সোমবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৫

সুদঃ ইন্টারেস্ট বা মুনাফা, ব্যংকের প্রফিট, শেয়ার, চাকুরী

সুদঃ ইন্টারেস্ট বা মুনাফা, ব্যংকের প্রফিট, শেয়ার, চাকুরী।
- আনসারুস সুন্নাহ
_________________________
সুদ খাওয়া কত বড় পাপ?
১. আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৭টি কবীরাহ গুনাহকে ধ্বংসাত্বক বলে সেইগুলোর ব্যপারে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তার মাঝে সুদ একটি।
সহীহ বুখারীঃ ২৭৬৬; সহীহ মুসলিমঃ ৮৯; আবু দাউদ; নাসাঈ।

২. আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
জেনেশুনে মানুষের কাছ থেকে মাত্র এক দিরহাম সুদ খাওয়া অপেক্ষা ৩৬ বার জিনা করা আল্লাহর কাছে অধিক গুরুতর বিষয়।
মুসনাদে আহমদঃ ৫/৩৩৫; ত্বাবারানীর কাবীর ও আউসাত্ব। হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ; সহীহুল জামিঃ ৩৩৭নং হাদীস।

৩. আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন,
সুদ খাওয়ার মাঝে রয়েছে ৭০ প্রকার পাপ। এর মাঝে সবচাইতে ছোট পাপ হচ্ছে নিজের মায়ের সাথে জিনা করার মতো। (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)!
ইবনে মাজাহঃ ২২৭৮। হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ; সহীহ ইবনে মাজাহঃ ১৮৪৪।
_________________________
কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যেমন ব্যংক, এনজিও, অর্থ লগ্নিকারী বা ঋণ দানকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি, যারা মানুষদেরকে ঋণ দিয়ে সুদ খায়, আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেনঃ
উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম।
২৭৮. হে ঈমানদারগণ!  তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং, যদি তোমরা সত্যিই ঈমানদার হয়ে থাক তাহলে বকেয়া সুদের টাকা ছেড়ে দাও।
 ২৭৯. আর তোমরা যদি সুদের টাকা না ছাড়, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ কর।
_________________________
কোন সুদখোর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করা বা তাদের অধীনে চাকুরী করা হারাম এবং মারাত্মক গুনাহর কাজঃ
১. আল্লাহ তাআলা বলেন,
সৎকর্ম এবং তাক্বওয়া (আল্লাহভীতীর) ব্যপারে তোমরা একজন আরেকজনকে সাহায্য করবে, আর পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে তোমরা একে অন্যকে সাহায্য করবেনা। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কঠোর শাস্তিদাতা...।
সুরা আল-মাইয়িদাহঃ ২।

২. আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
যে ব্যক্তি সুদ খায় এবং যে সুদ দেয়, যে সুদের কথা লিখে রাখে এবং যারা সুদের সাক্ষী হয়, তাদের সবার উপরে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লানত (বা অভিশম্পাত) করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, এই সবগুলো মানুষ পাপের দিক থেকে সমান।
সহীহ মুসলিমঃ ১৫৯; মুসনাদে আহমদ, আবু দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ এবং ইবনে মাযাহ্। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) এই হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
_________________________
সুদ এবং ব্যংক সম্পর্কিত কিছু মাসয়ালাঃ
১. কোন সুদখোর ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা ব্যংকের অধীনে চাকুরী করা হারাম। সেটা ম্যানেজার, অফিসার, সুপারভাইজার, দারোয়ান, সিকিউরিটি গার্ড বা পিয়ন, যেকোন পোস্টেই হোক না কেনো। কারো যদি জীবন রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যকীয়, এমন জরুরী অবস্থা সৃষ্টি না হলে এমন চাকুরী করা তার জন্যে বৈধ হবেনা। 
২. কোন সুদখোর ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের মালিক, অথবা সুদী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, এমন কোন নারী অথবা পুরুষকে বিয়ে করা জায়েজ নয়। গার্জিয়ানদের জন্যে এমন কারো সাথে মেয়ের বিয়ে দেওয়া জায়েজ নয়।
৩. সুদের টাকা এবং সুদী প্রতিষ্ঠানে কাজের বিনিময়ে অর্জিত উপার্জন হালাল নয়। এইভাবে জমানো টাকা সুদ দাতাকে ফেরত দিতে হবে, বা সওয়াবের নিয়ত ছাড়াই গরীব-মিসকীনকে দিয়ে দিতে হবে।
৪. সুদের উপরে লোন নিয়ে বাড়ি নির্মান করা, গাড়ী বা অন্য কিছু ক্রয় করা, বিয়েতে জাকজমকপূর্ণ অপব্যয় ও বিলাসী কাজ করা, ইত্যাদি কাজগুলো নাজায়েজ, হারাম।
৫. সরকারী অফিসে পেনশনের সাথে যেই টাকা সুদ হিসেবে অতিরিক্ত যোগ হয়, সেটা হারাম। নিজের প্রাপ্য মূল বেতন-ভাতার বাইরে সুদ হিসেবে অতিরিক্ত যেই টাকা আসে, সেটা সওয়াবের নিয়ত ছাড়াই গরীব-মিসকীনকে দিয়ে দিতে হবে।
৬. অনেক নারী ও পুরুষ ফিক্সড ডিপোজিট করে, অথবা ব্যংকে টাকা রেখে ইন্টারেস্ট বা মুনাফা গ্রহণ করে। এই টাকা সুদ, যারা এই মুনাফা ভোগ করে তারা সুদখোর, তারা সুদখোর।
৭. সুদের টাকা দিয়ে ক্রয় করা খাবার খাওয়া হারাম।
৮. ব্যংক বা বীমা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনা হারাম।
৯. প্রাইজ বন্ড ক্রয় করা হারাম, এর পুরষ্কার গ্রহণ করা হারাম।
১০. প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ইয়াহুদী জাতির লোকেরা সুদ খাওয়ার ব্যপারে সবচাইতে এগিয়ে। 
১১. ইয়াহুদী-খ্রীস্টানরা ড. ইউনুসকে নোবেল পুরষ্কার দিয়ে সম্মানিত করতে পারে, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে তিনি মোটেও সম্মানিত বা ভালো কোন মানুষ নন। বরং মনভোলানো সুন্দর সুন্দর কথা বলে তিনি দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে সুদের মাধ্যমে জোঁকের মতো তাদের রক্ত চুষে খাওয়ার একটা অভিশপ্ত ব্যংক চালু করেছেন।  
১২. সুদী ব্যংক বা প্রতিষ্ঠান সেটা সরকারী হোক কিংবা বেসরকারী - সবগুলোই হারাম বা নিষিদ্ধ।
১৩. কোন ব্যক্তিকে ধার বা ঋণ দিয়ে তার জন্যে কোন আমানত বা বন্ধক নিলে, সেই বন্ধকের দ্বারা কোনভাবে লাভবান হওয়া একপ্রকার সুদ।
প্রখ্যাত তাবেয়ী বিদ্বান ইমাম হাসান আল-বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তোমার কাছে ঋণগ্রস্থ এমন ব্যক্তির কাছ থেকে তুমি যদি কিছু খাও, তাহলে সেটা সুদ।
কিতাবুল কাবায়ের, ইমাম আয-যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ।
উদাহরণঃ কোন ব্যক্তি কাউকে ২ বছরের জন্যে ২০ হাজার টাকা ধার দিলো, কোন প্রকার সুদের শর্ত ছাড়াই। কিন্তু টাকার জামানত বা সিকিউরিটির জন্যে সে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে এক ভরি স্বর্ণ, একটা গরু বা এক কাঠা জমি আমানত বা বন্ধক হিসেবে নিলো। এখন যতদিন পর্যন্ত না সে তার ধারের টাকা ফেরত দিচ্ছে সে যদি সেই স্বর্ণ তার স্ত্রী-কন্যাকে ব্যবহার করতে দেয়, বা সেই গরু দিয়ে হাল চাষ করে বা তাঁর দুধ দোহন করে খায় বা বিক্রি করে, অথবা সেই জমি চাষ করে লাভবান হয়, তাহলে সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে এটা খুব বেশি দেখা যায়। ঋণদাতা যদি এই সুদ থেকে বাঁচতে চায়, তাহলে তাকে স্বর্ণ ব্যবহারের জন্যে বা গরু থেকে লাভবান হওয়ার জন্যে তার মূল্য বা অংশ, জমি চাষের জন্যে তার লীজ মূল্য দিতে হবে।
১৩. আরো হয়তোবা অনেক বিষয় বাকি রয়ে গেলো, এই মুহূর্তে মনে পড়ছেনা।
_________________________
যার সুদ এবং সমস্ত হারাম রুজি থেকে বেঁচে থাকতে চান, তারা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শেখানো এই দুইটি দুয়া নিয়মিত পড়বেনঃ
ক. ছোট্ট, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দুয়াঃ

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْماً نافِعاً، وَرِزْقاً طَيِّباً، وَعَمَلاً مُتَقَبَّلاً

উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা ইন্নী আস-আলুকা ইলমান নাফিআন, ওয়া রিযক্বান ত্বাইয়্যিবান, ওয়া আমালান মুতাক্বাববালান।
অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট উপকারী জ্ঞান, পবিত্র জীবিকা ও গ্রহণযোগ্য আমল প্রার্থনা করছি। ইবনে মাজাহ, হিসনুল মুসলিম পৃষ্ঠা ১১৩।
প্রতিদিন ফযরের ফরয সালাত শেষে এই দুয়া একবার করে পড়া সুন্নাহ।
খ. ঋণের বোঝা এবং হারাম উপার্জন থেকে বাঁচার জন্যে দুয়াঃ

اللَّهُمَّ اكْفِنِي بِحَلاَلِكَ عَنْ حَرَامِكَ، وَأَغْنِنِي بِفَضْلِكِ عَمَّنْ سِوَاكَ

উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মাকফিনী বিহালা-লিকা আন হারা-মিকা ওয়া আগনিনী বিফাযলিকা আম্মান সিওয়া-ক।
অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার হালাল বস্তু দ্বারা সন্তুষ্ট করে আপনার হারাম বস্তু থেকে ফিরিয়ে রাখুন। আর আপনার অনুগ্রহ দ্বারা আপনি ছাড়া অন্য সকলের কাছ থেকে আমাকে অমুখাপেক্ষী রাখুন।
তিরমিযীঃ ৩৫৬৩। হাসান সহীহ, শায়খ আলবানী।
_________________________
মুসলিমদের মাঝে যারা সামর্থ্যবান তাদের দায়িত্ব হচ্ছে যাকাত, উশর, দান-সাদাকা, কর্জে হাসানাহ ইত্যাদি শরিয়াহ নির্দেশিত কাজের মাধ্যমে অন্য মুসলিম ভাইদেরকে সাহায্য করা এবং মুসলিম সমাজ থেকে সুদের মতো অভিশাপকে উৎখাত করার জন্যে সাধ্য অনুযায়ী জিহাদ করা।
_________________________
আল্লাহ আমাদেরকে সেই তোওফিক দান করুন, এবং আমাদের আমাদের পরিবারেকে সুদ এবং যাবতীয় হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করুন। (আমিন)

_________________________