শনিবার, ৮ মার্চ, ২০১৪

দুয়া ও মোনাজাত কিভাবে করবেন ৩



মোনাজাত যেইভাবে করতে হবেঃ দুয়া করার আদব –

দুআ করার আদবসমূহঃ

১. দুআর শুরুতে আল্লাহর হামদ (প্রশংসা) করে এর পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি ছোট/বড় যেকোনো দরুদ পড়ে এর পরে নিজের জন্য দুয়া করতে হবে। দুআর শুরুতে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি দরূদ পড়া দুআ কবুলের সহায়ক বলে হাদীসে এসেছে।

"একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন এক ব্যক্তি দুআ করছে কিন্তু সে দুআতে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূলের প্রতি দরূদ পাঠ করেনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে লক্ষ্য করে বললেন, সে তাড়াহুড়ো করেছে। অতঃপর সে আবার প্রার্থনা করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে অথবা অন্যকে বললেন, যখন তোমাদের কেউ দুআ করে তখন সে যেন আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও তার গুণগান দিয়ে দুআ শুরু করে। অতঃপর রাসূলের প্রতি দরূদ পাঠ করে। এরপর যা ইচ্ছা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে। 
আবু দাউদঃ ১৪৮১, তিরমিজীঃ ৩৪৭৭, শায়খ আলবানীর মতে হাদীসটি সহীহ। 

*প্রশংসা হিসেবেঃ আলহা'মদুলিল্লাহি রাব্বিল আ'লামিন বা আরো অন্য কিছুও বলা যায়
*দুরুদ হিসেবেঃ আল্লাহুম্মা সাল্লি আ'লা মুহা'ম্মাদ ও আ'লা আলি মুহা'ম্মাদ, অথবা অন্য যেকোনো দুরুদ পড়া যাবে।

২. দুআ করার সময় তা কবুল হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে দুআ করাঃ
এইভাবে দুয়া করা যাবেনা যে, "হে আল্লাহ আপনার ইচ্ছা দুয়া কবুল করেন..."
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
"তোমাদের কেউ এ রকম বলবে নাঃ হে আল্লাহ আপনি যদি চান তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিন। যদি আপনি চান তাহলে আমাকে অনুগ্রহ করুন। যদি আপনি চান তাহলে আমাকে জীবিকা দান করুন। বরং দৃঢ়তার সঙ্গে প্রার্থনা করবে এবং মনে রাখবে তিনি যা চান তা-ই করেন, তাকে কেউ বাধ্য করতে পারে না।
সহীহ বুখারীঃ ৭৪৭৭।

আবার উদাসীন হয়েও দুয়া করা যাবেনা।

৩. বিনয় ও একাগ্রতার সঙ্গে দুআ করা এবং আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ ও তার শাস্তি থেকে বাঁচার প্রবল আগ্রহ নিয়ে দুআ করাঃ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
"তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালকের কাছে দুআ করবে"। (আল-আরাফঃ ৫৫)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ  
"তারা সকর্মে প্রতিযোগিতা করে ও তারা আমার কাছে প্রার্থনা করে আশা ও ভীতির সঙ্গে এবং তারা থাকে আমার নিকট বিনীত"। (আল-আম্বিয়াঃ ৯০)

৪. আল্লাহর কাছে অত্যন্ত বিনীতভাবে ধর্না দেয়া এবং নিজের দুর্বলতা, অসহায়ত্ব ও বিপদের কথা আল্লাহর কাছে প্রকাশ করা

৫. আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ ও তাঁর মহ গুণাবলি দ্বারা দুআ করাঃ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
"আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাকে সে সকল নাম দিয়ে প্রার্থনা করবে"।  (আল-আরাফঃ ১৮০)
আল্লাহ তাআলার সুন্দর নাম ও মহান গুণাবলির মাধ্যমে দুআ করার কথা আল-কুরআনে ও হাদীসে বহু স্থানে এসেছে।
আল্লাহর সুন্দর নামগুলো উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন শুনলেন এক ব্যক্তি সালাতে আত্তাহিয়্যাতুর বৈঠকে এ বলে দুআ করছে :
أللهم إني أسألك يا الله الأحد الصمد الذي لم يلد ولم يولد ولم يكن له كفوا أحد، أن تغفر لي ذنوبي إنك أنت الغفور الرحيم. فقال صلى الله عليه وسلم : "قد غفر له، قد غفر له. )رواه أبو داود والنسائي وأحمد وابن خزيمة وصححه الحاكم(
"হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি- আপনি তো এক; অদ্বিতীয়, যিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাকেও কেউ জন্ম দেয়নি। কেউ নেই তাঁর সমকক্ষ- আপনি আমার পাপগুলো ক্ষমা করুন। আপনি পরম ক্ষমাশীল ও দয়াময়"।
এ প্রার্থনা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে! তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। (আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইবনু খুযাইমা)
উল্লেখিত ব্যক্তি আল্লাহর সুন্দর নাম ও গুণাবলির মাধ্যমে দুআ করার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুআ কবুলের সংবাদ দিলেন।

ইউনূছ আ. এর প্রার্থনা -যখন তিনি মাছের পেটে ছিলেন- তুমি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই তুমি পবিত্র, মহান! আমি তো সীমালংঘনকারী। যে কোনো মুসলিম এ কথা দিয়ে প্রার্থনা করবে তার প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করবেন। (তিরমিজী) 

৬. আল্লাহর কাছে নিজের পাপ ও গুনাহ স্বীকার করে লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা।

৭. প্রার্থনাকারী নিজের কল্যাণের দুআ করবে নিজের বা কোনো মুসলিমের অনিষ্টের জন্য দুআ করবে না বা বদদুয়া করবেনা।

৮. সকাজের অসীলা দিয়ে দুআ করাঃ
যেমন সহীহ হাদীসে বিপদগ্রস্ত তিন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যারা এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে পাথর ধসে পড়ার কারণে পাহাড়ের গুহায় আটকে পড়েছিল। তারা তখন প্রত্যেকে নিজ নেক আমলের অসীলা দিয়ে প্রার্থনা করেছিল। একজন মাতা-পিতার উত্তম  সেবার কথা বলেছিল। দ্বিতীয়জন ব্যভিচারের সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও এ কাজ থেকে বিরত থেকে ছিল। তৃতীয় জন এক ব্যক্তির আমানত রক্ষা ও তাকে ফেরত দিয়েছিল। এরা প্রত্যেকে বলেছিল, হে আল্লাহ আমি যদি এ কাজটি আপনাকে সন্তুষ্ট করার জন্য করে থাকি তাহলে এ কাজের অসীলায় আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর এ বিপদ থেকে উদ্ধার করুন। আল্লাহ তিনজনের প্রার্থনাই কবুল করে তাদের বিপদ থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীসে দেখা যায় যে নেক আমলের অসীলা দিয়ে দুআ করলে দুআ কবুল হয়।

৯. বেশি বেশি করে ও বার বার দুআ প্রার্থনা করাঃ
যেমন হাদীসে এসেছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
"তোমাদের কেউ যখন দুআ করে সে যেন বেশি করে দুআ করে কেননা সে তার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করছে"। (মুসলিম)

১০. সুখে দুঃখে সর্বাবস্থায় দুআ করাঃ
মানুষ কখনো সুখের সময় অতিবাহিত করে কখনো দুঃখের সময়। অনেক মানুষ এমন আছে যারা শুধু বিপদে পড়ে আল্লাহকে ডাকেন ও প্রার্থনা করেন। আবার অনেকে এমন আছেন যারা বিপদে পড়লে আল্লাহকে ডাকতে ভুলে যান। কিন্তু সত্যিকার মুমিন ব্যক্তি সুখে ও দুঃখে সর্বদা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে থাকেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
"যে চায়, আল্লাহ বিপদ-মুসীবতে তার প্রার্থনা কবুল করুন সে যেন সুখের সময় আল্লাহর কাছে বেশি করে প্রার্থনা করে"। (তিরমিজী ও হাকেম)

১১. দুআর বাক্য তিনবার করে উচ্চারণ করাঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি সুন্নাহ হল তিনি কোনো কোনো দুআর বাক্য তিনবার করে উচ্চারণ করতেন। যখন মুশরিকরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সালাতাবস্থায় উটের নাড়ী-ভুঁড়ি তাঁর পিঠের ওপর রাখল তখন তিনি সালাত শেষ করে দুআ করলেন এভাবেঃ
"হে আল্লাহ কুরাইশদের তুমি পাকড়াও করো! হে আল্লাহ কুরাইশদের তুমি পাকড়াও করো!! হে আল্লাহ কুরাইশদের তুমি পাকড়াও করো!!!

১২. দুআয় উচ্চস্বর পরিহার করাঃ
অনেক মানুষকে দেখা যায় তারা দুআ করার সময় স্বর উচু করেন বা চিকার করে দুআ করেন। এটা দুআর আদবের পরিপন্থী। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
"তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালকের কাছে দুআ কর; তিনি সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না"। (আল-আরাফঃ ৫৫)
এ আয়াতে গোপনে দুআ করতে বলা হয়েছে এবং দুআয় সীমালংঘন সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।
প্রায় সকল তাফসীরবিদের অভিমত হল এ আয়াতে সীমালংঘনকারী বলতে তাদের বুঝানো হয়েছে যারা উচ্চ আওয়াযে দুআ করে।
আল্লাহ তাআলা নবী যাকারিয়া আ. এর প্রশংসায় বলেছেন :
"যখন সে তার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করেছিল নিভৃতে"। (মারইয়ামঃ ০৩)
এ আয়াতে গোপনে দুআ করতে বলা হয়েছে এবং দুআতে সীমালংঘন থেকে সতর্ক করা হয়েছে।
অপরদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
"হে মানবসকল! তোমরা নিজেদের ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর। তোমরা কোনো বধির বা অসুপস্থিত সত্তাকে ডাকছ না। তোমরাতো ডাকছ এমন সত্তাকে যিনি সর্বশ্রোতা ও অতি নিকটে এবং তোমাদেরই সঙ্গে"। (বুখারী ও মুসলিম)
যখন একদল সাহাবী উচ্চ আওয়াযে দুআ করছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথা বলেছিলেন।

১৩. দুআ প্রার্থনার পূর্বে অযু করাঃ
আবু মুছা আল-আশআরী রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছেঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন দুআ করতে ইচ্ছা করলেন তখন পানি চাইলেন, অযু করলেন অতঃপর দু’হাত তুলে বললেন : ‘হে আল্লাহ! তুমি কিয়ামতে তাকে অনেক মানুষের উপরে স্থান দিও। আমি বললাম আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আব্দুল্লাহ ইবনু কায়েসের পাপ ক্ষমা কর ও তাকে সম্মানিত স্থানে প্রবেশ করিও। (বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীসে দেখা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুআ করার পূর্বে অজু করে নিলেন।
ইবনু হাজার রহ. বলেন, এ হাদীস দ্বারা আমরা জানলাম যে, দুআ করার পূর্বে অজু করে নেয়া মুস্তাহাব। (ফাতহুল বারী)
*দুয়ার পূর্বে উত্তম হচ্ছে ওযু করা, এটা ফরয নয়।

১৪- দুআয় দুহাত উত্তোলন করা :
যেমন হাদীসে এসেছে
আবু মুছা রা. বলেন, অত:পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু হাত তুললেন এবং বললেন, "হে আল্লাহ! তুমি উবাইদ আবি আমেরকে ক্ষমা করে দিও"।
তিনি এতটা হাত তুললেন যে আমি তার বগলের শুভ্রতা দেখতে পেলাম। (বুখারী)

১৫- কিবলামুখী হওয়া
দুআর সময় কিবলামুখী হওয়া মুস্তাহাব। যেমন হাদীসে এসেছে :
عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : "استقبل النبي صلى الله عليه وسلم الكعبة، فدعا على نفر من قريش.  (رواه البخاري 3960 ومسلم 1794(

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবার দিকে মুখ করলেন এবং কতিপয় কুরাইশ নেতাদের বিরুদ্ধে দুআ করলেন। (বুখারী ও মুসলিম)