তোওবা কিভাবে করতে হবে?
তোওবা শব্দের অর্থ হচ্ছে
প্রত্যাবর্তন করা, ফিরে আসা। অর্থাৎ, গুনাহ থেকে ফিরে আসা। তোওবা
কবুল হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হবে, তাহলেই আল্লাহ তাআ’লা সেই তোওবা কবুল করবেন। শর্তগুলো হচ্ছেঃ
(১)
পাপ কাজ করা বন্ধ করতে হবে। এখন শুধু মুখে মুখে তোওবা করে নেই, কয়েকদিন পর থেকে
পাপ কাজটা ছেড়ে দেব, এরকম খারাপ নিয়ত থাকলে তোওবা কবুল হবেনা।
(২)
অতীতের সমস্ত পাপকাজ ও ভুল-ত্রুটি আল্লাহর
কাছে স্বীকার করে তাঁর কাছে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে।
(৩)
অন্তরে খারাপ কাজের প্রতি ঘৃণা রেখে
সেইগুলোতে আবার ফিরে না যাওয়ার জন্য দৃঢ়
প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
(৪)
লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে সমস্ত গুনাহ-খাতার জন্য “ইস্তিগফার” করতে হবে অর্থাৎ
ক্ষমা চাইতে হবে + “তোওবা” করতে হবে। তোওবা অর্থ হচ্ছে
গুনাহ করা বন্ধ করে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসতে হবে।
(৫)
কারো হক্ক নষ্ট করে থাকলে, যেভাবেই হোক তাকে
তার পাওনা ফিরিয়ে দিতে হবে। সামর্থ্য না
থাকলে অনুরোধ করে, ক্ষমা চেয়ে তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নিতে হবে। উল্লেখ্য, তোওবা
করলে আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন, এমনকি কারো পাপ জমীন থেকে আকাশ পর্যন্ত
পৌঁছে গেলেও সে যে যদি আন্তরিক তোওবা করে তাহলে
আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন। কিন্তু বান্দার কোনো হক্ক নষ্ট করলে,
বান্দা সেটা মাফ না করলে আল্লাহও ক্ষমা
করবেন না।
(৬)
অন্তরে আশা রাখতে হবে যে, আমি গুনাহগার কিন্তু আল্লাহ গাফুরুর রাহীম, অতীব
ক্ষমাশীল ও দয়ালু। সুতরাং ,আমি যতবড় গুনাহগার
হয়ে থাকিনা কেনো, তিনি আমার তোওবা কবুল করবেন ইনশা’আল্লাহ। অন্তরে আল্লাহর প্রতি এই আশা ও ভালো
ধারণা রাখতে হবে।
(৭)
তোওবা করার পরে প্রাণপণে চেষ্টা করতে হবে পাপ কাজ থেকে সম্পূর্ণ দূরে
থাকতে, এবং সাধ্য অনুযায়ী বেশি করে নেকীর কাজ করার জন্য। কারণ, নেকীর কাজ দ্বারা পাপ কাজের মোচন
হয়।
(৮)
যে পাপ কাজ থেকে তোওবা করা হলো, (সমস্ত পাপ কাজ
থেকেই তোওবা করা ফরয), কোনো ভুলে বা কুপ্রবৃত্তির কারণে সেই
পাপ আবার করে ফেললে সাথে সাথে পুনরায় আন্তরিক
তোওবা করে সেটা থেকে ফিরে আসতে হবে। এইভাবে যখনই কোনো পাপ কাজ সংঘটিত হবে, সাথে
সাথেই তোওবা করতে হবে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত।
হাসান আল-বাসরী রাহিমাহুল্লাহকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো,
“বান্দার কি লজ্জা পাওয়া
উচিত না যে, পাপ করার পর সে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। তারপর আবার পাপ করে এবং আবারো অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করে?” হাসান
আল-বাসরী রাহিমাহুল্লাহ বললেন, “শয়তান তো ঠিক এটাই চায়, কখনো অনুতপ্ত হয়ে ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা
করা) থামিয়ে দিয়ো না।” জামিউ’ল উলুমঃ ২০৫ পৃষ্ঠা।
(৯)
কারো তোওবা কবুল হয়েছে কিনা এটা কিভাবে বুঝবেন? এ সম্পর্কে
অনেক আলেম বলেছেন,
কারো যদি তোওবা করার পরের জীবন আগের জীবন থেকে ভালো হয় অর্থাৎ
পাপের কাজ অনেক কমে যায় ও ভালো কাজের সংখ্যা বৃদ্ধি
পায়, তাহলে আশা করা যেতে পারে,
তার তোওবা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে। কিন্তু কারো যদি
এমন না হয় অর্থাৎ, তোওবার আগের ও পরের জীবনে
কোনো পার্থক্য না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তার তোওবাতে ত্রুটি রয়েছে।
তার উচিত হতাশ না হয়ে বার বার আন্তরিকতার সাথে খালেস নিয়তে তোওবা করা, এ ব্যপারে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া।
একজন আ’লেম (জ্ঞানী ব্যক্তিকে) প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “বান্দা যখন তাওবা করে, সে কি বুঝতে পারে
যে, তার তাওবা কবুল হয়েছে কিনা?” তিনি বললেন, “এ সম্পর্কে আমি তোমাকে কোন মীমাংসা দেবোনা। কিন্তু এর
কয়েকটি আলামত আছে। যার তাওবা কবুল হয়েছে বলে আশা করা যায়ঃ (ক) সে নিজেকে পাপমুক্ত
বলে মনে করবেনা, (খ) তার অন্তর থেকে আনন্দ উঠে যাবে এবং সে (নিজেকে নিয়ে) চিন্তিত
হবে, (গ) সে সৎ ব্যক্তিদের নিকটবর্তী হবে এবং অসৎ ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকবে, (ঘ)
সে দুনিয়ার অল্প জিনিসকে বেশি মনে করবে এবং পরকালের অনেক আমলকে অল্প মনে করবে, (ঙ)
আল্লাহ তাকে যে বিষয়ের জিম্মাদারী দিয়েছেন, সেইগুলোতে সে সর্বদা মত্ত থাকবে এবং
আল্লাহ যেই বিষয়ের জামিন হয়েছেন, সে বিষয়ে সে নির্লিপ্ত থাকবে, (চ) সে নিজের
জবানকে হেফাজত করবে ও সর্বদা চিন্তা-ভাবনা করবে। আর গভীরভাবে দুঃখ ও অনুশোচনা করবে।”
উৎসঃ ইবনে হাজার আসকালানী, “আল-ইসতিদাদ লি-ইয়াওমিল
মাআদ” (পরকালের পাথেয়)।
(১০) আন্তরিক তোওবা যদি আল্লাহর
কাছে কবুল হয়, তাহলে বান্দার পূর্বের সমস্ত গুনাহ আল্লাহ মাফ করে
দেন। এমনকি যেই গুনাহগুলো মাফ করে দেন, কেউ যদি সেগুলো থেকে ফিরে আসে,
এইগুলোর বিপরীতে আল্লাহ তাকে সওয়াব দান করেন। যেমনটা আল্লাহ কুরানুল কারীমে উল্লেখ
করেছেন, “কিন্তু যারা তওবা করে ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের
গোনাহসমূহকে পুন্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন।
আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” সুরা ফুরক্বানঃ ৭০।
আল্লাহ আমাদের
সবাইকে আন্তরিক তোওবা করার তোওফিক দান করুন, আমিন।
______________________________________
তোওবার জন্যে কি দুয়া পড়তে
হবে?
আমাদের দেশের
মানুষকে ‘তোওবার দোয়া’ নামে যে দুয়াটা শেখানো হয়
তা হচ্ছে, “আস্তাগফিরুল্লাহা
রাব্বি মিং কুল্লি যামবিও-ওয়া আতুবু ইলাইহি,
লা হা’উলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলায়্যিল আযীম।”
এটা একটা দোয়া,
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ক্বুরআন ও হাদীসের
কোথাও এই দোয়া খুঁজে পাওয়া যায়না! তার মানে এই দোয়া হচ্ছে
হুজুরের বানানো দোয়া, অর্থাৎ man made! অনেকে যুক্তি দেখাতে পারেন, দোয়াতো
দোয়াই, আল্লাহর কাছে একভাবে চাইলেই হবে। তাদেরকে বলবোঃ
(১)
নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি
ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে যেই দোয়া শিখিয়ে গেছেন, তা
না শিখিয়ে হুজুরের বানানো দোওয়া কেনো শেখানো হবে? হুজুর
কি নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি
ওয়া সাল্লাম এর থেকে ভালো দোয়া বানাতে পারে
(নাউযুবিল্লাহ)!
(২)
হুজুরের বানানো দোয়া পড়লে কতটুকু নেকী পাওয়া
যাবে? কোনো গ্যারান্টি আছে হুজুরের বানানো দোয়া আল্লাহ তাআ’লা কবুল করবেন? উত্তর
হচ্ছেঃ না, নাই। আসলে এগুলো একটা ষড়যন্ত্র, মানুষকে ক্বুরআন
হাদীস ছেড়ে হুজুরের বানানো ইসলাম শেখানোর জন্য। যে
দোয়া পড়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি
ওয়া সাল্লাম তোওবা করতেন ও আমাদেরকে পড়তে বলছেনঃ
أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الْعَظيمَ
الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ القَيّوُمُ وَأَتُوبُ إِلَيهِ
উচ্চারণঃ আসতাগফিরুল্লা-হাল
আ’যীমাল্লাযী লা-ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হা’ইয়ুল ক্বাইয়ূমু ওয়া আতুবু ইলাইহি।
অর্থঃ আমি আল্লাহর
কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যিনি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য আর কোন উপাস্য নেই। যিনি
চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। আমি তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তন
করছি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে
ব্যক্তি এই দোয়া পড়বে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন, যদিও সে জিহাদের ময়দান থেকে
পলাতক আসামী হয়।” হিসনুল
মুসলিম পৃষ্ঠা ২৮৬, তিরমিযীঃ
৪/৬৯, আবু দাউদঃ ২/৮৫, হাদীসটি
সহীহ, সিলসিলা সহীহাহঃ২৭২৭।
অর্থাৎ,
সে যদি বড় রকমের গুনাহগার হয় আর এই দুয়া পড়ে তোওবা করে,
তবুও আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন।)
হুজুরের বানানো
দুয়া থেকে রাসুলুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আ’লাইহি
ওয়া সাল্লাম এর দুয়া বেশি দামী। সুতরাং সুন্নাতী দুয়া শিখতে আমাদের অলসতা করা ঠিক না। তোওবার
মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়, তাই এই দুয়াটা অবশ্যই মুখস্থ করবেন এবং নিয়মিত
উঠতে বসতে, যখনই মনে পড়বে, বেশি বেশি করে এই
দুয়া পড়ে আল্লাহর কাছে মাফ চাইবেন ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ্যঃ এই
দুয়াটা আসতাগফিরুল্লা-হাল আ’যীমাল্লাযী...এবং
আসতাগফিরুল্লা-হালাল্লাযী...এই দুইভাবেই হাদীসে আছে। দুইটাই
সহীহ হাদীস, যার যেটা ভালো লাগে পড়বেন।