এ বছর আরাফার ময়দানে হজ্জের খুতবার অনুবাদঃ
- ফযীলাতুশ-শায়খ আ’বদুল আ’যীয ইবন আ’বদুল্লাহ আলে শাইখ হা’ফিজাহুল্লাহ।
অনুবাদঃ আলী হাসান তৈয়ব, সম্পাদনাঃ ড. আবু বকর
মুহাম্মাদ যাকারিয়া
১৪৩৬ হিজরী, ২০১৪ সালেহ প্রকাশিত।
“হে আল্লাহ, সমস্ত প্রশংসা তোমার জন্য। তুমি আমাদের সৃজন করেছ, যখন আমাদের কোন অস্তিত্বই
ছিলোনা। আমাদেরকে ছোট থেকে বড় করেছ। সবল করেছ দুর্বলতা থেকে। ধনবান করেছ নির্ধনতা
থেকে। চক্ষুষ্মান করেছ অন্ধত্ব থেকে। শ্রবণক্ষম করেছ বধিরতা থেকে। জ্ঞানবান করেছ
মূর্খতা থেকে। সুপথ দেখিয়েছ পথভ্রষ্টতা থেকে। আমরা তোমার প্রশংসা করি আমাদেরকে
ঈমান দান করার জন্য। তোমার প্রশংসা কুরআন নাযিল করার জন্য। তোমার প্রশংসা পরিবার, ধন-দৌলত ও সুস্থতার জন্য। তুমি আমাদের শত্রুদের পরাস্ত করেছ, আমাদের নিরাপত্তা বিধান করেছ। হে আমাদের রব! তোমার কাছে যা-ই চেয়েছি, তুমি তাই আমাদেরকে দিয়েছ। অতএব তোমার জন্য যাবতীয়
প্রশংসা যাবৎ তুমি সন্তুষ্ট হও। তোমার জন্য প্রশংসা সন্তুষ্টির পরেও।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য
দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর
রাসূল। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর ওপর এবং তাঁর পরিজন ও সাহাবীদের ওপর।
হে আল্লাহর বান্দারা!
আমি আপনাদের এবং প্রথমত নিজের পাপাচারী ক্ষুদ্র অন্তরকে আল্লাহভীরুতার উপদেশ
দিচ্ছি। কেননা তা সব কল্যাণকর্মের সমন্বয়ক। আল্লাহ বলেন,
﴿
وَمَن يَتَّقِ
ٱللَّهَ يَجۡعَل
لَّهُۥ مَخۡرَجٗا
٢ وَيَرۡزُقۡهُ
مِنۡ حَيۡثُ
لَا يَحۡتَسِبُۚ
وَمَن يَتَوَكَّلۡ
عَلَى ٱللَّهِ
فَهُوَ حَسۡبُهُۥٓۚ
إِنَّ ٱللَّهَ
بَٰلِغُ أَمۡرِهِۦۚ
قَدۡ جَعَلَ
ٱللَّهُ لِكُلِّ
شَيۡءٖ قَدۡرٗا
٣ ﴾
[الطلاق: ٢،
٣]
“যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক
দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার
জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের
জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।”
[সূরা আত-তালাক, আয়াতঃ ২-৩]
প্রিয় দীনী ভাইয়েরা, আজ জুমাবার। আজকের দিনটিই আবার
আরাফা দিবস। আপনারা জানেন আরাফা দিবস কী? এ মহান দিবসে
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সুদৃষ্টি দেন। এদের নিয়ে গর্ব করেন ফেরেশতাদের
সামনে। আল্লাহর রহমতের ব্যপ্তি কেমন দেখুন। আরাফার এ অবস্থানস্থলে বান্দারা
পাপরাশি নিয়ে সমবেত হয়েছে। অথচ দয়ালু প্রভু তাদের নিয়েই ফেরেশতাদের সামনে গর্ব
করছেন। তাই যে কেউ জাহান্নাম থেকে মুক্তি চায় সে যেন আরাফার দিনটিকে লুফে নেয়। এ
বার্তাটি আর কারও নয় সে মহামানব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের, যিনি নিজ থেকে বানিয়ে কিছু বলেন না; যা বলেন
আল্লাহর পক্ষ থেকেই বলেন। তিনি বলেছেন,
مَا
مِنْ يَوْمٍ
أَكْثَرَ مِنْ
أَنْ يُعْتِقَ
اللهُ فِيهِ
عَبْدًا مِنَ
النَّارِ، مِنْ
يَوْمِ عَرَفَةَ،
وَإِنَّهُ لَيَدْنُو،
ثُمَّ يُبَاهِي
بِهِمِ الْمَلَائِكَةَ،
فَيَقُولُ: مَا
أَرَادَ هَؤُلَاءِ؟
“আরাফার মতো কোনোদিন নেই, যাতে
আল্লাহ এতো বেশি বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন। আল্লাহ সেদিন দুনিয়ার
আকাশের নিকটবর্তী হন এবং এদের (যারা আরাফার ময়দানে উপস্থিত তাদেরকে) নিয়ে
ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, ওরা কী চায়?”
[সহীহ মুসলিমঃ ১৩৪৮]
যে কেউ তার চিরশত্রু ইবলিসকে পরাভূত করতে চায়, সে যেন আরাফার দিনটিকে কাজে লাগায়। তালহা বিন উবাইদ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا رُئِيَ
الشَّيْطَانُ يَوْمًا،
هُوَ فِيهِ
أَصْغَرُ وَلَا
أَدْحَرُ وَلَا
أَحْقَرُ وَلَا
أَغْيَظُ، مِنْهُ
فِي يَوْمِ
عَرَفَةَ. وَمَا
ذَاكَ إِلَّا
لِمَا رَأَى
مِنْ تَنَزُّلِ
الرَّحْمَةِ، وَتَجَاوُزِ
اللَّهِ عَنِ
الذُّنُوبِ الْعِظَامِ
».
“শয়তানকে কখনো আরাফা দিবসের মতো এমন
ছোট, হীন,
পরাভূত ও ক্ষুব্ধ দেখা যায় না। আর তা এজন্য যে, সেদিন
আল্লাহর রহমত নাযিল হয় এবং বড় বড় গুনাহ ক্ষমা করা হয়।”
[মুয়াত্তা মালেকঃ ২৪৫, হাদীসটির সনদ মুরসাল]
আরাফা দিবসে আরাফায় অবস্থান ও দু‘আর মাধ্যমে আপনি পারেন আমলনামা থেকে পাপগুলো মুছে ফেলতে। পারেন আপনাকে শয়তানের
বিচ্যুত ও পথভ্রষ্ট করার একটি পূর্ণ বছরের সাধনা এবং বিগত জীবনের পুরো প্রচেষ্টাকে
মাটি করে দিতে। আরাফা দিবসে রহমতের মেঘমালা অবতীর্ণ হয়। আর তা ছেয়ে যায় এর
অবস্থানকারীদের। এ সম্পর্কে ফুযাইল ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর দারুণ এক উক্তি স্মরণীয়। আরাফায় মানুষের ক্রন্দনরোল দেখে তিনি বলেছিলেন,
أرايتم
لو أن
هؤلاء صاروا
إلى رجل
واحد فسألوه
دانقاً أكان
يردهم ؟
قيل لا
، قال
: والله للمغفرةُ
عند الله
عز وجل
أهون من
إجابة رَجُلٍ
لهم بدانق .
“তোমরাই বল, এত লোক যদি কোনো ব্যক্তির কাছে গিয়ে সমস্বরে একটি মুদ্রার মাত্র এক ষষ্ঠাংশ
প্রার্থনা করে তিনি কি তাদের আবেদন ফেলতে পারবেন? কখনোই না। আল্লাহর শপথ, আল্লাহর কাছে এদের ক্ষমা করা তাদের
জন্য ওই লোকটির মুদ্রার ষষ্ঠাংশ দেয়ার চেয়েও সহজতর।”
এটি এমন এক দিবস যা পেলে একে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণে অভিশপ্ত ইয়াহূদীরাও
আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে। তারিক বিন শিহাব থেকে বুখারীর এক বর্ণনায় এসেছে,
“এক ইয়াহূদী ব্যক্তি খলীফা উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলল, আপনাদের কিতাবে আপনারা একটি আয়াত পড়েন, যদি তা আমাদের ওপর নাযিল হতো, আমরা এ দিবসকে ঈদ
হিসেবে পালন করতাম।’ উমর
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, ‘সেটি কোন আয়াত?’ লোকটি বলল, ‘আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন
হিসেবে পছন্দ করলাম।’ {সূরা মায়িদা :
৩} উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, ‘আমি অবশ্যই সে দিন এবং সে জায়গা সম্পর্কে অবগত যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আয়াতটি নাযিল হয়েছিল। তিনি ছিলেন আরাফার ময়দানে
দণ্ডায়মান। আর দিনটি ছিল জুমাবার।”
[বুখারী : ৪৫, মুসলিম : ৩০১৭]
আরাফা এমন এক দিবস, যেদিন বান্দারা হাশরের ময়দানে
নিজেদের সম্মিলনের কথা স্মরণ করে। এদিন তারা সবাই পার্থিব জৌলুস ও চাকচিক্য থেকে
মুক্ত হয়। দু’ টুকরো সফেদ কাপড় গায়ে
জড়ায়। এ যেন তাদের কাফনের কাপড়। যেন তারা হাশরের মাঠে তাদের রবের সামনে দাঁড়ানোর
জন্য পুনরুত্থিত হয়েছে। সবার কাঁধ আকাশ অভিমুখী। সবার স্বর দু‘আ ও কান্নায় গুঞ্জরিত। পার্থক্য শুধু এতটুকু, এদিন দু‘আ কবুল করা হবে।
মাগফিরাত ও রহমত করা হবে। আর হাশরের দিন খাতাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। সুতরাং
হিসাবের খাতা বন্ধ করার আগেই দিনটিকে কাজে লাগাতে হবে।
আরাফা ময়দানে হাজিরা ছাতা, তাবু ও গাড়ির আড়ালে
ছায়া খোঁজেন। কিন্তু কিয়ামতের দিন দয়াময় আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া কোনো ছায়াই থাকবে
না। অতএব কেন আমরা হায়াতকে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে লুফে নেব না। যাতে আগামীকাল তা
কাজে লাগে। যেদিন সবাই দয়াময়ের আরশের ছায়ার জন্য হাপিত্যেশ করবে। আমরা কেন সেখানে
ছায়া লাভকারী সাতশ্রেণীর কেউ হব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“আল্লাহ তায়ালা সাত শ্রেণীর
ব্যক্তিকে সেদিন তাঁর আরশের নিচে ছায়া দান করবেন যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতিত আর কোনো
ছায়া থাকবে না; তারা হলোঃ
১. ন্যায়পরায়ণ বাদশা (রাষ্ট্রনেতা)।
২. ওই যুবক, যার যৌবনকাল আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত
হয়।
৩. ওই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে ঝুলে থাকে (মসজিদের প্রতি তাঁর মন সদা
আকৃষ্ট থাকে)।
৪. ওই দু’ব্যক্তি যারা আল্লাহর
সন্তুষ্টির নিমিত্তে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; এ ভালোবাসায় তারা মিলিত হয় এবং এ ভালোবাসা নিয়েই বিচ্ছিন্ন হয়।
৫. ওই ব্যক্তি যাকে কোনো উচ্চবংশীয় সুন্দরী নারী (অবৈধ যৌন মিলনে) আহ্বান করে, কিন্তু সে বলে, ‘আমি আল্লাহকে
ভয় করি।’
৬. ওই ব্যক্তি যে গোপনে দান করে, এমনকি তাঁর ডান
হাত যা দান করে তার বাম হাত পর্যন্ত তা জানতে পারে না।
৭. ওই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তাঁর উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।
[বুখারী : ১০৩১]
সর্বোপরি আরাফা দিবসে সারা বছর খুঁজে না পাওয়া মুসলিম জাতির একতার চিত্র ভেসে
ওঠে। বর্ণ, ভাষা ও দেশের ভিন্নতা ঘুচে গিয়ে এদিন
ঐক্যের অনুপম সুর বেজে ওঠে। সবার পোশাক এক। সবার শ্লোগান অভিন্ন। সবার কাজও এক।
সবার রবও অভিন্ন।
আল্লাহর বান্দারা, আরাফা দিবসের উপযুক্ত মূল্যায়ন
করুন। আরাফা দিবসের মর্যাদা কেবল হাজীদের জন্যই সীমিত নয়, বরং হজে না আসাদের জন্যও এ দিবসে সিয়ামের মতো মহান ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর
সন্তুষ্টি অর্জনের সুযোগ রয়েছে। হাজী ছাড়া অন্যদের জন্য আরাফা দিবসের সাওম সুন্নত
প্রবর্তিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরাফা দিবসের সাওম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। উত্তরে
তিনি বলেন,
«يُكَفِّرُ السَّنَةَ
الْمَاضِيَةَ وَالْبَاقِيَةَ»
‘(এটি) বিগত ও আগত এক বছরের (গুনাহগুলোর) কাফফারা স্বরূপ।’ [মুসলিম : ১১৬২]
আল্লাহর বান্দারা, একটি গুনাহর ক্ষতিপূরণও আমাদের
জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। আর সেখানে পুরো দুটি বছরের কাফফারা! অথচ অনেকে এদিনও
নিষিদ্ধ কাজে ব্যস্ত থাকে। যেমন গান শোনা, চ্যানেলগুলোয়
সম্প্রচারিত মন্দ ও অশ্লীতার পেছনে পড়ে থাকে। আবার অনেকে এদিন বৈধ কাজেই
ব্যতিব্যস্ত থাকে। কিন্তু আল্লাহর কসম করে বলা যায় সেটি তার জন্য ক্ষতিকরই বটে।
যেমন অনেকে এ মহান দিনে ছুটি পেয়ে বিনোদনে ডুবে যিকির ও ইবাদতের সুযোগ হাত ছাড়া
করে। হজে আসতে না পারা সবাইকে আমি এদিন রোজা রেখে যথাসম্ভব বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত, যিকির, দু‘আ ও দয়াময়, ক্ষমাশীল আল্লাহর কাছে বিনীত
কান্নাকাটির উপদেশ দিচ্ছি।
৯ যিলহজ ১৪৩৫ হি. মোতাবেক ২০১৪ সালে মক্কার আরাফার মসজিদে নামিরায় প্রদত্ত
হজের খুতবার সার-সংক্ষেপ।