশের গোত্রসমূহকেও যুদ্ধের জন্য বের হওয়ার আহ্বান জানালেন। এরপর এই বলে দুয়া করলেন, হে আল্লাহ! কুরাইশ গুপ্তচরদের কাছে আমাদের এ সংবাদ পৌঁছা বন্ধ কর, যাতে আমরা হঠাৎ করে তাদের দেশে পৌঁছুতে পারি। 
তারপর তিনি মদীনা থেকে প্রায় দশ হাজার যোদ্ধা সাহাবী নিয়ে বের হলেন। আর আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতূমকে মদীনার দায়িত্ব প্রদান করেন।
পথিমধ্যে তিনি যখন জুহফায় ছিলেন, তখন তাঁর চাচা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল, তিনি সপরিবারে ইসলাম গ্রহণ করে হিজরত করে মদীনা আসছিলেন। অতঃপর যখন তিনি আবওয়া নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন রাসুলের চাচা আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেস ইবনে আবদিল মুত্তালিব ও তাঁর ফুফাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবন আবি উমাইয়্যা তার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তারা উভয়েই ছিল তাঁর ঘোর শত্রু; কিন্তু তারা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করল। রাসুল তাদের ইসলাম গ্রহণ মেনে নিলেন। তিনি আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেস সম্পর্কে বললেন, আমি আশা করি তিনি হামযার স্থলাভিষিক্ত হবেন। 
তারপর যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার নিকটবর্তী মাররুয যাহরান নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন তিনি সৈন্য বাহিনীকে আগুন জ্বালাতে নির্দেশ দিলেন, তারা ১০,০০০ আগুনের চুলা জ্বালালেন। আর মুসলিম সেনাবাহিনীর প্রহরায় উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নিযুক্ত করলেন। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খচ্চরে আরোহণ করে এমন এক ব্যক্তিকে তালাশ করতে লাগলেন যে কুরাইশদের কাছে এ সংবাদ নিয়ে যাবে যে, তারা যেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মুখে এসে যুদ্ধ পরিহার করে নিরাপত্তা চায়। যাতে মক্কায় যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত না ঘটে। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু চলতে চলতে হঠাৎ আবু সুফিয়ান (ইবনে হারব) এর কথার আওয়াজ শুনলেন, সে বুদাইল ইবন ওয়ারাকাকে বলছে, গত রাতের মতো এত আগুন প্রজ্জ্বলিত হতে আমি আর কখনো দেখিনি। তখন বুদাইল বলল, এ তো খোযাআ গোত্র। আবু সুফিয়ান বলল, খোযাআরা তো এরচেয়ে অনেক কম ও হীন লোক। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু আবু সুফিয়ানদের আওয়াজ বুঝতে পেরে ডাকলেন, আবু সুফিয়ান বলল, হে আবুল ফযল! তোমার কী হয়েছে? আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এই তো আল্লাহর রাসুল সকলের মাঝে উপস্থিত। আবু সুফিয়ান বলল, এখন আমি কী করব? আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমার সঙ্গে চল, আমি তোমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে যাব এবং তোমার জন্য নিরাপত্তা চাইব। এরপর আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে এলেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আবু সুফিয়ান তোমার জন্য ধ্বংস, এখনো কি তোমার বুঝে আসেনি যে, আল্লাহ তাআলা ছাড়া সত্যিকারের কোনো মাবুদ নেই? উত্তরে আবু সুফিয়ান বলল, আপনার প্রতি আমার পিতামাতা উৎসর্গ হোক! আপনি কতই না সহিষ্ণু, সম্মানিত ও আত্মীয়পরায়ণ। আমি ভালোভাবে জানি যে, যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ থাকত, তাহলে এখন সে আমার কাজে লাগত।
অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি এখনো বুঝতে পারোনি যে আমি আল্লাহর রাসুল? এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান ইতস্তত করতে লাগলেন। তাকে উদ্দেশ করে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তোমার জন্য ধ্বংস; ইসলাম গ্রহণ কর। এরপর আবু সুফিয়ান কালেমায়ে শাহাদাৎ পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
পরক্ষণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন আবু সুফিয়ানকে নিয়ে পাহাড়ের সংকীর্ণ উপত্যকায় অবস্থান করেন এবং মানুষ যেন তার পাশ দিয়ে যাতায়াত করে। এরপর তার পাশ দিয়ে বিভিন্ন গোত্রের লোকজন তাদের ঝান্ডাসহ অতিক্রম করতে লাগল। যে গোত্রই অতিক্রম করত আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে গোত্রের পরিচিতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন, তখন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু উভয়ের মাঝে পরিচয় করিয়ে দিতেন। আর আবু সুফিয়ান বলতেন, আমাদের মাঝে ও তাদের কী হলো? ইতোমধ্যে একটি কাফেলা তার মুখোমুখি হলে আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করলেন এরা কারা?
আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এরা হলো মদীনার আনসার, তাদের নেতা হলেন সাদ ইবন উবাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু তার সঙ্গেই ঝান্ডা ছিল, যখন সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তার পাশাপাশি আসলেন, তখন তিনি বললেন, হে আবু সুফিয়ান! আজকের দিন ধ্বংসযজ্ঞের দিন, আজ কাবায় রক্তপাত হালাল করা হয়েছে।
অতঃপর ছোট অথচ সম্মানিত একটি কাফেলা এলো যাদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কিরামও ছিলেন। তাদের ঝান্ডা ছিল যুবায়ের ইবন আওয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাতে। যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু সুফিয়ানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, আবু সুফিয়ান তখন তাকে সাদ ইবন উবাদা রাদিয়াল্লাহু যা বলেছিলেন সে সম্পর্কে রাসুলকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেনঃ
সাদ ভুল বলেছে। বরং, আজ এমন এক দিন যাতে আল্লাহ তাআলা কাবাকে সম্মানিত করেছেন। আজ কাবাকে গিলাফাচ্ছাদিত করা হবে।
অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাত থেকে ঝান্ডা নিয়ে তার ছেলে কায়েসের হাতে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি লক্ষ্য রাখছিলেন যে, যখন ঝান্ডাটা তার ছেলের হাতে দেয়া হচ্ছিল তখন তা সম্পূর্ণরূপে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর হস্তচ্যুত হয় নি।
তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামনে অগ্রসর হলেন, তিনি তাঁর ঝাণ্ডাটি হাজুন নামক স্থানে স্থাপন করতে বললেন। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দৃঢ়পদে বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করছিলেন। তিনি সেখানে আল্লাহ তাআলার প্রতি বিনীত হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রবেশ করছিলেন। এমনকি তাঁর মাথা বাহনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল এবং তিনি উঁচু আওয়াজে বার বার পড়ছিলেন:
নিশ্চয় আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দিয়েছি। সূরা আল-ফাতহঃ ১।
তিনি মক্কা নগরীর এক প্রান্তে খালিদ ইবন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং অন্য প্রান্তে যোবায়ের ইবন আওয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রেরণ করে এ ঘোষণা দিতে বললেন, যে ব্যক্তি মাসজিদে হারাম তথা বায়তুল্লাহতে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ। যে আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ। আর যে ব্যক্তি নিজের ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করবে সেও নিরাপদ। 
এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামনে অগ্রসর হয়ে মসজিদে হারামে প্রবেশ করে তিনি তার বাহন উটের উপর থেকেই তাওয়াফ করলেন। তখন বাইতুল্লাহর পাশে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সঙ্গে থাকা ধনুকের অগ্রভাগ দিয়ে মূর্তিগুলোর গায়ে আঘাত করে তিরস্কার করে বলছিলেনঃ হক এসেছে এবং বাতিল বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় বাতিল বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল। সুরা বানী ইসরাঈলঃ ৮১।  
সত্য এসেছে এবং বাতিল কিছু সৃষ্টি করতে পারে না, আর কিছু পুনরাবৃত্তিও করতে পারে না। সুরা সাবাঃ ৪৯।
আর তখন মূর্তিগুলো আপনা আপনি মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছিল। 
এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবার ভিতরে প্রবেশ করলেন। তিনি সেখানে কিছু ছবি দেখতে পেলেন। তিনি সেগুলোকে মিটিয়ে দেবার নির্দেশ দিলে তা নিশ্চিহ্ন করা হলো। তারপর তিনি সেখানে সালাত আদায় করলেন; সালাত শেষ করার পর তিনি কাবার বিভিন্ন দিকে ঘুরে ফিরে দেখলেন এবং সবদিকে তাওহিদের বাণী উচ্চারণ করলেন। তারপর তিনি বায়তুল্লাহর দরজার উপর আসলেন, আর কুরাইশরা ছিল তাঁর নীচে; তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি করেন তা প্রত্যক্ষ করার অপেক্ষায় ছিল। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবার দরজার দুপাল্লা ধরে বললেনঃ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকারের মাবুদ নেই। তাঁর কোনো শরীক নেই। সকল রাজত্ব তাঁরই, তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা, তিনি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান। তিনি স্বীয় ওয়াদা সত্য করে দেখিয়েছেন। স্বীয় বান্দার সাহায্য করেছেন। একাকী সমস্ত শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করেছেন। হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহ তাআলা তোমাদের থেকে জাহিলিয়্যাতের অহমিকা ও পূর্বপুরুষদের নিয়ে অহংকার দূর করে দিয়েছেন। সকল মানুষ আদম আলাইহিস সালাম থেকে জন্ম নিয়েছে। আর আদম আলাইহিস সালাম মাটির তৈরি।
হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত। সুরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১৩।
তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমার সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা? আমি তোমাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করব? তারা বলল, আমরা শুধু উত্তমই আশা করি, সম্মানিত ভাই এবং সম্মানিত ভ্রাতুষ্পুত্র। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি তোমাদের তেমনি বলব, যেমন ইউসূফ আলাইহিস সালাম তাঁর ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেনঃ আজ তোমাদের প্রতি কোনো ভর্ৎসনা নেই, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। সুরা ইউসুফঃ ৯২। তোমরা যাও, তোমরা মুক্ত। তোমাদের থেকে কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না।
মক্কা বিজয়ের দ্বিতীয় দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভাষণ দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন। প্রথমে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও স্তুতি পেশ করলেন এরপর বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মক্কা নগরীকে সম্মানিত করেছেন। কোনো মানুষ তা সম্মানিত ঘোষণা করে নি। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের উপর ঈমান রাখে, তার জন্য এখানে রক্তপাত এবং গাছ কর্তন করা বৈধ নয়। সুতরাং তোমাদের কেউ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুদ্ধের কারণে এখানে যুদ্ধের অবকাশ চাইলে তাকে বলবে, আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসুলকে অনুমতি দিয়েছিলেন, তোমাদের অনুমতি দেন নি। তিনি বললেন, আমাকে দিনের কিছু অংশ অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আজ মক্কার হুরমত ও সম্মান পুনরায় বহাল হলো, যেমনটি গতকাল ছিল। তোমাদের উপস্থিতরা যেন আমার বাণী অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দেয়। 
আর যে সময়টুকু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য মক্কায় যুদ্ধ হালাল করা হয়েছিল, তা হলো বিজয়ের দিন সূর্যোদয় থেকে নিয়ে ওই দিন আসর পর্যন্ত। এরপর তিনি মক্কায় ১৯ দিন অবস্থান করেছিলেন এবং তখন সালাত কসর করেছিলেন।  আর মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে তিনি সিয়ামও পালন করেন নি। কেননা তখনও তিনি সফর শেষ করার নিয়ত করেন নি। তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের শিক্ষাকে সুদৃঢ় করা, ইসলামের ভিত্তি অন্তরে বদ্ধমূল করে দেয়া, ঈমান দৃঢ় করা এবং মানুষের কাছ থেকে বাইআত গ্রহণ করার জন্য।
সহীহ বুখারীতে মুজাশে রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনায় উল্লেখিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি আমার ভাইকে নিয়ে মক্কা বিজয়ের পর হিজরতের জন্য বাইআত গ্রহণের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলে তিনি বললেন, হিজরতকারীরা হিজরতের সকল কল্যাণ নিয়ে অগ্রগামী হয়ে গেছে। তাই এখন আমি তাকে ইসলাম, ঈমান ও জিহাদের ওপর বাইয়াত গ্রহণ করছি। 
আর এ প্রকাশ্য বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য পূর্ণাঙ্গ রূপ ফেলো, লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে লাগল। আর আল্লাহর নগরী মক্কা পুনরায় ইসলামী রুপান্তরিত হলো; যেখানে আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্যতা এবং আল্লাহর কিতাবের দৃঢ়তার ঘোষণা প্রদত্ত হলো। আর এর ক্ষমতা মুসলিমদের হাতে চলে এলো। শির্ক দূরীভূত হলো এবং তার আঁধার বিলুপ্ত হলো। আল্লাহই সবচে বড়, আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা; আর এটি কিয়ামতাবধি তাঁর বান্দাদের ওপর তাঁর রহমতের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
হে আল্লাহ! আমাদের এ মহান নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের তাওফীক দিন। সব জায়গায় সব সময় মুসলিম উম্মাহর বিজয় নিশ্চিত করুন। আমাদের ও আমাদের পিতামাতা এবং সকল মুসলিমকে আপনার দয়ায় ক্ষমা করুন, হে পরম করুণাময়।

আর আল্লাহ সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের ওপর।