সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০১৪

আল্লাহ সম্পর্কে বা ঈমান নিয়ে ওয়াসওয়াসা আসলে কি করতে হবে?


আল্লা সম্পর্কে বা ঈমান নিয়ে ওয়াসওয়াসা আসলে কি করতে হবে?
প্রশ্নঃ (১২) আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে শয়তান একজন মানুষকে এমন ওয়াস-ওয়াসা (কুমন্ত্রনা) প্রদান করে যে, সে ঈমান চলে যাওয়ার আশঙ্কা করে। এ সম্পর্কে আপনার উপদেশ কি?
প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন আল্লামাহ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ। উৎস গ্রন্থঃ ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, ঈমান অধ্যায়।
উত্তরঃ প্রশ্নকারী যে সমস্যার কথা ব্যক্ত করলেন এবং যার পরিণতিকে ভয় করছেন, আমি তাকে বলব যে, হে আল্লাহর অনুরাগী বান্দা! আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। উক্ত সমস্যার ভালো ফলাফল ব্যতীত মন্দ কোন ফল হবে না। কেননা, এই ওয়াস-ওয়াসাগুলো শয়তান মুমিনদের অন্তরে প্রবেশ করায়, যাতে সে মানুষের ঈমানকে দুর্বল করে দিতে পারে এবং তাদেরকে মানসিক অস্থিরতায় ফেলে দিয়ে ঈমানী শক্তিকে দুর্বল করে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, অনেক সময় মুমিনদের সাধারণ জীবন-যাপনকে বিপন্ন করে তুলে।
প্রশ্নকারী ব্যক্তির সমস্যাই মুমিনদের প্রথম সমস্যা নয় এবং শেষ সমস্যাও নয়; বরং দুনিয়াতে একজন মুমিন অবশিষ্ট থাকলেও এই সমস্যা বর্তমান থাকবে। সাহাবীগণও এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। সাহাবীদের একদল লোক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আগমণ করে জিজ্ঞাসা করলো, আমরা আমাদের অন্তরে কখনো কখনো এমন বিষয় অনুভব করি, যা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা আমাদের কাছে খুব কঠিন মনে হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন যে, সত্যিই কি তোমরা এরকম পেয়ে থাক? তাঁরা বললেন হ্যাঁ, আমরা এরকম অনুভব করে থাকি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা তোমাদের ঈমানের স্পষ্ট প্রমাণ। সহীহ মুসলিমঃ কিতাবুল ঈমান, অনুচ্ছেদঃ অন্তরের ওয়াস-ওয়াসা।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, তোমাদের কারো কাছে শয়তান এসে বলে, এটা কে সৃষ্টি করেছে? ওটা সৃষ্টি করেছে? এমনিভাবে এক পর্যায়ে সে বলে, তোমার প্রতিপালক আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছে? তোমাদের কারও অবস্থা এরকম হলে, সে যেন শয়তানের কুমন্ত্রনা হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায় এবং এরকম চিন্তা-ভাবনা করা হতে বিরত থাকে। সহীহ বুখারীঃ কিতাবু বাদাইল খালক্ব, অনুচ্ছেদঃ ইবলিস ও তার সৈন্যদের আলোচনা।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিতনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একজন লোক আগম করে বলল, আমার মনে কখনো এমন কথার উদয় হয়, যা উচ্চারণ করার চেয়ে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া আমার কাছে বেশী ভাল মনে হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি এই বিষয়টিকে নিছক একটি মনের ওয়াস-ওয়াসা হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। আবু দাউদঃ কিতাবুল আদাব, অনুচ্ছেদঃ ওয়াস-ওয়াসা প্রতিরোধ।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ তাঁর কিতাবুল ঈমানে বলেছেন, মুমিন ব্যক্তি শয়তানের প্ররোচনায় কখনো কুফরীর ওয়াস-ওয়াসায় পতিত হয়। এতে তাদের অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়। সাহাবীগণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ব্যক্ত করলেন যে, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমাদের কেউ কেউ তার অন্তরে এমন বিষয় অনুভব করে, যা মুখে উচ্চারণ করার চেয়ে আকাশ থেকে জমিনে পড়ে যাওয়াকে অধিক শ্রেয় মনে করে। এটা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইহা ঈমানের সুস্পষ্ট আলামত। অন্য বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি শয়তানের কুমন্ত্রণাকে নিছক একটি মনের ওয়াস-ওয়াসা হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। মুমিন ব্যক্তি এই ধরণের ওয়াস-ওয়াসাকে অপছন্দ করা সত্ত্বেও তার মনে এর উদয় হওয়া এবং তা প্রতিহত করতে প্রাণপন চেষ্টা করা তার ঈমানদার হওয়ার প্রমাণ বহন করে। যেমন কোন মুজাহিদের সামনে শত্রু এসে উপস্থিত হল। মুজাহিদ শত্রুকে প্রতিহত করল এবং পরাজিত করল। এটি একটি বিরাট জিহাদ। (অনুরূপভাবে শয়তানের ওয়াস-ওয়াসাকে প্রতিহত করাও একটি বড় জিহাদ)। এই জন্যই ইলম অর্জনকারী ও বাদতে লিপ্ত ব্যক্তিগণ বেশী বেশী ওয়াস-ওয়াসা এবং সন্দেহে পতিত হয়ে থাকে। অথচ অন্যদের এ রকম হয়না। কেননা এরা তো আল্লাহর পথ অনুসরণ করে না। এরা আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণে লিপ্ত রয়েছে। শয়তানের উদ্দেশ্যও তাই। অপর পক্ষে, যারা ইলম অর্জন এবং বাদতের মাধ্যমে তাদের প্রতিপালকের পথে চলে, শয়তান তাদের শত্রু। সে তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে রাখতে চায়
প্রশ্নকারীকে আমি বলব যে, যখন আপনি বুঝতে পারবেন, এটা শয়তানের কুমন্ত্রনা, তখন তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হোন। আর জেনে রাখুন যে, আপনি যদি তার সাথে সদা-সর্বদা যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন, তার পিছনে না ছুটেন, তাহলে সে আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমলে পরিণত করা অথবা মুখে উচ্চারণ না করা পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতের মনের ওয়াস-ওয়াসাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ গোলাম আযাদ করা, অনুচ্ছেদঃ তালাক ও গোলাম আযাদ করার ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটি প্রসংগে।
আপনাকে যদি বলা হয় শয়তান মনের ভিতরে ওয়াস-ওয়াসা দেয়, তা কি আপনি বিশ্বাস করেন? সেটাকে আপনি কি সত্য মনে করেন? আপনার মনে আল্লাহ সম্পর্কে যে ধরণের ওয়াস-ওয়াসার উদয় হয়, তার ব্যাপারে আপনার ধারণা কি তাই? উত্তরে আপনি অবশ্যই বলবেন, এ ব্যাপারে আমাদের কথা বলা সম্পূর্ণ অনুচিত। সুবহানাল্লাহ! (হে আল্লাহ! আপনি পূত-পবিত্র)। এটি একটি বিরাট অপবাদ। আপনি অন্তর দিয়ে মনের এ সব ওয়াস-ওয়াসাকে ঘৃণা করবেন এবং জবানের মাধ্যমে প্রতিবাদ করবেন। আর আপনি এ থেকে দূরে থাকবেন। সুতরাং এগুলো শুধুমাত্র মনের কল্পনা এবং ওয়াস-ওয়াসা, যা আপনার অন্তরে প্রবেশ করে থাকে। এটি একটি শয়তানের ফাঁদ। মানুষকে শির্কে লিপ্ত করার জন্যই সে এ ধরণের ফাঁদ পেতে রেখেছে। মানুষকে গোমরাহ করার জন্য শয়তান তাদের শিরা-উপশিরায় চলাচল করে থাকে।
সামান্য কোন জিনিষের ক্ষেত্রে শয়তান মানুষের মনে কুমন্ত্রনা দেয় না। আপনি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে জনবসতিপূর্ণ বড় বড় শহরের কথা শ্রবণ করে থাকেন। এসমস্ত শহরের অস্তিত্ব সম্পর্কে আপনার অন্তরে বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক হয়না। অথবা এ ধরণের সন্দেহ হয়না যে, শহরটি বসবাসের উপযোগী নয়, অথবা শহরে কোন জন-মানুষ নেই। এ ক্ষেত্রে সন্দেহ না হওয়ার কারণ হল, শয়তানের এতে কোন লাভ নেই। কিন্তু মানুষের ঈমানকে বরবাদ করে দেয়ার ভিতরে শয়তানের বিরাট স্বার্থ রয়েছে। জ্ঞানের আলো এবং হেদায়েতের নূরকে মানুষের অন্তর থেকে নিভিয়ে দেয়ার জন্য ও তাকে সন্দেহ এবং পেরেশানীর অন্ধকার গলিতে নিক্ষেপ করার জন্য শয়তান তার অশ্বারোহী এবং পদাতিক বাহিনী নিয়ে সদা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শয়তানের ওয়াস-ওয়াসা থেকে বাঁচার উপযুক্ত ঔষধও আমাদের জন্য বর্ণনা করেছেন। এসব ধারণা থেকে বিরত থাকা এবং শয়তানের ধোঁকা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। মুমিন ব্যক্তি যদি ওয়াস-ওয়াসা থেকে বিরত থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় বাদতে লিপ্ত হয়, আল্লাহর ইচ্ছায় অন্তর থেকে সেটা চলে যাবে। সুতরাং, আপনার অন্তরে এ জাতীয় যা কিছু উদয় হয়, তা থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ থাকুন। আপনি তো আল্লাহর বাদত করেন, তাঁর কাছে দুয়া করেন এবং তাঁর বড়ত্ব ঘোষণা করেন। আপনার অন্তরে যে সমস্ত কুধারণার উদয় হয়, তার বর্ণনা যদি অন্যের কাছ থেকে শুনেন, তাহলে আপনি তাকে হত্যা করে ফেলতে ইচ্ছা করবেন। তাই যে সমস্ত ওয়াস-ওয়াসা মনের মধ্যে জাগে, তার প্রকৃত কোন অস্তিত্ব নেই; বরং তা ভিত্তিহীন মনের কল্পনা মাত্র। এমনিভাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পবিত্র কাপড় পরিধানকারী কোন ব্যক্তির মনে যদি এমন ওয়াস-ওয়ার জাগ্রত হয় যে, হয়তোবা কাপড়টি নাপাক হয়ে গেছে, হয়তোবা এ কাপড় পরিধান করে নামায আদায় করলে নামায বিশুদ্ধ হবে না, এমতাবস্থায় সে উক্ত ওয়াস-ওয়াসার দিকে ভ্রুক্ষেপ করবে না।
উপরোক্ত আলোচনার পর আমার সংক্ষিপ্ত নসীহত এই যেঃ
(১) ওয়াস-ওয়াসার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ মোতাবেক ওয়াস-ওয়াসা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে এবং আল্লাহর কাছে শয়তানের প্ররোচনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে।
(২) বেশী করে আল্লাহর যিকির করবে।
(৩) আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকবে। যখনই বান্দা পরিপূর্ণরূপে ইবাদতে মশগুল থাকবে, ইনশাআল্লাহ এধরণের কুচিন্তা দূর হয়ে যাবে।
(৪) এই রোগ থেকে আল্লাহর কাছে আরোগ্য লাভের জন্য আল্লাহর কাছে বেশী বেশী দুয়া করবে।
ঈমানের মধ্যে সন্দেহে পতিত ব্যক্তির দুয়া
(১) আল্লাহ্‌র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। এই দুয়া বলে আশ্রয় প্রার্থনা করবেঃ আঊযু বিল্লা-হিমিনাশ-শায়ত্বানির রাযীম। সহীহ বুখারীঃ ৩২৭৬, সহীহ মুসলিমঃ ১৩৪।
(২) যে সন্দেহে নিপতিত হয়েছে তা দূর করবে। এটা সে বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে, সঠিক উত্তর জেনে মনের সন্দেহ বা ওয়াস-ওয়াসা দূর করবে। সহীহ বুখারীঃ ৩২৭৬, সহীহ মুসলিমঃ১৩৪।
(৩) এই দুয়া বলবে,
آمَنْتُ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ
উচ্চারণঃ আ-মানতু বিল্লা-হি ওয়া রুসুলিহি।
অর্থঃ আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলগণের উপরে ঈমান আনলাম। সহীহ মুসলিমঃ ১৩৪।
(৪) আল্লাহ্‌ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী পড়বে,
هُوَ الْأوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظّاهِرُ وَالْباطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
উচ্চারণ হুয়াল আউওয়ালু ওয়াল আ-খিরু ওয়ায্যা-হিরু ওয়াল-বা-ত্বিনু ওয়া হুয়া বিকুল্লি শাইইন আলীম।
অর্থঃ তিনিই সর্বপ্রথম, তিনিই সর্বশেষ, তিনিই সকলের উপরে, তিনিই সকলের নিকটে এবং তিনি সব কিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।
এটা সূরা হাদীদের ৩ নাম্বার আয়াত। আবু দাউদঃ ৫১১০। শাইখ আলবানী সহীহ আবু দাউদে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
উৎসঃ হিসনুল মুসলিম, ঈমান সুরক্ষা, ড. সাঈদ ইবনে আলী ইবনে ওয়াহফ আল-ক্বাহত্বানী।