বুধবার, ১০ জুন, ২০১৫

দাজ্জালের মারাত্মক ফেতনা ও ঈসা (আঃ) এর আশ্চর্যজনক কাহিনী

দাজ্জালের মারাত্মক ফেতনা ও ঈসা (আঃ) এর আশ্চর্যজনক কাহিনী
- আনসারুস সুন্নাহ।
__________________________
নাওওয়ান ইবন সামআন কিলাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের আলোচনা করলেন এবং বিষয়টির ভয়াবহতা এবং নিকৃষ্টতা সব কিছু তুলে ধরেন। এমনকি আমাদের ধারণা হচ্ছিল যে, দাজ্জাল মনে হয় এই মুহূর্তে আমাদের খেজুর বাগানেই উপস্থিত রয়েছে।
নাওওয়াস রাদিয়াল্লাহু আনহু আরো বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছ থেকে ফিরে গেলাম। পরে বিকালে আবার তাঁর কাছে এলাম। তিনি আমাদের মাঝে দাজ্জালের ভীতির চিহৃ দেখে বললেন, তোমাদের একি অবস্থা?
আমরা বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি সকালে দাজ্জালের আলোচনা করেছিলেন এবং বিষয়টির ভীষণতা এবং নিকৃষ্টতা এমন উল্লেখ করেছিলেন যে, আমাদের মনে হচ্ছিল সে বুঝি খেজুর বাগানের কিনারে এসে হাজির।
তিনি বললেন, আমি তোমাদের জন্য দাজ্জাল ছাড়া অন্য কিছুর ব্যপারে অধিক আশংকা আমার রয়েছে। তোমাদের মাঝে আমার জীবদ্দশায় যদি দাজ্জালের আবির্ভাব হয় তাহলে আমিই তোমাদের পক্ষে তাঁর বিরুদ্ধে বিতর্কে জয়ী হব। আর আমি যদি তোমাদের মাঝে না থাকি তখন যদি সে বের হয়, তবে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের পক্ষে তার বিরুদ্ধে বিতর্ককারী হবে। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আমার স্থলে আল্লাহ তাআ'লা নিজেই সহায়ক হবেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
দাজ্জাল হল একজন যুবক মানুষ। তার চুল হবে অতিশয় কুকড়ানো ও চোখ তার স্থির। সে আবদুল উযযা ইবন কাতান এর মতো দেখতে হবে। তোমাদের কেউ যদি তাকে পায়, তবে সে যেন সুরাতুল কাহফ (১৮ নাম্বার সুরা) এর শুরুর দিকের আয়াতগুলো তিলাওয়াত করে। তিনি আরো বলেন, শাম ও ইরাকের মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে সে বের হবে। ডান দিক ও বাম দিক সে ফেতনা-ফাসাদের সৃষ্টি করে ফিরবে। হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা তখন দৃঢ় থাকবে।

আমরা বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যে দিনটি হবে এক বছরের মত বড় সে দিন কি একদিনের সালাতেই আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে বলে আপনি মনে করেন?

তিনি বললেনঃ না, বরং তোমরা এর জন্য (স্বাভাবিক দিনের পরিমান) আন্দায করে নিবে (এবং সে হিসাবমত সালাত আদায় করবে)।

আমরা বললামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! পৃথিবীতে দাজ্জালের গতি কত দ্রুত হবে?

তিনি বললেনঃ বায়ু তাড়িত মেঘমালার মত। সে কোন এক সম্প্রদায়ের কাছে আসবে। তাদেরকে সে নিজের দলে যোগ দেওয়ার জন্যে ডাকবে। কিন্তু তারা তাকে অস্বীকার করবে এবং তার দাবী প্রত্যাখান করবে। সে তখন তাদের থেকে ফিরে আসবে আর (যেই সম্প্রদায় দাজ্জালকে মানবেনা) তাদের সম্পদ দাজ্জালের পিছে পিছে চলে যাবে। তাদের হাতে আর কিছুই থাকবে না। তারপর সে আরেক সম্প্রদায়ের কাছে যাবে। সে তাদেরকে নিজের দিকে ডাকবে। তারা তার কথা গ্রহণ করবে এবং তাকে সত্য বলে স্বীকার করে নিবে। তখন সে আকাশকে বৃষ্টি ঝড়াতে আদেশ দিবে। তারপর (আল্লাহর ইচ্ছা ও হুকুম অনুসারেই মানুষের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ) সে অনুযায়ী বৃষ্টি নামবে। দাজ্জাল যমীনকে উদ্ভিদ জন্মাতে নির্দেশ দিবে যার ফলে ফসল হবে। বিকালে তাদের পশুপালগুলো পূর্বের চেয়েও লম্বা, কুঁজ, বিস্তৃত নিতম্ব, দুগ্ধপুষ্ট ওলান বিশিষ্ট হয়ে ফিরে আসবে।

তারপর দাজ্জাল এক বিরান ধবংসস্তূপের কাছে আসবে। সেটিকে লক্ষ্য করে সে বলবেঃ তোমার ধনভান্ডার বের করে দাও। তারপর সে এখান থেকে ফিরে আসবে আর যেভাবে রানী মৌমাছিকে ঘিরে ধরে অন্য মৌমাছিগুলি তার অনুসরণ করে থাকে, তেমনিভাবে সব ধনভান্ডার দাজ্জালের অনুসরণ করবে।

এরপর সে যৌবনে পরিপূর্ণ এক তরুন যুবককে তার দিকে আহবান জানাবে। (সেই যুবক তাকে না মানলে) সে তাকে তলোয়ারের আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে ফেলবে। পরে তাকে ডাকবে। যুবকটি (জীবিত হয়ে) হাস্যেজ্জল চেহারা নিয়ে এদিকে আসবে।

এমতাবস্থায় এদিকে ঈসা (আঃ) দুইজন ফেরেশতার ডানায় তাঁর হাত রেখে গেরুয়া রঙ্গের বসনে স্বেত-শুভ্র মিনারার কাছে দামেশকের পূর্ব দিকে অবতরণ করবেন। তাঁর মাথা নীচু করলে পানি ঝড়তে থাকবে আর তা উঠানে মোতির মত ফোটায় ফোটায় পানি পড়বে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ঈসাঃ (আঃ) এর শ্বাস-প্রশ্বাস কাফেরদের মাঝে যাকেই স্পর্শ করবে, সেই মারা যাবে। আর দুই চোখের দৃষ্টি যেখানে গিয়ে শেষ হবে, সেখান পর্যন্ত তাঁর নিঃশ্বাসের বাতাস পৌছবে। তিনি দাজ্জালকে তালাশ করবেন এবং লুদ (বায়তুল মুকাদ্দাসের নিকটবর্তী একটি শহর) এর নগর দরওয়াজার কাছে তাকে পাবেন। তারপর তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন।

এরপর আল্লাহ যতদিন চান ঈসা (আঃ) এভাবে বসবাস করবেন। পরবর্তীতে আল্লাহ তাআ'লা তাকে ওয়াহী পাঠাবেনঃ আমার বান্দাদেরকে তুর পাহাড়ে সরিয়ে নাও। আমি আমার এমন একদল বান্দা নামাচ্ছি যাদের সংগে লড়াই করার ক্ষমতা কারো নেই। এরপর আল্লাহ তাআলা ইয়াজুজ-মাজুজের দল পাঠাবেন। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার বিবরণ মত প্রতি উচ্চ ভূমি থেকে তারা ছুটে আসবে। তাদের প্রথম দলটি তাবারিয়া উপসাগর (শামে অবস্থিত একটি ছোট সাগর) অতিক্রম করা কালে এর মাঝে যা পানি আছে সব পানি তারা পান করে শেষ করে ফেলবে। এমন অবস্থা হবে যে, পরে তাদের শেষ দলটি যখন এই উপসাগর অতিক্রম করবে তখন তারা বলবে এখানে এক কালে হয়ত পানি ছিল। আবার তারা চলবে এবং বায়তুল মুকাদ্দাসে অধ্যায়তে যেয়ে তাদের এই যাত্রার শেষ হবে। তারা পরস্পর বলবে; পৃথিবীতে যারা ছিল তাদেরকে তো বধ করেছি এস এবার আসমানে যারা আছে তাদের শেষ করে দইে। তারপর তারা আসমানের দিকে তাদের তীর ছুড়বে। আল্লাহ তাআলা তাদের তীরগুলোকে রক্ত রঞ্জিত করে ফিরিয়ে দিবেন। ঈসা ইবন মারয়াম (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীগণ অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকবেন। তাদের অবস্থা এমন কঠিন হয়ে দাঁড়াবে যে, আজকে তোমাদের কাছে একশত স্বর্ণ মুদ্রার যে দাম, তাদের কাছে তখন একটি ষাড়ের মাথা তার চাইতে অনেক উত্তম বলে মনে হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তারপর ঈসা (আ) ও তাঁর সঙ্গীগণ আল্লাহর কাছে দুয়া করবেন। আল্লাহ তাআলা ইয়াজুজ মাজুজদের গর্দানে ‘‘নাগাফ’’ জাতীয় এক জীবানু মহামারিরূপে প্রেরণ করবেন। তারা সব ধবংশ হয়ে মরে যাবে যেন একটি মাত্র প্রাণের মৃত্যু হল। এরপর ঈসা (আঃ) ও তার সঙ্গীগণ পাহাড় থেকে নেমে আসবেন, কিন্তু তারা এব বিঘত পরিমান জায়গাও এমন পাবেন না, যেখানে ইয়জুজ-মাজুজের গলিত চর্বি, রক্ত ও দুর্গন্ধ ছড়িয়ে না আছে। তারপ ঈসা (আ) ও তাঁর সঙ্গীগণ আল্লাহর কাছে আবার দুয়া করবেন। তখন আল্লাহ তাআলা উটের মত লম্বা গলা বিশিষ্ট এক প্রকার পাখি প্রেরণ করবেন। পাখিগুলি ইয়াজুজ-মাজুজদের লাশ উঠিয়ে নীচু গর্তে নিয়ে ফেলে দিবে। মুসলিমগণ তাদের ফেলে যাওয়া ধনুকে জ্যা, তীর এবং তুলীর সাত বছর পর্যমত্ম জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করবে। আল্লাহ তাআলা প্রবল বৃষ্টি করবেন শহর বা গ্রামের কোন বাড়িঘরই তা থেকে রক্ষা পাবে না। সমস্ত যমীন ধৌত হয়ে যাবে এবং তা আয়নার মত ঝক ঝকে হয়ে উঠবে।

পরে যমীনকে বলা হবে, তোমার সব ফল ও ফসল বের করে দাও, সব বরকত ফিরিয়ে দাও। এমন হবে যে সেদিন একটি আনার একদল লোক খেতে পারবে এবং একদল লোক এর খোসার নীচে ছায়া গ্রহণ করতে পারবে। দুধের মাঝেও এমন বরকত হবে যে, একটি দুগ্ধবতী উট বহুসংখ্যক লোকের একটি বড় দলের জন্যও যথেষ্ট হবে। একটি দুগ্ধবতী গাভী একটি গোত্রের জন্য যথেষ্ট হবে। এদর উপরই কিয়ামত সংঘটিত হবে, একটি দুগ্ধবতী ছাগল একটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট হবে।

এমন অবস্থায় তারা দিন জীবন-যাপন করতে থাকবে হঠাৎ আল্লাহ তাআলা এক বাতাস প্রবাহিত করবেন। এই বাতাস প্রত্যেক মুমিনের রূহ কবয করে নিয়ে যাবে। বাকী কেবল দুষ্টু লোকেরাই থেকে যাবে। তারা গাধার মত নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্যে নারী সঙ্গমে লিপ্ত হবে। আর এদের উপরই কিয়ামত সংঘটিত হবে।

[সহিহ আত্-তিরমিজি, ফিতনা অধ্যায়, অধ্যায় নং-৩৩, হাদিস নং- ২২৪০ এর ভাবার্থ]