বিতির সালাতের নিয়মঃ
“বিতির” শব্দের অর্থ কি?
বিতির শব্দের অর্থ হলো বেজোড়। আর বেজোড় সংখ্যা হলো ১, ৩, ৫, ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিতির সালাত হিসেবে ১ রাকাত, ৩ রাকাত, ৫ রাকাত, ৭ রাকাত, এমনকি নয় রাকাতও পড়েছেন।
বিতির পড়া কি ফরয/ওয়াজিব না সুন্নতঃ
যদিও আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ বিতির সালাতকে ওয়াজিব মনে করে কিন্তু আসলে বিতির সালাত হলো সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
দলীলঃ ১ – আলী (রাঃ) বলেন, “বিতির সালাত ফরয সালাতের মতো বাধ্যতামূলক নয়, তবে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) একে সুন্নত করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ বেজোড় (বিতির), তিনি বেজোড় সংখ্যা পছন্দ করেন। সুতরাং, হে আহলে কুরআন! তোমরা বিতির পড়তে থাকো।”
আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ।
দলীলঃ ২ – আবু মুহাম্মাদ নামে এক লোক বললো, বিতির সালাত ওয়াজিব। এই কথা শুনে প্রখ্যাত সাহাবী উবাদাহ বিন সামিত (রাঃ) বলেন, আবু মুহাম্মাদ ভুল বলেছে।......হাদীসের শেষ পর্যন্ত।
আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে হিব্বান।
দলীলঃ ৩ – রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ফরয সালাত কখনোই সওয়ারীর (গাধা বা ঘোড়ার) পিঠে চড়ে পড়তেন না, শুধু নফল সালাত পড়তেন। কিন্তু তিনি বিতির সালাত সওয়ারীর উপর পড়েছেন। এ থেকে প্রমানিত হয় বিতির সালাত ফরয বা ওয়াজিব নয়।
বুখারী, মুসলিম, দারা কুতনী ১৬১৭।
বিতির পড়ার সওয়াব কতটুকুঃ
বিতির নামায লাল রংয়ের উটের চাইতে বেশি মূল্যবান।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“আল্লাহ একটি নামায দান করে তোমাদেরকে বিশেষ সুযোগ করে দিয়েছেন যা তোমাদের জন্য লাল রংয়ের উটের চাইতে উত্তম। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সেটা কোন নামায? তিনি বললেন, ‘বিতির নামায’ যা পড়া হয় ইশা নামাযের পর থেকে ফযর উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।”
আবু দাউদঃ ১৪১৮, তিরমিযীঃ ৪৫২, ইবনে মাজাহ, দারেমী, হাদীসটি সহীহ।
* বর্তমান যুগে যেমন দামি গাড়ি মার্সিডিস বেঞ্চ বা ফেরারী ঠিক তেমনি, তখনকার যুগে লাল রংয়ের উটের দাম অনেক বেশি ছিলো।
কখন পড়তে হবে?
ইশার পর থেকে ফযরের আগে পর্যন্ত পড়া যাবে। তবে রাতের সর্বশেষ সালাত হিসেবে বিতির পড়তে হবে। বিতির রাতের শেষ অংশে পড়া বেশি সওয়াব, তবে নিয়মিত উঠার অভ্যাস না থাকলে বা শেষ রাত্রে উঠার নিশ্চয়তা না থাকলে ঘুমানোর আগেই পড়ে ফেলতে হবে।
বিতির সালাত কাযা পড়া যাবেঃ
বিতির ফযরের আগে পড়তে না পারলে ফযরের পরে বা সকাল বেলায় সুযোগ মতো পড়া যাবে। এনিয়ে বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এমনকি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজে সকাল বেলা বিতির কাযা পড়েছেন (তাবারানী)।
বিতির সালাত কত রাকাতঃ
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কয়েকভাবে বিতির পড়েছেন। তিনি বিতির ১ রাকাত, ৩ রাকাত, ৫ রাকাত, ৭ রাকাত, ৯ রাকাত পড়েছেন। এইসবগুলোই সুন্নত। কারো ইচ্ছা হলে সে এর যেকোনো একটা পড়তে পারে। তবে নিচে শুধুমাত্র ১ আর ৩ রাকাত বিতির পড়ার নিয়ম বর্ণনা করা হলো।
বিতির কিভাবে পড়তে হবেঃ
১ রাকাত – অনেকে হয়তো প্রথম শুনছেন বা মনে করতে পারেন ১ রাকাত আবার সালাত আছে নাকি? লেখক সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করার আগে বলছি,
আপনি কুরআন-হাদীস পড়বেন না, জানবেন না সেটা আপনার দোষ। এখন কেউ যদি কুরআন, সুন্নাহ থেকে কিছু বলার কারণে আপনার কাছে অদ্ভুত লাগে সেটা আপনার ব্যর্থতা। ১ রাকাত বিতির এটা জানার জন্য খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। ইমাম বুখারী বিতির সালাত সম্পর্কে সবার প্রথম যে হাদীস নিয়ে এসেছেন সেখানেই আছে, বিতির সালাত ১ রাকাত।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “রাতের সালাত (তারাবীহ/তাহাজ্জুদ/কিয়ামুল লাইল) ২ রাকাত ২ রাকাত করে। অতঃপর তোমাদের কেউ ফযর হওয়ার আশংকা করলে সে যেনো এক রাকাত বিতির পড়ে নেয়।”
বুখারী ও মুসলিম।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “বিতির হলো শেষ রাতে এক রাকাত”।
মুসলিম।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “বিতির প্রত্যেক মুসলমানের উপর হক্ক। সুতরাং যে ৫ রাকাত পছন্দ করে সে ৫ রাকাত পড়ুক, যে ৩ রাকাত পছন্দ করে সে ৩ রাকাত পড়ুক, যে ১ রাকাত পছন্দ করে সে ১ রাকাত পড়ুক”।
ইবনে মাজাহ, মিশকাত ১২৬৫।
১ রাকাত পড়ার নিয়মঃ নিয়ত করে (নাওয়াইতু পড়েনা, অন্তরে নিয়ত করে) সানা, আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ পড়ে সুরা ফাতিহা পড়বে। এর পরে যে কোনো একটা সুরা মিলাবে। এর পরে দুয়া কুনুত পড়বে।
কুনুত দুইভাবে পড়া যায়, রুকুর আগে ও রুকুর পরে, তবে রুকুর পরে পড়াই উত্তম। তাই রুকুর পরে পড়ার অভ্যাস করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে কুনুত পড়ার আগে আল্লাহু আকবার বলে হাত তুলে ইশারা করার যে নিয়ম এই নিয়ম রাসুলুল্লাহ (সাঃ) থেকে প্রমানিত না। তাই আল্লাহু আকবার বলে হাত না তুলে কিরাতের পরে সরাসরি দুয়া কুনুত পড়তে হবে। কুনুত পড়ার সময় মুনাজাত করার মতো হাত তুলে কুনুত পড়া মুস্তাহাব।
আর রুকুর পরে কুনুত পড়লে, কিরাতের পরে রুকু করবেন, রুকু থেকে দাঁড়িয়ে সামিয়াল্লাহ হুলিমান হা’মীদাহ, রাব্বানা লাকাল হা’মদ বলার পরে দাঁড়ানো অবস্থাতে মুনাজাতের মতো হাত তুলে কুনুত পড়বেন। কুনুত শেষ হলে আল্লাহু আকবার বলে সিজদাতে যাবেন। দুই সিজদা করার পর আর দাঁড়াবেন না (কারণ আপনি ১ রাকাত বিতির পড়ছেন). আত্তাহিয়্যাতু, দুরুদ ও অন্য দুয়া পড়ে সালাম ফিরাবেন।
কুনুত পড়া কি ওয়াজিব?
কুনুত পড়া ওয়াজিব নয়। কারণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সব সময় বিতির সালাতে কুনুত পরতেন না। তাই আমাদের উচিত বিতির সালাতে কখনো কখনো দুয়া কুনুত ছেড়ে দেওয়া, কারণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নত এমনই।
আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী, মিশকাত ১২৯১-১২৯২।
৩ রাকাত বিতিরের নিয়মঃ
বিতির ৩ রাকাত দুইভাবে পড়া যায়, এক সালামে অথবা দুই সালামে।
এক সালামে পড়লে, আপনি সাধারণ সালাতের মতো দুই রাকাত পড়বেন কিন্তু দুই রাকাতের যে বৈঠক সেখানে বসবেন না। কারণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা বিতিরকে মাগরিবের মতো করে দিওনা”. এখন দুই রাকাতের বৈঠকে না বসে আপনি ৩ রাকাত বিতিরকে মাগরিবের সালাতের সাথে পার্থক্য সৃষ্টি করে দিলেন। ২য় রাকাতে বৈঠকে না বসে দাঁড়িয়ে ৩য় রাকাত পুরো করবেন, আর ৩য় রাকাতে আপনি ১ রাকাত বিতির পড়ার যে নিয়ম সেইভাবে কুনুত পড়বেন। এর পরে রাকাত পুরো করে সালাম ফিরাবেন।
বিতির সালাতের এই নিয়মটা আজ পর্যন্ত মক্কা ও মদীনাতে অনুসরণ করা হয় (ভিডিও দেখুন) -
আর দুই সালামে পড়তে চাইলে, প্রথম দু রাকাত সাধারণ নফল সালাতের মতো পড়বেন, বৈঠক করে সালাম ফিরাবেন। এর পরে ১ রাকাত বিতিরের যে নিয়ম বর্ণনা করা হলো ঠিক সেইভাবেই ১ রাকাত পড়বেন, এই হলো ২+১=৩ রাকাত বিতির।
উল্লেখ্য - কারো অতিরিক্ত নফল সালাত পড়ার ইচ্ছা থাকলে সে ২ রাকাতের পর আরো দুই রাকাত পড়বে, এইভাবে ২ রাকাত রাকাত পড়ে শেষে ১ রাকাত দিয়ে সবগুলোকে বেজোড়ে (বিতিরে) পরিণত করবে।
*** বুঝাতে না পারলে ক্ষমা করবেন। আর যাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে এই পোস্ট লেখা – দেরী করার জন্য তারাও ক্ষমা করবেন।
admin : আনসারুস সুন্নাহ
আরো জানতে এই বইটা পড়তে পারেন।
http://islamhousebd.wordpress.com/2013/06/29/বইঃ-বিতর-সালাতনামায/