আল-কুরানুল কারীমে বর্ণিত
বিস্ময়কর ঘটনাঃ
পর্ব – “যুলকারনাইন ও ইয়াজুজ-মাজুজ”।
যুল-কারনাইন নামে একজন
ন্যায়-পরায়ন বাদশাহ ছিলেন। তাঁর সময়ে ইয়াজুজ-মাজুজ নামে দুই্টা সম্প্রদায় মানুষের
উপর অনেক অত্যাচার শুরু করে। ইয়াজুজ মাজুজ হলো আদম
আ’লাইহিস
সালাম-এর সন্তানদের মধ্য থেকে দুইটা গোত্র, অর্থাৎ তারা মানুষ ছিলো। তাদের চেহারা বা মুখ
ছিলো প্রসারিত আর চোখ ছিলো ছোট। পূর্ব দিকের কোনো একটা দেশের
দুইটা পাহাড়ের মাঝখানে তাদের ঘাটি ছিলো, যেখান থেকে তারা লোকালয়ে এসে তুর্কীদের উপর অনেক অত্যাচার করতো। তারা তুর্কীদেরকে হত্যা করতো,
তাদের খেত-বাগান নষ্ট করতো, এমনকি তাদের শিশুদেরকেও
হত্যা করতো, সবরকম সর্বনাশ করতো বর্বর এই জাতিগুলো।
যুল-কারনাইন তাঁর
বিশ্ব ভ্রমণের সময় সেই এলাকার লোকদেরকে
যখন দেখতে যান, তখন তারা ইয়াজুজ-মাজুজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এবং তাদের ও ইয়াজুজ-মাজুজের মাঝখানে একটা দেয়াল তুলে তাদেরকে বন্দী করার জন্য অনুরোধ জানায়। তখন যুল-কারনাইন পাহাড়ের মাঝখানে যেখান দিয়ে ইয়াজুজ-মাজুজ লোকালয়ে আসতো, সেখানে লোহা ও তামা দিয়ে একটা দেয়াল নির্মান করে দেন। সেই দেয়াল এতো উঁচু আর মজবুত ছিলো যে, ইয়াজুজ-মাজুজেরা
সেই দেয়ালের উপর দিয়ে বা দেয়াল ভেঙ্গে আর লোকালয়ে আসতে পারতোনা। আজ পর্যন্ত তারা সেখানেই আটকা পড়ে আছে। ইয়াজুজ-মাজুজেরা প্রতিদিন সেই দেয়াল গর্ত করে ভাঙ্গার
চেষ্টা করে, আর সারাদিন ভেংগে যখনই তারা দেয়ালের শেষ মাথার খুব নিকটে চলে আসে, তখন বলেঃ আজ এই পর্যন্ত থাকুক, আগামীকাল বাকিটুকু শেষ করবো। কিন্তু পরদিন এসে
দেখে, আল্লাহর ইচ্ছায় সেই দেয়াল আবার আগের মতোই হয়ে গেছে। এইভাবে কেয়ামত খুব নিকটে আসা পর্যন্ত চলতে থাকবে। কেয়ামত যখন খুব কাছে চলে আসবে আর
ঈসা আ’লাইহিস সালাম দাজ্জালকে হত্যা করে ফেলবেন, তখন আল্লাহর ইচ্ছায় তারা একদিন
বলবেঃ ইনশা’আল্লাহ আগামী কাল এসে বাকি দেয়াল ভাংবো। এই “ইন শা’ আল্লাহ” বলার বরকতে পরিদন তারা এসে দেখবে আজকে দেয়াল আর আগের মতো পূর্ণ হয়ে যায়নি। তখন তারা এই দেয়াল ভেঙ্গে ভেদ করে লোকালয়ে চলে আসবে। তারা এসে মানুষের উপর আবার অনেক হত্যা ও নির্যাতন শুরু করবে। তারা সংখ্যায় এতো বেশি হবে যে, ফিলিস্তিনের
হ্রদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা হ্রদের সব পানি খেয়ে শেষ করে ফেলবে! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীসে বলেছেন, “মানুষের মধ্যে ১০০০
জনে ৯৯৯ জনই জাহান্নামে যাবে, এই জাহান্নামীদের মধ্যে অধিকাংশ হবে এই ইয়াজুজ ও মাজুজেরা।”
ইয়াজুজ মাজুজের ফেতনা
কেউ প্রতিহত করতে পারবেনা, বা তাদের হাত থেকে বাঁচতে পারবেনা। ঈসা আ’লাইহিস
সালাম তখন মুসলিমদেরকে নিয়ে তুর পাহড়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবেন। ঈসা আ’লাইহিস
সালাম তাদের বিরুদ্ধে বদ দুয়া করলে তাদের মাথায় পোকা হয়ে তারা সবাই মৃত্যুবরণ করবে। ঈসা আ’লাইহিস
সালাম তুর পাহাড় থেকে মাটিতে অবতরণ করে দেখবেনঃ সারা জমিন জুড়ে ইয়াজুজ-মাজুজের লাশ ছড়ানো। তাদের মৃতদেহের দুর্গন্ধে ভরে যাবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআ’লা এক জাতীয় পাখি প্রেরণ করবেন; যারা তাদের লাশগুলো তুলে সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে।
তারপর আল্লাহ প্রবল বৃষ্টি বর্ষাবেন, যাতে সারা পৃথিবী পরিষ্কার হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, অনেকে মনে করে আলেকজান্ডার দি গ্রেট হচ্ছে যুল-কারনাইন। এটা মিথ্যা এবং ভুল কথা। কারণ, আলেকজান্ডার ছিলো কাফের আর যুল-কারনাইন ছিলেন ঈমানদার, ন্যায়পরায়ন বাদশাহ। আবার অনেকে মনে করে, চীনের মহাপ্রাচীর হচ্ছে যুল-কারনাইন যে দেয়াল বানিয়েছেন, সেটা। এই ধারণাও ভুল। আসলে ইয়াজুজ মাজুজের দেয়াল
কোথায় আছে কেউ জানেনা।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত
জানার জন্যে আপনারা তাফসীর
ইবনে কাসীরের ১৪-তম খন্ডের সুরা কাহাফের ৮৩-৯৯ নাম্বার আয়াতের তাফসীর দেখতে পারেন।
কুরআনুল কারীমে যেই আয়াতে কারীমাগুলোতে আল্লাহ সুবহা’নাহু তাআ’লা যুলকারনাইন ও ইয়াজুজ-মাজুজের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেনঃ
আ’উযুবিল্লা-হিমিনাশ-শাইতানির রাযীম।
৮৩. (হে নবী!) তারা আপনাকে যুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলুন, আমি তাঁর কিছু ঘটনা তোমাদের কাছে বর্ণনা করব।
৮৪. আমি যুল-কারনাইনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের কার্যোপকরণ
দান করেছিলাম।
৮৫. অতঃপর তিনি একটি পথ ধরলেন।
৮৬. অবশেষে তিনি যখন
সুর্যের অস্তাচলে পৌছলেন; তখন তিনি সুর্যকে একটি কর্দমাক্ত জলাশয়ে অস্ত যেতে দেখলেন এবং তিনি সেখানে এক সম্প্রদায়কে
দেখতে পেলেন। আমি (আল্লাহ তাআ’লা) বললাম, হে যুলকারনাইন! আপনি তাদেরকে শাস্তি দিতে পারেন অথবা
তাদেরকে সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পারেন।
৮৭. তিনি বললেনঃ যে
ব্যক্তি সীমালঙ্ঘনকারী হবে আমি তাকে শাস্তি দেব। অতঃপর সে তাঁর পালনকর্তার কাছে ফিরে যাবে। তিনি তাকে কঠোর শাস্তি
দেবেন।
৮৮. এবং যে ব্যক্তি ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে, তার জন্য প্রতিদান রয়েছে কল্যাণ এবং আমার কাজে তাকে সহজ নির্দেশ
দেব।
৮৯. অতঃপর তিনি অন্য একটি
পথ ধরলেন।
৯০. অবশেষে তিনি যখন
সূর্যের উদয়াচলে পৌঁছালেন, তখন তিনি সূর্যকে এমন একটি সম্প্রদায়ের উপর উদিত হতে দেখলেন, যাদের জন্যে সূর্যতাপ থেকে আত্নরক্ষার জন্য কোন আড়াল আমি সৃষ্টি করিনি।
৯১. প্রকৃত ঘটনা এমনিই।
তার বৃত্তান্ত আমি সম্যক অবগত আছি।
৯২. আবার তিনি এক পথ
ধরলেন।
৯৩. অবশেষে যখন তিনি
দুই পর্বত প্রচীরের মধ্যস্থলে পৌঁছালেন, তখন তিনি সেখানে
এক জাতিকে পেলেন, যারা যুল-কারনাইনের কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না।
৯৪. তারা বললঃ হে যুলকারনাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ দেশে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আপনি বললে আমরা
আপনার জন্যে কিছু কর ধার্য করব এই শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রাচীর
নির্মাণ করে দেবেন।
৯৫. যুল-কারনাইন বললেন, আমার পালনকর্তা আমাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট। অতএব, তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য
কর। আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দেব।
৯৬. তোমরা আমাকে লোহার
পাত এনে দাও। অবশেষে যখন পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকাস্থান লোহা দ্বারা পূর্ণ হয়ে গেল, তখন তিনি বললেনঃ তোমরা হাঁপরে দম দিতে থাক।
অবশেষে যখন তা আগুনের মতো লাল রঙ্গে পরিণত হল তখন তিনি বললেন, তোমরা গলিত তামা নিয়ে এস, আমি তা এর উপরে ঢেলে দেই।
৯৭. অতঃপর ইয়াজুজ ও
মাজুজ সেই প্রাচীরের উপরে আরোহণ করতে পারল না, এবং সেটা ভেদ করতেও সক্ষম হল না।
৯৮. যুলকারনাইন বললেন, এই প্রাচীড় আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ। যখন আমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুত
সময় আসবে, তখন তিনি একে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন এবং আমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুতি সত্য।
৯৯. আমি সেই দিন ইয়াজুজ-মাজুজকে দলে দলে তরঙ্গের
আকারে ছেড়ে দেব।
সুরা আল-কাহাফঃ আয়াত ৮৩-৯৯।
এছাড়াও
সুরা আল-আম্বিয়াতে ইয়াজুজ-মাজুজের আগমনের কথা উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “এমন কি যখন ইয়াজূজ ও মাজুজকে মুক্তি দেওয়া হবে, এবং তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি
হতে ছুটে আসবে।” সুরা আল-আম্বিয়াঃ ৯৬।