প্রশ্নঃ
কাফের, মুশরেক, মুনাফেক, মুর্তাদ, আহলে কিতাব ও ফাসেক কাকে বলে?
উত্তরঃ
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য। আল্লাহ দরূদ ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর; আর তাঁর বংশধর, তাঁর সাহাবীগণ এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা সুন্দরভাবে
তাঁদের অনুসরণ করবে তাদের উপর (আমিন)।
=>
“কাফের”
‘কুফর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অস্বীকার করা, অবিশ্বাস করা
অথবা গোপন করা। বাংলাতে ‘কাফের’ শব্দের অর্থ করা হয় অবিশ্বাসী। যে ব্যক্তি আল্লাহর
নাযিলকৃত দ্বীন ইসলাম বা ইসলামের কোন অংশকে, ক্বুরানুল কারীম বা এর কোন আয়াত, মুহাম্মাদ
সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম অথবা কোন একজন নবী অথবা রাসূলকে
অস্বীকার করে, ইসলামি আকিদাহ বা এর মৌলিক কোন ধর্মীয় বিশ্বাস বা অকাট্য দলিল দিয়ে প্রমানিত
ইসলামের কোন বিধি-বিধানকে অস্বীকার করে, অবিশ্বাস করে, প্রত্যাখ্যান অথবা এইগুলো নিয়ে
হাসি-ঠাট্টা বা অবজ্ঞা করে, নিঃসন্দেহে সে ব্যক্তি একজন কাফের। কাফের চির জাহান্নামী,
সে কোনদিন জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবেনা। অনন্তকাল সে জাহান্নামে কঠিন শাস্তি পেতে
থাকবে।
উদাহরণঃ
ইয়াহুদী ও খ্রীস্টানরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে ‘রাসুল’ বা আল্লাহর দূত হিসেবে বিশ্বাস করেনা, ক্বুরানুল
কারীম ‘আল্লাহর কালাম’ বিশ্বাস করেনা, একারণে তারা কাফের, তারাও চির
জাহান্নামী যদিওবা তারা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। অনুরূপভাবে নাস্তিক যারা
আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেনা তারাও কাফের। হিন্দুরাও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে রাসুল হিসেবে বিশ্বাস করেনা,
সুতরাং একদিক থেকে তারা যেমন মুশরেক, অন্যদিক থেকে তারা কাফেরও বটে।
=>
“মুশরেক”
‘শিরক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কোন কিছুতে কাউকে শরিক বা
অংশীদার বানানো। যে ব্যক্তি শিরক করে তাকে মুশরেক বলা হয়, বাংলাতে ‘মুশরেক’ শব্দের অর্থ করা হয় অংশীবাদী। মুশরেক বলা হয়
তাকে যে কোন কিছুকে আল্লাহর অপ্রতিদ্বন্দ্বী একক সত্ত্বা, মর্যাদা বা ক্ষমতার সমান
বা অংশীদার বলে বিশ্বাস করে, মনে করে অথবা দাবী করে। মুশরেক চির জাহান্নামী, সে কোনদিন
জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবেনা। অনন্তকাল সে জাহান্নামে কঠিন শাস্তি পেতে থাকবে।
উদাহরণঃ
হিন্দুরা তাদের মাটির তৈরী দেব-দেবীদেরকে আল্লাহর সমান মনে করে, সুতরাং জাতিগতভাবে
হিন্দুরা মুশরেক। মারেফাতে বিশ্বাসী সূফীবাদী অজ্ঞ লোকেরা যারা নিজেদের মুসলমান বলেই
মনে করে, কিন্তু তারা তাদের জিন্দা-মুর্দা পীর-ফকিরদেরকে আল্লাহর সমান সম্মান ভক্তি-শ্রদ্ধা
ও ভয় করে, তাদেরকে সেজদাহ করে, তাদের কাছে দুয়া করে, বিপদে আপদে উদ্ধার করার জন্য গায়েবী
সাহায্য চায়, তাদেরকে আলেমুল গায়েব ও হাজির-নাযির মনে করে. . .এই সবগুলো কাজ ডাহা শিরক।
যারা এইগুলো করবে তারাও মুশরেকদের অন্তর্ভুক্ত হবে যদিওবা তারা নিজেদের মুসলমান বলে
দাবী করে, যদিওবা তারা লোক দেখানো কিছু নামায-রোযা করে। খ্রীস্টানরা ঈসা আলাইহিস সালাম
কে আল্লাহর পুত্র মনে করে (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক), একারণে তারা মুশরেকও বটে।
=>
“মুনাফেক”
‘নিফাক’ অর্থ কপটতা, ভন্ডামি বা দ্বিমুখী নীতি। যার
মধ্যে নিফাক থাকে তাকে মুনাফেক বলা হয়। যে ব্যক্তি মুখে নিজেকে ঈমানদার, মুসলমান বলে
দাবী করে কিন্তু যার অন্তরে ঈমান নেই, যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলাম আল্লাহর নাযিল করা একমাত্র
সত্য ধর্ম, ক্বুরানুল কারীম আল্লাহর বাণী, নবী মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল, এগুলো বিশ্বাস
করেনা বা এগুলো নিয়ে সন্দেহ করে, তাকে মুনাফেক বলা হয়।
উদাহরণঃ
যারা ‘সেকুলারিজম’ বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মতবাদে বিশ্বাসী, যারা
ইসলামের নামায, রোযা, হজ্জ, কোরবানি মানে কিন্তু ‘শরিয়াহ’ বা আল্লাহর আইন দিয়ে ক্বুরান হাদীস দিয়ে দেশ
পরিচালনা করা, আইন-আদালত ও বিচার করাকে অস্বীকার করে, মুসলমান নাম নিয়ে হিজাব-পর্দাকে
কটাক্ষ করে তারা মুনাফেক।
=>
“মুর্তাদ”
‘রিদ্দা’ অর্থ হচ্ছে পূর্বের অবস্থানে প্রত্যাবর্তন করা
বা ফিরে যাওয়া। যে ব্যক্তি একবার ইসলাম ধর্ম কবুল করে মুসলিম হয়ে অথবা পূর্বে মুসলিম
থাকার পরে কুফুরী অথবা শিরক করে অথবা ইসলামকে অস্বীকার করে পুনরায় কাফের হয়ে যায়, তাকে
মুর্তাদ বলা হয়। দেশে ইসলামী আইন চালু থাকলে এবং সরকার প্রধান যদি মুসলিম হয় তাহলে
আদালতে নেওয়ার পূর্বে সে যদি তোওবাহ না করে, তাহলে আদলতে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে
মুর্তাদকে হত্যা করা হবে। কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি কেউ দ্বীন ত্যাগ করে (কুফুরীতে) ফিরে যায়
তাহলে তোমরা তাকে হত্যা করো” [সহীহ বুখারীঃ ৩০১৭] কোন
ব্যক্তি যদি সারা জীবন নামায রোযা করে কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে কাফের হয়ে মুর্তাদ অবস্থায়
মারা যায়, কোন সন্দেহ নেই সে ব্যক্তি চির জাহান্নামী, সে কোনদিন জাহান্নাম থেকে বের
হতে পারবেনা। অনন্তকাল সে জাহান্নামে কঠিন শাস্তি পেতে থাকবে।
উদাহরণঃ যে ব্যক্তি মুসলমানদের ঘরে মুসলমান হিসেবে বেড়ে উঠে কিন্তু
পরবর্তীতে নাস্তিক হয়ে যায় অথবা ইয়াহুদী বা খ্রীস্টান হয়ে যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে গালিগালাজ করে বা ইসলাম সম্পর্কে কটুক্তি করে তবে সে মুর্তাদ হয়ে যাবে।
=>
“আহলে কিতাব”
আহলে
কিতাব অর্থ হচ্ছে আল্লাহর নাযিল করা আসমানী কিতাব এর অনুসারী। ইয়াহুদী ও খ্রীস্টানদেরকে
আহলে কিতাব বলা হয়। কারণ ইয়াহুদীরা দাবী করে তারা মুসা আলাইহিস সালাম এর উপর নাযিল
করা তাওরাত (Old testament) এর অনুসরণ করে আর খ্রীস্টানরা দাবী করে তারা ঈসা আলাইহিস
সালাম এর উপর নাযিল করা ইঞ্জীল (New testament) এর অনুসরণ করে। উল্লেখ্য, যদিও তাদেরকে
আহলে কিতাব বলা হয় পরিচয় হিসেবে, প্রকৃতপক্ষে তারা তাওরাত বা ইঞ্জীলের অনুসরণ করেনা।
ইয়াহুদী ও খ্রীস্টানরা তাদের সুবিধা ও খেয়াল-খুশি অনুযায়ী কিতাবের বিকৃত বা অপব্যখ্যা
করে সেইগুলোকে পরিবর্তন করে ফেলেছে। বর্তমানে ‘বাইবেল’ নামে যা আছে ইয়াহুদী ও খ্রীস্টানদের কাছে,
Old testament ও New testament এর সমন্বয়ে, এটা আসলে তাওরাত ও ইঞ্জীলের বিকৃত রূপ।
=>
“ফাসেক”
‘ফিসক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অবাধ্যতা। বাংলাতে ‘ফাসেক’ শব্দের অর্থ করা হয় পাপীষ্ঠ। যে ব্যক্তি নিয়মিত
কবীরাহ গুনাহতে লিপ্ত থাকে অথবা প্রকাশ্যে আল্লাহর নিষিদ্ধ ঘোষিত হারাম কাজ করতে অভ্যস্ত
এবং তোওবা করে পাপ কাজ থেকে ফিরে আসেনা, তাকে ফাসেক বলা হয়। ফাসেক ব্যক্তি যদি নামাযী
মুসলমান হয়, দ্বীনের অন্য বিধি-বিধান মেনে চলে কিন্তু কিছু কবীরাহ গুনাহতে লিপ্ত থাকে,
তাহলে মীযানে তার নেক আমল যদি পাপ কাজের ওজনের চাইতে ভারী হয় তাহলে সে জান্নাতে যাবে।
অথবা আল্লাহর বিশেষ রহমতে তাকে যদি ক্ষমা করে দেন, তাহলে সে কোন শাস্তি ছাড়াই সরাসরি
জান্নাতে যাবে। কিন্তু তার পাপ কাজ যদি নেকীর চাইতে বেশি ভারী হয় এবং আল্লাহর রহমত
পেতে ব্যর্থ হয় তাহলে সে জাহান্নামে পাপের শাস্তি ভোগ করবে। জাহান্নামে কঠিন শাস্তির
পরে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হলে এর পরে সে জান্নাতে যাবে ইন শা’ আল্লাহ্।
উদাহরণঃ নিচের প্রত্যেকটা কাজ কবীরাহ গুনাহঃ
- যে ব্যক্তি পিতা-মাতার অবাধ্য বা তাদের হক্ক আদায় করেনা
- যে ব্যক্তি কোন ওযর ছাড়া জামাতে শরীক হয়না
- যে ব্যক্তি দাঁড়ি মুন্ডন (শেইভ) করে
- যে ব্যক্তি টাখনুর নিচে কাপড় পড়ে
- যে ব্যক্তি স্ত্রীর হক্ক আদায় করেনা, ঘরের লোকদের সাথে অন্যায় ও যুলুম
অত্যাচার করে
- দাইয়ুস এবং যে ব্যক্তি ঘরের নারীদেরকে হিজাব-পর্দার আদেশ করেনা
- যে নারী হিজাব-পর্দা করেনা, পর পুরুষদের সাথে চলা-ফেরা করে
- যে নারী স্বামীর অবাধ্য, স্বামীকে কষ্ট দেয়
- যারা অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা ও জিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত
এই কাজগুলো বা এইরকম কবীরাহ গুনাহর সাথে যারা জড়িত থাকবে, যারা এইগুলো থেকে
বাঁচার চেষ্টা করবেনা তারা ‘ফাসেক’ বলে বিবেচিত হবে।
=> “সর্বশেষ
সতর্কতা”
আপনারা কোন ব্যক্তি
নির্দিষ্ট ব্যক্তি, যে নিজেকে মুসলিম দাবী করে তাকে আন্দাজে ‘কাফের’ বা ‘মুশরেক’ বলে ফতোয়া দেবেন না অথবা কারো মাঝে কোন
গুনাহর কাজ দেখলেই তাকে ‘ফাসেক’ বলে গালি দেবেন না। কোন কুফর বা শিরক করলেই
কেউ কাফের বা মুশরেক হয়ে যায়না। কেউ যদি না জেনে কোন ভুল করে ফেলে যা আসলে শিরক বা
কুফর, কোন কিছু তাকে জোর করে করানো হয় বা সে ভয়ে বা অজান্তে কুফুরী-শিরকের সাথে
জড়িত হয় সেই ক্ষেত্রে তাকে কোনমতেই কাফের বা মুশরেক বলা যাবেনা। প্রথমে তাকে সেই ভুলের
ব্যপারে সতর্ক করতে হবে, দলিল দেওয়ার পরেও সে যদি স্বেচ্ছায় কোন শিরক অথবা কুফরে
লিপ্ত হয় তাহলে সে কাফের বা মুশরেক বলে বিবেচিত হবে। আর কাউকে কাফের বলে ঘোষণা করা
খুব জটিল ও বিপদজনক একটা বিষয়। অযথা
কাউকে নাস্তিক বা কাফের বলা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ! আপনারা ভালো করে নিচের হাদীসটি লক্ষ্য
করুন,
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন,
“যে ব্যক্তি তার অপর কোন ভাইকে কাফের বলে, তাহলে
তা দুইজনের যেকোন একজনের দিকে ফিরবে। যদি সে যা (কাফের) বলেছে বাস্তবে তাই হয়, তাহলেতো
ঠিক আছে। আর সে যদি কাফের না হয় তাহলে উক্ত বিষয়টি (কুফুরী) যে বলেছে, তার দিকেই ফিরে
আসবে।” [সহীহ
মুসলিমঃ ২২৫]
অনুরূপভাবে, কোন
ব্যক্তি দাঁড়ি শেইভ করলে অথবা কোন নারী বেপর্দা চলাফেরা করলেই আপনারা তাকে ‘ফাসেক’ বলে গালি দেবেন না বা তাকে নিয়ে
তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন না। এর ফলে সে ইসলাম থেকে আরো দূরে যাবে, যার জন্য আপনি
দায়ী থাকবেন। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে কেউ কোন পাপ কাজ করলে তাকে উপদেশ দেওয়া, তাকে
ভালো কাজের দিকে আহবান করা ও তাকে দলিল দিয়ে বুঝানো। সে মানুক না আর না মানুক সেটা
তার আর আল্লাহর মাঝে ছেড়ে দিন। কে ফাসেক আর কে আল্লাহর ওয়ালী সেটা বিচার করার এখতিয়ার
আল্লাহর, আমাদের না।