নারীদের ঋতু সংক্রান্ত মাসয়ালাগুলোর সঠিক উত্তর জেনে নিন ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহর "ফতোয়া আরকানুল ইসলাম" বইয়ের পবিত্রতা অধ্যায় থেকে। আজকে সেখান থেকে নির্বাচিত কিছু প্রশ্নের উত্তর পোস্ট করা হলো, মা বোনেরা এই পোস্টটা সেইভ করে রাখুন অথবা বইটা না থাকলে (অবশ্যই সংগ্রহে থাকা উচিত) প্রিন্ট করে রাখুন।
বিনীত,
আনসারুস সুন্নাহ
১০ই মুহাররাম, ১৪৩৬।
__________________________
প্রশ্নঃ (১৭০) ঋতুর সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ নির্দিষ্ট দিন বলে কি কিছু আছে?
উত্তরঃ বিশুদ্ধ মতে ঋতুর সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ দিন নির্দিষ্ট বলে কিছু নেই। কেননা আল্লাহ বলেনঃ
অর্থাৎ “আর তারা তোমার কাছে জিজ্ঞাসা করে হায়েয সমপর্কে। বলে দাও, এটা অপবিত্র। কাজেই তোমরা হায়েয অবস্থায় স্ত্রী মিলন থেকে বিরত থাক। তখন পর্যন্ত তাদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হবে না; যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়ে যায়।” (সূরা বাক্বারা- ২২২) এখানে স্ত্রী সহবাসের নিষিদ্ধতা নির্দিষ্ট দিনের সাথে সম্পর্কিত করা হয়নি। এর সম্পর্ক হচ্ছে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়ার সাথে।
এ থেকে বুঝা যায়, বিধানটির কারণ হচ্ছে ঋতু থাকা বা না থাকা। যখনই ঋতু পাওয়া যাবে, বিধান প্রযোজ্য হবে। যখনই পবিত্র হয়ে যাবে, তার বিধান সমূহও রহিত হবে।
তাছাড়া নির্দিষ্ট দিন বেঁধে দেয়ার কোন দলীলও নেই। অথচ বিষয়টি বর্ণনা করে দেয়ার দরকার ছিল। বয়স বা দিনের নির্দিষ্টতা যদি শরীয়ত সম্মত হত, তবে তা অবশ্যই আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নাতে বর্ণিত হত।
অতএব এই ভিত্তিতে নারীদের কাছে পরিচিত স্রাব যখনই দেখা যাবে, নারী তখনই নিজেকে ঋতুবতী গণ্য করবে। এখানে কোন দিন নির্দিষ্ট করবে না। কিন্তু নারীর স্রাব যদি চলতেই থাকে বন্ধ না হয়, অথবা সামান্য সময়ের জন্য বন্ধ হয়, যেমন মাসে একদিন বা দু’দিন তবে তা ইসে-হাযার স্রাব (বা অসুস্থতা) বলে গণ্য হবে।
______________________________
প্রশ্নঃ (১৭৩) নির্গত স্রাবের ব্যাপারে নারী যদি সন্দিহান হয় যে, এটা কি হায়েযের রক্ত না কি ইসে-হাযার রক্ত না কি অন্য কিছুর রক্ত? এবং সে পার্থক্যও করতে পারে না। তবে সে উহা কি গণ্য করবে?
উত্তরঃ আসল কথা হচ্ছে, নারীর গর্ভ থেকে নির্গত রক্ত হায়েযেরই হয়ে থাকে। কিন্তু যখন প্রমাণিত হয়ে যাবে যে, তা ইসে-হাযার স্রাব তখন ইসে-হাযা হিসেবে গণ্য করবে। অন্যথায় ইসে-হাযা কিনা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্গত রক্ত হায়েয বা ঋতু হিসেবেই গণ্য করবে।
_______________________________
প্রশ্নঃ (১৭৫) জনৈক নারীর ঋতুর নির্দিষ্ট দিন ছিল ছয় দিন। অতঃপর এই দিনের পরিমাণ বৃদ্ধি হয়ে গেছে। সে এখন কি করবে?
উত্তরঃ এই নারীর ঋতুর দিন ছিল ছয় দিন। কিন্তু তা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে নয় দিন বা দশ দিন বা এগার দিন হয়ে গেছে, তবে তা ঋতু হিসেবে গণ্য করে পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত নামায-রোযা থেকে বিরত থাকবে। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঋতুর জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করে দেননি। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর তারা তোমার কাছে জিজ্ঞাসা করে হায়েয সমপর্কে। বলে দাও, এটা অপবিত্র।” (সূরা বাকারা- ২২২)
অতএব যতক্ষণ পর্যন্ত এই স্রাব অবশিষ্ট থাকবে, নারীও নিজ অবস্থায় থেকে পবিত্র হওয়ার পর গোসল করে ছালাত-ছিয়াম আদায় করবে। পরবর্তী মাসে যদি তার স্রাবের দিন কম হয়ে যায়, তবে স্লাব বন্ধ হলেই গোসল করে পবিত্র হয়ে যাবে। যদিও আগের মাসের সমান দিন পূর্ণ না হয়।
মোটকথা নারী যতদিন ঋতু বিশিষ্ট থাকবে ততদিন সে ছালাত-ছিয়াম থেকে বিরত থাকবে। চাই ঋতুর দিন পূর্ববর্তী মাসের বরাবর হোক বা কম হোক বা বেশী হোক। স্রাব বন্ধ হয়ে পবিত্র হলেই গোসল করবে।
__________________________________
প্রশ্নঃ (১৭৬) জনৈক নারী মাসিক থেকে পবিত্র হওয়ার পর গোসল করে নামায শুরু করেছে। এভাবে নয় দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আবার স্রাব দেখা গেছে। তিন দিন স্রাব প্রবাহমান ছিল। তখন নামায পড়েনি। তারপর পবিত্র হলে গোসল করে এগার দিন নামায আদায় করেছে। তারপর আবার তার স্বাভাবিক মাসিক শুরু হয়েছে। সে কি ঐ তিন দিনের নামায কাযা আদায় করবে? নাকি তা হায়েযের দিন হিসেবে গণ্য করবে?
উত্তরঃ নারীর গর্ভ থেকে যখনই রক্ত প্রবাহিত হবে তখনই তা ঋতু বা হায়েয হিসেবে গণ্য হবে। চাই সেই ঋতুর সময় পূর্বের ঋতুর সময়ের চাইতে দীর্ঘ হোক বা কম হোক। ঋতু থেকে পবিত্র হওয়ার পাঁচ দিন বা ছয় দিন বা দশ দিন পর পুনরায় স্রাব দেখা গেছে, তবে সে পবিত্র হওয়ার অপেক্ষা করবে এবং নামায পড়বে না। কেননা এটা ঋতু। সর্বাবস্থায় এরূপই করবে। পবিত্র হওয়ার পর আবার যদি ঋতু দেখা যায়, তবে অবশ্যই নামায-রোযা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু স্রাব যদি চলমান থাকে- সামান্য সময় ব্যতীত কখনই বন্ধ না হয়, তবে তা ইসে-হাযা বা অসুস্থতা বলে গণ্য হবে। তখন তার নির্দিষ্ট দিন সমূহ শুধু ছালাত-ছিয়াম থেকে বিরত থাকবে।
___________________________________
প্রশ্নঃ (১৭৭) ঋতু শুরু হওয়ার দু’দিন পূর্বে নারীর গর্ভ থেকে যে হলুদ রংয়ের তরল পদার্থ নির্গত হয় তার বিধান কি?
উত্তরঃ হলুদ রংয়ের এই তরল পদার্থ যদি ঋতুর সময় হওয়ার পূর্বে নির্গত হয়, তবে তা কিছু নয়। কেননা উম্মে আত্বীয়্যা (রাঃ) বলেন, “আমরা হলুদ রং ও মেটে রংয়ের তরল পদার্থ বের হলে তা কোন কিছুই গণ্য করতাম না।” (বুখারী)
আবু দাঊদের বর্ণনায় এসেছে, উম্মে আত্বীয়্যা (রাঃ) বলেন, “পবিত্র হওয়ার পর হলুদ রং ও মেটে রংয়ের তরল পদার্থ বের হলে আমরা তাকে কোন কিছুই গণ্য করতাম না।”
ঋতুর পূর্বের এই হলুদ রংয়ের তরল পদার্থ যদি ঋতু বের হওয়ার সাথে সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে তা কোন কিছু নয়। কিন্তু নারী যদি উহা ঋতুর সূচনা স্বরূপ মনে করে, তবে তা ঋতু হিসেবে গণ্য করবে এবং পবিত্র হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।
___________________________________
প্রশ্নঃ (১৭৮) পবিত্র হওয়ার পর হলুদ রং ও মেটে রংয়ের তরল পদার্থ বের হওয়ার বিধান কি?
উত্তরঃ ঋতুর ক্ষেত্রে নারীদের সমস্যা সাগরতুল্য যার কোন কুল কিনারা নেই। এর অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, গর্ভ বা মাসিক নিরোধক ঔষধ ব্যবহার করা। পূর্বে মানুষ এত ধরণের সমস্যা সম্পর্কে অবগত ছিল না। সন্দেহ নেই সৃষ্টি লগ্ন থেকে নারীর নানান সমস্যা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এর আধিক্য এত বেশী যে মানুষ তার সমাধানের ক্ষেত্রে হয়রান হয়ে যায়; যা দুঃখজনক বিষয়।
তবে মূলনীতি হচ্ছে, নারী যদি নিশ্চিতভাবে ঋতু থেকে পবিত্রতা দেখতে পায়, যেমন নারীদের কাছে পরিচিত সাদা পানি বের হওয়া, বা হলুদ বা মেটে রং বের হওয়া বা ভিজা পাওয়া এগুলো সবই হায়েয বা ঋতু নয়। এগুলো নামায বা ছিয়াম থেকে বাধা দিবে না। স্বামী সহবাসে বাধা থাকবে না। কেননা এটা হায়েয নয়। উম্মু আতিয়্যা (রাঃ) বলেন, “পবিত্র হওয়ার পর হলুদ রং ও মেটে রংয়ের তরল পদার্থ বের হলে, আমরা তা কোন কিছুই গণ্য করতাম না।” এর সনদ ছহীহ।
এই ভিত্তিতে, নিশ্চিতভাবে পবিত্র হওয়ার পর এ ধরণের যা কিছুই ঘটুক, তাতে নারীর কোন অসুবিধা নেই। ছালাত-ছিয়াম ও স্বামী সহবাসে কোন বাধা নেই। কিন্তু পবিত্রতা না দেখা পর্যন্ত তাড়াহুড়া করবে না। কেননা কোন কোন নারী রক্ত বের হওয়াতে কিছুটা শুস্কতা দেখলেই পবিত্রতার চিহ্ন না দেখেই তাড়াহুড়া করে গোসল করে নেয়। এই জন্য মহিলা ছাহাবীগণ উম্মুল মু’মেনীন আয়েশা (রাঃ)কে দেখানোর জন্য তুলা নিয়ে আসতেন যাতে পীত রংয়ের তরল পদার্থ লেগে থাকতো। তখন তিনি তাদেরকে বলতেন, “সাদা পানি নির্গত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা তাড়াহুড়া করবে না।”
___________________________________
প্রশ্নঃ (১৭৯) ঋতু বন্ধ করার জন্য ঔষধ (ট্যাবলেট) ব্যবহার করার বিধান কি?
উত্তরঃ ঋতু বন্ধ করার জন্য ঔষধ (ট্যাবলেট) ব্যবহার করলে স্বাস্ত্যগত দিক থেকে কোন ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকলে, তাতে কোন অসুবিধা নেই। তবে তাতে স্বামীর অনুমতি থাকতে হবে। কিন্তু এযাবত আমি যা জেনেছি তাতে এ সমস্ত ঔষধ নারীর জন্য ক্ষতিকারক। একথা সবার জানা যে, মাসিকের রক্ত প্রবাহিত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। আর সময় মত স্বাভাবিক বিষয়ের গতিতে বাধা দিলে সেখানে অবশ্যই ক্ষতির আশংকা থাকে। নারীর শরীরে তার ক্ষতিকর প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া ইহা ব্যবহার করলে অনেক সময় নারীর স্বাভাবিক মাসিক বাধাগ্রস্ত হয় এবং সে পেরেশানী ও সন্দেহের মধ্যে পতিত হয়। নামায-রোযা ও স্বামীর সাথে সহবাসের ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখিন হয়।
এ জন্য আমি বলিনা যে এটা হারাম। কিন্তু নারীর ক্ষতির দিক চিন্তা করে বলি, এটা ব্যবহার করা উচিত নয়। আমার মতে এ পদক্ষেপ পসন্দনীয় নয়।
আরো বলি, আল্লাহ নারীর জন্য যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তাতেই তার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। বিদায় হজ্জে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মুল মু’মেনীন আয়েশা (রাঃ)এর ঘরে গিয়ে দেখেন তিনি কাঁদছেন। তখন আয়েশা (রাঃ) ওমরার ইহরাম বেঁধেছিলেন।
তিনি তাঁকে বললেন, “কি হয়েছে তোমার, কাঁদছো কেন? আয়েশা (রাঃ) বললেন, আমি বললাম, আল্লাহর শপথ এ বছর আমি হজ্জ না করলেই ভাল হত। তিনি বললেন, সম্ভবতঃ তুমি ঋতুবতী হয়ে গেছো? আমি বললাম, হ্যাঁ। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এটা এমন এক বিষয় যা আল্লাহ তা’আলা আদম সন্তানের মেয়েদের জন্য লিখে দিয়েছেন। (সুতরাং দুঃখ করার কিছু নেই।) অতএব নারীর উচিত হচ্ছে, এ সময় ধৈর্য ধারণ করা। ঋতুর কারণে ছালাত-ছিয়াম করতে না পারলে তো আল্লাহর যিকিরের দরজা উম্মুক্ত রয়েছে। তাসবীহ-তাহলীল করবে, দান্তসাদকা করবে, মানুষের সাথে সদাচরণ করবে, কথা-কাজে মানুষের উপকার করার চেষ্টা করবে, ইত্যাদি কাজ তো সুন্দর ও অত্যাধিক ফযীলতপূর্ণ আমল।
__________________________
প্রশ্নঃ (১৮৩) অসুস্থতার কারণে যদি কোন নারীর রক্তস্রাব নির্গত হতেই থাকে, তবে কিভাবে সে ছালাত ও ছিয়াম আদায় করবে?
উত্তরঃ এই নারীর অসুখ শুরু হওয়ার পূর্বে তথা গত মাসে তার ঋতুর যে দিন তারিখ নির্দিষ্ট ছিল, সেই নির্দিষ্ট দিন সমূহে সে নিজেকে ঋতুবতী হিসেবে গণ্য করে ছালাত-ছিয়াম প্রভৃতি থেকে বিরত থাকবে। উদাহরণ স্বরূপ বিগত মাসগুলোর প্রথম দিকে তার ছয়দিন ঋতু ছিল, তারপর এক সময় তার অসুখ শুরু হয়েছে, এক্ষেত্রে সে প্রত্যেক মাসের প্রথম দিকে ছয় দিন অপেক্ষা করবে এবং ছালাত ছিয়াম থেকে বিরত থাকবে। এ দিন সমূহ শেষ হলেই গোসল করে ছালাত-ছিয়াম আদায় করবে।
এ নারী বা তার মত নারীদের নামাযের পদ্ধতি হচ্ছে,
ক) ফরয নামাযের সময় হওয়ার পর পূর্ণাঙ্গরূপে লজ্জাস্থান ধৌত করবে।
খ) তারপর সেখানে প্যাড বা পট্টি জাতীয় কোন কিছু বেঁধে দিবে,
গ) এরপর ওযু করবে এবং নামায আদায় করবে।
নামাযের সময় উপস্থিত হওয়ার পূর্বে এরূপ ওযু ইত্যাদি কাজ করবে না। ফরয নামাযের সময় ব্যতীত অন্য সময় নফল নামায পড়তে চাইলেও এভাবে ওযু ইত্যাদি করবে।
এ অবস্থায় যেহেতু বারবার এতকাজ করা তার জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তাই দু’নামাযকে একত্রিত করা জায়েয। যোহরের সাথে আছরের নামায আদায় করে নিবে বা আছরের সাথে যোহরের নামাযকে আদায় করবে। এবং মাগরিবের সাথে এশার নামায আদায় করবে অথবা এশার সময় মাগরিব ও এশার নামায আদায় করবে। যাতে করে তার একবারের পরিশ্রম দু’নামায যোহর ও আছরের জন্য যথেষ্ট হয় এবং দ্বিতীয়বারের পরিশ্রম মাগরিব ও এশার জন্য যথেষ্ট হয়। আর একবার ফজর নামাযের জন্য। অর্থাৎ- পাঁচবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য লজ্জাস্থান ধৌত করা, পট্টি বাঁধা, ওযু করা প্রভৃতি কষ্টকর বিষয়। তাই এর পরিবর্তে তিনবারেই একাজ আদায় হয়ে যাবে। কষ্টও অনেক লাঘব হবে। (আল্লাহই তাওফীক দাতা ও তিনিই অধিক জ্ঞাত আছেন)
____________________________
বিনীত,
আনসারুস সুন্নাহ
১০ই মুহাররাম, ১৪৩৬।
__________________________
প্রশ্নঃ (১৭০) ঋতুর সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ নির্দিষ্ট দিন বলে কি কিছু আছে?
উত্তরঃ বিশুদ্ধ মতে ঋতুর সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ দিন নির্দিষ্ট বলে কিছু নেই। কেননা আল্লাহ বলেনঃ
অর্থাৎ “আর তারা তোমার কাছে জিজ্ঞাসা করে হায়েয সমপর্কে। বলে দাও, এটা অপবিত্র। কাজেই তোমরা হায়েয অবস্থায় স্ত্রী মিলন থেকে বিরত থাক। তখন পর্যন্ত তাদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হবে না; যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়ে যায়।” (সূরা বাক্বারা- ২২২) এখানে স্ত্রী সহবাসের নিষিদ্ধতা নির্দিষ্ট দিনের সাথে সম্পর্কিত করা হয়নি। এর সম্পর্ক হচ্ছে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়ার সাথে।
এ থেকে বুঝা যায়, বিধানটির কারণ হচ্ছে ঋতু থাকা বা না থাকা। যখনই ঋতু পাওয়া যাবে, বিধান প্রযোজ্য হবে। যখনই পবিত্র হয়ে যাবে, তার বিধান সমূহও রহিত হবে।
তাছাড়া নির্দিষ্ট দিন বেঁধে দেয়ার কোন দলীলও নেই। অথচ বিষয়টি বর্ণনা করে দেয়ার দরকার ছিল। বয়স বা দিনের নির্দিষ্টতা যদি শরীয়ত সম্মত হত, তবে তা অবশ্যই আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নাতে বর্ণিত হত।
অতএব এই ভিত্তিতে নারীদের কাছে পরিচিত স্রাব যখনই দেখা যাবে, নারী তখনই নিজেকে ঋতুবতী গণ্য করবে। এখানে কোন দিন নির্দিষ্ট করবে না। কিন্তু নারীর স্রাব যদি চলতেই থাকে বন্ধ না হয়, অথবা সামান্য সময়ের জন্য বন্ধ হয়, যেমন মাসে একদিন বা দু’দিন তবে তা ইসে-হাযার স্রাব (বা অসুস্থতা) বলে গণ্য হবে।
______________________________
প্রশ্নঃ (১৭৩) নির্গত স্রাবের ব্যাপারে নারী যদি সন্দিহান হয় যে, এটা কি হায়েযের রক্ত না কি ইসে-হাযার রক্ত না কি অন্য কিছুর রক্ত? এবং সে পার্থক্যও করতে পারে না। তবে সে উহা কি গণ্য করবে?
উত্তরঃ আসল কথা হচ্ছে, নারীর গর্ভ থেকে নির্গত রক্ত হায়েযেরই হয়ে থাকে। কিন্তু যখন প্রমাণিত হয়ে যাবে যে, তা ইসে-হাযার স্রাব তখন ইসে-হাযা হিসেবে গণ্য করবে। অন্যথায় ইসে-হাযা কিনা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্গত রক্ত হায়েয বা ঋতু হিসেবেই গণ্য করবে।
_______________________________
প্রশ্নঃ (১৭৫) জনৈক নারীর ঋতুর নির্দিষ্ট দিন ছিল ছয় দিন। অতঃপর এই দিনের পরিমাণ বৃদ্ধি হয়ে গেছে। সে এখন কি করবে?
উত্তরঃ এই নারীর ঋতুর দিন ছিল ছয় দিন। কিন্তু তা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে নয় দিন বা দশ দিন বা এগার দিন হয়ে গেছে, তবে তা ঋতু হিসেবে গণ্য করে পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত নামায-রোযা থেকে বিরত থাকবে। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঋতুর জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করে দেননি। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর তারা তোমার কাছে জিজ্ঞাসা করে হায়েয সমপর্কে। বলে দাও, এটা অপবিত্র।” (সূরা বাকারা- ২২২)
অতএব যতক্ষণ পর্যন্ত এই স্রাব অবশিষ্ট থাকবে, নারীও নিজ অবস্থায় থেকে পবিত্র হওয়ার পর গোসল করে ছালাত-ছিয়াম আদায় করবে। পরবর্তী মাসে যদি তার স্রাবের দিন কম হয়ে যায়, তবে স্লাব বন্ধ হলেই গোসল করে পবিত্র হয়ে যাবে। যদিও আগের মাসের সমান দিন পূর্ণ না হয়।
মোটকথা নারী যতদিন ঋতু বিশিষ্ট থাকবে ততদিন সে ছালাত-ছিয়াম থেকে বিরত থাকবে। চাই ঋতুর দিন পূর্ববর্তী মাসের বরাবর হোক বা কম হোক বা বেশী হোক। স্রাব বন্ধ হয়ে পবিত্র হলেই গোসল করবে।
__________________________________
প্রশ্নঃ (১৭৬) জনৈক নারী মাসিক থেকে পবিত্র হওয়ার পর গোসল করে নামায শুরু করেছে। এভাবে নয় দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আবার স্রাব দেখা গেছে। তিন দিন স্রাব প্রবাহমান ছিল। তখন নামায পড়েনি। তারপর পবিত্র হলে গোসল করে এগার দিন নামায আদায় করেছে। তারপর আবার তার স্বাভাবিক মাসিক শুরু হয়েছে। সে কি ঐ তিন দিনের নামায কাযা আদায় করবে? নাকি তা হায়েযের দিন হিসেবে গণ্য করবে?
উত্তরঃ নারীর গর্ভ থেকে যখনই রক্ত প্রবাহিত হবে তখনই তা ঋতু বা হায়েয হিসেবে গণ্য হবে। চাই সেই ঋতুর সময় পূর্বের ঋতুর সময়ের চাইতে দীর্ঘ হোক বা কম হোক। ঋতু থেকে পবিত্র হওয়ার পাঁচ দিন বা ছয় দিন বা দশ দিন পর পুনরায় স্রাব দেখা গেছে, তবে সে পবিত্র হওয়ার অপেক্ষা করবে এবং নামায পড়বে না। কেননা এটা ঋতু। সর্বাবস্থায় এরূপই করবে। পবিত্র হওয়ার পর আবার যদি ঋতু দেখা যায়, তবে অবশ্যই নামায-রোযা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু স্রাব যদি চলমান থাকে- সামান্য সময় ব্যতীত কখনই বন্ধ না হয়, তবে তা ইসে-হাযা বা অসুস্থতা বলে গণ্য হবে। তখন তার নির্দিষ্ট দিন সমূহ শুধু ছালাত-ছিয়াম থেকে বিরত থাকবে।
___________________________________
প্রশ্নঃ (১৭৭) ঋতু শুরু হওয়ার দু’দিন পূর্বে নারীর গর্ভ থেকে যে হলুদ রংয়ের তরল পদার্থ নির্গত হয় তার বিধান কি?
উত্তরঃ হলুদ রংয়ের এই তরল পদার্থ যদি ঋতুর সময় হওয়ার পূর্বে নির্গত হয়, তবে তা কিছু নয়। কেননা উম্মে আত্বীয়্যা (রাঃ) বলেন, “আমরা হলুদ রং ও মেটে রংয়ের তরল পদার্থ বের হলে তা কোন কিছুই গণ্য করতাম না।” (বুখারী)
আবু দাঊদের বর্ণনায় এসেছে, উম্মে আত্বীয়্যা (রাঃ) বলেন, “পবিত্র হওয়ার পর হলুদ রং ও মেটে রংয়ের তরল পদার্থ বের হলে আমরা তাকে কোন কিছুই গণ্য করতাম না।”
ঋতুর পূর্বের এই হলুদ রংয়ের তরল পদার্থ যদি ঋতু বের হওয়ার সাথে সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে তা কোন কিছু নয়। কিন্তু নারী যদি উহা ঋতুর সূচনা স্বরূপ মনে করে, তবে তা ঋতু হিসেবে গণ্য করবে এবং পবিত্র হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।
___________________________________
প্রশ্নঃ (১৭৮) পবিত্র হওয়ার পর হলুদ রং ও মেটে রংয়ের তরল পদার্থ বের হওয়ার বিধান কি?
উত্তরঃ ঋতুর ক্ষেত্রে নারীদের সমস্যা সাগরতুল্য যার কোন কুল কিনারা নেই। এর অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, গর্ভ বা মাসিক নিরোধক ঔষধ ব্যবহার করা। পূর্বে মানুষ এত ধরণের সমস্যা সম্পর্কে অবগত ছিল না। সন্দেহ নেই সৃষ্টি লগ্ন থেকে নারীর নানান সমস্যা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এর আধিক্য এত বেশী যে মানুষ তার সমাধানের ক্ষেত্রে হয়রান হয়ে যায়; যা দুঃখজনক বিষয়।
তবে মূলনীতি হচ্ছে, নারী যদি নিশ্চিতভাবে ঋতু থেকে পবিত্রতা দেখতে পায়, যেমন নারীদের কাছে পরিচিত সাদা পানি বের হওয়া, বা হলুদ বা মেটে রং বের হওয়া বা ভিজা পাওয়া এগুলো সবই হায়েয বা ঋতু নয়। এগুলো নামায বা ছিয়াম থেকে বাধা দিবে না। স্বামী সহবাসে বাধা থাকবে না। কেননা এটা হায়েয নয়। উম্মু আতিয়্যা (রাঃ) বলেন, “পবিত্র হওয়ার পর হলুদ রং ও মেটে রংয়ের তরল পদার্থ বের হলে, আমরা তা কোন কিছুই গণ্য করতাম না।” এর সনদ ছহীহ।
এই ভিত্তিতে, নিশ্চিতভাবে পবিত্র হওয়ার পর এ ধরণের যা কিছুই ঘটুক, তাতে নারীর কোন অসুবিধা নেই। ছালাত-ছিয়াম ও স্বামী সহবাসে কোন বাধা নেই। কিন্তু পবিত্রতা না দেখা পর্যন্ত তাড়াহুড়া করবে না। কেননা কোন কোন নারী রক্ত বের হওয়াতে কিছুটা শুস্কতা দেখলেই পবিত্রতার চিহ্ন না দেখেই তাড়াহুড়া করে গোসল করে নেয়। এই জন্য মহিলা ছাহাবীগণ উম্মুল মু’মেনীন আয়েশা (রাঃ)কে দেখানোর জন্য তুলা নিয়ে আসতেন যাতে পীত রংয়ের তরল পদার্থ লেগে থাকতো। তখন তিনি তাদেরকে বলতেন, “সাদা পানি নির্গত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা তাড়াহুড়া করবে না।”
___________________________________
প্রশ্নঃ (১৭৯) ঋতু বন্ধ করার জন্য ঔষধ (ট্যাবলেট) ব্যবহার করার বিধান কি?
উত্তরঃ ঋতু বন্ধ করার জন্য ঔষধ (ট্যাবলেট) ব্যবহার করলে স্বাস্ত্যগত দিক থেকে কোন ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকলে, তাতে কোন অসুবিধা নেই। তবে তাতে স্বামীর অনুমতি থাকতে হবে। কিন্তু এযাবত আমি যা জেনেছি তাতে এ সমস্ত ঔষধ নারীর জন্য ক্ষতিকারক। একথা সবার জানা যে, মাসিকের রক্ত প্রবাহিত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। আর সময় মত স্বাভাবিক বিষয়ের গতিতে বাধা দিলে সেখানে অবশ্যই ক্ষতির আশংকা থাকে। নারীর শরীরে তার ক্ষতিকর প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া ইহা ব্যবহার করলে অনেক সময় নারীর স্বাভাবিক মাসিক বাধাগ্রস্ত হয় এবং সে পেরেশানী ও সন্দেহের মধ্যে পতিত হয়। নামায-রোযা ও স্বামীর সাথে সহবাসের ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখিন হয়।
এ জন্য আমি বলিনা যে এটা হারাম। কিন্তু নারীর ক্ষতির দিক চিন্তা করে বলি, এটা ব্যবহার করা উচিত নয়। আমার মতে এ পদক্ষেপ পসন্দনীয় নয়।
আরো বলি, আল্লাহ নারীর জন্য যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তাতেই তার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। বিদায় হজ্জে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মুল মু’মেনীন আয়েশা (রাঃ)এর ঘরে গিয়ে দেখেন তিনি কাঁদছেন। তখন আয়েশা (রাঃ) ওমরার ইহরাম বেঁধেছিলেন।
তিনি তাঁকে বললেন, “কি হয়েছে তোমার, কাঁদছো কেন? আয়েশা (রাঃ) বললেন, আমি বললাম, আল্লাহর শপথ এ বছর আমি হজ্জ না করলেই ভাল হত। তিনি বললেন, সম্ভবতঃ তুমি ঋতুবতী হয়ে গেছো? আমি বললাম, হ্যাঁ। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এটা এমন এক বিষয় যা আল্লাহ তা’আলা আদম সন্তানের মেয়েদের জন্য লিখে দিয়েছেন। (সুতরাং দুঃখ করার কিছু নেই।) অতএব নারীর উচিত হচ্ছে, এ সময় ধৈর্য ধারণ করা। ঋতুর কারণে ছালাত-ছিয়াম করতে না পারলে তো আল্লাহর যিকিরের দরজা উম্মুক্ত রয়েছে। তাসবীহ-তাহলীল করবে, দান্তসাদকা করবে, মানুষের সাথে সদাচরণ করবে, কথা-কাজে মানুষের উপকার করার চেষ্টা করবে, ইত্যাদি কাজ তো সুন্দর ও অত্যাধিক ফযীলতপূর্ণ আমল।
__________________________
প্রশ্নঃ (১৮৩) অসুস্থতার কারণে যদি কোন নারীর রক্তস্রাব নির্গত হতেই থাকে, তবে কিভাবে সে ছালাত ও ছিয়াম আদায় করবে?
উত্তরঃ এই নারীর অসুখ শুরু হওয়ার পূর্বে তথা গত মাসে তার ঋতুর যে দিন তারিখ নির্দিষ্ট ছিল, সেই নির্দিষ্ট দিন সমূহে সে নিজেকে ঋতুবতী হিসেবে গণ্য করে ছালাত-ছিয়াম প্রভৃতি থেকে বিরত থাকবে। উদাহরণ স্বরূপ বিগত মাসগুলোর প্রথম দিকে তার ছয়দিন ঋতু ছিল, তারপর এক সময় তার অসুখ শুরু হয়েছে, এক্ষেত্রে সে প্রত্যেক মাসের প্রথম দিকে ছয় দিন অপেক্ষা করবে এবং ছালাত ছিয়াম থেকে বিরত থাকবে। এ দিন সমূহ শেষ হলেই গোসল করে ছালাত-ছিয়াম আদায় করবে।
এ নারী বা তার মত নারীদের নামাযের পদ্ধতি হচ্ছে,
ক) ফরয নামাযের সময় হওয়ার পর পূর্ণাঙ্গরূপে লজ্জাস্থান ধৌত করবে।
খ) তারপর সেখানে প্যাড বা পট্টি জাতীয় কোন কিছু বেঁধে দিবে,
গ) এরপর ওযু করবে এবং নামায আদায় করবে।
নামাযের সময় উপস্থিত হওয়ার পূর্বে এরূপ ওযু ইত্যাদি কাজ করবে না। ফরয নামাযের সময় ব্যতীত অন্য সময় নফল নামায পড়তে চাইলেও এভাবে ওযু ইত্যাদি করবে।
এ অবস্থায় যেহেতু বারবার এতকাজ করা তার জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তাই দু’নামাযকে একত্রিত করা জায়েয। যোহরের সাথে আছরের নামায আদায় করে নিবে বা আছরের সাথে যোহরের নামাযকে আদায় করবে। এবং মাগরিবের সাথে এশার নামায আদায় করবে অথবা এশার সময় মাগরিব ও এশার নামায আদায় করবে। যাতে করে তার একবারের পরিশ্রম দু’নামায যোহর ও আছরের জন্য যথেষ্ট হয় এবং দ্বিতীয়বারের পরিশ্রম মাগরিব ও এশার জন্য যথেষ্ট হয়। আর একবার ফজর নামাযের জন্য। অর্থাৎ- পাঁচবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য লজ্জাস্থান ধৌত করা, পট্টি বাঁধা, ওযু করা প্রভৃতি কষ্টকর বিষয়। তাই এর পরিবর্তে তিনবারেই একাজ আদায় হয়ে যাবে। কষ্টও অনেক লাঘব হবে। (আল্লাহই তাওফীক দাতা ও তিনিই অধিক জ্ঞাত আছেন)
____________________________